#অস্পষ্টতা
পর্ব – ২
লেখা : শঙ্খিনী
তারিফের সঙ্গে প্রথম দেখার ছয় মাস পর আবার দেখা হয়। সেদিন খামারবাড়ির কোনো এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বিশাল অডিটরিয়ামে বসে অনুষ্ঠান দেখছি। হঠাৎ চোখ পড়লো আমার দুই সিট পরে বসে থাকা ছেলেটার দিকে। সেই ছেলেটা ছিল আমার তারিফ।
ওকে দেখে উৎসাহিত কণ্ঠে বললাম, “ভালো আছেন?”
আমাকে দেখে সে চমকে উঠে বলল, “জি?”
“চিনতে পেরেছেন?”
তারিফ কিছুক্ষণ ভালোভাবে আমাকে লক্ষ্য করলো।
অবশেষে চিনতে পেরে বলল, “ওহ্ হ্যাঁ! কেমন আছেন?”
“এইতো ভালো। আপনি?”
“চলছে। চলুন বাইরে গিয়ে কথা বলি?”
“হ্যাঁ!”
তারিফের সঙ্গে চলে গেলাম অডিটরিয়ামে বাইরে।
তারিফ আমাকে বলল, “বেশ কাকতালীয়ভাবেই দেখা হয়ে গেল না?”
“হুঁ! আমার কাছে কিন্তু আপনার নাম্বার এখনো আছে। ফোন দিতে চেয়েছিলাম অনেকবার, কিন্তু দেইনি।”
সে অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“সাহস হয়নি। যদি কিছু মনে করেন!”
“কিচ্ছু মনে করবো না! আজকে অবশ্যই ফোন দিবেন। আমার কাছে আপনার নাম্বারটা নেই। তাই চাইলেও আমি ফোন করতে পারবো না।”
“নাম্বার না থাকলে, চাইতে তো পারেন।”
“চাইবো না।”
“কেন?”
“নাম্বার চাওয়াটা হবে অভদ্রতা। আমি অভদ্রতা পছন্দ করি না।”
খিলখিল করে হেসে উঠলাম। এমন কোনো হাসির কথা না হলেও কেন হেসেছিলাম কে জানে! হাসির মাঝেই খেয়াল করলাম, স্যার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তার তাকিয়ে থাকা দেখে আমার আরও হাসতে ইচ্ছে করলো।
রাতে বাড়ি ফিরে সবার আগে ফোন করেছিলাম তারিফকে।
মিষ্টি গলায় বললাম, “কি করছেন?”
তারিফ বলল, “কিছু না।”
“কিছু না আবার কি? মানুষ তো সবসময়ই কোনো না কোনো কাজ করে!”
“তাহলে আমি আপনার সাথে কথা বলছি! আপনি কি করছেন?”
আমি হেসে বললাম, “আপনি যার সঙ্গে কথা বলছেন, সেও নিশ্চই আপনার সঙ্গে কথা বলছে!”
“তাইতো! আচ্ছা চলেন না, কাল দেখা করি।”
“কাল? আচ্ছা ঠিক আছে? কোথায় দেখা করা যায়, বলুন তো!”
“এয়ারপোর্টের পিছনে খুব সুন্দর একটা পার্ক আছে। আমার যখন খুব মন খারাপ থাকে, আমি সেখানে চলে যাই। সেখানেই দেখা করি!”
“কালকে আপনার মন খারাপ থাকবে না-কি?”
“না, না মন খারাপ থাকবে না। বরং মনটা অনেক ভালো থাকার সম্ভাবনা আছে।”
পরদিন গেলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। সে এলো নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে। আর আমি লাল রঙের শাড়িতে। সেদিনই প্রথম আমাদের লাল-নীল সংসারের একটা আভাস দেখতে পেয়েছিলাম।
এরপর কেটে গেল অনেকগুলো দিন। প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় একই জায়গায় দেখা করাটা আমাদের একপ্রকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। তারিফ হয়ে উঠলো আমার এক দারুন বন্ধু। আমি নির্বিকার ভাবে আমার সমস্যার কথাগুলো বলতে পারতাম তাকে। জানতাম, পৃথিবীতে এই একটাই মানুষ আছে যার কাছে আমি জাজড হবো না।
একদিন ভয়ে ভয়ে তারিফকে বললাম, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করুন।”
“আমি কি আপনাকে প্রপোজ করতে পারি?”
ছেলেটা একটুও অবাক না হয়ে বলল, “না!”
“কেন?”
“কারন আমি ঠিক করে রেখেছি আমি আপনাকে আগে প্রপোজ করবো। আপনি চাইলেই আমার আগে প্রপোজ করতে পারেন না!”
এই পাগল ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করবো কিভাবে, এই ভেবে জোরে হেসে উঠলাম আমি।
এই ঘটনার দুদিন পর, আমার তৎকালীন বাসার দরজার সামনে দেখি এক জোড়া কানের দুল, বেশ দামী কানের দুল। তার ঠিক পাশেই দেখতে পেলাম এক গাদা বেলি ফুল। বেলি ফুলের গন্ধ আমাকে মনে করিয়ে দিলো তারিফের কথা। এটাই তাহলে স্যারের প্রপোজ করার ধরন!
এরপর খুব সাবধানে কানের দুলের বাক্স থেকে এক চিরকুট উদ্ধার করলাম। চিরকুটে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা –
তোমার আকাশের চাঁদ হতে চাই।
তোমার জানালার কাচ হতে চাই।
তোমার বৃষ্টির মেঘ হতে চাই।
তোমার চশমার ফ্রেম হতে চাই।
তোমার অন্ধকারের ছায়া হতে চাই।
হতে পারি?
কি পাগলই না ছিল ছেলেটা! জনাবের এই অদ্ভুত প্রপোজের মধ্যে দিয়ে শুরু হলো আমাদের প্রেমপর্ব। প্রতিদিন দেখা করা, হাত ধরা, একসাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যে খুঁজে পেলাম অসম্ভব সুন্দর এক সুখ।
এখনো মনে পরে প্রথম যেদিন ছেলেটার হাত ধরেছিলাম। ইচ্ছে করে হাতটা ধরলেও, দিয়েছিলাম ভুলের অজুহাত।
একদিন, দুজনে বসে আছি আমাদের প্রিয় জায়গাটায়।
কি যেন মনে করে আমি তারিফকে বললাম, “আচ্ছা বলো তো, আমাদের প্রেমের রঙ কি?”
তারিফ ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “প্রেমের আবার রঙ হয় না-কি?”
“হয় না-কি জানি না। তবে যেকোনো সম্পর্কের মধ্যে আমি একটা রঙ দেখি। এই যেমন ধরো, যাদের সম্পর্কটা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ তাদের প্রেমের রঙ লাল। আবার যাদের সম্পর্কে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে আছে, তাদের প্রেমের রঙ বাদামী।”
“তা, আমাদের প্রেমের রঙ কি?”
“সবুজ।”
“প্রেমের রঙ সবুজ হওয়ার অর্থ?”
“আমাদের সম্পর্কটা চিরস্থায়ী। তাই প্রেমের রঙ সবুজ।”
ভালোবেসে ফেলেছিলাম তারিফকে, খুব। ততদিনে ও আমাকে ভালোবেসেছিলো কিনা জানি না। ভালোবাসা যে খুবই শক্তিশালী একটা অনুভূতি, প্রথম টের পেয়েছিলাম সেই সময়টায়।
এরপর আবার একদিন খুব শখ করে নিজ হাতে রান্না করে নিয়ে গেলাম স্যারের সাথে দেখা করতে।
আমার হাতে বড় একটা ব্যাগ দেখে তারিফ বলল, “তোমার হাতে কি?”
“আজকে তোমার জন্য রান্না করে এনেছি।”
“বাবা! রান্না করতে পারো না-কি?”
“পারতাম না। হঠাৎ কেন জানি ইচ্ছা হলো, তাই ইউটিউব দেখে দেখে শিখছে।”
তারিফ বলল, “হুঁ, বুঝি বুঝি।”
“কি?”
“কিসের যে ইচ্ছা ভালো করেই বুঝি।”
আমি ইতস্তত হয়ে বললাম, “মানে?
কিসের ইচ্ছা? কি বোঝো তুমি?”
“সেটা আবার তুমি বুঝবে না। এখন বেশি কথা না বলে কি এনেছো বের করো তো! ক্ষুধা লেগেছে।”
পুরনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে! কি অবাক কান্ড! ছেলেটা এখনো সারাদিন আমার ভাবনায় থাকে। আচ্ছা, আমিও কি সারাদিন তার ভাবনায় থাকি? নিশ্চয়ই না।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম মায়ের কাছে।
শীতল গলায় বললাম, “মা শোনো, এক কাজ করি। আমাদের দুজনের কোভিড টেস্ট করিয়ে ফেলি। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছি, কালকে স্যাম্পল কালেক্ট করতে আসবে।”
আমার এমন কথায় মা হতবাক হয়ে বলল, “কোভিড টেস্ট? কোভিড টেস্ট করাতে হবে কেন? আমাদের জ্বর না কাশি?”
“আরে, টিভিতে দেখো না কোভিড টেস্ট ছাড়া কোনো হসপিটালে ভর্তি নিচ্ছে না। যদি কোনো ইমারজেন্সি কেস হয়! তাই আগেভাগেই টেস্ট করিয়ে রাখি।”
“ওহ্ আচ্ছা! এই শোন, স্যাম্পল নেওয়ার সময় কি অনেক ব্যাথা করবে?”
“কিচ্ছু হবে না! আমি আছি না।”
পরদিন ঘটল এক উদ্ভট ঘটনা…
(চলবে)