অসম্ভবে অসঙ্গতে পর্ব-০২

0
403

#অসম্ভবে_অসঙ্গতে
লেখক: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২|

-“অনিন্দা!”

আবিরের আওয়াজ শুনে বুকটা কেমন কেঁপে উঠল আমার। মনে পড়ে গেল ঠিক আট বছর আগের সংঘর্ষগুলো। তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছি। বয়স উনিশ পেরোবে পেরোবে ভাব, চাল-চলনে ছিল চাঞ্চল্য। বয়সের চেয়ে অত্যাধিক উড়নচণ্ডী ছিলাম আমি। আবির ছিলেন আমার সেজো মামির ভাগ্নে। তাদের বাড়িও আমাদের মামা বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। যতবার ছুটি পেয়ে মামাবাড়ি যেতাম, ততবারই আবিরের সাথে দেখা হতো, একটা আড্ডা জমত। তিনি আমার চেয়ে চার বছরের বড়ো। তবুও কীভাবে কীভাবে যেন বেশ সুন্দর একটা বন্ধুত্ব হয়ে যায় ছোট থাকতেই। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত চমৎকার আর আমি কিঞ্চিৎ দুষ্ট প্রকৃতির। বর্তমানে আমি পালটেছি সম্পূর্ণভাবে, তারটা বলতে পারলাম না। তবে বিপরীত আকর্ষণবলের ক্রিয়া আমার মধ্যে সামান্য দেখা গিয়েছিল।

সেবার যখন আমার বিয়ে ঠিক হলো, আমি মামাবাড়ি গিয়ে সবার আগে বিষয়টা আবিরকে জানিয়েছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-“তুই রাজি, অনিন্দা?”

আমি রাজি ছিলাম না। তাকে পছন্দ করতাম। কিন্তু মনের পছন্দটা সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি, যেই পর্যায়ে গেলে তা মুখে আনা যায়। আবিরও আমাকে অন্য কোনো নজরে দেখতেন না। আমি তাকে জানাই,
-“হ্যাঁ, আবির ভাই। তুমি কিন্তু আসবে।”

আবির হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,
-“ঠিক আছে, যাব।”

কিন্তু তিনি আসেননি। তারপর আর দেখা হয়নি তাঁর সাথে। বিয়ে হলো, বিয়ের পর কতবারই তো গেলাম মামাবাড়ি। অথচ তাঁর দেখা পাইনি। সেজোমামির কাছে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছেন। তারপর একসময় মুহিব আমার সেই কিশোর হৃদয়ের ভালোলাগা পুরোপুরি মিটিয়ে দিলো। মুহিব!

শুরুটা যেখানেই হোক না কেন, শেষটা মুহিবের মাঝে গিয়েই আটকে রইল। আমার উত্তেজনা সব নেমে গেল। মিহি হেসে বললাম,
-“ভালো আছেন?”

আবির আমার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি ডেস্কে বসেছিলাম। তিনি দু-বার শ্বাস ফেলে হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধার সাহায্যে কপাল ঘোষলেন, এরপর বললেন,
-“আমার কেবিনে আসুন।”

সেকেন্ডের ব্যবধানে উলটোদিকে ঘুরে কেবিনে চলে গেলেন। আমি হাতের কাজটা শেষ করে উঠে সরাসরি তার কেবিনের দিকে গেলাম। দরজা নক করে বললাম,
-“আসব?”

আবির আমাকে এক পলক দেখে সেদিকেই তাকিয়ে রইল। আমি সেই চাহনির মানে বুঝে ভেতরে প্রবেশ করে মুখোমুখি দাঁড়ালাম। তারপর স্মিত হাসলাম। হাসির চেয়ে ধারালো কোনো অস্ত্র নেই। কেবলমাত্র ছোট্ট একটা হাসির দ্বারা প্রবল শক্তিসম্পন্ন প্রতিপক্ষকেও দ্বিধায় ফেলা সম্ভব।
আবির আমার শত্রু নয়, তবে এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তা যেন আমার জন্য ছিল এক ভীষণ দুঃস্বপ্ন। সেই দুঃস্বপ্ন বাস্তবতায় মিশে গেল।

আবির কাঠকাঠ গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তুমি এখানে কেন?”

আমি মুখ থেকে হাসি সরালাম না, সেভাবেই ভ্রু কুঁচকে বললাম,
-“কাজ করি এখানে।”
-“কেন?”
-“কেন আবার? জব করতে পারি না আমি?”
-“হঠাৎ?”

হাসি মলিন হলো আমার। অনমনীয় চোখে তাকিয়ে বললাম,
-“কী শুনতে চাইছেন?”
-“এ-ই, কর্মজীবী মেয়েদের দেখে সবসময় যেই মেয়েটা বলত, ‘বিয়ের পর আমি মোটেও চাকরি-বাকরি করব না। সম্পূর্ণ সময়টা সংসারে দেবো।’ সেই মেয়েটা এখানে কেন?”

চোখে চোখ রাখলাম আবিরের,
-“জানেন না কিছু?”

আবিরের চোখের পাতা সামান্য কেঁপে উঠল দেখলাম, সে বলল,
-“জানি না, জানতে চাইছি।”

আমি প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললাম,
-“তেমন কিছু না।”
-“বলার মতো না?”
-“আসলে মুহিব.. মানে আমার স্বামী! গত মাসের ৬ তারিখে মারা গেছে। তাই.. এখন অনেক ইচ্ছে-অনিচ্ছেই নিজেদের রাস্তা পালটেছে।”

আবির অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, যেন মেনে নিতে পারছেন না। ধরা গলায় বললেন,
-“এত সাবলীলভাবে এত বিশ্রী সত্য বলতে পারছ?”
-“পারছি।”
-“কী করে?”
-“সত্য বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়।”

আবির আমাকে সান্ত্বনা দিতে বললেন,
-“তুমি ঠিক আছ, অনিন্দা? ফ্যামিলিতে প্রবলেম হচ্ছে? কোনো সমস্যা? আমাকে বলো।”

বরাবরের মতোই উপহাসসূচক সেই হাসিটা ঠোঁটের ভাঁজে রাখলাম,
-“সহানুভূতি দেখাবেন না, আমার ভালো লাগে না।”

থেমে আবার বললাম,
-“মুহিব তার সকল অ্যাকাউন্টের নমিনি আমাকে করে রেখে গেছে। যা টাকা-পয়সা আছে, মনে হয় না গোটাজীবন বসে বসে খেলেও ফুরোবে।”
-“তবে চাকরি করছ কেন?”

আমি স্মিত হেসে বললাম,
-“আয়ের উৎস নিশ্চিত না করে কেবল ব্যয় করতে থাকলে, নিঃস্ব হতে সময় লাগে না।”

আবির কিছু বললেন না, টেবিলের ওপর থেকে গ্লাস তুলে পানি পান করলেন। এরপর নিজের চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু ভাবলেন সম্ভবত। আমি তাকিয়ে আছি শুধু। বহুদিন পর মানুষটাকে দেখলাম। মনের ভেতর সেই ভালোলাগার অনুভূতিটা আছে, তবে তা কেবল সম্মানের। অন্য কোনোভাবে কল্পনা করার সুযোগ পাইনি আগে, আর এখন সম্ভব না। আমি এগিয়ে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনি ভালো আছেন?”

আবির সঙ্গে সঙ্গে উত্তর নিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-“হু, ভালো।”
-“আচ্ছা, আমি আসি তবে?”
-“হ্যাঁ, যাও।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। বেরিয়ে আসার আগ মুহূর্তে আবির পূনরায় ডাকলেন,
-“অনিন্দা!”

পিছে তাকিয়ে বললাম,
-“হু?”
-“অফিস আওয়ার শেষে নিচে ওয়েট কোরো। একসাথে বেরোব।”
-“কেন?”
-“কথা আছে সামান্য।”
-“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

______
পাঁচটায় বেরোনোর সময় আবির গাড়ি নিয়ে এগিয়ে এলেন। আমি বিনাবাক্যে উঠে পড়লাম পাশে। আবিরকে বললাম,
-“ছয়টার মধ্যে আমাকে রোকেয়া সরণিতে নামিয়ে আসবেন।”
-“তাড়া আছে?”
-“হ্যাঁ, মেয়ে অপেক্ষায় আছে।”

আবির গাড়ি স্টার্ট করল, এরপর বলল,
-“মেয়ের নাম কী রেখেছ?”
-“কুহেলি আরশাত। ডাকনাম কুহু।”
-“সুন্দর নাম। বয়স কত?”
-“এ বছর পাঁচ পেরোবে।”
-“বাপের বাড়িতেই থাকছ?”
-“না, আমার বাড়ি ছেড়ে কই যাব?”

কিঞ্চিৎ অবাক হলো আবির,
-“তোমার বাড়ি? আলাদা থাকো?”
-“নাহ। মুহিবের বাড়িই তো আমার বাড়ি।”
-“ও বাড়ির সবাই ভালো?”
-“ভালো।”
-“সমস্যা হয় না তো কোনো?”
-“সমস্যাকে সমাধান করতে জানি।”

আবির হেসে ফেলল সামান্য,
-“তুমি অনেক পালটে গিয়েছ, অনিন্দা!”

আমিও হাসলাম,
-“ঠিক যেভাবে আমাদের মধ্যে তুই-তুমি থেকে, তুমি-আপনি চলে এসেছে।”
-“আগের মতো কিছুই নেই যে!”
-“তা বিয়ে করেননি কেন?”

হুট করেই অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে পড়লাম আমি। আবির যেন প্রস্তুত ছিলেন এমন প্রশ্নে,
-“বিয়ের বয়স হয়নি আমার।”

এহেন কথায় হো হো করে হাসলাম আমি। হাসতে হাসতে বললাম,
-“রসিকতা করছেন?”
-“রসিকতা করব কেন? বয়সই বা কত আমার? সবে ৩২। ছেলেদের বিয়ের বয়স এরপর থেকে শুরু হয়।”
-“আচ্ছা, বুঝলাম।”

তারপর গাড়ি যখন বেশ নিস্তব্ধ সড়ক দিয়ে চলতে লাগল, আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে আবিরকে বললাম,
-“আবির ভাই, জীবনটা কাফনের রঙের মতো সাদা। শুধু শুধু কালি ছেঁটানো কি উচিত?”

আবির কিছু বললেন না। আমি হেসে বললাম,
-“আবির ভাই, আমি ভালো আছি। মুহিব আমাকে একা চলতে শিখিয়েছিল ওর উপস্থিতিতেই, ও আমাকে ভালো থাকতে শিখিয়েছিল। ও আমাকে বলেছিল, কারো অনুপস্থিতি কারো জীবনে খুব বেশি সময় প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই ওই যেটুকু সময় প্রভাব ফেলে, সেটুকু সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত, প্রভাবিত যাতে না হই সেজন্য সর্বস্ব দেওয়া উচিত। আমি তা-ই করেছি। নিজেকে ব্যস্ত রাখছি। নিজে সাবলম্বী হতে চাইছি। ওর রেখে যাওয়া টাকায় আমি কুহুকে নিয়ে ভালোই থাকতে পারতাম। কিন্তু লোকেরা সুযোগ নিতে চাইত। অবলা নারী ভেবে হাত বাড়াতে কেউ ইতস্তত করত না। ইতোমধ্যে চারপাশের কুৎসিত নজরগুলোর শিকার আমি হয়েছি। কিন্তু যখনই দেখে আমি নিজেকে চালানোর সামর্থ্য রাখি, অধিকাংশের নজর আমার থেকে ঝুঁকে যায়। আর বাকি যারা এখনও ছুকছুকানো নজরে তাকিয়ে থাকি, আমি অনিন্দিতা তাদের দৃষ্টিকে পায়ে মাড়াই না।”

আমি থেমে গেলাম, আবির পুনরায় বললেন,
-“একা চলা.. একা নারীর পক্ষে এতই সহজ?”
-“উঁহু, সহজ নয়। তবে আমি চাইলেই সহজ বানাতে পারি।”
-“কীভাবে?”
-“দেশে সিঙ্গেল মাদারদের অভাব নেই।”

আবির থেমে থেমে বললেন,
-“তোমার হাজব্যান্ডকে খুব ভালোবাসতে?”
-“হ্যাঁ, বাসি।”

তারপর পুরো রাস্তায় আবির আর কিছু বললেন না। আমিও বললাম না। গন্তব্যে পৌঁছে নামার সময় তাকে বললাম,
-“আবির ভাই, শুনুন?”
-“বলো।”
-“আমার প্রতি কখনও সহানুভূতি দেখাবেন না, অনুরোধ।”

আবির মলিন হেসে বললেন,
-“সহানুভূতির সাথে অনিন্দিতা নামটা যায় না ঠিক।”
-“আসি।”
-“এসো।”

তারপর থেকে গোটা মাস অফিসে বাড়তি কোনো কথা-বার্তা কেউই বললাম না। আবির ভীষণ বুঝদার মানুষ। উনি ভালো করেই জানেন, একজন বিধবা অথবা ডিভোর্সি নারীর সাথে অন্য কোনো পুরুষের মেশাটা সমাজ বেশ কটুচোখে দেখে। সমাজকে আমি কিংবা আবির কেউ-ই তোয়াক্কা করি না। তবে দু’জনেই শান্তিপূর্ণ মানুষ। শুধু শুধু অশান্তি ডেকে আনতে চাইনি। তাই খুব প্রয়োজন ব্যতীত একে-অপরের থেকে দূরে দূরে থাকলাম। অফিসে এ-ই, অফিসের বাইরে দেখা হলে এড়িয়ে যাইনি, বরঞ্চ মুচকি হেসে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেছি। তিনিও কো-অপারেট করে গেছেন আমাকে।

জীবনটা খুব স্মুদলি যাচ্ছে। অথচ এটা জীবনের নিয়ম না। জীবন অকস্মাৎ চমকে দিতে ভালোবাসে…

|চলবে|

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে