#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১৬.
দ্বৈপায়ন গ্রামে অলকানন্দার নিবিড় একটা শাসন ব্যবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকে মানতে পারছে না কেউবা আবার করছে ধন্য ধন্য। অলকানন্দা নিজের বোনকে শহরের চিকিৎসালয়ে রেখেই আবার এসেছে গ্রামে। বোনের সাথে সাথে একটা পরিবার সাথে একটা গ্রামও তাকে পরিচালনা করতে হয়। তার উপর তার কাছে খবর গিয়েছে নবনীল গ্রামে নেই। কোনো একটা কারণে সে তার পিতৃালায়ে ফিরে গিয়েছে, মনোহর কিছুটা সুস্থ হতেই আবার নিজেকে হর্তাকর্তা ভাবা শুরু করে দিয়েছে। গ্রামে শুরু হয়ে গিয়েছে অরাজকতা। অবশেষে দীর্ঘ ক্লান্তি নিয়ে সে ফিরেছে গ্রামে প্রায় বেশখানিকটা দিন পরই।
গ্রামে ফিরতেই অলকানন্দার চক্ষু চড়কগাছ। কৃষকদের যেই জমি নিয়ে অলকানন্দা এত হৈচৈ করল, সাহেবদের সাথে অব্দি কত ধরণের কথা কাটাকাটি, শত্রুতা করল, এমনকি, হয়তো সেজন্যই আজ তার বোনের এই অবস্থা অথচ সেই জমিতে আজ ফসলের ছিটেফোঁটাও নেই। হেমন্ত কালে যে জমি থাকত ফসলে ভরপুর, মনে হতো যেন সোনার খনি হেতায় আজ সেই জমি ফসল শূন্য কেন! এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। অলকানন্দার মাথা ঘুরে উঠল, নিজেকে মনে হলো দিকশূন্য। ফসলের জমি পেরিয়ে নিজেদের ‘বিহারিণী মহলের’ সামনে আসতেই অলকানন্দা আরেক দফা বিস্মিত হলো। এই ভর সন্ধ্যাবেলা তাদের মহলের সামনে এই অনাকাঙ্খিত জন সমুদ্রের ঢেউ দেখে সে হতবাক। হুট করে কী এমন হলো গ্রামে! সব এত এলোমেলো কেন! অলকানন্দার বুক মোচড় দিয়ে উঠল। অপ্রত্যাশিত কিছুর আভাস তার কানে বাজল। সে বিচলিত হয়ে গাড়ি থেকে নামতেই সকলের নজর তার দিকে এলো। তরঙ্গিণী ছুটে এলো, কিছুটা ফিসফিস করেই বলল,
“নন্দা, চলো তো ভেতরে। এখন ওদের সাথে কথা বলার দরকার নেই।”
অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“কী হয়েছে?”
“অনেক কিছু হয়েছে। আপাতত তোমার শুনতে হবে না, তুমি ভেতরে আসো।”
অলকানন্দা ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে নিয়েও আবার ফিরে গেল গ্রামবাসীদের দিকে। সকলের মুখ থমথমে। অলকানন্দা সকলের সামনে উপস্থিত হলো। সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কী সমস্যা হয়েছে আপনাদের? আমাকে বলুন।”
জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেদিনের বৃদ্ধ লোকটা থমথমে মুখ নিয়ে বলল,
“তোমার আদর্শ বিচারের জন্য কী হয়ে গিয়েছে গ্রামে তা শুনবে না?”
বৃদ্ধার থমথমে কণ্ঠের এমন প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেলো অলকানন্দা। আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে জেঠা বাবু?”
“তুমি বিচার করেছিলে তোমার দেবরের। আমি বলেছিলাম মেয়েটাকে বিয়ে দিতে তোমার দেবরের সাথে কিন্তু তুমি দিলে না। তুমি ন্যায় বিচার করবে, অপরাধীর শাস্তি দিবে, তোমার কথা-ই রইলো। অপরাধীর শাস্তি হলো। আজ অপরাধীই বেঁচে আছে আর যার সাথে অপরাধ হয়েছে সে ঝুলে আছে বৃক্ষে। কেবল সে না, তার বাপ মাসহ ঝুলে আছে। এতক্ষণে বোধহয় ন্যায় বিচার হলো, বলো? অপরাধী বেঁচে রইলো, মরলো নিরপরাধ মেয়েটা।”
অলকানন্দা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তার মিনিট কয়েক লাগল বৃদ্ধর কথাগুলো বুঝতো। কিন্তু যখনই তার মস্তিষ্কের নিউরণে কথা গুলো প্রতিধ্বনিত হলো ঠিক তখনই সে দু-কদম পিছিয়ে গেলো। প্রাণ শূন্য চোখে তাকাল বৃদ্ধার পানে। হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল,
“কবে মারা গিয়েছে ওরা? কেনই বা এটা হলো?”
বৃদ্ধ লোকটির চোখে আগুনের ফুলকি, কণ্ঠে তার তেজ, সে ক্রোধ নিয়ে বলল,
“কেন হবে বুঝতে পারছ না? একটা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান কী বলো? কার চরিত্র। আর মেয়েটার সে চরিত্রই লুটে নিয়েছিল তোমার দেবর, তো বাঁচবেই বা কেন ও? মেয়েটা ঘর থেকে বেরুতে পারত না, স্কুল গিয়েছিল কিন্তু শিক্ষকদের বিরূপ মন্তব্য মেয়েটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। আর না পেরে তিনজনই নিজেদের জীবন দিয়ে দিল গতকাল। সেদিন যদি মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিতে তবে আজ এমনটা হতো না। যোগ্য আসনে যোগ্য বিচারকই লাগে, খালি তেজ দিয়ে কিছু হয়না তুমি তার প্রমাণ।”
পুরো পরিবেশ জুরে থমথমে নিরবতা। কোনো শোরগোল নেই, হৈচৈ নেই। নিভু নিভু বাতাসে বাড়ির চারপাশে জ্বালানো মশাল গুলো থেমে থেমে কাঁপছে। দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো প্রকৃতি। অলকানন্দার চক্ষু টলমল করছে। হুট করে আবার সবটা তার হাতের বাহিরে বেরিয়ে যাচ্ছে, সবটা অন্য স্রোতে চলে যাচ্ছে। মিস্টার স্টিফেন একটা কথা ঠিকই বলেছিলেন সেদিন- ‘কেবল সাহসিকতা দিয়ে রাজনীতি করা যায় না’ আজ অলকানন্দা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
ভিড়ের মধ্য থেকে আরেকটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “কী করবেন এখন বউমা? মৃত দেহ গুলো এখনো গাছেই ঝুলানো আছে। কেউ ধরেনি। কী করবেন?”
এমন কথার জন্য হয়তো অলকানন্দা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। গতকাল যারা মারা গিয়েছে আজও তাদের মৃত দেহ দাহ্য করা হয়নি! কিন্তু কেন? অলকানন্দার ভেতর তৈরী হওয়া প্রশ্নটা সে আর দমিয়ে রাখতে পারল না। কিছু তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই বলল,
“কাল ওরা মারা গিয়েছে অথচ আজও দাহ্য হয়নি কেন? কী সমস্যা?”
“ওরা ছোটো জাত। আমাদের গ্রামে একমাত্র ওরাই ছোটো জাত ছিল যার জন্য ওদের বাড়িটা একটু পেছনের দিকটাতে ছিল। ওদের কোনো কাজে আমরা যেতে পারবো না। জাতের অমান্য হবে। তাই ওদের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
উপস্থিত একজনের কথা শুনে অলকানন্দার ভাবমূর্তি আরও বিস্মিত হলো। কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ওঠল। অবাক হলো জনসমাগম সাথে অবাক হলো মহলের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা অলকানন্দার পরিবারের মানুষ গুলো। এমন একটা পরিস্থিতিতে এহেন কান্ড করার মেয়ে তো অলকানন্দা না, তবে ওর হাসির কারণ কী!
সকলের চোখে মুখে যখন তাজ্জব ভাবটা ছড়িয়ে পড়েছে তখন অলকানন্দার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা। বহু কষ্টে সে হাসি থামিয়ে বলল,
“ওরা ছোটো জাত বলে মৃতদেহ গাছে ঝুলছে অথচ ওদেরকে ন্যায় বিচার দিতে চাওয়া আমাকে আপনারা বিচার করা শুরু করে দিয়েছেন। কোন আসন আমার যোগ্য কোনটা অযোগ্য তা নিয়ে শুরু করে দিয়েছেন হৈচৈ। আপনাদের দেবতা ভাববো না দৈত্য তা নিয়ে আমি সংশয়ে আছি।”
“খবরদার।”
“আপনারা খবরদার। আমার সাথে ভুলেও কঠিন হতে আসবেন না। আমি কঠিন হলে কিন্তু মাটিও কাঁপবে। নারী মানে জানেন তো? মমতাময়ী মা আবার ধ্বংসলীলা চালানো কালীও। সাবধান।”
যে লোকটা অলকানন্দাকে ধমক দিয়েছিল সে রীতিমতো পিছিয়ে গেল অলকানন্দার বজ্রকণ্ঠে। অলকানন্দা গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করে পাহারাদার একজনকর ডাকল,
“বিনু দাদা, বিনু দাদা।”
সাথে সাথে মোটাতাজা একজন লোক ছুটে এলেন। হাতে তার মোটা বাঁশের লাঠি। সে মাথা নত করে বললেন,
“বলুন, বটঠাকুরণ।”
“এক্ষুনি আমার সাথে চলুন আপনি। ওদের মৃতদেহ সৎকার করার সকল ব্যবস্থা করব আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে, চলুন।”
বিনু নামের লোকটা মাথা নাড়ালেন। কিন্তু অন্দরমহল থেকে এবার বেরিয়ে এলেন নন্দন মশাই। হুংকার ছাড়তে ছাড়তে বললেন,
“এখনো তোমার লজ্জা হয়না, তাই না? তোমার জন্য তিনটা মানুষ মরেছে তবুও তুমি ক্ষমতা দেখাচ্ছো? আর তুমি কী জাত নষ্ট করার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছ? এমনেতেই তো বাছ বিচার মানছো না। শহরে চলে যাচ্ছ, পুরুষ ডাক্তারদের দিয়ে বোনের চিকিৎসা করছ, নিজেকেও তাদের সাথে মিশাচ্ছো, লাজ লজ্জা সকল বিসর্জন দিয়েছ, আর কী চাও? জাত ধর্ম খেতে চাও? সমাজ তোমাকে একঘরে করে দিবে জানো তুমি সেটা?”
সমাজের এই বিধান অবশ্য অলকানন্দার অজানাই ছিল। তাই সে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তাহলে আপনি কী করতে বলছেন? মৃতদেহ গুলো এভাবে ঝুলবে!”
“হ্যাঁ, এভাবেই থাকবে। বন জঙ্গল ওদিকে, নেকড়ে আছে সেখানে, এসে ছিঁড়ে খেয়ে নিবে। আমাদের যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
নন্দন মশাইয়ের এমন হৃদয়হীন কথাবার্তায় কেঁপে ওঠল অলকানন্দা। ধিক্কার জানিয়ে বলল,
“আপনি মানুষ!”
নন্দন মশাইয়ের ইচ্ছে হলো এই ভরা জনসমাগমে অলকানন্দাকে সশব্দে দু’টো চড় লাগিয়ে দেওয়ার কিন্তু অলকানন্দার প্রতি একটা নিবিড় ভীত ভাব তাকে এটা করার সাহস দিল না। ততক্ষণে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে তরঙ্গিণীও। অলকানন্দার পাশ দাঁড়িয়ে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল,
“চল নন্দা, আমিও যাব তোমার সাথে।”
অলকানন্দা আশ্বাস পেল। একবার গ্রামবাসী আরেকবার অন্দরমহলের সকলের দিকে তাকিয়ে সে ওঠে গেলো গরুর গাড়িটিতে। তার পিছে এলো দুজন পাহারাদারও। মজা দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি গ্রামবাসী, তাই কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এলো তারাও।
_
দ্বৈপায়ন গ্রামের প্রায় শেষদিকের বাড়িটাই ছিল বিদিশাদের। যে মারা গিয়েছে। ছোটো জাত হওয়ায় সভ্য সমাজ থেকে একটু দূরেই তাদের স্থান হয়েছিল। বিদিশাদের বাড়ির পাশেই বড়ো অশ্বত্থ গাছ। আর সেখানেই বিদিশা চির নিদ্রায় আচ্ছাদিত। অলকানন্দার বেশ মায়া হলো মেয়েটার জন্য। মশালের আলোয় মেয়েটার মুখ একটু হলদে সাদা দেখাচ্ছিল। বারো তেরো বছরের হবে মেয়েটা। কী সুন্দর চেহারা! মিষ্টতা পুরো মুখ জুড়ে যেন। অথচ একটা কুলাঙ্গারের জন্য মেয়েটার সুন্দর জীবনটা শেষ। পাহারাদারদের সাহায্যে অলকানন্দা সব গুলো দেহ নিচে নামাল। পুরোহিতকে আনতে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু পাহারাদার এসে খবর জানাল পুরোহিত নাকি আসবে না। লাশ গুলো স্নান করানো প্রয়োজন অথচ কোনো সাহায্যকারী এগিয়ে আসছে না। অলকানন্দা বিনু নামের লোকটাকে আবার ডাকল,
“বিনু দাদা, এখানে আসুন।”
আদেশ পেতে পেতেই বিনু চলে এলো। মাথা নত করে বলল,
“বলুন, বৌঠাকুরণ।”
“গ্রামে কে মৃতদেহ স্নান করায়! খবর দিয়েছেন তাদের?”
“দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা আসবে না জানিয়েছে।”
গ্রামের প্রায় বেশ খানিকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার মাঝে থেকেই একজন বলল,
“ওরা ছোটো জাত, ওদের কেউ-ই স্পর্শ করবে না।”
অলকানন্দা যেন সে কথা কানেই তুলল না বরং কাঠ কাঠ কণ্ঠে বিনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বিনু দাদা, স্নান করানোর ব্যবস্থা করুন। বিদিশা আর ওর মা’কে আমি স্নান করাবো।”
মানুষে পরিপূর্ণ স্থানটায় মুহূর্তে কলরব সৃষ্টি হয়ে গেলো। বিস্ফোরিত নয়ন জোড়া মেলে একজন অপরজনের দিকে কেবল চাওয়াচাওয়ি করল। বিনু মাথা নত করে বলল,
“কিন্তু বিদিশার বাবা?”
অলকানন্দা পড়ল বিপাকে। সত্যিই তো, ঐ মানুষটাকে কে স্নান করাবে! নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভব করল সে। ততক্ষণে অবশ্য জায়গাটার চারপাশে মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করে দেওয়া হয়েছে। অলকানন্দা সে আলোতেই মানুষের উপচে পড়া ভীড় দেখছে। সেখান থেকে কেউ কী নেই অলকানন্দাকে সাহায্য করবে! অলকানন্দা আশা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সবার পানে কিন্তু কারো মুখে টু শব্দটুকু নেই। আজ নবনীল থাকলে এতটা অসহায় হয়তো সে নিজেকে অনুভব করতো না। মানুষটা ছাড়া অলকানন্দার এই আসনে টিকে থাকা যে বড়ো বেশিই মুশকিল তা সে মুহূর্তে মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারছে।
অলকানন্দা যখন একবারেই আশা ছেড়ে দিতে নিল ঠিক তখনই ভীড় থেকে একটা বৃদ্ধ কণ্ঠ বলে উঠল,
“আমি গোসল করাবো বিদিশার পিতাকে। আমি নিচ্ছি এই দায়িত্ব।”
সকলের দৃষ্টি তখন সেই বৃদ্ধের দিকে। অলকানন্দা অস্ফুটস্বরে বলল,
“মুমিনুল মাস্টারমশাই!”
মুমিনুল ইসলাম নামক লোকটা এগিয়ে এলো। অলকানন্দাদের বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষক। সে এগিয়ে এসে ধীর কণ্ঠে বলল,
“আমি করাবো গোসল, নন্দা।”
সকলের মাঝে আবার হৈ হৈ রব উঠলো, কয়েকজন তো এগিয়ে এসে হিংস্রতার সাথে বলল,
“না, আমরা হিন্দুজাতি আর আপনারা মুসলিম, আপনারা এখানে কিছু করতে পারবেন না।”
মুমিনুল ইসলাম বড়ো শান্তির সাথে উত্তর দিলেন, “আমি মানুষ জাতি আর ওরাও মানুষ, আপনারা না পারলে আমি মানুষ হিসেবে তো সাহায্য করতেই পারি। উদারতার চেয়ে বড়ো ধর্ম নেই।”
গ্রামের লোক মানতে নারাজ। এর মাঝেই পাহারাদার বিনু বলে ওঠলেন,
“আমিও স্নান করাতে সাহায্য করবো মাস্টারমশাই। আমি আছি।”
অলকানন্দার চক্ষু জুড়ে উপচে পড়লো কৃতজ্ঞতা বোধ। মানবধর্ম সবচেয়ে বড়ো ধর্ম সেটা আবারও এই মানুষ গুলো প্রমাণ করল। এমন একটা পিছিয়ে পরা শতকে এমন বদল সত্যিই বিস্ময়কর এবং চমকপ্রদ। কিন্তু এর জন্য পোহাতে হবে অনেক দুর্গতি।
#চলবে
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১৭.
চারপাশে মিহি রাত। ঝিঁ ঝিঁ পোকার অদৃশ্য কোলাহল। হারিকেনের আলো মৃদুমন্দ বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে। অলকানন্দা সেই বাতাসের দোল দেখছে নিবিড় চোখে। রাত তখন গাঢ় হওয়ার পথে। সারাদিনের ক্লান্তি তার উপর বিদিশাদের সেই বিচার কার্য নিয়ে হৈচৈ, মতবিরোধীতা, সব মিলিয়ে অলকানন্দা ঝিমিয়ে এসেছে। অলকানন্দার দরজায় ক্ষীণ শব্দ হলো,
“বড়দি, দরজা খুলো।”
অলকানন্দার তন্দ্রায় ভার হয়ে আসে চোখে দুটো কুঁচকে এলো। এত রাতে কৃষ্ণপ্রিয়ার কণ্ঠ পেয়ে সে কিঞ্চিৎ অবাকও হলো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“কে? কৃষ্ণা?”
“হ্যাঁ বড়দি, দরজাটা খুলো।”
অলকানন্দার তন্দ্রা ছুটে গেলো। সে বিছানা থেকে ওঠে গিয়ে দরজা খুলল। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। যে যার মতন হয়তো ঘুমে মগ্ন। এত রাত্রে জেগে থাকারও কথা না। কিন্তু কৃষ্ণপ্রিয়ার এত রাতে এঘরে কী কাজ!
দরজা খুলতেই সাবধানী চোখে আশপাশ পরখ করে কৃষ্ণপ্রিয়া ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকেই দরজায় খীল দিয়ে দিল। কৃষ্ণপ্রিয়ার এমন আচরণে কৌতূহল জন্মালো অলকানন্দার। সে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কী সমস্যা ছোটোবউ? এমন করছো কেন?”
কৃষ্ণপ্রিয়া এগিয়ে অলকানন্দার পাশে দাঁড়াল। ধীর কণ্ঠে বলল,
“আমার একটু কথা আছে, বড়দি।”
“হ্যাঁ, বলো না?”
“আমাকে একটা সাহায্য করতে হবে, বড়দি।”
কৃষ্ণপ্রিয়ার আজকের কণ্ঠে ক্রোধ, রাগ, হিংসে কিছুই নেই। কিন্তু কেমন একটা গোপনীয়তার ছোঁয়া। অলকানন্দাও ওর মতন ফিসফিসিয়ে বলল,
“কী সাহায্য?”
“কালকে রাতে তোমাকে একটা জায়গায় যেতে হবে, বড়দি।”
অলকানন্দা ভারী আশ্চর্য কণ্ঠে বলল,
“কোথায় যাবো? তাও রাতের বেলা!”
“তোমার দেবর রাত হলে কোথাও একটা যায়। খুব সম্ভবত গ্রামের পেছন দিকে খারাপ মেয়ে মানুষদের আস্তানায়। প্রায প্রতি রাতেই যায়। কাল রাতেও যাবে। তুমি গিয়ে তাকে হাতে-নাতে ধরবে। তবেই তাকে জব্দ করতে পারবে। নাহয় সে আরও উশৃংখল হয়ে ওঠবে।”
অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কৃষ্ণপ্রিয়ার দিকে। মেয়েটা একধরণের স্বামী পাগল বলা যায়। স্বামীর প্রতি তার একটা অন্ধ বিশ্বাস সবসময়ই ছিল। আর সেই অন্ধ বিশ্বাসের জোরে মেয়েটা কখনো ভালো মন্দ বিচার করতে পারেনি। অথচ সে-ই মেয়েই কি-না স্বামীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে! অলকানন্দার শিরা-উপশিরায় যেন ছড়িয়ে গেল বিস্মিত ভাব। সে অবিশ্বাস্যকর কণ্ঠে বলল,
“তুমি সজ্ঞানে এই কথা বলছ তো!”
অলকানন্দার প্রশ্নে কৃষ্ণপ্রিয়ার মাথাটা ক্ষানিক নত হলো। সে প্রায় মিনমিন করে বলল,
“বড়দি, তোমাকে অনেক খারাপ কথা আমি বলেছি নিজের স্বামীর জন্য। আমি অন্ধ স্বামী ভক্ত ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার স্বামী কতটা খারাপ দিকে চলে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচাও বড়দি, আমার সংসারটা বাঁচাও।”
কথাটা বলতে বলতে কৃষ্ণপ্রিয়ার চক্ষুদ্বয়ে জলের স্রোত বইতে লাগল। অলকানন্দার মায়া হলো ছোটো মেয়েটার জন্য। সে নিজ ইচ্ছায় জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বলল,
“কেঁদো না কৃষ্ণা, আমি আছি না? আমি তোমার পাশে আছি। কান্না করো না।”
কৃষ্ণপ্রিয়ার হঠাৎ কী যেন হলো। সে দু-চোখ মেলে তাকিয়ে রইল অলকানন্দার মুখের দিকে। নিভু আলোয় মনে হলো কোনো দেবী যেন শোভা ছড়াচ্ছে। পুরো পৃথিবী খুঁজে বেড়ালেও এমন রূপের নারী খুঁজে পাওয়া বোধহয় দুষ্কর। কী পবিত্র সে মুখমন্ডল! কৃষ্ণপ্রিয়া এক ধ্যানে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে মিন মিন করে যেন বলল,
“আমাকে ক্ষমা করো বড়দি, ক্ষমা করো আমার সকল অপরাধ।”
তার পরপরই অলকানন্দা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। অলকানন্দা কেবল অবাক চক্ষুদ্বয় মেলে সেই প্রস্থান দেখল।
রাত বাড়তে থাকল হুড়মুড় করে। অলকানন্দার চোখে আর ঘুম নামল না। মনের ভেতর কিসের একটা অস্থিরতা তাকে ঘুমাতে দিল না। এত বড়ো গ্রামের দায়িত্ব, এত বাধা নিষেধ অমান্য করে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ। আজ তো গ্রামবাসীর চোখে তার জন্য একটা রাগ সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এরপর ক্ষমতা চালানোটা একটু কঠিনই হবে বোধহয়। সেই একটা গোপন ভয় তার ভেতরটা বারবার নাড়া দিল। সে খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে কোনোমতে রাতটা পার করল। নবনীলের স্পষ্ট মুখটা হৃদয়ের আঙ্গিনায় বার কয়েক উঁকিঝুঁকিও দিল। অবাধ্য কিশোরী বয়স, ভালোবাসা পেলে তো মাথা নত করতে বাধ্য।
_
বিহারিণী মহলের হাবভাব একটু গম্ভীর। কোনো হৈচৈ নেই, কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই, কথা কাটাকাটিও নেই। চারপাশে তখন ভরদুপুর। বাড়ির আশেপাশে কয়েকটা কাক অনবরত কা কা করছে। অকল্যাণের করুণ স্বরে কাঁপছে বাড়ির ভিত্তি। অলকানন্দা বসে ছিল নিজের ঘরে। তার স্কুলের পরীক্ষা শেষ। ফলাফল বের হলেই কলেজের পড়াশোনা। কিন্তু এ অব্দি গ্রামের কোনো মেয়ে কলেজের দরজায় পা রাখেনি। অবশ্য গ্রামের আশেপাশে কোনো কলেজও নেই। কলেজে পড়তে হলে যেতে হবে শহরে। আর মেয়েকে গ্রামের বাহিরে পাঠানোর কথা তাদের বাবা-মা ভাবতেও পারেন না। মেয়ের সংসার হবে, সংসার সামলাবে, এতটুকু অব্দিই সকলের ভাবনা। এর বেশি কিছু কল্পনা করাও তাদের কাছে দিবাস্বপ্ন। সেইখানে দাঁড়িয়ে অলকানন্দা স্বপ্ন দেখে, সে কলেজে পড়বে, অনেক বড়ো কিছু হবে। কথা গুলো ভেবে নিজেই আনমনে হাসে। তন্মধ্যে ঘরের এক কর্মচারী এসে জানায় তাকে সুরবালা ডাকছে। অলকানন্দা উঠে দাঁড়ায়। কালকের ঘটনার পর তার শাশুড়ি তার উপর বেজায় রেগে আছেন। কোনো কথাবার্তা বলেননি এ অব্দি। হয়তো কালকের জন্য কিছু বলতেই ডাকছেন। সে আর অপেক্ষা না করে পা বাড়ায় শাশুড়ির ঘরের দিকে।
সুরবালার ঘরে তখন প্রায় অনেকেই উপস্থিত। যাদের দেখে অলকানন্দা খানিক ভ্রু কুঁচকালো। তার ননদের স্বামী প্রসাদ, ননদ মনময়ূরী, কাকী শাশুড়ি, তরঙ্গিণীও উপস্থিত। অলকানন্দা ঘোমটা টেনেই উপস্থিত হলো। সকলের দৃষ্টি তার উপর বিধায় তার কিছুটা অস্বস্তিও হলো। সে আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
“মা, ডেকেছিলেন?”
সুরবালা তখন শুয়ে আছেন বিছানায়। এমন ভরদুপুরে শুয়ে থাকার মানুষ তিনি নন। অলকানন্দা কিছুটা বিচলিত হলো। সুরবালার পাশে বসতে বসতে বলল,
“কী হয়েছে, মা? আপনি শুয়ে আছেন কেন? এইসময় তো শুয়ে থাকার কথা না।”
সুরবালার কপালে ডান হাত ঠেকানো। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার কিছু হয়নি বউমা। তুমি বসো, তোমার সাথে কথা আছে আমার।”
অলকানন্দা কিছুটা অবাকই হলো। তার শাশুড়ির কণ্ঠস্বর আজ ভিন্ন। একটু বেশিই কী রেগে আছেন! অলকানন্দা যেই-না কথা বলতে নিবে তার আগেই সুরবালা বললেন,
“তুমি কালকে যেটা করেছ বউমা, সেটা আমার অমতেই করেছ। আমার অমতে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি। তোমার মনে হচ্ছে না, তুমি নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবা শুরু করেছ? যার জন্য তোমার শাশুড়ির ডাকও তোমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছে?”
অলকানন্দা শাশুড়ির কথা বিস্মিত হলো। কথা বলার ভাষাও যেন তার ফুরিয়ে গিয়েছে। সে অস্ফুটস্বরে বলল,
“মা, আপনার কাছেও জাতপাত বড়ো হলো!”
“অবশ্যই হলো বউমা। তার উপর মৃত মানুষের ভালো করতে গিয়ে তুমি কত মানুষের শত্রু হলে বলো তো? আজকে যদি তোমার কিছু হয় তবে কেউ তোমার পাশে দাঁড়াবে না সেটা বুঝতে পারছ না? পুরো গ্রামের বিরুদ্ধে গিয়ে তুমি সবার শত্রু হয়ে গেলে। এটা বুঝতে তোমার অসুবিধা হচ্ছে না? বউমা, ক্ষমতায় তখনই থাকতে পারবে যখন তোমার পক্ষে দল ভারী হবে। অথচ তুমি নিজেই সকলের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছ। ব্যাপার গুলো অন্য ভাবেও সামলানো যেত। তুমি ভুল করেছ, বউমা। তুমি আমার কথাও অমান্য করেছ। তোমার এই হটকারিতা তোমাকে অনেক বড়ো বিপদে ফেলবে, বউমা। যাও তুমি এখন এখান থেকে।”
সুরবালা দেবীর কথা গুলো অযৌক্তিক নয়। অলকানন্দা অনুভব করল, সত্যিই সে হয়ত একটু বেশিই করে ফেলেছে কিন্তু তাই বলে ঐ মানুষ গুলোর মৃতদেহ এভাবেই থাকতো! অলকানন্দার ভাবনার মাঝে সুরবালা আবার বললেন,
“যাও এখন তুমি। তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
এই বাক্যটুকু যথেষ্ট ছিল অলকানন্দাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা মানুষটা তাকে এখন সহ্য করতে পারছে না! কী অদ্ভুত। অলকানন্দা আর দাঁড়ালো না, ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চোখের অশ্রু প্রকাশ্যে আনতে চায় না সে।
_
প্রিয় নবনীল,
আপনি যাওয়ার পর হুট করে সব অগোছালো হয়ে গিয়েছে। একে একে আমার শাশুড়িমা থেকে শুরু করে পুরো গ্রাম আমার বিপক্ষে চলে গিয়েছে। হয়তো এর জন্য দায়ী আমিই। কিন্তু কী করব বলুন! আপনিই তো বলেছিলেন ন্যায় বিচার করতে। ন্যায় বিচার করলে সকলে যে এতটা বিপক্ষে চলে যায় সে তো বলেননি। বেধবাকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখালেন অথচ তার পাশে না থেকেই চলে গেলেন! প্রতিটা ক্ষণ আমি আমার শূন্যতা অনুভব করছি। ক্ষমতার আসন থেকে একা শাসন করাটা অনেক বড়ো কাজ। আমার ছোটো হাতে সেই বড়ো দায়িত্ব না দিলেও পারতেন। আপনি খুব দ্রুতই ফিরে আসুন। আপনাকে আমার প্রয়োজন।
ইতি
অলকানন্দা
চিঠি শেষ করেই একটা মোটা খামে ভরে তা পাঠানোর ব্যবস্থা করল অলকানন্দা। তারপর শাড়ি বদলে ঘর থেকে বেরুতেই লক্ষ্মীদেবীর মুখোমুখি হলো। লক্ষ্মী দেবী মানুষটা আগের মতন তেমন হৈচৈ করেন না। নবনীল আসার পর থেকেই তার চুপচাপ থাকা শুরু। হয়তো উনার ছেলে নিষেধ করেছেন।
আজও লক্ষ্মী দেবী অলকানন্দার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিলেন কিন্তু বাঁধ সাধলো অলকানন্দা। প্রায় কোমল স্বরে সে জিজ্ঞেস করল,
“পিসিমা, ভালো আছেন?”
লক্ষ্মী দেবী মোটেও প্রস্তত ছিলেন না এমন একটা প্রশ্নের জন্য। তার বিস্মিত ভঙ্গিই সেটা বলে দিল। তা দেখে অলকানন্দা হাসল। পিসির কাছে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে পিসিমার বাহু জড়িয়ে ধরে বলল,
“কী হয়েছে, পিসিমা?”
পিসিমার চোখ গুলো জ্বলজ্বল করে ওঠল। সে ধীর গতিতে অলকানন্দার হাত দু’টো সরিয়ে প্রস্থান নিলেন জায়গা থেকে। অন্যসময় হলে হৈচৈ করে মানুষটা বাড়ি মাথায় তুলতেন, অথচ আজ তেমন কিছুই করলেন না যা ভারী অপ্রত্যাশিত। অলকানন্দা ছোটো একটা শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো। বিনু নামক দেহরক্ষীকে সাথে নিয়েই চলল পাশের গ্রামে। গ্রামের জমি নিয়ে অ্যালেন আর স্টিফেনের সাথে কিছু আলোচনা আছে।
_
বিরাট বিলাসবহুল গেইট পেরিয়েই ইংরেজ সাহেবদের বাড়ি। মার্বেল পাথরের খোদাই করা সে বাড়ির আনাচে কানাচে যেন জ্বলজ্বল করছে সৌন্দর্যতা। বিদেশি এক ধরণে দারুণ জিনিসও অলকানন্দার চোখে পড়ল। একটা ময়ূর দাঁড়ানো আর তার মুখ থেকে বৃষ্টির মতন অনবরত জল পড়ছে। সেটা আবার ছোটো একটা জায়গায় জমা হচ্ছে কিন্তু উপচে বাহিরে আসছে না। বড্ড বেশিই বিস্ময়কর ব্যাপারটা!
অলকানন্দারা বসে আছে বাড়ির সামনে বাগানটায়। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন রকমের ফুল গাছ যা অলকানন্দা আগে কখনো দেখেনি। সাথে বিশাল একটা জায়গা জুড়ে পাথরের তৈরী বসার জায়গা। কতটা যত্ন নিয়ে এ বাড়ি তৈরী করা হয়েছে তা চারপাশ দেখলেই বোঝা যায়!
ঠিক মিনিট পাঁচ পেরুতেই অ্যালেনও মিস্টার স্টিফেন উপস্থিত হলো সেখানে। অলকানন্দাকে দেখেই অ্যালেনের হাসি প্রসস্থ হলো। সে এগিয়ে এসে আন্তরিকতার সঙ্গে বলল,
“গুড ইভেনিং বিউটিফুল লেডি। এখানে আসিয়াছেন আপনি, আপনার জন্য কী করিতে পারি বলুন?”
অলকানন্দা হাত জোর করে প্রণাম জানাল। অতঃপর ঘোমটার আঁচলটা শক্ত করে ধরে বলল,
“আপনাদেরকে আমি বার-বার বলেছিলাম আমার কৃষকদের জমিটা নিবেন না। কিন্তু আপনারা কথা দিয়েও কথা রাখলেন না কেন!”
“আপনাদের জমিদার মহল থেকে অনুমতি এসেছিল, সেজন্যই আমরা আমাদের কথা থেকে নড়চড় হয়েছি।”
অলকানন্দার কথার পিঠে জবাব দিল স্টিফেন। অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো, বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আমাদের এখান থেকে!”
তার একে একে হিসেব মিলল। নিশ্চয় এটা তার দেবর আর খুঁড়ো শ্বশুরের কাজ। ইশ, সে মহলে কথাটা না তুলেই এখানে চলে আসল। কথা ঘুরানোর জন্য অলকানন্দা আবার বলল,
“কিন্তু আপনারা আমাকে কথা দিয়েছিলেন, অন্য কারো কথা শোনাটা আপনাদের উচিত হয়নি।”
“আপনার সাথে আমাদের কোনো তেমন সম্পর্ক নেই যে আমাদের কথা রাখতেই হবে। আপনি রাজনীতিতে কাঁচা বড্ড।”
স্টিফেনের কাঠ কাঠ জবাবে অলকানন্দা বিরক্ত হলো। সেও কঠিন স্বরে বলল,
“এই জমি কিছুতেই আমি আপনাদের দেবো না।”
“ওকে, দেখা যাক।”
অ্যালেনকে কিছু বলারও সুযোগ দিলো না স্টিফেন। অলকানন্দাও গটগট পায়ে বেরিয়ে এলো। ইংরেজি সাহেবরা যে পাষাণ সেটা স্টিফেন নামক লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায়।
_
রাত বাড়ল তার নিজ গতিতে। আকাশে আজ চাঁদ নেই। অন্ধকার আচ্ছন্ন প্রকৃতি। অলকানন্দা জা-এর কথা রাখতেই একা ছুটলো গ্রামের পরিত্যক্ত সেই জায়গাটাতে। সেখানে যেতেই বিশ্রী মানুষজন দেখে তার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। অথচ সে খুঁজে পেল না নিজের দেবরকে। কিন্তু তার সাথে ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা। দেবরকে খোঁজার জন্য একটা ঘরে ঢুকতেই ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের ভেতর নেশাগ্রস্থ একজন মানুষ তাকে দেখে কামুকী হাসি দিল। অলকানন্দা ছুটোছুটি করল, বের হওয়ার চেষ্টা করল অথচ বাহির থেকে দরজা তখন আটকানো। নেশাগ্রস্থ মানুষটা অলকানন্দার শরীরে স্পর্শ করার চেষ্টা করল। ছিঁড়ে ফেলল বক্ষবন্ধনীটা। শাড়ির আঁচল খুলল। কপালে পড়া চন্দনের ফোঁটাটাও মুছে গেল ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে। কিন্তু পুরুষের শক্তির কাছে ছোটো অলকানন্দা যে বড্ড নাজুক। তার শরীর ক্লান্ত হয়ে আসতেই দরজাটা খুলে গেল। অলকানন্দা যেন প্রাণ ফিরে পেল। যেই-না ছুটে সে বেরুলো তার সামনে তখন উপস্থিত হলো গোটা গ্রামবাসী। মশালের লালাভ আলোয় উজ্জ্বল হলো অলকানন্দার চরিত্রহীন হওয়ার দৃশ্য। কিশোরী অলকানন্দা শরীর ঢাকতে ব্যস্ত অথচ অপর দিকে গ্রামবাসীর চোখে বিস্ময়তা। চরিত্র নিয়েও বিধবা হয়েছিল বলে যে নারীর নামকরণ করা হয়েছিল বে শ্যা। আজ তার শরীরে সেই তকমা জ্বলজ্বল করছে। সমাজ এবার কী দণ্ডবিধি ধার্য করবে সেই চরিত্রহীনার! কী মূল্য দিতে হবে অলকানন্দাকে!
#চলবে