আঁধার
৪.
রাসেল আমার দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বলল, ” তুমি এভাবে চুপ হয়ে যাও কেনো? ”
” আপনার কথার পৃষ্ঠে কোনো কথা খুঁজে পাইনা। তাই চুপ হয়ে যাই। ”
” তুমি আমাকে পছন্দ করো না, তাইনা? ” রাসেল এমনভাবে কথাটা বলল যেন মনে হলো তাকে পছন্দ করাটা আমার জন্য ফরজ কাজ! হ্যাঁ, আসলেই ফরজ কাজ আমার জন্য। সে আমার স্বামী। তাকে ভালোবাসতে হবে, পছন্দ করতে হবে। তার এই আশা লালন করাটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। আমি ছিলাম এক জাহান্নামে। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করেছি। তারপর একদিন মুক্তি পেলাম। কিন্তু সেই মুক্তি ছিলো মেকি। কয়েক মুহূর্তের পরেই বুঝে গেলাম। এটা আরেকটা জাহান্নাম। রাসেল আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছে না। আমার এভাবে চুপ হয়ে থাকার কারণে রাসেল নিঃশব্দে চলে গেল বারান্দা থেকে। হয়তোবা বুঝতে পেরেছে আমার উত্তর না। আসলে উত্তর না-ও না আবার হাঁ-ও না। একসময় তাকে ভালো লাগে। আরেক সময় তাকে অসহ্যকর লাগে। যেমন একটু আগেও তাকে অসহ্যকর লাগছিল। বন্য চাহনিতে আমার বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছিল।
বেডরুম থেকে আমার মোবাইলের রিংটোন কানে আসছে। বারান্দা থেকে রুমে এসে মোবাইল হাতে নিলাম। মা’য়ের নাম্বার। সকালেও কয়েকবার ফোন করেছিলেন। রিসিভ করিনি। বাসার কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগেনা। কী মনে করে যেন ফোন রিসিভ করলাম।
” কীরে ফোন ধরোস না ক্যা?”
মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো সে খুব রেগে আছেন। আমার যুক্তিযুক্ত একটা কারণ তার প্রশ্নের উত্তরে দিতে হবে। তা নাহলে ধরা পড়ে যাবো। যে আমি তাদেরকে ইগ্নোর করার চেষ্টায় আছি।
” কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এখানে তো আর তোমাদের বাড়ির মতো কাজের লোকের ছড়াছড়ি নাই৷ আমার কাজ আমাকেই করতে হয়। সেটা যতই অসুস্থ থাকিনা কেনো। ” একটু রাগি রাগি কণ্ঠে বললাম।
” তোর বাবাকে কে বুঝাবে? যে মেয়ে নিজ হাতে কিছু করতে পারেনা । সেই মেয়েকে কীভাবে সে এইরকম ছেলের সাথে বিয়ে দিল। আমি ভেবে পাইনা। ”
” তুমি তো টু শব্দ করো না তার সামনে। এখন মোবাইলে চিল্লাইলে তো আর কাজ হবেনা। এই চিল্লানিটা তার সামনে দিতে পারলে। না হয় বুঝতাম তোমার ভাবনা কতদূর। ”
মা কিচ্ছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ” সেই ক্ষমতা কি আমার আছে? থাকলে কি আর তোরে এই জায়গায় বিয়ে হতে দিতাম? ”
” তাহলে আর সেই প্রসঙ্গ নামিয়ে কথার ঝুড়ি ভরার দরকার নাই৷ কী কারণে ফোন করেছ তাড়াতাড়ি বলে ফেল। ”
” কারণ ছাড়া মা কি ফোন করতে পারেনা তার মেয়েকে? ”
” না, পারেনা। কারণ তার মেয়ে এখন তার অধিকারে নেই৷ তার মেয়ে এখন একজনের স্ত্রী। তার সেই একজনের কথায় উঠতে হবে, বসতে হবে। সেই একজনেরই একমাত্র অধিকার। ”
” তুই বদলাইলি না। ” মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন।
” আর কিছু বলবা? ” আমাকে বদলানোর চেষ্টা কখনো ভালোভাবে তোমরা করেছ? এই প্রশ্নটা করার ইচ্ছা ছিলো অনেক। কিন্তু কথা বলতে ভালো লাগছিল না। তাই আর করা হলোনা।
” আমরা কেমন আছি জিজ্ঞেসও করলি না একবার। ”
” তোমরা ভালো আছ। আর ভালো থাকার জন্যই আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিদায় করছো। ”
” প্রত্যেক মেয়েরই একসময় বাপেরবাড়ি ছাইড়া পরের বাড়ি যাওয়া লাগে৷ এইটা নিয়ম। ”
” হ্যাঁ, জানি। আর কিছু বলবা?”
” জামাই বলতেছিল তোকে এক সপ্তাহের জন্য এখানে রাইখা যাবে। তার নাকি কী কাজে ঢাকা যাওয়া লাগবে। তাই বল…” মা’কে কথা শেষ করতে দিতে পারলাম না৷ আমাকে তো ঢাকা যাওয়ার কথা বলেনি রাসেল! আর আমাকে ওখানে রেখে যেতে হবে কেনো? আমি এখানেই তো ঠিক আছি।
” আমাকে তো বলেনি সে। ”
” তা তো জানিনা জামাই ক্যান তোরে বলে নাই। তয় আমাকে গতকাল বিকালেই জানাইছে তোর আসার কথা৷ ”
” আমি যাবো না। আমি এখানে একাই ঠিক আছি। ”
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” তুই না একটু আগে কইলি তোর উপর তোর জামাইয়ের অধিকার। তুই তার কথা শুনতে বাধ্য। তাইলে এখন আবার আরেক কথা কস ক্যা? নীতিবাক্য ছাড়ার আগে কি মনে থাকেনা? ”
” আমাকে খোঁচা দেয়ার জন্যই কি তোমার ফোন করা? ” মা যে যুক্তি দেখালেন তার পৃষ্ঠে বলার মতো কোনো ভাষা আমার নাই। তাই পালটা তাকে আক্রমণ করার চেয়ে ভালো কোনো উপায় নাই তার প্রশ্নের জাল থেকে রক্ষা পাওয়ার৷
” আমি তোরে খোঁচা ক্যান দিমু? তুই আমার পেডের মাইয়া৷ তোর জন্মের সময় আমি নারাজ ছিলাম৷ তাই বইলা তো ফেলায় দেই নাই। মা’র জ্বালা তো বুঝবি না। খালি জানোস ত্যাড়াব্যাকা কথা বলা। ”
” আমার অতো বুঝে কাজ নাই। ”
” জামাইয়ের লগে ভালোয় ভালোয় চইলা আসবি। আর শোন বেশি বেশি দোয়া ইউনুস পড়বি। বুঝছোস?”
” হ্যাঁ, বুঝছি। তুমি তোমার ভাষা কবে ঠিক করবা? এতো হাই ক্লাস মানুষের এমন ভাষা ঠিক বেমানান না? ”
” আমি আমার আঞ্চলিকতা ছাড়বো না ধরবো সেইটা আমার ব্যাপার। আমার ক্লাস হাই হোক বা লো আমি আমার নিজস্বতা ধইরা রাখতে জানি। নিজস্বতাই আসল আর সবকিছু হইলো ঢপ। তোরে লো ক্লাসে দিছে তো কী হইছে? তোর নিজস্বতা তো ছাড়তে হইতেছে না। তুই তোর মতোই তো আছোস। কাজ না হয় করা লাগতেছে। এই কাজ সব মাইয়ারই করা লাগে। সংসার মানে হাত পা গুটাইয়া বইসা থাকা না। ”
বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলাম। মোবাইল বিছানার উপর রেখে দিয়ে দরজার দিকে ঘাড় ঘোরালাম। রাসেল দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মা’য়ের সাথের কথোপকথন এতক্ষণ সে শুনেছে। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। আমি ওকে অপমান করার জন্য লো ক্লা, কাজের কথা তুলিনি। মা’কে বিরক্ত করার জন্যই বলেছি। রাসেল লো ক্লাস না হাই ক্লাস তা দিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এমনকি একা একা সংসারের সব কাজ করতে হয়। এতেও মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা, ভয়, বিরক্তি ঠিক অন্য জায়গায়। যে সম্পর্কটা প্রত্যেকটা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহজ এবং স্বাভাবিক একটা বিষয়। সেই সম্পর্কটাই আমার কাছে সবচেয়ে কষ্টের আর বিরক্তিকর।
রাসেল আমার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ” তোমার একা কাজ করতে কষ্ট হয়। বললেই হতো। আমি একজন ছুটা কাজের লোক রেখে দিতাম। যে যেকোনো দুইটা কাজ করে দিয়ে যেত। ”
” আমি একাই করতে পারি। মা’কে এমনিই কথা গুলো বলেছি। মূলত তাকে রাগানোটাই উদ্দেশ্য ছিল আমার। ”
” কিন্তু কেনো? ” রাসেলের কপালে কয়েকটা ভাঁজ দেখা গেল।
” আমার ফ্যামিলির কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগেনা। তাই ইচ্ছা করে এমন বাজে ব্যবহার করি। যাতে আমার সাথে তারা নিজ থেকেই কথা বলতে না আসে। ”
” ভালো না লাগার কারণ কী? ”
” আপনার শুনে লাভ নাই। ”
” তোমার কথাবার্তা, কাজকর্মের কোনো আগামাথা আমি বুঝিনা। তুমি এমন কেনো? মিলা আমি তোমার স্বামী। সেই স্বামীর সাথেও তুমি লুকোচুরি খেলছ। আমি যতই চেষ্টা করি সম্পর্কটা হালকা করার। তুমি ততই জটিল করে তুলো। তুমি তোমার মা’য়ের কাছে কতকিছু বললা। সেই কথাগুলো আমাকে বললেই হতো। আমি এটার সমাধান বের করার চেষ্টা করতাম। তা না করে তুমি আম্মার কাছে নালিশ করে বসে আছ। ”
” আমি মোটেও নালিশ করিনি। আমি যা করি তাই বলেছি। আর তারা জানে আমিই ভালো না। তাই আপনার নামে হাজারটা নালিশ করলেও তারা বিশ্বাস করবেনা। ”
” বিশ্বাস করুক বা না করুক। আমার কথা হচ্ছে, তুমি আমাকে না বলে আম্মাকে কেনো বলবা?” রাসেলের কণ্ঠে চাপা অভিমান প্রকাশ পাচ্ছে ।
” এখন থেকে আর বলবো না। আর তাকে আমাকে ফোন করতে নিষেধ করে দিবেন। ”
” আমি এই কাজ করতে পারবো না৷ তোমার মা মেয়ের ব্যাপারে আমি যাবো না। আর পরশুদিন তোমাকে তোমার বাবার বাসায় রেখে আসবো৷ আমার ঢাকায় কিছু কাজ আছে। ”
” আমি এখানে একা থাকতে পারবো। ”
” না, তুমি একা একা এখানে থাকবে না। তোমাকে আমার কথা শুনতেই হবে। একটু আগেও আম্মার কাছে বলেছ যে, তোমার উপর আমার একমাত্র অধিকার। সো, অধিকার আমি খাটাবোই। ”
” ওগুলো মুখের কথা ছিল। ”
” না, এটাই নিয়ম৷ আমরা স্বামী – স্ত্রী। আমাদের একে অপরের উপর অধিকার আছে। তোমার উপর আমার অধিকার যেমন আছে। ঠিক আমার উপর তোমারও অধিকার আছে। ”
” হয়েছে আপনার নীতিবাক্যের লেকচার?”
” তুমি এমন কেনো মিলা?” রাসেল আমার দিকে আরো কয়েক কদম এগিয়ে এসে প্রশ্নটা করলেন।
” আমি জানিনা। ”
আমি কয়েক কদম পেছনে সরে এসে দাঁড়ালাম। রাসেল এক হাত বাড়িয়ে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিল। আরেক হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে ধরলো।
” তুমি হাই ক্লাস বলে যে আমি তোমার পায়ের নিচে পড়ে থাকবো। সেই আশা কখনোই করবেনা। আমি তোমার পায়ের নিচে পড়ার মতো পুরুষ না। আমি পায়ের নিচে ফেলানোর মতো পুরুষ। ” কথাটা খুব ধীরে ধীরে বললেন। আর গলার স্বরও অনেক শান্ত আর ঠান্ডা মনে হচ্ছে। তারপরও ভয়ে বুক কেঁপে উঠল।
আমার সাহসে হলো না তার এইধরনের কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার। রাসেল আচমকাই পুরো মুখে চুমু দিতে শুরু করলো। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পুরো মুখে আছড়ে পড়ছে। নিজেকে ছাড়ানোর সাহস পেলাম না। রাসেল তার আসল রূপ এখনো প্রকাশ করেনি। তার ঠান্ডা স্বরে বলা কথাই আমার মুখে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ জানেন, এর অগ্নিমূর্তির সামনে কীভাবে টিকে থাকবো!
চলবে…
~ Maria Kabir