আঁধার
৩.
বারান্দায় শাড়ী মেলার পরে হুশ হলো আমার। শাড়ী ভালো করে চিপড়ানো হয়নি। পানি টপটপ করে পড়তেছে। রাসেল এইখানে আসলেই তো বিরাট আছাড়া খাবে। তারপর হাত – পা, কোমড় ভাঙলে তো আমারই বিপদ।
দড়িতে ফ্লোর মোছার কাপড় নিয়ে মুছতে শুরু করলাম। বাসায় এভাবে কাজ করতে দেখলে মা আকাশ থেকে পড়তেন। আমার এই বিয়েটা ঠিক করেছিলেন আমার বড় দুলাভাই। তার মতে, আমার বাবার একজন মেয়ের জামাইয়ের প্যাকেটে ছেলে দরকার। অবশ্যই কোনো ভালো চাকরি করা এরকম ছেলে হতে চাইবে না। তাই আমাদের লেভেলের চেয়ে নিচু লেভেলের ছেলের সাথে যেকোনো এক মেয়েকে বিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যেত। কিন্তু বাবা এই চরম ভুলটা করে বসে আছেন। তার বড় আর মেজো মেয়েকে অলরেডি হাই ক্লাস অফিসারের সাথে বিয়ে দিয়ে বসে আছেন। বাকি রইলাম আমি। এক্সপেরিমেন্টটা আমার উপর দিয়েই চালানো হলো। বড় দুলাভাই যা বলেন বাবা তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী বাবা গো ধরে বসলেন আমাকে রায়ানের সাথে বিয়ে দিবেন না। ওই ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। রেজাল্ট ভালো আবার পরিশ্রমী অনেক। তার হাই ক্লাস জব হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। ধরে বেঁধে দেয়ারও প্রয়োজন ছিলো না। রায়ানের সাথে আমার তেমন সিরিয়াস রিলেশন ছিলো না। তার আমি বাদেও আরো তিন জন গার্লফ্রেন্ড ছিল। এখন জানিনা তার ক’জন আছে। আমাকে ধরে বেঁধে রাসেলের সাথে বিয়ে দেয়া হলো। রাসেল গ্রাজুয়েশন ও পোস্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার সাথে সাথে এই চাকরি হয়ে গেছে। তারপর সে হাত পা গুটিয়ে বসেছে। এবং সাথে সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে রেখেছে একটা – ” আমার ইহকালে আর কোনো চাকরি হবেনা। তাই আমি আর কোনো চাকরির পরীক্ষা দিবো না। ” এমনটা তার মা আমাকে বলেছেন। তার মা আমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। দায়িত্বটা হচ্ছে, ভুলিয়ে ভালিয়ে তার সুপুত্রকে হাই ক্লাস চাকরির পরীক্ষার জন্য রাজি করানো। সে কথা থাক। অন্য একদিন বলবো। আমার দুলাভাই তাকে কোথা থেকে পেয়েছেন এই খবর এখনো পর্যন্ত আমি জানিনা। তবে আশা আছে বড় আপা এই খবর আমার কানে পৌঁছে দিবেন।
বাবা রাসেলকে দেখে খুব পছন্দ করলেন। কিন্তু মা আর মায়ের দিক কার কেউই পছন্দ করলেন না। এমনকি বাবার দিক কার আত্মীয় স্বজনদেরও একই অবস্থা। তাদের মতে মহি সাহেব চরম ভুল করছেন। কে শুনে কার কথা!
আমার বাবা আর বড় দুলাভাইয়ের তোড়জোড়ে আমার অনুমতি ছাড়াই বিয়ের সবকিছু ঠিক হলো। আমার কিছু বলার ছিলো না। বড় দুলাভাই কেনো এই কাজ করেছেন৷ আমি ভালোভাবেই জানি। বাবার সাথে এই বিষয় নিয়ে আমার তর্কও হয়েছে দুই তিনবার। প্রতিবারই সে বলেছে, বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। ছেলে হলে বের হয়ে আসতাম। মেয়ে বলেই পারিনি। মেয়েদের পদে পদে বিপদ। আগে নাহয় মেয়েরা ঘরে সুরক্ষিত ছিলো। এখন সেটাও নেই। তাই আর কী করার!
বিয়ের দিন রাসেলকে দেখে আমি অবাক। আমি ভেবেছিলাম কোনো এক ভুড়িওয়ালা, মাথায় টাক, বয়স্ক ছেলে আমার জন্য ঠিক করেছে। কিন্তু এ তো দেখি পুরোপুরি বিপরীত। ফরশা, হ্যাংলা, চুপচাপ স্বভাবের। মাথার চুল একেবারে কমও না আবার বেশিও না। এর ছবি আগে দেখলে আমি মোটেও বিয়েতে বেঁকে বসতাম না। প্রাইমারি স্কুলের টিচার তাতে আমার সমস্যা নাই। আমি অল্প খরচে চলতে পারবো। বিয়ের রাতে আমার খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। মনে হয়েছে আমি গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছি আবার। মুক্তির জন্য যে পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই পথ আসলে মুক্তির না, অঅন্যকিছুর।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
আমার শৈশব তেমন ভালো কাটেনি। বাবা আর তার পরিবারের ইচ্ছা ছিলো এইবার একটা ছেলে হোক। কিন্তু হলাম আমি। বাবা আমার সাথে কখনো খুব একটা ভালো ব্যবহার করেনি। সবসময় একটা দায়ছাড়া ভাব তার মধ্যে ছিল। যেন আমি নেই এই সংসারের কোথাও! আমিও আড়ালে আবডালে ওঁৎ পেতে বসে থাকতাম। কীভাবে এদের থেকে দূরে থাকা যায়। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম কিনা জানিনা। কখনো সেদিকে খেয়াল দেইনি। তারপর বড় আপার বিয়ে হলো। আরো একটা অশান্তিতে পতিত হলাম আমি। মনে হলো জীবন এমন কেনো? মানুষ গুলো এমন কেনো?
নিজেকে যেন নর্দমার কীট মনে হতো। এই কষ্ট থেকে বাঁচার জন্যই চুটিয়ে প্রেম করেছি। ফায়দা কিছুই হয়নি। আরো বদনাম কপালে জুটেছে। স্কুলে আর কলেজে আমাকে প্লে-গার্ল বলে সম্ভাষণ করতো। আমি শুধু প্রেমই করতাম। ওই পার্কের কোণায়, হোটেলের রুমে বা ছেলেদের হোস্টেলে কখনো পা দেইনি। কিন্তু আমার ক্লাসে নাদিয়ার এইসব জায়গায় আনাগোনা ছিল। তারপরও তার নামের পাশে প্লে – গার্ল শব্দটা জুড়ে দেয়নি কেউ। কারণ একটাই সে খুবই চুপচাপ ছিল। মুখে সবসময় মধু ঝড়তো। আর আমি ছিলাম বাকপটু। যা যা করতাম সবই খোলাসা করে দিতাম।
কারো অপকার করিনি আবার উপকারও করিনি৷
বাসায় আমার এহেন কাজকর্মের জন্য অনেক কথা শুনতে হতো। প্রায়ই বাবা আমার মোবাইল কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলতেন। আমি আবারও নতুন উদ্যমে মোবাইল কিনে কথা বলা চালিয়ে যেতাম। বাসায় আমিই রাস্তার কুকুরের মতো ছিলাম। আমার স্বভাবের জন্যই হয়তোবা।
আমাকে এজন্যই রাসেলের মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে। যেন আমার পূর্ব জীবনের কাজকর্মের হিসাবের খাতা খুলে না বসে। বাবার কাছ থেকে মোটা অংকের যৌতুক যে সে তার পকেটে ভরেছে। এইক্ষেত্রে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই টাকা সে কী করেছে এখনো জানতে পারিনি। বেশভূষায় তো কোনো পরিবর্তন দেখিনা।
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
সে যখন কথা বলে তখন আমার খারাপ লাগেনা। মনে হয় লোকটাকে ভালোবাসা যায়। কিন্তু যখনই রাত আসে। তখনই সারাদিনের জমে থাকা সেই চিন্তা উবে যায় কর্পূরের মতো। আমার মনে হয়, আমার দ্বারা কাউকে ভালোবাসা হবেনা। যা হবে সেটা মানিয়ে নিয়ে বা ম্যানেজ করে চলা। ভালোবাসি না তারপরও তার সাথে শুতে হবে, হাসতে হবে, কথা বলতে হবে, তার মন ভালো করতে হবে। তার সব ইচ্ছা – অনিচ্ছা মেনে চলতে হবে। একসময় তার বাচ্চার মা হবো। তার বাচ্চাদের ভালোবাসবো কিন্তু তাকে আর ভালোবাসা হয়ে উঠবেনা। এমন কীভাবে হয়? একটা মানুষের সাথে সারা জীবন পার করে দিবো। তাকে ভালো না বেসেই। তার বাচ্চা আমার গর্ভে থাকবে, বড় হবে কিন্তু সে আমার ভালোবাসার ফসল হবেনা। এমন জীবন তো চাইনি!
কাঁধের উপর রাসেলের হাতের চাপ বুঝতে পেরে পেছনে ফিরলাম। রাসেল বলল, ” একা একা দাঁড়িয়ে কী করছো? ”
” শহর দেখছি, আপনি মধ্যরাতে যেটা করেন মূলত। ”
” তোমার একা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক না। ”
” কেনো? ”
” জায়গাটা ভালো না। দেখোনা এখানে লাইট জ্বালিয়ে রাখা সত্ত্বেও ওই জঙ্গলে ঘুটঘুটে অন্ধকার । ”
রাসেলের কথা মতোই তাকালাম। সত্যিই ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখে ব্যথা করে এমন অন্ধকারের দিকে তাকালে।
” হ্যাঁ, তাতে কী?”
” তুমি রাতে ঘুমের ঘোরে হাসো, কাঁদো, কথা বলো। তার উপর এখান থেকে কিছু সমস্যা হলে কী করবা কে জানে! ”
রাসেলের কথায় খুবই অবাক হলাম। ভালো না বেসে এভাবে কেয়ার কীভাবে মানুষ করতে পারে? আমি তো পারিনা। আমার শুধু মনে পড়ে এই কারাগার থেকে মুক্তির দিনের কথা৷ কবে আমি এখান থেকে বের হবো?
রাসেল আমার দিকে বন্য চাহনিতে তাকিয়ে আছে। এই তাকানোর অর্থ আমি এই দুই সপ্তাহে বুঝে গেছি। আমার অসহ্যকর লাগে এই চাহনি। অসহ্যকর…
চলবে….
~ Maria Kabir