#অস্পষ্টতা
পর্ব – ৩
লেখা : শঙ্খিনী
আমাদের স্যাম্পল নিতে এলো। স্যাম্পল দেওয়ার সময় আমার মা তো ভয়ে অস্থির! যতই বলছিলাম, “মা চোখ বন্ধ করে থাকো!” ততই চোখদুটো খুলে ফেলছিল সে।
তারিফ আবার এতটা ভীতু না। সে সাহসী, যথেষ্ট সাহসী। তার সাহসিকতার পরিচয় আমি পেয়েছিলাম তিন বছর আগে, আগস্ট মাসের ২৯ তারিখে।
রোজকার দেখা করার স্থানে চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছিলাম আমি। তারিফ তখনো এসে পৌঁছায়নি। আমি দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি, চোখ মুখ আমার রক্তশূন্য।
তারিফ এসে আমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার কপালে হাত রেখে বলল, “কি ব্যাপার? এরকম দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”
আমি কিছুটা চমকে উঠে বললাম, “একটা ঝামেলা হয়ে গেছে?”
“কি ঝামেলা?”
“আমার মামা মামী এখানকার ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিয়ে নারায়নগঞ্জে চলে যাচ্ছে। সেখানে আমার নানার বাড়ি আছে, এখন থেকে সেখানেই থাকবে।”
“তো?”
আমি বেশ রেগে গিয়ে বললাম, “তো মানে? তারা এখান থেকে চলে গেলে আমি থাকবো কোথায়? আমার কাছে একটাই মাত্র অপশন। সেটা হলো তাদের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে চলে যাওয়া। কিন্তু আমি তো যাবো না। এখানে আমার ক্যারিয়ার পরে আছে, আমাদের ভবিষ্যত পরে আছে। সবকিছু ছেড়ে আমি চলে যাবো?”
আমার কথাগুলো শোনার পর তারিফ বেশ অনেকটা সময় চুপ করে রইলো, গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছিল।
অবশেষে মুখ খুলে বলল, “চলো এক কাজ করি!”
“কি?”
“আমরা বিয়ে করে ফেলি!”
আমি চমকে উঠে বললাম,“হ্যাঁ?”
“হ্যাঁ কী?”
“মানে, কি বলছো তুমি?”
“ঠিকই বলছি। তুমি চিন্তা করে দেখো, এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় আছে?”
“উপায় নেই, তাই বলে বিয়ের মত একটা ডিসিশন এভাবে হুট করে নিয়ে নেব?”
“এই পরিস্থিতিতে ডিসিশন হুট করেই নিতে হবে।”
“আচ্ছা, নিলাম ডিসিশন। আমার মামা মামীকে কি বলবো? তোমার মাকেই বা কি বলবো?”
“তোমার মামা মামীকে সত্যি কথা বলবো, আমার মাকেও সত্যি কথা বলবো। এখানে ভনিতা করার তো কিছু নেই!”
“ওহ্ আচ্ছা! তুমি তাদের সামনে অনর্গল সত্য কথা বলে যাবে আর তারা খুব সহজে মেনে নেবে না?”
“না মানার কি আছে? তুমি তো আনাড়ি মেয়ে কোনো নও। আর আমিও দিশেহারা বেকার যুবক না যে তারা মেনে নিবে না? এটা বাংলা সিনেমা না যে মানামানি করতে হবে!”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “আচ্ছা ঠিকাছে। ধরলাম তারা মেনে নিলো। কিন্তু তাতেও তো কোনো লাভ হবে না! আমার মামা মামী আগামী সপ্তাহে চলে যাচ্ছেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় আয়োজন কি সম্ভব না-কি?”
“আয়োজন?”
আমি বললাম,“হুঁ!”
“আয়োজনের আবার কি আছে? কাজী অফিসে যাবো। কবুল, কবুল, কবুল – তিন কবুল বলতে সর্বোচ্চ তিন সেকেন্ড সময় লাগবে। তোমার তিন সেকেন্ড আমার তিন সেকেন্ড, ছয় সেকেন্ডের মামলা!”
“ছয় সেকেন্ড না?”
“হ্যাঁ!”
“তোমার সাথে না আমার আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। আমি গেলাম!”
“কোথায় যাচ্ছ?”
“বাসায়।”
“দাঁড়াও, আমিও তোমার সাথে যাবো!”
“মানে? কেন?”
“তোমার মামা মামীর সাথে বিয়ের কথা বলতে!”
“তারিফ দেখো, অনেক্ষণ যাবৎ তোমার ছেলেমানুষী সহ্য করছি। আর পারবোনা। প্লিজ ছেলেমানুষীটা বন্ধ করো।”
“এটাকে তুমি ছেলেমানুষী বললে ছেলেমানুষী, প্রাক্টিক্যালিটি বললে প্রাক্টিক্যালিটি। এখন চলো। আচ্ছা, বিয়েটা সেরে যাবা নাকি তাদের সাথে দেখা করার পর বিয়ে করবা?”
আমি রাগী দৃষ্টিতে তারিফের দিক তাকালাম।
তারিফ মুখে হাসির আভাস নিয়ে বলল, “ঠিকাছে চলো, আগে দেখাই করি।”
অনেক ভয়ে ভয়ে তারিফকে নিয়ে হাজির হলাম আমার মামার কাছে। ধরেই নিয়ে ছিলাম, আজ আমি শেষ! কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখি ভিন্ন চিত্র। যে ছেলেটা একটু আগে আমার সাথে তর্ক করছিল, সে এখন কি মিষ্টি করে কথা বলছে। মাত্র সাড়ে চার মিনিটের মধ্যে পটিয়ে ফেলল আমার মামাকে।
মামা আর তারিফ বসার ঘরে বসে গল্প করছে। আর আমি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছি।
গল্পের এক পর্যায়ে মামা চোখ দুটো উজ্জ্বল করে বলল, “তোমার বাবা আরিফুল চৌধুরী?”
তারিফ শান্ত গলায় বলল, “জি।”
“চৌধুরী গ্রুপস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ তাহলে তোমাদের?”
“জি।”
“বলে কি? তোমার বাবা বেঁচে থাকতে তোমাদের কোম্পানির সাথে কতগুলো ডিল করেছিলাম!”
“তাই না-কি? আপনার কোম্পানীর নাম কি?”
“আমার কোম্পানির নাম টাম নাই! ডিল হতো সব আমার নামে। তোমার বাবা আরিফুল সাহেব ছিলেন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তুমি পেয়েছো বাবার সভ্বাব।”
এদিকে রান্নাঘরে মামী চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে আমাকে বলল, “ছেলেটা কে রে?”
আমি রাগী কণ্ঠে বললাম, “এতক্ষণ যাবৎ নিজের গুণগান গাইছে, শোননি?”
“শুনেছি। কিন্তু তোর কি হয়?”
“আমার বেয়াই হয়।”
“কি যাতা বলছিস!”
“জানি না মামী, আমার মাথা কাজ করছে না। একটু চা দাও তো!”
“বাড়িতে মেহমান। আগে তাকে চা না দিয়ে তোকে দিবো, তা হয় না-কি?”
“আরে ও চা খেয়ে কি করবে? তুমি আমাকে দাও তো!”
মামী আমার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে, তাদের জন্যে চা নাস্তা নিয়ে বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
মামী ঢুকতেই তারিফ বলে উঠলো, “আমি আসলে আপনার কাছে এসেছি একটা পারমিশন নিতে!”
মামা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “পারমিশন? আমাদের কাছে? আমাদের কাছে কিসের পারমিশন?”
তারিফ থেমে থেমে বলল, “আমরা দু’জন, মানে আমি আর আশফা একে অপরকে অনেক পছন্দ করি। আশফা আপনাদের আগেই বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেনি।”
“আশফার মাথায় আসলেই কিছু নেই! সাহস করে উঠতে না পারার কি হলো? আমরা কি বাঘ না ভাল্লুক, যে পছন্দের কথা বললেই খেয়ে ফেলবো!”
“সেটাই! আমি তো কতবার বলেছি, আমার কথা শুনলে তো! এখন, আপনারা যখন নারায়নগঞ্জে শিফট করার ডিসিশন নিলেন তখন তো বেচারি ভীষন টেনশনে পরে গেছে। আমাকে ছেড়ে না-কি কোথাও যেতে পারবে না। বলেন তো কি একটা ব্যাপার! এমনকি এখানে আসার আগেও কাজী অফিস হয়ে আসতে চেয়েছিল। তখন আমিই বললাম, বিয়ে যখন করবো অভিভাবকদের জানিয়েই করবো।”
ছেলেটা বলে কি! ওর কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। বিয়ে করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে তারিফ আর দোষ দিচ্ছে আমাকে! এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না। তাই আমি গিয়ে দাড়ালাম বসার ঘরের সামনে।
মামা আমাকে বললেন, “কিরে আশফা! আমাদের এতটাই পর মনে হয়? তারিফ নিজে থেকে না বললে তো আমরা কখনো জানতেই পারতাম না!”
আমি ইতস্তত হয়ে বললাম, “আসলে মামা হয়েছে কি…”
“থাক, আর বলতে হবে না! বিয়ে করবি খুবই ভালো কথা। তাই বলে লুকোছাপা করে বিয়ে! আমি তোর ছোট মামা মামীকে ফোন করছি। আজ সন্ধ্যায়ই তোদের বিয়ে হবে।”
তারিফ টেরা হাসি হেসে বলল, “থ্যাংক য়্যু আঙ্কেল। আমি ভাবতেই পারিনি আপনি সবকিছুকে এত সহজ ভাবে দেখবেন।”
মামা বলল, “সহজ ভাবে না দেখার কি আছে? আমার ভাগ্নিটাই তো গাঁধা! বাবা তুমি খুব ভালো কাজ করছো। আর আজ বিয়ে নিয়ে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?”
“না, না। কি যে বলেন, আমার আপত্তি থাকবে কেন?”
“ভালো কথা, তোমার পরিবার জানে তো সবকিছু? তাদেরও খবর দাও!”
“আঙ্কেল আমার পরিবার বলতে আপনার মা। সে এখন গেছে চট্টগ্রামে বেড়াতে। আমি মাকে ফোন করে সব বলে দিয়েছি। আজকে বিয়ে হলে তার কোনো আপত্তি থাকার কথা না।”
“তাহলে তো হয়েই গেল! তুমি এক কাজ করো এখন, তোমার বন্ধু বান্ধবদের খবর দাও।”
“আমি বরং নিজে গিয়েই তাদের নিয়ে আসি।”
“তা-ই করো। এই আশফা, তুইও ওর সঙ্গে যা! তোর বান্ধবীদের নিয়ে আয়। শীলা না মিলা কি যেন নাম তোর ওই বদ বান্ধবীটার! ওটাকেও নিয়ে আসিস।”
আমি ভাঙা গলায় বললাম, “জি মামা।”
আমাদের বাসা থেকে তারিফ আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমরা চেপে উঠলাম একটা রিকশায়।
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এসব কি ছিল তারিফ?”
তারিফ অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল, “কোনসব?”
“আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি না? আমি চেয়েছিলাম কাজী অফিস হয়ে বাসায় যেতে?”
“না, আমি চেয়েছিলাম।”
“তাহলে মিথ্যা বললে কেন? কতগুলো কথা শুনতে হলো তোমার জন্য।”
“আশফা, একটা কথা বলে দিলেই হয় না। কথাটা বলার আগে, সেটা বলার পরিণাম কি হবে – এই নিয়ে চিন্তা করতে হয়।”
“তো তুমি কোন পরিণামের কথা চিন্তা করে কথাটা বললে?”
“দেখো, যদি আমি তোমার মামার সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো করে বলতাম, ‘চৌধুরী সাহেব আমি আপনার ভাগ্নিকে ছাড়া বাঁচবো না! আমি আশফাকেই বিয়ে করবো, আমি যা পারেন করেন।’ তাহলে কি উনি এত সহজভাবে আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিতেন? নিশ্চই না।”
“কেন না?”
“কারন তাহলে উনি ভাবতেন, আমি একজন খারাপ ছেলে। আর খারাপ ছেলের সঙ্গে ঘরের মেয়ের বিয়ে? প্রশ্নই ওঠে না।”
“খারাপ ছেলে ভাবতে যাবে কেন?”
“একটা ছেলে একটা মেয়েকে পছন্দ করলেই সে খারাপ ছেলে, এটাই বাঙালি পরিবারগুলোর স্ট্রেটিজি। কিন্তু যদি তাদের মেয়েই ছেলেটাকে পছন্দ করে বসে থাকে? তখন তো আর তাদের কিছু করার নেই।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “বুঝলাম। তা, এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“আমার বাসায়। তোমার মামাকে তো আমাদের ব্যাপারে জানিয়ে আসলাম। এখন আমার মাকে জানাতে যাচ্ছি।”
“তুমি না বললে তোমার মা চট্টগ্রামে! ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছো!”
“আমার মা ঢাকাতেই আছেন এবং আমাদের ব্যাপারে কিচ্ছু জানেন না।”
আমি আবার তীক্ষ্ম গলায় বললাম, “তোমার এই মিথ্যাটা বলার পরিণাম কি হবে?”
“সেটা একটু পরেই জানতে পারবে। আর
শোনো, তোমার মামার সামনে যেমন চুপ করে ছিলে আমার মায়ের সামনেও চুপ করে থাকবে। কেবল আমার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাবে আর না-তে না। বুঝছো?”
“জানি না। আমার মাথা একদমই কাজ করছে না।”
“কবুল বলার আগ পর্যন্ত মাথা কাজ না করলেও চলবে।”
“কি?”
“কিছু না। আপাতত তুমি মাথায় ঘোমটা টেনে বসে থাকো?”
“ঘোমটা টেনে বসে থাকো মানে? ঘোমটা দিবো কেন? আমি কি নতুন বউ না-কি?”
“আহ্, যা বলছি করো না!”
তারিফের কথামতো ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম তারিফদের বাড়ির সামনে। ওদের বাড়িটা দেখে আমি তো অবাক!
(চলবে)