#অস্পষ্টতা
পর্ব – ৫
লেখা : শঙ্খিনী
সত্যিই, আমাদের বিয়ের দিনটা পাগলামিতে ভরা ছিল। দিনটার কথা মনে করে এখনো হাসি। ইশ! আবার যদি সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারতাম।
মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত। আমি কি কখনো ভেবেছিলাম আমার জীবন এমন হবে? একটা সময় আমার জীবন ছিল শুধু তারিফকে ঘিরে। আর এখন, শুধুমাত্র আমাদের স্মৃতিগুলোকে আকড়ে ধরে বেঁচে আছি। সেই স্মৃতিগুলোই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। মা তাড়াহুড়ো করে আমার ঘরে ঢুকলেন।
আমি বললাম, “কি হয়েছে মা? কিছু বলবে?”
মা থেমে থেমে বলল, “না, রে।”
“তাহলে? এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”
“আমরা কোভিড টেস্ট করলাম না?”
“হ্যাঁ।”
“রেজাল্ট এসেছে?”
“জানিনা। মোবাইলে ম্যাসেজ আসবে।”
“একটু চেক কর না!”
আমি মোবাইল বের করে টেস্টের রিপোর্ট খুঁজতে লাগলাম।
মা বলল, “এসেছে?”
“হুঁ।”
“রেজাল্ট কী?”
“নেগেটিভ! আমাদের পজিটিভ হতে যাবে কেন?”
“যাক বাবা, বাঁচলাম!”
“টেনশনে ছিলে না-কি?”
“একটু টেনশন তো করতেই হয়। নেগেটিভ যখন এসেছেই, এবার তো একটু বাইরে যেতেই পারি।”
“মা কোভিড টেস্ট নেগেটিভ আসা মানেই কিন্তু তুমি সেফ না। এই নেগেটিভ যেকোনো সময়ে পজিটিভ হয়ে যেতে পারে।”
“তাই বলে এভাবে ঘরের মধ্যে বন্দী থাকা যায় না-কি? কতদিন বাইরে যাই না! তুই তো বাগানেও যেতে দিস না!”
“মা, আমি কতবার বলেছি মালিটাকে আসতে মানা করে দাও তাহলেই আমি তোমাকে বাগানে যেতে দিবো।”
“মালিকে আসতে মানা করলে এতগুলো গাছ সামলাবে কে?”
“তাও ঠিক! আচ্ছা, আমাদের ছাদে কি কেউ যায়?”
“মৌসুমী প্রতিদিন যায়, কাপড় মেলতে।”
“মৌসুমী বাদে আর কেউ যায়?”
“না।
“ঠিক আছে। তাহলে আজ বিকেলে তোমাকে ছাদে ঘুরতে নিয়ে যাবো।”
“সত্যি?”
“সত্যি!”
কথা রাখতে মাকে নিয়ে বিকেল বেলা গেলাম ছাদে। কতদিন বর ঘর থেকে বের হলাম! চেনা ছাদটাও অচেনা লাগছে আজ।
মা আমাকে বিরক্ত গলায় বলল, “এখানে তো কেউ নেই। মাস্ক পরে থাকতে হবে কেন?”
“কারন আমি বলেছি!”
“তুই বললেই হলো?”
“হুঁ হলো! এখন বলো, এখানে এসে ভালো লাগছে না?”
“হ্যাঁ! অনেক ভালো লাগছে।”
বেশ অনেকটা সময় আমরা চুপ করে রইলাম।
শেষে মা নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “তোর সেই টার্কিশ মিষ্টির কথা মনে আছে?”
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“এমনিই, মনে পড়ে গেল। তাই জিজ্ঞেস করলাম তোর মনে আছে কিনা?”
“কিছু স্মৃতি সূর্যের আলোর মতো। দিনের অনেকটা সময় তাকে দেখতে বা অনুভব করতে না পারলেও তার চিরস্থায়ীত্বতা কখনো শেষ হয়ে যায় না।”
“দেখলি, দিলাম তো তোর মনটা খারাপ করে!”
আমি নিচু গলায় বললাম, “মন খারাপ হওয়ার কিছু নেই মা, মনটাই তো নেই।”
টার্কিশ মিষ্টি, আমার একসময়ের খুব প্রিয় এক খাদ্যবস্তু। বিয়ের পর অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় প্রতিদিন তারিফ আমার জন্যে এটা আমার জন্য নিয়ে আসতো।
আমাদের বিয়ের তখন প্রায় এক মাস হয়েছে।সেদিন তারিফ বাসায় ফিরলো আগে আগে।
আমি দরজা খুলে বললাম, “বাহ্, আজ এত তাড়াতাড়ি।”
তারিফ ক্লান্ত গলায় বলল, “কি করবো বলো, বাসায় অনেক দামী একটা জিনিস রেখে যাই তো। সারাটাদিন খুব টেনশনে থাকি।”
“দামী জিনিস? কী?”
“তুমি দেখতে চাও?”
“হ্যাঁ, চাই।”
“তাহলে এক কাজ করো, আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরো। দেখতে পাবে।”
আমি হেসে বললাম, “তারিফ তুমিও না!”
তারিফ আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নাও!”
“আবার সেই টার্কিশ মিষ্টি? তারিফ প্রতিদিন এগুলো আনার কি দরকার বলো তো? পুরো ফ্রিজ মিষ্টিতে ভর্তি! অন্য কিছু রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই।”
“দরকার পড়লে আরেকটা ফ্রিজ কিনবো। তবুও আমি প্রতিদিন এই টার্কিশ মিষ্টি নিয়ে আসবো।”
“কেন?”
“একটা জিনিস নিয়ম করে কেনার মধ্যে যে কি শান্তি লুকিয়ে আছে তুমি জানো?”
“তাই না? তাহলে এখন আপনি ফ্রশ হয়ে এসে আমাকেও শান্তি দেন প্লিজ।”
তারিফ কিছু না বলে, হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি চমকে উঠে বললাম, “কি হলো আবার?”
“এই, আমার না অফিসে একদম ভালো লাগে না। তোমাকে ছাড়া কোথাও ভাল্লাগে না।”
“তাই না?”
“হুঁ! তুমি আমার সাথে অফিসে যাবে?”
“আমি তোমার সাথে অফিসে যাবো?”
“হ্যাঁ!”
“মোটেও না! আমি বাসায় আছি, আরামে আছি, ভালো আছি। এখন প্লিজ ফ্রেশ হয়ে আসো, প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।”
তারিফ কিছুটা মন খারাপ করে বলল, “যাচ্ছি।”
রাতে খাওয়ার পর তারিফ সেই যে নেটফ্লিক্স নিয়ে বসতো আর উঠতো রাত দুটো তিনটার দিকে। এত রাত জেগে সকালে উঠে অফিসে কিভাবে যায় কে জানে! তবে স্যার ভদ্র আছেন। ঘরে বসে টিভি দেখলে আমার ঘুমাতে অসুবিধা হয় বলে বসার ঘরের টিভি দেখে। আমার দায়িত্ব হলো, খাওয়ার পর স্যারকে কফি বানিয়ে দেওয়া।
আমি দায়িত্ব অনুযায়ী কফি বানিয়ে তারিফের কাছে গেলাম।
কফি মগ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “স্যার, আপনার কফি!”
“থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।”
“ইউ আর ওয়েলকাম।”
“তুমি আমার সাথে এই সিরিজটা দেখো না কেন?”
“কী নাম সিরিজের?”
“মানি হাইস্ট।”
“নাহ্, আমার এসব ভালো লাগে না।”
এরমধ্যে মা আসলো বসার ঘরে।
তীক্ষ্ম গলায় বলল, “কিরে তোরা এখনো জেগে আছিস? ঘুমাবি কখন আর উঠবিই বা কখন?”
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “আমি ঘুমাতেই যাচ্ছিলাম মা, কিন্তু তোমার ছেলে এখন ঘুমাবে না। এখন ঘুমালে উনার ফানি হাইস্ট কে দেখবে?”
তারিফ বলল, “ফানি হাইস্ট না মানি হাইস্ট।”
“একই কথা!”
“মোটেই না!”
মা ধমক দিয়ে বলল, “আহ্ তোরা থামবি? আমি যেটা বলতে এসেছি, শোন। বিয়ের পর তো তোরা কোথাও ঘুরতে গেলি না। আমি বলছিলাম যে, এবার কোথাও গিয়ে ঘুরে আয়।”
তারিফ অবাক হয়ে বলল, “ঘুরতে যাইনি মানে? গত পরশুই তো শপিংয়ে গেলাম!”
“আরে সেই ঘুরতে যাওয়া না। আমি বলেছি, ঢাকার বাইরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে।”
“ঢাকার বাইরে আবার কোথায় যাবো?”
“সেটা তোরা ঠিক করবি। আমি বাবা এখন ঘুমাতে যাই। আর পাঁচ মিনিট জেগে থাকলেই প্রেসার বেড়ে যাবে। তোরা থাক।”
এই বলেই মা উঠে চলে গেল।
তারিফ আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলল, “আচ্ছা, মা কি আমাদের ইন্ডায়রেক্টলি হানিমুনে যেতে বলল?”
আমি বললাম, “অবশ্যই। নিজেকে এত বুদ্ধিমান দাবি করো, আর এতটুকু বুঝতে পারলা না?”
“হয়েছে আমাকে পচানো? এখন কাজের কোথায় আসি! ঠিক করো কোথায় যাওয়া যায়!”
“আমি হুট করে ডিসিশন নিতে পারি না, তুমি বলো।”
“কক্সবাজার?”
“নাহ্! কক্সবাজারে অনেক গিয়েছি।”
“কিন্তু তোমার তো সমুদ্র পছন্দ!”
“সমুদ্র পছন্দ বলেই কক্সবাজারে যেতে হবে না-কি?”
“তাহলে কুয়াকাটা?”
“সেই একই তো কথা হলো! দেখো, আমি জীবনে যতবারই ঘুরতে গিয়েছি, প্রত্যেকবারই গিয়েছি সমুদ্র দেখতে। এবার আর সমুদ্রের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না।”
তারিফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “বান্দরবানে গিয়েছ কখনো?”
“না।”
“জায়গাটা অনেক সুন্দর, যাবে?”
“হুঁ!”
এক সপ্তাহ পর আমরা চলে গেলাম বান্দরবানে। নামটা অদ্ভুত হলেও জায়গাটা বেশ সুন্দর। এত সবুজ একসঙ্গে আমি কোনো দিনও দেখিনি। আমাদের রিসোর্টটা তার থেকেও সুন্দর।
প্রথমদিন আমরা আর কোথাও বের হলাম না, এতদূর বাস জার্নি করে খুব টায়ার্ড ছিলাম। রাতে বেশ শান্তির একটা ঘুম হলো। কিন্তু সেই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। আমি ঘুমাচ্ছিলাম,
তখনি তারিফ আমাকে ধীরে ধীরে ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই আশফা! আশফা!”
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, “কি?”
“উঠো!”
“উঠো মানে?”
“উঠো মানে উঠো!”
“উঠবো কেন?”
“মানুষ কি বেড়াতে এসে ঘুমিয়ে থাকে না-কি?”
“উফ! কয়টা বাজে?”
“পাঁচটা।”
“কি?”
“পাঁচটা!”
“এত সকালে উঠবো কেন?”
“সূর্যোদয় দেখবো!”
“কি?”
“এত কি কি করো কেন? যাও না, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো প্লিজ।”
“উফ তোমার এই নাছোড়বান্দা স্বভাব কবে যাবে বলোতো?”
“নাছোড়বান্দা আবার কি? আমি হলাম মিস্টার উনস্টপেবেল। আমাকে বা আমার সিদ্ধান্তকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। এখন উঠো তো!”
তারিফের সঙ্গে তর্ক করে কোনোই লাভ নেই। সে একবার যা বলবে, তা-ই হবে। আমি বাধ্য হয়ে উঠে গেলাম ফ্রেশ হতে।
হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি স্যার রিসোর্টের লনে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখছেন। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কিছুটা কঠিন গলায় বললাম, “তোমার কান্ডকারখানা আমি কিছুই বুঝি না। সূর্যোদয় দেখবে, ভালো কথা। আমাকে সাথে নিয়ে দেখতে হবে কেন? কেউ কখনো বউকে ঘুমের মাঝ থেকে তুলে এনে সূর্যোদয় দেখে না-কি?”
“কেউ দেখে না, শুধু আমি দেখি। অন্য কেউ কিভাবে দেখবে? আমার তো আর আমার মতো সুন্দরী বউ নেই।”
“তোমার তো শুধু আমাকে অকেশনালি সুন্দর লাগে।”
“ভুল বললে। আমার তো তোমাকে একেক অকেশনে একেক রকম সুন্দর লাগে।
তুমি হাসলে এক রকম সুন্দর, কাঁদলে আরেক রকম সুন্দর, রাগলে আবার আরেক রকম সুন্দর আর ঘুমিয়ে থাকলে আরেক রকম।”
আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলাম। খেয়াল করলাম, তারিফ একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি বললাম, “এভাবে কি দেখছ?”
“তোমাকে।”
“আমাকে আবার দেখার কি হলো, রোজই তো দেখো!”
তারিফ আমার হাত দুটো ধরে বলল, “তোমাকে এতটা ভালোবাসি কেন আশফা?”
“জানি না। তবে এটা জানি, যে আমি তোমাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসি। আমার মতো করে তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। তুমিও না।”
“একদিন যদি এই ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়?”
“কোনোদিনও না। তোমার ভালোবাসা শেষ হয়ে যেতে পারে কিন্তু আমার ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না।”
“আমার ভালোবাসাও শেষ হবে না।”
“আচ্ছা, দেখে নিবো!”
“দেখে নিও। আশফা?”
“হুঁ?”
“আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না প্লিজ।”
“আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো না তারিফ। প্রকৃতি আমাকে সেই ক্ষমতা দেয়নি।”
“আর যদি দিয়ে দিতো?”
“দিলেও সেই ক্ষমতার কোনো মূল্য থাকতো না।
বান্দরবানে তথাকথিত হানিমুন, খুব ভালো কাটলো আমাদের। নিভৃতে, নির্জনে শুধু আমরা দু’জন। জীবনটা যদি বান্দরবানের সবুজের মাঝে থেকে থাকতো, কতই না ভালো হতো।
ঘোরাঘুরি শেষ করে ছয় দিন পর ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় এসে দেখি আরেক কান্ড!
(চলবে)