আঁধারের আলো পর্ব-০৫

0
1683

#আঁধারের_আলো
#পর্ব_৫
#লেখাঃInsia_Ahmed_Hayat

শাওনের দুই বোনের চিল্লাচিল্লিতে পুরোবাড়ি মাথায় উঠে গেছে পাশের বাসার চাচীরাও চলে এসেছে। শাওনের বড় বোন সাথী রুপার চুল ধরে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়েছে। সূচি শাওনের অপেক্ষা করছে। শাওনকে ৫ মিনিটের মধ্যে বাসায় আসতে বলছে। শাওনের মা তার দুই মেয়ে কান্ড দেখে বুঝতে পারছে না কি করবে।

সাথীঃ তোকে এইবাড়ি থাকতে দিয়েছি খেতে দিয়েছি কি অন্যের সংসার ভাঙ্গার জন্য। (বলেই হাত মুষ্টি বদ্ধ করে রুপার পিঠে দুটো কিল মেরে দিলো)

সূচিঃ এতোদিন ধরে মায়ের জন্য চুপ করে আছি। কারন মায়ের বোনের মেয়ে বলে কিন্তু অনেক সহ্য করেছি। আমাদের বাসায় থেকে খেয়ে আমাদেরই ক্ষতি করতে চলে এসেছিস।ডাইনি তোকে তোহ (আরো দুইটা চড় বসিয়ে দিলো)

শাওনের মা দুই বোনের কাছ থেকে রুপা ছাড়িয়ে নিলো।

শাওনের মাঃ কি হয়েছে এমনে আমার বোনঝি টারে মারতাছোস কেনো।

সূচিঃ মা তুমি আজ আমাদের মাঝে এসো না তোমার কোনো কথা আমরা শোনবো না। আজ তুমি শোনবা অপেক্ষা করো শাওন আসুক। (এই প্রথম নিজের বড় ভাইকে নাম ধরে ডাকায় সবাই অবাক। বুঝতে আর বাকি রইলো না কতোটা রেগে আছে)
রুপা রীতিমতো কান্না শুরু করে দিয়েছে। শাওনের বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে। আজ দুই বোন প্রচুর রেগে আছে রাগের কারন কেউ জানে না। কিছুক্ষন পর
শাওন এসে হাজির। শাওন বাসায় ডুকার সাথে সাথে সাথী নিজের ছোট ভাইকে দুই গালে চড় বসিয়ে দিলো। নিজের বোনের এমন কান্ডে স্তব্ধ হয়ে আছে শাওন। ঘটনাটা আচমকা হওয়ায় বুঝে উঠতে পারছে না আসলে হলো টা কি।

শাওনঃ আপা! কি হয়েছে। (অবাক হয়ে)
শাওনের কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।
সাথীঃ আলো কোথায় (জোরে)

শাওনঃ আলো ওর বাবার বাড়ি গিয়েছে।

সূচিঃ আচ্ছা বাবার বাড়ি গিয়েছে। যদি বাবার বাড়ি যায় তাহলে আকরাম এসে তোকে শাসিয়ে গেলো কেন।

শাওনের মাঃ সূচি আমরা কেমনে কমু আলো কই গেছে আমগো তোহ আর কইয়া যায় নাই। আর আমার পোলারে এমনে তোরা মারতাছোস কেন।

সাথীঃ হ্যা আপনার পোলা এই পোলা পোলা করে পোলাকে জুয়াখোর, জানোয়ার বানিয়েছেন। কখনো পোলাকে কিছু বলেন নাই। চুপ থেকে ঠান্ডা মাথায় কিভাবে অত্যাচার করা যায় সেটা ঠিকই শিখিয়েছেন।

সূচিঃ একটা মেয়েকে আপনারা এতো অত্যাচার করেছেন যে সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কতোটা খারাপ মানুষ আপনারা। আল্লাহ আমাদের বাচিয়েছে যে আমাদের কপালে আপনাদের মতো শশুর বাড়ি পরেনি।

সাথীঃ আর তুই(রুপা) এখনি এই বাড়ি থেকে বের হো।নইলে আজ তোকে এমন মার মারবো আজীবন বিছানায় পড়ে থাকবি।

সূচি তেড়ে গিয়ে রুপার চুলের মুঠি ধরে চড় বসিয়ে দিলো ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিলো। রাগে গা কাপছে দুবোনের। এদের শায়েস্তা করার জন্য সকালে রওনা দিয়ে চলে আসছে আজ চুপ থাকলে চলবে না।

শাওনের মাঃ আরে মাইয়াডারে এমনে মারতাছোস কেন? কি করছো রুপায়?

সূচিঃ কি করছে জানতে চান। কিছুদিন আগে তোহ বড় গলায় আলোকে ভাতের জন্য কথা শুনিয়েছিলেন এইযে এই আপনার বোনঝি ভাত ফেলে দিতো যাতে করে আলো খেতে না পারে। আর তার প্রমান আমার কাছে আছে। কতোটা খারাপ হলে আরেকজনের খাবার দেখতে পারে না। রোজ রোজ ভাত নিয়ে বাড়ির পেছনের পুকুরে ফেলে দিতো। ওইদিন পুকুরে না পড়ায় আপনি দেখে আলোকে কথা শুনিয়েছেন যা নয় তাই বলেছেন। আর রুপাযে ভাত গুলো ফেলে দিতো তার প্রমান আছে দিবো নে প্রান ভরে নিজের বোনঝির কার্যকলাপ দেইখেন।

শাওনের মা সহ সবাই অবাক রুপা কেদে বাসিয়ে ফেলছে। এভাবে ধরা খাবে ভাবতে পারেনি। শাওন অবাকের শেষ পর্যায় চলে গেছে। বলে কি এরমানে এতোদিন যা শাস্তি দিয়েছে তার জন্য আলো নির্দোষ ছিলো। বিনা দোষে শাস্তি পেয়েছে।

সাথীঃ ওইযে গরুর মাংসে লবন বেশি হওয়ার জন্য যে আলোকে কথা শুনিয়েছিলেন সেটাও আপনার বোনঝি করেছে যাতে করে আমরা খেতে না পারি। কতোবার বলেছি একে এইবাড়িতে রাখবেন না কিন্তু কথা শুনেনি।
আর তুই শাওন তোরে কি বলবো। জুয়াখোর, নির্দয়, পাষাণ তোর কারনে একটা মেয়ে রাত ১,২ টা পর্যন্ত জেগে থাকে কখনো কি একবার জিজ্ঞেস করেছিস যে আলো তুমি কি খেয়েছো। আরে কখনো কি একটা সূতাও কিনে দিয়েছিস বা জিজ্ঞেস করেছিস আলো তোমার কিছু লাগবে। বিয়ে করেছিস ব্যস দায়িত্ব শেষ। কোনো দায়িত্ববোধ নামক জিনিস আছে নাকি নাই।

সূচিঃআরে নিজে গামলা ভরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তা। তুমি দেরি করে আসছো নিজে বেড়ে খেতে পারোনা। আর কোনখানের নিয়ম রাখছেন মা যে জুয়াখোর ছেলে জুয়া খেলে রাত ১, ২টা পর্যন্ত তারপর বাসায় আসবে আর তার জন্য না খেয়ে বসে থাকবে তার স্ত্রী। আলো কি মানুষ না আপনাদের কি বিবেক বলতে কিছুই নাই।

শাওনের মাঃ এইখানে ভুলের কি সংসার তোহ আমিও করছি। আলো একলা করে নাই। আর ওই মাইয়ার লিগা এতো ঝগড়া করতাছোস কেন।

সাথীঃ ঝগড়া করবো না কেন। নিজে তোহ ছেলেকে শিক্ষা দেননাই। আমরা ভালো করার জন্য একজন সাংসারিক মেয়েকে বিয়ে করাইছি। ভাবলাম ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু কে জানতো যে শাওন অমানুষ হয়ে গেছে রাত ১ টা বাজে মাছ কিনে আনে আবার সকালে খাবে তাই সারারাত মাছ কাটতে দিয়ে নিজে আরামে ঘুমাই। কেন আলোর ঘুম পায় না নাকি সে মানুষ না সে রোবট।

শাওন মাথা নিচু করে আছে। নিজের বোনদের কাছে অপরাধী মনে হচ্ছে।

সূচিঃ আচ্ছা ভাই আজ যদি তোর মতো আমাদের বরও এমন আচরন করতো তখন কেমন হতো বল। তোমরা সবাই যে একটা মানুষকে এতো অত্যাচার করলা এটা কি ঠিক করলা। আরে রোজ রোজ ভাত কম পড়ায় কতোদিন না খেয়ে ছিলো কে জানে৷ এই রুপা এতো কিছু করলো তোমাদের কি চোখে পড়ে নাই। নাকি চোখে ছানি পড়েছে।

শাওনের মা, শাওন কি বলবে বুঝতে পারছে না।

শাওনের মাঃ তোরা এতো কথা কিভাবে জানোস।

সাথীঃ এখনো আপনার এটা নিয়ে মাথা ব্যাথা যে আমরা কিভাবে জানি এতো কথা। একটুও অনুতপ্ত নাই। ছি ছি ছি কেমন ঘরে আমাদের জন্ম হলো।

সূচিঃ মা আলোর বাচ্চা হয় না একবারও কি ডাক্তার দেখাইছেন। মানুষের কথা শুনে শুনে এই কবিরাজ সেই কবিরাজের কাছে নিয়ে গেছেন। পোলা আর পোলার বউরে নিয়ে ডাক্তার দেখাইতেন কিন্তু তা করেন নাই। আমাদের পাশের বাসার চাচী বিয়ের ২২ বছর হয়ে গেছে নিসন্তান কই তারা তো সুখে সংসার করছে। তোদের যদি কখনো ফোনে কল দেই তখনো আলোর দোষের লিস্টে আমাদের শোনাতি।কখনো কি তার গুনের কথা বলেছিস তোরা।

শাওনের মা মুখ কালো হয়ে গেলো। কিছু কিছু মানুষকে শত বুঝালেও তারা বুঝবে না।তেমনি শাওনের মা।

শাওনঃ আমি কেন ডাক্তার দেখাবো সমস্যা আমার না আলোর।

সূচিঃ তুই ডাক্তার হ্যা তুই কি ডাক্তার নাকি। আরে ডাক্তারও তোহ বলতে পারবে না যে সমস্যা তার নাকি তার বউ এর। একবার চেকাপ করাতি। আর সমস্যা কি খালি মেয়েদেরই থাকে ছেলেদের থাকেনা। তোরে বলে লাভ নাই।

সাথীঃএই রুপা এই মহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে তুই চলে যাবি।আর তুই এইবাড়িতে থাকলে আমরা এই বাড়িতে কখনো আসবো না।

সুচিঃ আর শাওন তোরে কয়েকদিনের সময় দিচ্ছি আলোর কাছে মাফ চেয়ে সসম্মানে আলোকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবি। আলো যদি না থাকে তাহলে মনে রাখ তোর বোনেরা মরে গেছে।

শাওনের মাঃ হায়হায় আল্লাহ দেখছো কালসাপিনী গেলো তোহ গেলো আমার সংসারটারে ভেঙে দিয়ে গেলো( বলে কান্না করছে)

শাওনের বাবাঃ চুপ একদম চুপ তোর কান্না আজ আমার সহ্য হচ্ছে না। কখনো তোকে কিছু বলি নাই। কিন্তু আজ চুপ থাকতে পারলাম না। আমি মুখ বুঝে তোদের কাহিনি দেখতাম কিছু বলার সাহস থাকতো না। নিজেকে দোষ দিতাম কেন একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করলাম। আলোরে পছন্দ করে বউ বানিয়ে এই বাড়িতে আনছি। মাইয়াটা এতো ভালো। আর তারে কালসাপিনী বলস। আরে বল তোহ কখনো কি আলো তোর সাথে উচু গলায় কথা বলছে। শাওন তুই বল কখনো ও তোর কথার অমান্য করছে। তোদের কাছে কি কখনো কিছু চেয়েছে। তোরা যা বলতি তাই করতো। কিন্তু তার বিনিময়ে তোরা কি দিলি চিন্তা কর। সুযোগ পেলেই তোর এই বোনঝি কাজের ওর্ডার দিয়ে বসতো। রাত বিরাতে শাওনের ঘরে গিয়ে এইখাবে সেই খাবে বলে আলোর ঘুম হারাম করে দিছে। এইগুলো কি তোর(শাওনের মার) চোখে পড়তো না। শাওনের মারে কতো বড় ভুল করলি। সংসার আলো না তোরাই ভেঙে দিলি। সোনার হরিনকে চিনতে পারলি না। এখনো সময় আছে আলোর কাছে মাফ চেয়ে নিয়ে আয় এই বাড়িতে।

শাওন চুপ করে মাথা নিচু করে আছে। কথা গুলো তীরের মতো লাগছে। সত্যি তোহ কি না করেনি আলোর সাথে। মানুষিক ভাবে অত্যাচার করেছে। কতো রাত না খেয়ে নির্ঘুমে থেকেছে। আজ সত্যি নিজের মাঝে অপরাধবোদ কাজ করছে।

সাথীঃ আর একটা কথা কি জানিস তুই না সত্যি আলোর যোগ্য না। তুই থাক তোর মতো। আর তুই রুপা তুইও থাক। আজ আমি এই বাড়ি একেবারের জন্য ছেড়ে দিলাম। অমানুষরা আমার আপনজন হতে পারে না।

সূচিঃ রুপারে কি করলি তুই এইগুলো কেন করলি। একটা মানুষকে তিলে তিলে এইভাবে মারলি ছি ছি ছি। আপা চল এইবাড়িতে থাকলে আমাদের উপরও এমন প্রভাব ফেলবে। আব্বা আপনিও আইসা পড়েন আমাদের সাথে। এরা থাকুক।

সুচি আর সাথী বের হয়ে গেলো। পেছন পেছন শাওন ও শাওনের মাও বেরিয়ে এলো। সাথী আর সূচিকে ধরে রাখছে।

শাওনঃআপারে আমাকে মাফ করে দে আমি অনেক বড় ভুল করেছি। সূচি আমাকে মাফ করে দে।আমি আলোকে খুজে নিয়ে আসবো। তোরা এইভাবে চলে যাবি না প্লিজ।

বলেই দুইবোনের পায়ের কাছে বসে পড়লো

শাওনের মাঃ মাগো যাইয়ো না আমারে রাইখা। আমার ভুল হইয়া গেছে। রুপারে আর রাখমুনা আমার পোলার বউরে বাড়ি আনমু আর কষ্ট দিমু না। সত্যি বলতাছি মাগো যাইয়ো না (কাদছে আর বলছে)

শাওনের বাবার চোখও ছলছল করছে। এভাবে সংসারটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।

রুপাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো। শাওন আলোর ভাইয়ের বাড়িতে গেলো। সেখানে আকরাম ও ফাতেমা তাকে অপমান করে বাড়িতে ডুকতে দেয়নি। অনেক জায়গায় খুজেও আলোর কোনো খোজ পেলো না শাওন।

আলো নিজে বিয়ের কাবিননামার একটা ফটোকপি নিয়ে গিয়েছিলো। আর প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র নিয়ে গিয়েছে।একজন কাজির সাথে কথা বলে ডিভোর্স পেপার তৈরি করে পাঠিয়ে দিলো শাওনের কাছে। আলো নিজের সোনার চেইন ও আংটিটা মনিরার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে যা তার বাবার দেওয়া ছিলো। আর মনিরার কাছে বিক্রি করার কারন হলো নিজের কাছে টাকা হলে যেনো আবার কিনে নিতে পারে। মনিরা টাকা দিতে চেয়েছে কিন্তু আলো নেয়নি একটা মানুষের কাছ থেকে আর কতো কি নিবে। কাবিননামার টাকা নেওয়ারও ইচ্ছা নেই আলোর। সে আর পেছন ফিরে তাকাতে চায় না।

শাওনের বোনরা সত্যি এইবাড়িতে আসবে না সাফ সাফ জানিয়ে। এরচেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই না।শাওনের বাবা অনেক কষ্টে জমি বিক্রি করে মুদির দোকান দিয়েছিলো।যাতে শাওন কোনো কাজ করে কিন্তু কাজ কম জুয়া খেলায় সব শেষ তাই দোকান তিনি ফেরত নিয়ে নিজেই দোকানদারি করছে।শাওনকে উনি আলাদা করে দিয়েছে।বলেছে শাওন এখানে থাকলে তার মেয়েরা আসবে না তাই শাওন যেনো অন্য কোথাও চলে যায়। শাওন আজ শূন্য। শত অনুতপ্ত হলে পূরনোদিন ফিরে পাওয়া যায় না।
শাওনের মা তার এমন ভাঙা সংসার দেখে আফসোস করছে।কি হয়ে গেলো।

আলো চলে যাওয়ার ২ মাস হয়ে গেলো। আলো নিজের জন্য একটা রুম ভাড়া নিয়েছে। সেখানে সে কিস্তিতে একটা সেলাই মেশিন কিনেছে।আপাতত ঘরে কিছু নেই।সামান্য টাকা ছিলো তা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছে। একটা ঘরে কি না লাগে সেগুলো আস্তে আস্তে কিনবে প্রথমে অল্প করে শুরু করতে চায়। মনিরা অনেকবার বলেছে তার সাথে থাকতে আলো কারো উপর বোঝা হতে চায় না।কিন্তু মনিরা তাকে একটা ভালো ঘর নিয়ে দিয়েছে। মনিরার পরিচিত হওয়ায় ঘর ভাড়া কমিয়েছে। মানুষ বড়ই অদ্ভুত চেনা নাই জানা নাই একজনকে সাহায্য করছে। মনিরার এই ঋণ কোনোদিন পূরন করতে পারবে না আলো। 8 পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছে তাই আশেপাশের ছোট ছোট প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের পড়ায়। মনিরা বাচ্চাগুলোকে জোগাড় করে দিয়েছে। আশেপাশের দর্জি তেমন না থাকায় আলোর জন্য সুবিধা হয়েছে। নিজের এই কাজ দিয়েই নতুন জীবন শুরু করছে আলো। প্রথম জামা প্রথম কাস্টমার মনিরাই ছিলো। সে অনেক গুলো জামা বানায় কিন্তু বিনিময়ে আলো তার কাছ থেকে টাকা নেয় না। নিতে চায় না থাকনা বড় বোনের কাছ থেকে কি টাকা নেওয়া যায়। তারপরও মনিরা জোড় করে আলোকে কয়েকটা থ্রিপিস উপহার দেয়। টাকা না দিয়ে উপহার দিয়ে টাকাটা যেমন শোধ করলো তেমনি আলোর প্রয়োজনও মিটলো।

আলোর দিনকাল ভালোই যাচ্ছে। নতুন কিছু শুরু করেছে একটু কষ্ট হবে।আস্তে আস্তে নিজের ঘরকে সুন্দর করে নিজের মতো সাজাবে আলো। নিজের কষ্টের টাকায় সাজানো নতুন জীবন নতুন সংসার।

ওইদিকে আঁধারকে খোজে বের করে আকরাম । সব জানায় আঁধারকে। নিজের প্রিয়তমার এমন নির্মম কষ্টের কথা সহ্য হচ্ছে না আঁধারের।কোথায় খুজবে আঁধার আলোকে। আকরাম যাওয়ার আগে আলোর একটা ছবি দিয়ে যায় বয়স তখন ২৪ ছবিটা আলোর বিয়ের দিনে তোলা। আকরাম তুলে নিজের কাছে রেখেছে। যে করেই হোক তার বোনকে সুখ এনে দিবে আর সেই সুখ আধারের সাথে থাকলেই পাবে।
আসলে এমনিতে হারিয়ে গেলে খুজে পাওয়া যায় কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে হারিয়ে গেলে খুজে পাওয়া বড়ই কষ্টকর ব্যাপার।

আঁধার নিজের হাতে প্রিয়তমার ছবিটি নিয়ে রেখেছে। ছবিটি দেখতে হাত কাপছে ঠিক কতো বছর পর দেখতে যাচ্ছে তার আলোকে। অনেক চেষ্টা করেছিলো আলোকে দেখার কিন্তু পারেনি। আলোর বাড়িতে ডুকতে দিতো না তার দাদী। আলোকে বাহিরে বের হতে দিতো না।প্রয়োজনে বের হলে ওর মা সাথে করে বের হতো। এখান থেকে যেতে আমার অনেক সময় লাগতো। অনেক অপেক্ষা করতাম এক নজর দেখার জন্য। অবশেষে দেখতে পারবো আধারের_আলোকে সরাসরি না হোক ছবিই দেখি। নতুন করে আশার আলো যখন পেয়েছি তখন আর হাতছাড়া করবো না। চেষ্টা করে যাবো তোমাকে আমার জীবনের সাথে নিয়ে চলতে।
লেখনীতেঃInsia Ahmed Hayat

অবশেষে আধার তার প্রিয়োতমার ছবিটি দেখেই ফেলল। ভালোবাসার মানুষ যেমনই হোক তার কাছে সবচেয়ে সুন্দরী রমনী লাগে। মন ভরে ছবিটা দেখছে। সাথে চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। বাসায় গিয়ে সবাইকে আলোর ছবি দেখালো। সবাই অনেকটা চিন্তিত কিন্তু আঁধার খুব খুশি। এবার আলোকে খোজার পালা। আলোকে যে করেই হোক খুজতে হবে।

এভাবে ৬ মাস কেটে গেলো আলো এখন ভালোই আছে। সে সেলাইয়ের পাশাপাশি থ্রি-পিস বিক্রি করে। নিজের ঘরের সামনেই রমজান মাসে ইফতার বানিয়ে বিক্রি করেছে। চিন্তা করে রেখেছে পিঠাও বিক্রি করবে। এলাকাটা শহর হওয়ায় বাজার একটু দূরে হওয়ায় কেনাবেচা ভালোই চলে আলোর। সাথে বাচ্চাদের পড়ানো এই নিয়েই তার জীবন চলছে। এখন আর খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। না খেয়ে ঘুমাতে হয় না।নির্ঘুমে থাকতে হয় না। আলো নিজের বর্তমান পরিস্থিতির কথা গার্লস গ্রুপে শেয়ার করে।সবাই খুশি হয়েছে। অনেকে আবার বলছে মনিরার মতো কাউকে পেলে চলে যাবে। আলো সেখানে বলেছে সবাই মনিরা আপুর মতো ভালো হয় না অনেক প্রতারক ধোকাবাজও আছে। তাই যা করার ভেবে চিনতে করতে হবে। নিজেকে চিনতে হবে তুমি কি পারো তা দিয়েই শুরু করো বাকিটা না নয় আল্লাহ ঠিক করে দিবে। কেউ পাশে থাকুক আর না থাকুক সৃষ্টিকর্তা সব সময় আমাদের পাশে থাকে।

ওইদিকে আকরাম আলোর চিঠিটা লুকিয়ে রেখেছে চিঠিতে কি আছে ফাতেমা জানে না একদিন ফাতেমা চিঠিটা চুরি করলো। চিঠি পড়ে তার চোখ বেয়ে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়লো

চিঠিতে

প্রিয় ছোট ভাই
আশা করি ভালো আছিস আর ভালো থাকবি। আজকে কথা গুলো লিখছি হয়তো আমার প্রথম ও শেষ কথা মনোযোগ দিয়ে পড়বি। যখন তোর জন্ম হয়েছিলো সারা বাড়ির সবাই অনেক খুশি ছিলো আমিও অনেক খুশি ছিলাম আমি তোকে দেখার জন্য কোলে নেওয়ার জন্য ব্যকুল ছিলাম কিন্তু তখনো দাদী তোর আর আমার মাঝের তফাত বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে একটা রুমে আটকে দিয়েছিল। তখন বাবা সবে মাত্র বিদেশে গিয়েছে। আমি সারাদিন ওই রুমে ছিলাম। এরপর পাশের বাসার ছোট দাদী এসে আমায় নিয়ে গিয়েছিলো। জানিস তোকে না আমার কোলে নিতে অনেক ইচ্ছে করতো কিন্তু কখনো হয়ে উঠেনি। ভাবছিস এতো ছোট বেলার কাহিনি কিভাবে মনে আছে আসলে আমরা সুখের চেয়ে দুঃক্ষের কথা খুব বেশি মনে রাখি। আস্তে আস্তে আমরা বড় হচ্ছিলাম তুই ছোট থেকেই কম কথা বলতি। কিন্তু সারাদিন আমার পিছু পিছু ঘুরতি আর আমার জামা পড়ে ফেলতি। সেই জামা আমি ছোট করে নতুন করে বানিয়ে দিয়েছি জামাটা তোর পছন্দের ছিলো তাই নিজের কাছে রেখে দিতাম। তোর যদি মেয়ে হয় আমার পক্ষ থেকে দিয়ে দিস। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি কিন্তু প্রকাশ করিনি। মনে আছে আমার রিং কানের দুল দাদী খুলে নিয়ে গিয়েছিলো আর তুই দাদীর সাথে ঝগড়া করে আমায় এনে দিয়েছিলি সেটা আমি তোকে দিয়ে দিলাম এটা তোর মেয়েকে দিয়ে দিস। এর চেয়ে বেশি কিছু দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেইরে ভাই।
যাক অনেক কথা বললাম বলার কারনও আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর তুই একদম চুপচাপ ছিলি তুই আমার কাছে কম আসতি কিন্তু দূরে থেকেও আমায় সাহায্য করতি।সবাই যখন আমায় দোষারোপ করছিলো বাবার মৃত্যুর কারনে তুই তখন এক কোনায় চুপ করে ছিলি অসহায়ের মতো আমার দিকে চেয়ে ছিলি। আমার জন্য তুই এটা সেটা নিয়ে আসতি। অবশেষে ফাতেমাকে নিয়ে এলি যাতে আমার কষ্ট কম হয়।ফাতেমাকে পারলে আগেই নিয়ে আসতি কিন্তু তোদের বয়স কম হওয়ার পারিসনি। ফাতেমা মেয়েটা খুবই ভালো আমার বেশ পছন্দ হয়েছেরে ওর খেয়াল রাখিস। আমার জন্য কিছু আনলে ফাতেমাকে দিয়ে পাঠাতে প্রথমে বলতি ফাতেমার জন্য এনেছিস পছন্দ হয় নাই তাই আমাকে দিয়ে দিলি। এতে দাদীও কিছু বলতো না আমাকে সাহায্য করতে পারলে। আমার বিয়ে করতে করতে ২৪ বছর হয়ে যায় দাদী আমাকে যার তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দিতো কিন্তু তুই তার মাঝে থাকায় দিতে পারেনি। তুই নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ নিয়েছিলি যাতে করে আমার কষ্ট কম হয়। ছোট হয়ে বড় ভাইয়ের মতো দায়িত্ব পালন করেছিস। শাওন যখন টাকার জন্য আসে তুই কেন টাকা দিয়ে দিলি আরে বোকা আমায় জিজ্ঞেস করতি। তুই যেদিন টাকা দিয়েছিস তার পরের দিন আমি এসেছিলাম তোর শাশুড়ী আমায় তোর বাড়িতে যেতে মানা করে।সে আমায় বলেছে আমি যদি এইবাড়িতে আসি তাহলে ফাতেমাকে নিয়ে যাবে আর দিবে না তাই।আমি আসিনি। তুই ওনাকে কিছু বলিস না। সব মাই চায় তার মেয়ে ভালো থাকুক। এখানে উনি চেয়েছে উনার মেয়ে যেনো ভালো থাকে উনি তোমার কথাও ভেবেছে তুমি কতো কষ্ট করে কাজ করছো তার উপর এতো গুলো টাকা দিয়ে দিলে।আমি কখনো আর আসবো না। হ্যা ঠিকই আসবো না ওনার কথার জন্য না নিজের জন্য চলে যাচ্ছি বহুদূর। এক অচেনা শহরে যেখানে কষ্ট দেওয়ার মতো কেউ থাকবেনা। অনেক কথা বললাম এবার শেষ কথা শোন তোর মেয়ে হলে মেয়ের জন্য কিছু করে যাবি নয়তো তারও অবস্থা আমার মতো হবে।আর বিয়ে দেওয়ার আগে দেখেশোনে বিয়ে দিস। বিয়ে দিয়ে খোজ খবর নিবি।বাবা হওয়ার সব দায়িত্ব পালন করাবা ভালো মতো আর একটা কথা শাওনের সাথে আমি সুখি ছিলাম না তাদের নানান অত্যাচারে আমি দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। না ঠিক মতো খেতে পেরেছি না ঘুমাতে কিন্তু শাওনের দুইবোন খুব ভালো আমায় অনেক ভালোবাসে। শাওন আজকে আমায় বলেছে তোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতাম। টাকা না নিলে যেনো আমার মুখ না দেখাই শাওনের এই কথাটা আমি রাখলাম সত্যি আমার মুখ আর দেখাবো না শাওনকে। শেষ বারের মতো তোকে সব বলে দিলাম কারন তোর জানার দরকার আমি কেন চলে গিয়েছি। আমাকে খোজে লাভ নেই পাবি না আমায় তার চেয়ে ভালো নিজের খেয়াল রেখে ভালোভাবে সংসার করো। ফাতেমার খেয়াল রেখো মায়ের যত্ন নিও। আর দাদীরও খেয়াল রেখো।ভালো থেকো।
তোকে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিলো কিন্তু তোর সাথে দেখা হলে তুই আমাকে দেখলে যেতে দিবি না তাই আমি তোর আড়ালেই চলে যাচ্ছি ভাই।

ইতি
তোমার বড় বোন আলো

ফাতেমা চিঠিটা পড়ে তার মায়ের সাথে অনেক রাগারাগি চিল্লাচিল্লি করছে। চিঠি পড়ে সে খুব করে কাদছে। এখন বুঝলো আকরামের কেমন লেগেছে সে কেনো এতো কেদেছে আর কেনো কাদে। ৮ মাসের শেষের দিকে পড়েছে ফাতেমা এভাবে চিল্লাচিল্লির ফলে পেটে অনেক ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। ফাতেমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। অবশেষে আকরাম ও ফাতেমার কোল জুড়ে এলো ছোট একটি পরী একটি মেয়ে বাবু জন্ম হলো। এটাই আকরাম চেয়েছে । পরম আদরে নিজের মেয়েকে ভালোবাসছে আদর করছে। নিজের মাকে সবাইকে বলছে তার মেয়ে হয়েছে। নিজের দাদীকে ৫০ বার জানিয়েছে তার মেয়ে হয়েছে।

মিষ্টি নিয়ে সবার প্রথম দাদীকে খাইয়ে বলেছে ” আমার মেয়ে হয়েছে ছেলের জন্য অনেক দোয়া করছিলেন আপনার দোয়া কবুল হয় নাই দাদী। আমার মেয়ের সাথে যদি উলটা পালটা কিছু করেননা খবর আছে আপনার ”

মেয়ের নাম রাখা হয় আফরা ইসলাম ফারজানা।
আলোর দাদী নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তিনি নিজের নাতনির কাছে ক্ষমা চাইবে। অনেক বড় ভুল করেছে উনি। আকরামকে বলেছে আলোকে নিয়ে আসতে। অনেক খোজাখুজি করছে।

একদিন আলো বাজার করে বাসায় ফিরছিলো তো সামনেই কিছু স্কুল কলেজের ২,৩ জন ছেলে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
আলোর থেকে বয়সে অনেক ছোট। আলো হেটে হেটে যাচ্ছিলো হঠাৎ ছেলেগুলো আলোকে দেখে বাজে মন্তব্য করছিলো। আলো এক নজর ছেলেদের দেখে চলে গেলো।
একটু সামনে গিয়ে আশেপাশের কয়েকটা দোকানদারদের জিজ্ঞেস করলো ছেলেদের ব্যাপারে। দোকানি বলল এলাকার স্থানীয় ছেলে গুলো। ভদ্র পরিবারের ছেলে এখানেই বসে থাকে। আলো তাদের নাম জিজ্ঞেস করলো। একজন রিফাত,অনিক,সাগর। তাদের ঠিকানা নিয়ে নিলো। এরপর বাসায় চলে গেলো।

পরের দিন সকালে রিফাত ঘুম থেকে উঠে নিজেদের ড্রইং রুমে এসে অবাক। মূহুর্তেই ঘা ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।
কি করবে বুঝতে পারছে না। কারন তার মায়ের সামনে বসে আছে গতকালকের সেই মেয়ে। দুজনে কথা বলছে। রিফাত তার মাকে খুব ভয় পায়। রিফাত যলদি ঘুরে নিজের ঘরে পা বাড়ালো আর ওমনি তার মায়ের ডাক।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে