#অস্পষ্টতা
পর্ব – ১২
লেখা : শঙ্খিনী
দুদিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। ঘনিয়ে এলো আমার ফ্লাইটের দিন। মায়ের কাছ থেকে আগেভাগেই তারিফের ঠিকানা নিয়ে রেখেছিলাম।
যাওয়ার আগে মাকে বললাম, “মা শোনো, ফ্লাইটে কিন্তু আমার ফোন বন্ধ থাকবে। তুমি একটু পর পর তারিফের খোঁজ নিও।”
মা বলল, “তুই কোনো চিন্তা করিস না তো। সাবধানে পৌঁছে আমাকে জানাবি।”
“জানাবো। আর মা নিজের খেয়াল রেখো।”
“রাখবো। তুইও কিন্তু নিজের খেয়াল রাখবি!”
এয়ারপোর্টে গিয়ে মনে হলো যেন কোনো এক ভুতুড়ে বাড়িতে এসেছি। আলোয় জাকজমক, লোকে লোকরণ্য এয়ারপোর্ট এখন নিষ্প্রাণ। এয়ারপোর্টের বেশির ভাগ আলোই নেভানো, ফ্লাইটের কয়েকজন যাত্রী ছাড়া আর কেউ নেই।
লোক বেশি না থাকায় ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি শেষ করতে বেশি একটা সময় লাগলো না।
প্লেন ছাড়লো রাত বারোটার দিকে। একটু একটু করে তারিফের কাছাকাছি যাচ্ছি আমি। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। বুঝতে পারছি, এই আকাশপথেই আমার জীবনের তৃতীয় অধ্যায়টা শুরু হয়ে গেছে।
বাইশ ঘন্টা বিমান যাত্রার পর অবশেষে পা রাখলাম নিউইয়র্কের মাটিতে। এখানে এখন ভোর বেলা, সূর্য মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। এই শহরে এর আগে একবারই এসেছিলাম। চার বছর আগে, মামার সাথে।
তখন আমার প্রকৃত মা মৃত্যুর দিন গুনছিলেন। মৃত্যু তার দ্বারে এসে গিয়েছিল। হাসপাতালে খুব করুন অবস্থায় ভর্তি। মৃত্যুর আগে ইচ্ছে হলো শেষে বারের মতো দুই মেয়েকে নিজ চোখে দেখবেন। সেই ইচ্ছা পুরন করতেই মামা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন।
কি অদ্ভুত ব্যাপার না? এর আগের বারও বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে নিউইয়র্কের মাটিতে পা রেখেছিলাম, এবারও তাই করছি। কিন্তু গতবার এক করুন শোক নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল। এবারো কি…?
না, না। কি সব ভাবছি আমি! আমার তারিফের কিচ্ছু হবে না।
ইমিগ্রেশন শেষে এয়ারপোর্টের বাইরে এসেই দেখতে পেলাম সুইটির হাস্যোজ্বল মুখটা।
সুইটি, আমার প্রকৃত মায়ের বিশ্বস্ত সহচর। সহজ ভাষায় বলতে গেলে তার অ্যাসিসটেন্ট। বয়স কম হলেও এক পুত্র সন্তানের জননী সে। সুইটি ছিল বাল্যবিবাহের শিকার। তার গর্ভে সন্তান আসা মাত্রই তাকে এদেশে পাচার করে দেওয়া হয়। মায়ের সঙ্গে তার পরিচয় এখানেই। তাকে মা আমাদের থেকেও বেশি ভালোবাসতো। তাই তো তার সম্পত্তির অর্ধেক মালিক সুইটি। মালিক হলেও এক ফোঁটা অহংকার নেই তার মধ্যে।
সুইটি দৌঁড়ে এসে আমার হাত থেকে সুটকেস নিলো।
হাসি মুখে বলল, “আপা আসতে কোনো সমস্যা হয় নাই তো?”
আমি বললাম, “না, না। তোমাকে কতদিন পর দেখলাম বলোতো!”
“আপনাকেও তো কতদিন পর দেখলাম। আমাদের কাছে তো আসেনই না!”
“কই, আসলাম তো!”
“এতদিন পর আসলে চলে?”
“আচ্ছা এসব বাদ দাও। তোমাকে যে বাড়ির অ্যাড্রেস পাঠিয়েছিলাম, খুঁজে বের করেছো তো?”
“ও আল্লা, কি বলেন আপা। খুঁজে বের করার কি আছে? ওই বাড়িটা তো আমাদের বাসা থেকে অল্প একটু দূরে। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই যাওয়া যায়।”
“ও তাই নাকি? তাহলে তো ভালোই হলো।”
“ওই বাড়িতে কে থাকে আপা?”
আমি খানিকটা অনিশ্চিত গলায় বললাম, “আমার বন্ধু।”
বন্ধু বললাম কেন কে জানে! তারিফ কি এখনো আমার বন্ধু?
নিউইর্য়ক শহরে আমার মায়ের এক বিশাল বাংলো বাড়ি রয়েছে। কোনো এক অজ্ঞাত কারনে মৃত্যুর আগে মা পুরো বাড়ীটা আমার নামে লিখে দিয়ে গেছেন। এই বাড়িতে সুইটি তার ছেলেকে নিয়ে থাকে।
বাড়িতে পৌঁছে সুইটি আমাকে বলল, “আপা তাহলে ফ্রেশ হয়ে আসেন। আমি খাবার দেই। সারা রাত বসে আপনার জন্য রান্না করছি।”
“এত ব্যস্ত হতে হবে না। আমি আগে একটু মাকে দেখে আসি।”
“এখনি যাবেন? একটু রেস্ট নিয়ে তারপর গেলে ভালো হতো না?”
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, “নাহ্, এখনি যাই!”
আমি দাড়িয়ে আছি আমার জন্মদাতা মায়ের কবরের সামনে। এ বাড়ির বিশাল এক বাগানে চির নিদ্রায় শায়িত তিনি।
কি অদ্ভুত ব্যাপার! মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ কোনো খারাপ লাগা কাজ করছে না। আমি কখনো আমার মাকে ভালোবাসতে পারিনি। পারলে বোধ হয় এভাবে হারিয়ে যেতে দিতাম না। কিন্তু ভালোবাসবো কি করে? ভালোবাসার কোনো সুযোগই তিনি আমাকে দেননি।
ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে দেয়ে আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি। এবাড়ির সবথেকে বড় ঘরটা আমার।
আমি এতবছর আসিনি বলে ঘরটাকে অযত্নে রাখা হয়নি।
সাধারনত লম্বা বিমান যাত্রার পর জেট ল্যাগের ধাক্কায় দু তিন দিন ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয় সবাই। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। একটাই মাত্র চিন্তা কাজ করছে – তারিফের চিন্তা। ছেলেটা কী করছে, কেমন আছে কিছুই জানি না।
সূর্যের আলো কিছুটা প্রখর হলে, আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পরলাম। আর বিশ্রাম নিয়ে কাজ নেই। ঘর থেকে বের হয়ে সোজা রান্না ঘরে চলে গেলাম।
দুপুরের আগেই তারিফের সব পছন্দের খাবারগুলো রান্না করে ফেললাম। এগুলো এখনো ওর পছন্দের তালিকায় আছে কিনা জানি না। তবে এক সময় তো পছন্দ ছিল!
ইমিউনিটি স্ট্রং করার ওষুধ, জ্বরের ওষুধ সব আগেই সুইটিকে আনিয়ে রাখতে বলেছিলাম।
আমার রান্না করা খাবারগুলো আর ওষুধগুলো খুব সুন্দর একটা গিফট ব্যাগে ভরে ফেললাম। সাথে একটা টু ডু লিস্ট। কখন কি করতে হবে সব লেখা আছে সেখানে। এবং সবশেষে একটা চিরকুট।
চিরকুটটা আমার লেখা। গোটা গোটা করে লিখেছি, “অনেক দিন পর তোমার জন্য রান্না করলাম। জানি না আগের মতো হয়েছে কিনা। চকলেট মুজ নিশ্চই এখনো তোমার প্রিয়, অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি কিন্তু! আর একটা লিস্ট দেওয়া আছে। নিয়ম গুলো ঠিকমতো ফলো করো। গেট ওয়েল সুন তারিফ।”
চিরকুট লেখার কারন একটাই। যাতে তারিফ বুঝতে পারে, তার চেনা কেউ তার জন্য এগুলো পাঠিয়েছে। অচেনা কেউ নয়।
ব্যাগটা নিয়ে সুইটির সঙ্গে বেরিয়ে পরলাম। আমরা হাঁটছি তারিফের বাড়ির উদ্দেশ্যে। এক পা এক পা আগাচ্ছি, আর একটু একটু করে আমার হৃদসপন্দন বেড়ে যাচ্ছে। আমার থেকে কতটা দূরে চলে এসেছিল তারিফ। কিন্তু আমার ঠিকই ওর কাছে চলে এলাম! একটু একটু করে ওর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ সুইটি এক বাড়ির সামনে থেকে বলল, “আপা, এটাই সেই বাড়ি।”
আমি কিছুক্ষণ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, “তুমি সিওর তো? দেখো, ভুল হলে কিন্তু বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে।”
“ভুল হওয়ার কোনো চান্স নাই আপা।”
আমার সারা শরীর কাঁপছে, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসতে। আমি একটু একটু এগিয়ে যাচ্ছি বাড়ির দরজার দিকে।
দরজার সমানে বেশ সুন্দর একটা বেঞ্চ। সেই বেঞ্চে ব্যাগটা রাখলাম। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির কলিং বেল চাপলাম।
কলিং বেল চেপে দিলাম এক দৌড়।
দৌড়ের মধ্যেই সুইটিকে বললাম, “এই সুইটি তাড়াতাড়ি বাসায় চলো।”
সুইটি অবাক গলায় বলল, “আপা আপনার বন্ধুর সাথে দেখা করবেন না?”
“তুমি আসো তো!”
তারিফ কোভিড পজিটিভ বলে পালাইনি কিন্তু। ওর মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার নেই।
সারা দিনটা আমার ভীষণ অস্থির ভাবে কাটল। মাথায় একটাই চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি যে তারিফকে নিয়ে ভাবছি, ওর জন্য রান্না করছি, ওর যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করছি – এই ব্যাপারগুলোকে সে কিভাবে গ্রহণ করবে? আদৌ কি গ্রহণ করবে?
(চলবে)