অসত্য ও সত্য – লেখা : শঙ্খিনী

0
564

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

অসত্য ও সত্য
লেখা : শঙ্খিনী

সাধারনত শেফার ঘুম ভাঙ্গে বেলা এগারোটার দিকে। বারোটায় থাকে তার ক্লাস, এক ঘণ্টার মধ্যে কোনমতে তৈরি হয়ে রওনা দিতে হয়। কিন্তু অনলাইন ক্লাস হওয়াতে বেশ সুবিধা হয়েছে। ঠিক বারোটার সময় ঘুম থেকে ওঠে সে। অনলাইন ক্লাসে ঢুকে এটেন্ডেস দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পরে।

কিন্তু আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে সে। উঠেছে বললে ভুল হবে, শেফা সারারাত ঘুমাতে পারেনি। নিজের জীবন সম্পর্কে অনেক বড় একটা সত্য জানতে পেরেছে গতকাল।

শেফা খুব ভালো করে জানে তার বাবা রূপক ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। তাই বাবাকে ফোন করল সে।

রূপক ফোন তুললে শেফা শান্ত গলায় বলল, “গুড মর্নিং বাবা।”
রূপক কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “গুড মর্নিং। কী ব্যাপার? আজ এত সকালে।”
“ঘুম ভেঙে গেছে, আমি কী করবো?”
“সকলটা উপভোগ করো! দিনের সবথেকে বেস্ট পার্ট কিন্তু এই সকাল।”
“ঠিক আছে। কী করছিলে তুমি?”
“অফিস ওয়ার্কস। তুমি?”
“জানি না।”
শেফার গলার স্বর সাধারনের থেকে কিছুটা অন্যরকম লাগছে, বুঝতে পেরে রূপক বলল, “শেফা? সব ঠিক আছে তো?”
“হুঁ।”
“তোমার মায়ের সাথে আবার ঝগড়া হয়েছে না-কি?”
“না তো!”
“কেমন আছে তোমার মা?”
“জানি না।”
“হুঁ?”
“আসলে আমি এখন নানিদের বাসায়।”
“সে কী? এরকম একটা ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে তুমি ঘর থেকে বের হলে কেন?”
“মাস্ক পরেই এসেছি, সমস্যা হবেনা।”
“সেখানে যাওয়াটা এত জরুরী হলো কেন?”
“আমি অনেক ভেবচিন্তে ডিসিশন নিয়েছি বাবা। আমার আসলে নানা-নানির সঙ্গেই থাকা উচিত। নানা-নানি কিন্তু নিরপেক্ষ, তোমাকেও সাপোর্ট করে না আবার মাকেও সাপোর্ট করে না। আমি তাদের মতো নিরপেক্ষ হতে চাচ্ছি। আইডিয়াটা ভালো না?”
“শেফা কি বলছো এসব? নিশ্চয়ই তোমার মায়ের সাথে আবার কোনো ঝামেলা হয়েছে!”
“কোনো ঝামেলা হয়নি বাবা। আমার বয়স এখন তেরো এবং আমি নিজের ডিসিশন নিজেই নিতে পারি।”
“খুব পাকা পাকা কথা শিখেছো না?”
“হ্যাঁ শিখেছি। এখন রাখলাম, সকালটা উপভোগ করতে হবে।”

ফোন রেখে শেফা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

শেফার বয়স যখন ছয়, তখন তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। ডিভোর্সের পর শেফা থাকতে শুরু করে তার মায়ের সঙ্গে।

ছোটবেলায় থেকেই শেফার মা রূপা তার মাথায় ঢুকিয়েছে যে, রূপক একজন চরিত্রহীন মানুষ। একাধিক মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারনেই তাকে ডিভোর্স দিয়েছিল রূপা। এ কারনেই তখন থেকে বাবার এক অদৃশ্য ঘৃণা জন্ম নিতে থাকে শেফার মনে। রূপক মাঝে মাঝে শেফার সঙ্গে দেখা করতে এলেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো তাকে।

মেয়েকে খুশি করার হাজারো চেষ্টা করেছিল রূপক। কখনো তার জন্যে অসংখ্য খেলনা এনে, আবার কখনো বা ঘুরতে নিয়ে যেয়ে। কিন্তু ততদিনে রূপকের প্রতি জন্ম নেওয়া ঘৃণা শেফার মনে ছড়িয়ে পড়েছে।

হঠাৎ করেই শেফার ফোনটা বেজে উঠলো। মায়ের নামটা ভেসে উঠেছে মোবাইলের স্ক্রিনে।

শেফা ফোন তুলে ক্লান্ত গলায় বলল, “কী হয়েছে মা?”
রূপা অস্থির গলায় বলল, “তুই কিন্তু আমাকে ভুল বুঝেছিস। আমি তোকে বুঝিয়ে বলতে পারি আসলে কী হয়েছে।”
“আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।”
“তুই যা দেখেছিস, সেটা ভুল।”
“আমি আমার নিজের চোখ দিয়ে ভুল দেখেছি? এটাই বোঝাতে চাচ্ছো?”
“তুই আমার কথাটা শোন…”
“আমি রাখছি।”

শেফা তৎক্ষণাৎ ফোন রেখে দিলো।

গতকাল সন্ধ্যায় নিজের ঘরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিল শেফা। তখন তার ঘরে এসে রূপা কি যেন একটা মেইল পাঠাতে বলল। রূপা তার ফোনটা শেফার হাতে দিয়ে চলে গেল।

শেফা খেয়াল করে, একটা লোক অনবরত তার মাকে এসএমএস পাঠাচ্ছে। মানুষের ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর স্বভাব শেফার নেই। তবুও নিজের অজান্তে সেই এসএমএসে চাপ পরে গেল।

নিজের অজান্তে এসএমএসে চাপ পরাটা তার জীবনের সবথেকে বিশ্রী ঘটনা। শেফা দেখল, লোকটা রূপার সঙ্গে তোলা কয়েকটা ছবি আবার রুপাকেই পাঠিয়েছে। সেগুলো কোনো স্বাভাবিক ছবি নয়, আপত্তিকর ছবি। ছবিগুলো এতটাই আপত্তিকর যে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না শেফার পক্ষে।

হঠাৎ তার মনে পরল, ছবিগুলোর নিচে কী লেখা সেটা একবার পড়া উচিত। ছবিগুলোর নিচে লোকটা লিখেছে, “মনে আছে, এই ছবিগুলোর কারনেই তোমার সংসার ভেঙ্গে গেছিল? আমাদের কিন্তু আবার সময় কাটানো উচিত। এখন তো আর তোমার সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার ভয় নেই! হা, হা, হা।”

লেখাগুলো পড়ে শেফার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে, মাথা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরছে, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।

এরই মধ্যে রূপা এসে বলে, “কিরে, পাঠিয়েছিস মেইল?”

শেফার মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না। ফোনটা বিছানার ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।

তখন রূপার চোখ পরল ফোনটার স্ক্রিনের দিকে।

সবকিছু বুঝতে পেরে রূপা আতঙ্কিত গলায় বলল, “শেফা, আসলে হয়েছে কি…”
শেফা তাকে থামিয়ে দিয়ে শীতল গলায় বলল, “মা আমি নানির কাছে যাবো।”
“আমার কথাটা শোন আগে।”
“প্লিজ ডোন্ট ইন্সিস্ট মি টু লিভ উইথ ইউ।”

শেফা এখনো দাড়িয়ে আছে বারান্দায়। তার নানির বাসার দারোয়ান হঠাৎ বারান্দায় এসে থমথমে গলায় বলল, “ভাইজান আসছে আপনের লগে দেখা করতে?”
শেফা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “কোথায় বাবা?”
“নিচে, গাড়িতে বইসা আছে?”

শেফা সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে এলো। বাবার কালো রঙের গাড়িটা দাড়িয়ে থাকতে দেখে অদ্ভুত এক শান্তি কাজ করলো তার মধ্যে।

শেফা গাড়িতে উঠতেই রূপক ব্যস্ত হয়ে বলল, “মাস্ক কই?”
“এইতো হাতে।”
“হাতে কেন? পরো!”
শেফা মাস্ক পরতে পরতে বলল, “নিজেই ড্রাইভ করে আসলে?”
“হুঁ, ড্রাইভার সাধারন ছুটির আগেই বাড়ি চলে গেছে।”
“কতদিন পর বের হলে বাসা থেকে?”
“প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি। আমি তো ভয়ে বাসা থেকে বেরই হতে চাই না। তুমি এখানে কী এমন মহৎ কাজ করছো, দেখতে চলে এলাম।”
শেফা ঠোঁটে বিচিত্র হাসির আভাস নিয়ে বলল, “তুমি অনেক ভালো, বাবা।”
“দেখা করতে এসেছি বলে ভালো হয়ে গেলাম না-কি?”
“তা, না। তুমি অল্টুগেদার অনেক ভালো।”
“হঠাৎ এটা মনে হলো কেন?”
“আমাকে সত্যিটা বলোনি কেন?”
“কোন সত্যি?”
“আমাকে এতগুলো বছর মিথ্যার মধ্যে বসবাস করতে দিলে কেন? সত্যকে কখনো গোপন রাখা যায় না, একদিন না একদিন তা সবার সামনে চলে আসেই।”
“তুমি কী বলতে চাইছো শেফা? আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পরছি না।”
শেফা দু চোখের কোণে দু এক ফোঁটা অশ্রু নিয়ে বলল,“তোমাদের ডিভোর্সের কারন তুমি ছিলে না, তাই না?”

শেফার এই প্রশ্ন শুনে রূপক স্তম্ভের আকার ধারন করলো।

বেশ অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, “কিভাবে জানতে পারলে?”
“আগে আমার প্রশ্নটার উত্তর দাও! ডিভোর্সের কারন মা ছিলো না?”
“হুঁ।”
“আগে বলোনি কেন আমাকে? আমি লিটেরালি ঘৃণা করেছি তোমাকে। নিজে জানতে না পারলে হয়তো সারাটা জীবন তোমাকে ভুল বুঝে যেতাম! কেন বলোনি?”
রূপক আহত গলায় বলল, “কারন আমি চাইনি তুমি সারাটা জীবন তোমার মাকে ঘৃণা করো।”
“কিন্তু এখন তো করছি!”
“নিজের মাকে ঘৃণা করার কোনো অধিকার তোমার নেই শেফা।”
“তোমার ইমোশন নিয়ে খেলেছে সে।”
“তাতে তোমার কি? তোমার ইমোশন নিয়ে তো আর খেলেনি। তুমি তাকে ঘৃণা করতে যাবে কেন?”
“এটা তুমি বলছো?”
“হুঁ বলছি। কারন তোমাকে পৃথিবীতে আনার জন্য মানুষ কী পরিমাণ কষ্ট করেছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

শেফা চুপ করে রইলো। চোখ বেয়ে তার অনবরত জল পরছে।

রূপক আবার বলল, “শুধুমাত্র আমার জন্যে তোমার একটা মানুষকে ঘৃনা করার কোনো প্রয়োজন নেই শেফা। তার ওপর আমার তো কোনো রাগ নেই। তুমি কেন অযথা রাগ নিয়ে বসে থাকবে?”
“আমি জানি না কখনো মাকে ক্ষমা করতে পারবো কিনা!”
“তোমাকে ক্ষমা করতে হবে কেন? তোমার সাথে তো আর অন্যায় কিছু হয়নি। যা হয়েছে আমার সাথে হয়েছে।”
“তুমি মাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?”
“দিয়েছি।”
“কেন?”
“একটা মানুষের ওপর সারাটা জীবন রাগ পুষে রেখে আমার লাভটা কী?”
“আমার এখন কী করা উচিত?”
“এসব ভুলে যাওয়া উচিত।একে অপরের গুণগুলোকে বড় করে দেখা এবং দোষগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়াই যে যেকোনো সম্পর্কের মূলমন্ত্র।”
“সেই মুহূর্তে তুমি কি দোষগুলো পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলে?”
“না। পাশ কাটিয়ে যেতে পারিনি বলেই তো ডিভোর্সের মতো কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সম্পর্কের এই ছোট ছোট মন্ত্রগুলো যে মেনে চলতে পারে, দিনশেষে সেই কিন্তু প্রকৃত সুখী।”
“আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
“তোমার আসল বাসায়। এখানে থেকে নিরপেক্ষ হয়ে আর কাজ নেই।”
শেফা হেসে বলল, “নানা-নানি তোমাদের কাউকেই সাপোর্ট করে না। কিন্তু এখন আমি তোমাদের দুজনকেই সাপোর্ট করতে পারি।”
“দ্যাটস এ গুড আইডিয়া!”

বাসায় ফিরে শেফা দেখল, রূপা আহত মুখে ছাদের এক কোণে বসে আছে। শেফা গিয়ে তার বসল। এতে রূপা একটুও অবাক হলো না। যেন এতক্ষন শেফার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে।

রূপা ব্যাথিত গলায় বলল, “আমি অনেক খারাপ না?”
শেফা চুপ করে রইলো।
রূপা বলল, “সাত বছর আগে যখন আমাদের ডিভোর্স হয়, তখন আরও বেশি খারাপ ছিলাম। কিন্তু আমি তো সারাজীবন খারাপ থাকতে চাইনি। একটু একটু করে ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছি। চেয়েছিলাম পৃথিবীর সেরা মা হতে। তোকে সারাজীবন নিজের কাছে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম।”
“এজন্যেই বাবার নামে এতগুলো মিথ্যে বলেছিলে?”
“হুঁ। তোকে হারানোর ভয়টা আমার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু হারিয়ে ফেললাম তো।”
“মা, তুমি কিন্তু আমার বেস্টফ্রেন্ড। বেস্টফ্রেন্ডরা সবসময় বেস্টফ্রেন্ডই থাকে।”
রূপা চমকে উঠে বলল, “এসব ভুলে ক্ষমা করতে পারবি আমাকে?”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেফা বলল, “পারবো।”

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে