আঁধার
১৪.
সাদা গোলাপের পাপড়ির রঙ আর রাকার ত্বকের রঙের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তুলতুলে নরম মেদহীন শরীরের তুলনা কখনো হয়না৷ মিলার সাথে তো না-ই। মিলা উজ্জ্বল শ্যামলা তার উপর হাত পায়ে মেদ না থাকলেও তার পেটে মেদ আছে। এমনকি তলপেটে কাটা দাগ আছে। রাকার শরীরের কোথাও কোনো কালো দাগ নেই। পুরো শরীরে বেলীফুলের ঘ্রাণ। আর টসটসে স্ট্রবেরির মতো ঠোঁট আর মিলার ঠোঁট… আজব তো! আমি এই মূহুর্তেও মিলার কথা ভাবছি? কখনোই তো এমন হয়নি। রাকার সাথে যতবারই ঘনিষ্ঠ হয়েছি। ততবারই ওকে ছাড়া কোনোকিছুই ভাবতে পারিনি। হঠাৎ এমন কেনো হলো? মিলার সাথে বারবার তুলনা করছি। এই মুহূর্তে আমাকে এভাবে থেমে যেতে দেখে রাকা জিজ্ঞেস করল, ” কিছু হয়েছে রাসেল? হঠাৎ এভাবে থেমে গেলে? ”
” না, না আমি আসলে কনডম আনতে ভুলে গেছি। ”
” কী? তুমি ভুলে গেলা কীভাবে বলোতো? ” রাকাকে বিরক্ত মনে হলো। বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে তো ধরা পড়ে যাবে। মাহমুদ ভাই আজ দেড় মাস যাবত শীপে। আর বউ যদি এখন প্রেগন্যান্ট হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই মাহমুদ ভাই প্রশ্ন তুলবেন।
” আসলে এতো বেশি এক্সাইটেড ছিলাম! ” মিথ্যা বললাম। এক্সাইটেড ছিলাম তবে অতোটাও না। একটা খারাপ লাগা কাজ করছিল। এমন কখনো হয়না।
” তাহলে একটু অপেক্ষা করো আমি পিল খেয়ে আসি। ”
” আফটার পিল খেলেই হবে। এখন উঠে গেলে মুড নষ্ট হয়ে যাবে। ”
” রিস্ক নিতে পারবো না আমি। এমনিতেই এমন এক রিস্ক নিতে গিয়ে ওশান চলে এসেছে। ”
” তুমি কি খুশি না আমার সন্তান জন্ম দিয়ে? তুমি তো সবসময় চাইতে আমার সন্তান গর্ভে রাখার, লালন পালন করার। ”
” হ্যাঁ, চাইতাম কিন্তু সেটা তোমার আর আমার সংসারের। আমি মাহমুদের সংসার করি। ও যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে যে ওশান ওর সন্তান না। তখন তুমি বুঝো আমাদের কী হবে? ”
” কী হবে? তোমাদের বাসা থেকে বের করে দিবে? ওশানকে ভরণপোষণ দিবে না? ”
” হ্যাঁ, তাই করবে। আর সমাজ আছে না? আমি সমাজে মুখ দেখাব কী করে? ”
” আমি তাহলে কী করতে আছি? আমার সন্তান আমি নিয়ে নিব আর তোমাকেও নিজের করে চাই। এভাবে লুকিয়ে আর কত দিন? আমার নিজের সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনতে চাই। ”
” ওশানের এক মাসের খরচ তোমার সেলারির চেয়েও বেশি৷ ওকে তুমি মানুষ করতে পারবেনা। ”
” আমার সন্তানের মুখে আমি বাবা ডাক শুনতে পারবো না৷ এই কষ্ট আমি কীভাবে তোমাকে বুঝাবো? আমাদের ভালোবাসার ফসল। তুমি তো ঠিকই তার মা ডাক শুনো। কিন্তু আমি…” গলা ধরে আসাতে আর বলতে পারলাম না।
” তোমাকে বিয়ে করাইছি কী কারণে তাহলে? বউ তো আছে। নিয়ম করে তো তার সাথে ঠিকই থাকা হচ্ছে তোমার।… ”
” কীসব বলছ তুমি? ওকে তো আমার পছন্দই হয়না। দেখা যায় কেমন? ওর গর্ভের সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনতে আমি কখনো চাইনা। ”
” কী হাবিজাবি বলতেছ? বড় খালা দুইদিন পরেই লাফ দিয়ে বলবেনে, রাসেল আমি নাতীর মুখ দেখতে চাই। ”
” তুমি ভালো করেই জানোই মিলা পাগল। মা’কে বলে দিব ওর মাথা ঠিক হলে বাচ্চা নিব। তা নাহলে দেখা যাবে বাচ্চাকে নিজেই খুন করে বসে আছে। ”
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” তারপরও কোন সময় সে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় তার ঠিক আছে! তোমার যে ভোলা মন। দিনে কতবার কী করো কে জানে! ”
” তুমিও তো মাহমুদ ভাই আসলে তার সাথে বিছানায় যাও। আমি কি কখনো এটা নিয়ে বলি? তুমি তার বাচ্চারও তো মা হয়ে যেতে পারো। ”
” আমি তো বাধ্য রাসেল। বাসা থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। কিন্তু তুমি তো বাধ্য না। মিলা তো আর আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো না যে তুমি কাছে না গেলে প্রশ্ন তুলবে। ”
” আমার উপর ওর অধিকার আছে। এই অধিকার আমার পালন করতে হবে যতদিন ওর সাথে আছি। ”
” কিন্তু আমার তো ভালো লাগেনা। যখন মনে পড়ে তুমি অন্য কোনো মেয়ের সাথে এক বিছানায়, এক ঘরে থাকছো। তখনই কষ্ট হয়। ”
” তাহলে আমাকে বিয়ে কেনো করতে বললে? আমি তো বিয়ে ছাড়া ভালোই ছিলাম। ”
” বড় খালা আর মা আমাদের ধরে ফেলত রাসেল। ”
” তাতে কী? আমি আমার বাচ্চা আর বাচ্চার মা’কে পেয়ে যেতাম। এখনো আমাদের হাতে সময় আছে। তুমি ওশানকে নিয়ে আমার সাথে ফরিদপুরে চলো। ”
রাকা ভূত দেখার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।
” কাঁদতেছ কেনো রাকা? ”
” আমি তো কবেই তোমার কাছে চলে যেতাম কিন্তু বাপির জন্য পারিনা। বাপির মান সম্মান সব নষ্ট হয়ে যাবে। ”
” সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয়ে তুমি আমার জীবনটা তো বাজিতে ফেলে দিছ। ”
” না, তুমি ছাড়া আমি অচল রাসেল। তুমি আমাকে সবদিক দিয়ে সুখ দাও। শরীর, মন দুটোই তুমি ভালো রাখতে জানো। ”
” মাহমুদ ভাই পারেনা? তার তো টাকাপয়সার অভাব নাই। সম্পদের অভাব নাই। সে পারেনা তোমার শরীরের চাহিদা মেটাতে? ”
” ভালোবাসার মানুষের স্পর্শ তুমি বুঝবা না? ”
রাকার এই প্রশ্নে আমার মেজাজ চড়ে গেল।
” আমি বুঝবো না? তাহলে আমি এখানে কেনো আসছি? আমি আমার অসুস্থ স্ত্রীকে জোর করে বাপেরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে এখানে কেনো এসেছি? তাকে একা একা পাঠিয়ে দিছি। সে অসুস্থ ছিল। চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। এমনকি সে বাসায় গিয়ে ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছে কিনা সেই খোঁজ পর্যন্ত নেইনি। আর তুমি বলতেছ আমি বুঝবো না? ” আমি চাপা স্বরে বললাম। মনে হচ্ছিল আশেপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলি।
” স্ত্রীর জন্য এতো পুড়তেছে। তাহলে আসছো কেনো তুমি? কোলে নিয়ে বসে থাকতা। ” রাকার কণ্ঠে রাগ ঝড়ে পড়তেছে৷
” কোলে নিয়েই বসে থাকবো। তোমাকে বলতে হবেনা। ”
” তাহলে আমার সাথে বিছানায় শুয়ে আছো কেন? ”
” আমি একা না তুমিও শুয়ে আছো। ” বিছানা ছেড়ে উঠে প্যান্ট হাতে নিলাম।
” তুমি আমাকে ভালোবাস না রাসেল। ”
প্যান্ট পরে নিলাম।
তারপর বললাম, ” তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”
” তাহলে তুমি চলে যাচ্ছো কেনো? আমাকে এই অবস্থায় ফেলে… ” রাকা নিঃশব্দে কাঁদছে।
আমি সবকিছু ভুলে ওর কাছে বসলাম। রাকা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ” আমাকে আর ওশানকে নিয়ে যাও রাসেল৷ আমি আর এখানে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। ”
” আমি নিয়ে যাবো খুব তাড়াতাড়ি। ”
*****
” রাসেল যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। ” রাকা কপালে চুমু দিয়ে বলল।
” না, এখন খাবো না। ”
” এমন করে না পাখি। তোমার শরীর খারাপ করবে। ”
” ঠিকাছে তবে… ” রাকার ফোন বেজে উঠাতে আমার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল৷ রাকা কোনোমতে কাঁথা নগ্ন দেহে জড়িয়ে ফোন রিসিভ করল।
” মাহমুদ বলো। ”
রাকার বর ফোন করেছে। ওদের কনভারসেশন শুনলে আমার খারাপ লাগা বাড়বে। তাই দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। ওয়াশরুমে ঢুকে রাকার প্রসাধনী দেখে আজকে হতভম্ব হলাম৷ মাহমুদ ভাই তার স্ত্রীর জন্য কত ধরনের প্রসাধনীর ব্যবস্থা করেছেন। বাথরুমেই সাত আট ধরনের! আরো কত ধরনের প্রসাধনী আছে তার হিসাব নেই। মিলার জন্য আমি এই পর্যন্ত একটা প্রসাধনী কিনে আনিনি। কখনো চিন্তাও আসেনি কেনার। বিয়ের সময় বড় আপা লাগেজে যা যা দিয়েছিলেন। সেগুলোই ব্যবহার করে। এমনকি সে মুখ ফুটে বলেওনি আমার এটা লাগবে ওটা লাগবে। রাকা যা যা ব্যবহার করে এগুলো ব্যবহার করলে মিলার গায়ের রঙটা আরো পরিষ্কার হতো। ওকে একবার হলেও ফোন দেয়া উচিৎ । পাগল ছাগল যাইহোক বিয়ে তো করেছি। কোনো নালিশ সে করে না । কোনো কিছু সে চায়না। কেমন নির্লিপ্ত ভাব তার মাঝে!
ধ্যাৎ! এখানেও ওর চিন্তা। যত্তসব ফাউল মেয়ে মানুষ। বিয়ের আগে কার না কার সাথে শুয়েছে। সে আবার…
( মিলা )
পুরো রাত কাটল ঘোরের মধ্যে। ঘুম ভাঙলো রাত তিনটায়। বিছানায় উঠে বসতেই হাতে টান লাগল। ড্রিম লাইটের আলোতে হাতে লাগানো ক্যানাল দেখতে পেলাম। পাশেই মা ঘুমিয়ে আছেন। খুব সাবধানে ক্যানাল খুললাম। রক্তের একটা ধারা মনে হলো বের হয়ে আসছে। আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে বিছানা থেকে নামলাম।
কিছুক্ষণ শক্ত করে চেপে ধরলেই রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। দরজা ভেজান ছিল। নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বের হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। গাঢ় অন্ধকার চারপাশে। শুধুমাত্র আকাশের তারার আলো আর জোনাকি পোকা আছে দুই একটা। জঙ্গলের শেষ প্রান্তে খুব সুন্দর একটা পুকুর আছে। পুকুরে বারো মাস লাল শাপলা ফুটে। বিয়ের আগে যখনই বাসায় আসতাম ততবারই রাত এই পুকুর পাড়ে বসে কাটাতাম। আমার রাতে খুব একটা ভালো ঘুম হয়না। বিয়ের পরে মরার মতো রাতে ঘুমাতাম। তা নাহলে রাসেল বিরক্ত করে। আমি জেগে আছি বুঝতে পারলেই তার হলো। এই ভয়ে আরো বেশি করে ঘুমাই। রাসেলের কথা মনে করতেই মোবাইলের কথা মনে পড়লো। রাসেল তো অবশ্যই আমাকে ফোন করেছিলেন। কারণ একা একা পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাও নিজের অনিচ্ছায়। মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল তার আমাকে একা ছাড়ার কোনো ইচ্ছা নেই। জ্বরের কারণে তিনি যেভাবে আমার যত্ন করেছেন। তাতে তাকে খুব একটা খারাপ মনে হলো না। ইশ! মোবাইলটা সাথে নিয়ে আসলে ভালো হতো। তাকে ফোন করা যেত। বাবা তো তাকে আমার অসুস্থতার খবর দিয়েছেনই।
যেই ভাবা সেই কাজ বাড়ির দিকে আবার ফিরে গেলাম। পুরো বাড়ি গভীর ঘুমে মগ্ন। তার উপর আমি হাঁটি বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে। আমার ব্যাগ কোথায় রেখেছে? ড্রিম লাইটের আলোতে হাতের ক্যানাল দেখা গেলেও সবকিছু খুঁজে পাওয়া যায়না। টেবিলের উপর খুঁজতে গিয়ে মোবাইল পেলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে আসলাম।
মোবাইলের কল লিস্ট চেক করে দেখলাম রাসেলের নাম্বার থেকে দশবারের বেশি কল এসেছে। তারপর ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে তার নাম্বার থেকে আসা ম্যাসেজও পেয়ে গেলাম।
ম্যাসেজে লেখা, ” মোবাইল হাতে নিলে আমাকে কল ব্যাক করবা। মোবাইল কথা বলার জন্য মিলা৷ শোকেজে সাজিয়ে রাখার জন্য না। ”
চলবে…
~ Maria Kabir