অস্পষ্টতা – পর্ব : ৬

0
1937

#অস্পষ্টতা
পর্ব – ৬

লেখা : শঙ্খিনী

মা বাসায় নেই, বেড়াতে গেছে গ্রামের বাড়িতে। সম্ভবত আমাদের আরেকটু বেশি সময় একা থাকার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিল।

তারিফ তো বাসায় এসেই ঘুমিয়ে পরলো। খুব ক্লান্ত হয়ে পরেছিল বেচারা।

সেদিন সন্ধ্যার পর বাইরে হচ্ছিল ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি হলেই আমার ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু একা একা ভিজে কোনো মজা আছে না-কি? ঠিক করলাম, তারিফকে সাথে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো। বুঝতে পারছিলাম, ওকে সাথে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো ঠিক করলেই করা সম্ভব নয়। তারিফ তখন বসে ছিলো বসার ঘরে।

আমি ছোট ছোট পা ফেলে ওর কাছে গিয়ে বললাম, “একটা কথা বলি?”
তারিফ বলল, “বলো।”
“দেখো না, বাইরে কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে!”
“দেখেছি।”
“আমার না খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে। তুমিও আমার সাথে ভিজবে প্লিজ!”
“পাগল হয়ে গেলে না-কি তুমি?”
“পাগল হতে যাবো কেন?”
“না, তোমার কথাবার্তা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। এই ডেঙ্গুর সিজনে কেউ বৃষ্টিতে ভিজে না-কি? আমি তো ভিজবোই না, তুমিও ভিজবে না খবরদার!”
“পাগল আমি না পাগল তুমি? বৃষ্টিতে ভেজার সাথে ডেঙ্গুর কি সম্পর্ক? ডেঙ্গু তো হয় এসিড মশা কামড়ালে!”
“ম্যাডাম আশফা, মনে আছে বলেছিলাম – একটা কথা বলার আগে সেটা বলার পরিণাম কি হবে ভাবা উচিত!”
“মনে আছে। খুব ভালো মনে আছে।”
“তেমনি, একটা কাজ করার আগেও সেটা করার পরিণাম নিয়ে ভাবতে হয়। এখন যদি তুমি বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হয়ে যাও, একশ পাঁচ জ্বর আসে তাহলে কি হবে? কোন হসপিটালে নিয়ে যাবো তোমাকে? সব হসপিটাল ডেঙ্গু রোগীতে ভরা! কেউ তোমাকে ভর্তি নিবে না।”
আমি কঠিন গলায় বললাম, “তোমার সাথে কথা বলতে আসাটাই আমার ভুল ছিল। গেলাম আমি!”
“ঠিকাছে যাও। বৃষ্টিতে ভিজবে না কিন্তু।”

তারিফের নিষেধে কর্ণপাত করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি সোজা চলে গেলাম ছাদে। মন খুলে বৃষ্টিতে ভিজলাম। ছোটবেলায় আমি বৃষ্টিতে ভিজতাম আমার আপার সঙ্গে। আপা বলত, “বৃষ্টির জল মনকেও শুদ্ধ করে দেয়।”

হঠাৎ কিছুক্ষণ পর ছাদের দরজার সামনে তারিফ এসে দাঁড়াল।

তারিফ রাগী গলায় বলল, “আশফা!”
আমি চুপ করে রইলাম।
তারিফ আবার বলল, “এই আশফা!”
“কি?”
“আমার কথা তাহলে শুনলে না তাহলে! বারবার করে মানা করে দিলাম। কিন্তু না, আমার কথার তো কোনো দামই নেই।”
“যুক্তিযুক্ত কথা হলে ঠিকই দাম থাকতো!”
“যুক্তিযুক্ত কথাই ছিল। এখন তুমি ভিতরে আসো!”
“মোটেও না!”
“আশফা আসো!”
“বললাম তো না।”

ছেলেটা অমনি ছাদে এসে আমাকে কোলে তুলে ভিতরে নিয়ে গেলো। একটু শান্তিতে বৃষ্টিতে ভিজতেও দিবে না। পাগল একটা ছেলে!

পাগল হলেও তারিফের কথাই ঠিক হলো। রাতে আমার মাথা ভার হয়ে এলো, প্রচন্ড মাথাব্যাথা। মাথাব্যাথা এতটাই তীব্র যে ঘুমাতেও পারছিলাম না, এপাশ ওপাশ করছিলাম।

তারিফ হঠাৎ বলল, “ঘুমাওনি আশফা।”
আমি ইতস্তত করে বললাম, “এইতো, ঘুমাচ্ছি!”
“ঘুম আসছে না?”
“আসছে।”
“তাহলে ঘুমাচ্ছো না কেন?”

এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। মাথাব্যথার কথাটা তারিফকে বলা যাবে। বললেই বকা খাবো।

তারিফ আবার বলল, “তুমি ঠিক আছো তো আশফা?”
আমি কাঁপা গলায় বললাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।”
তারিফ আমার কপালে হাত রেখে বলল, “জ্বর এসেছে তো! তোমাকে না মানা করলাম বৃষ্টিতে ভিজতে। আমার কোনো কথাই পাত্তা দাও না!”

যেটার ভয় পেয়েছিলাম সেটাই হলো! তারিফ বিছানা থেকে উঠে গিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলো।

আমি বললাম, “আমি খুঁজছো তারিফ?”
“থার্মোমিটার।”
“আরে থার্মোমিটার লাগবে না! তুমি আসো তো। একটু পরেই জ্বর কমে যাবে।”
তারিফ কঠিন গলায় বলল,“তুমি আর কথা বলো না তো!”

তারিফ থার্মোমিটার এনে আমার মুখে দিল। কিছুক্ষণ পর সেটা মুখ থেকে বের করল কত জ্বর তা দেখার জন্য।

আমি বললাম, “জ্বর কত?”
“তোমাকে জানতে হবে না!”
“একশ পাঁচ না তো?”
“আরে না!”
“একশ চার?”
“উফ, তুমি নিজেই দেখে নাও।”

তারিফ আমার হাতে থার্মোমিটার ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একশ এক জ্বর! এতক্ষণে যে বকা খেতে খেতে আমি ক্লান্ত হয়নি, এইতো অনেক!

স্যার প্রথমে আমাকে ওষুধ খাওয়ালেন। এরপর একটা আইস ব্যাগ এনে আমার কপালে রাখলেন।

তারিফ শান্ত গলায় বলল, “একটু ভালো লাগছে না?”
“হুঁ।”
“দেখলে তো, আমার কথা না শুনলে কি হয়।”
“হুঁ।”

তারিফ একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছিল। আমি “হুঁ, হুঁ” করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম, কে জানে!

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি তারিফের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম। আর বেচারা হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে।

আমি উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ালাম। মাথাটা এখন অনেক হালকা লাগছে। জ্বর সেরে যাওয়ার পর যে অনুভূতিটা হয়, সেটা খুবই অদ্ভুত। ভালো লাগে না, আবার খারাপও লাগে না।

হঠাৎ তারিফ এসে পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

আমি বললাম, “সারারাত একটুও ঘুমাওনি না?”
“তোমার জ্বর কমেছে ভোর বেলায়। ঘুমাই কিভাবে?”
“জ্বর এসেছিল আমার, তোমাকে সারারাত জেগে থাকতে হবে কেন?”
“তোমাকে ওভাবে ফেলে রেখে আমার খুব ঘুম আসতো না?”
“তুমি এমন কেন তারিফ?”
“তোমার জন্য।”
“আমি কি এতটাই স্পেশাল?”
“আমার কাছে তো তুমি পৃথিবীর সবথেকে স্পেশাল মানুষ।”

এই ছিলো আমার জীবনের প্রথম অধ্যায়। আনন্দময়, সুখময় আর পাগলামিতে ঘেরা।
বিয়ের একটা বছর এই আনন্দ-সুখের মধ্য দিয়েই পাড় করে দেই আমরা। এসব ভাবলে এখনো চোখে জল চলে আসে কেন কে জানে!

আমি আর মা কিছুক্ষণ ছাদে থেকে বিকেলের মধ্যেই ঘরে চলে আসি।

ঘরে এসেই অফিসের কাজ নিয়ে বসে পরি। ওয়ার্ক ফ্রম হোম একটা বিশ্রী জিনিস। অফিসের কাজ অফিসে আর বাসার কাজ বাসায় – এটাই আমার নীতি। কিন্তু অফিস আর বাসা দুটোকে মিলিয়ে দিলে ব্যাপারটা মোটেই সহ্যকর হয় না।

রাত প্রায় নয়টার দিকে মা ফোন হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে এলো আমার ঘরে।

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “কি হয়েছে মা?”
মা থেমে থেমে বলল, “আশফা মা, তারিফ তোর সাথে কথা বলবে।”
“কি? তারিফ? আমার সাথে কথা বলবে?”
“হ্যাঁ।”

মা আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফোনটা হাতে নিয়ে আমার হাত কাপছে। আমি সাহস করে ফোনটা কানে নিলাম।

কাঁপা স্বরে বললাম, “হ্যালো?”
ওপাশ থেকে আমার খুব পরিচিত গলাটা বলে উঠলো, “হ্যালো, আশফা?”

তারিফের কণ্ঠস্বর এখনো আগের মতোই আছে। প্রথম যেদিন ছেলেটার সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম, সেদিনের মতো আজও মনে হচ্ছে এত সুন্দর পুরুষকণ্ঠ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।

আমি বললাম, “কেমন আছো তারিফ?”
“হুঁ, ঠিক আছি। আচ্ছা শোনো, তোমরা বাইরে যাও না তো?”
“না।”
“মাকে বাইরে যেতে দিও না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে যেন মাস্ক পরে যায়।”
“আচ্ছা।”
“প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আনতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, অনলাইনে অর্ডার করবা। আর বাসার ভিতরে আনার আগে সানেটাইজ করে নিও।”
“ঠিক আছে।”
“রাখলাম তাহলে।”

তারিফের কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কান্নায় গলা জড়িয়ে এসেছিল, তাই ছোট ছোট উত্তর দিয়েছি।

যে তারিফ পৃথিবীর সকল কষ্ট সহ্য করে ফেলতো শুধুমাত্র আমার জন্য, আর যে আমি তারিফের আশেপাশে না থাকলে প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলতাম – সেই আমরা এতটা বদলে গেলাম কেন?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে