#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
৮.
দীঘল কালো রজনী কেমন উন্মাদনায় মেতেছে। নন্দন মশাই জেসে কুটিকুটি। হাসি দেখা গেল লক্ষ্মী দেবীর ঠোঁটের কোণাতেও। অলকানন্দা বড়ো অশ্বত্থ গাছের আড়াতে দাঁড়িয়ে সেই সুখ দেখছে। তার এখনও মস্তিষ্ক অব্দি ঘটনাটা পৌঁছাতে পারেনি। আসলে এখানে হচ্ছেটা কী! অলকানন্দার আর ভাবতে হলো না কষ্ট করে। তার আগেই পরিচিত সেই ব্রাহ্মণের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কন্যাকে আনিতে হবে এখনই। দাহ্য করার সঠিক সময় হইয়া গিয়াছে। আকাশে কেমন ভরা পূর্ণিমা! নিয়ে আসুন উনাকে।”
অলকানন্দা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। কাকে আনার কথা বলছে সেও দেখতে চায়। ব্রাহ্মণের আদেশ পেতেই লক্ষ্মী দেবী হন্তদন্ত পায়ে ছুটে গেলো কোথাও একটা। গম্ভীর আঁধারে মিশে গেল লক্ষ্মী দেবীর সুন্দর দেহটা। অলকানন্দা গম্ভীর ভাবে অপেক্ষা করলো। ঠিক কাকে এখানে আনা হবে সেটাই জানার আগ্রহ তার। অলকানন্দার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটলো ঠিক মিনিট পাঁচেক পরেই। লক্ষ্মী দেবীকে ছুটে আসতে দেখা গেল হন্তদন্ত পায়ে। হাঁপিয়ে গেছে মানুষটা ছুটতে ছুটতে। অলকানন্দার এতক্ষণের অপেক্ষাকে বিশ্রাম দিয়ে উচ্চারণ করলো কাঙ্খিত বাক্য,
“ও মেয়ে তো ঘরে নেই। কোথায় গেল ও? ঘুমিয়ে ছিল দেখেছিলাম, এখন দেখি ঘর খালি।”
লক্ষ্মী দেবীর কথায় চমকে গেলো নন্দান মশাই। কিছুটা উচ্চস্বরেই বলল,
“কী!”
নন্দন মশাইয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কথাটা সে মোটেও আশা করেনি যেন। ব্রাহ্মণ ঠাকুর উঠে দাঁড়ালেন। ধমকে বললেন,
“এত যজ্ঞ, আয়োজন করিয়া এই কথা বলিলে কোনো লাভ হবে? যেখান হইতে পারিবেন সেখান হইতেই তাহা কে নিয়া আসুন৷”
“আমি ও মেয়েরে পুরো বাড়ি খুঁজে এলাম, কোথাও তার টিকি টুকুরও দেখা নেই। ও কী বুঝতে পেরে পালিয়ে গেল কোথাও?”
অলকানন্দা হয়তো বুঝতে পারলো ঠিক কাকে খুঁজছে এই তিনজন মানুষ। তাদেরকে আর ব্যস্ত হতে না দিয়েই অলকানন্দা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। ভাবলে ভাবে হেঁটে গেলো তাদের সামনে। অলকানন্দাকে এখানে কেউ-ই আশা করেনি যার ফলস্বরূপ ভূত দেখার মতন চমকে উঠে তারা। যা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে অলকানন্দা। আজ তার মাথায় ঘোমটা নেই। আঁচলটা গড়াচ্ছে মাটিতে। এমন সুন্দর হাসিতেও মেয়েটাকে কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে! লক্ষ্মী দেবী প্রথমে ভীত হলেন। জঙ্গল থেকে ভূত প্রেত এসে পড়েছে ভেবেই দিলের চিৎকার। বারংবার বলতে লাগলে, “রক্ষে করো মা, রক্ষে করো”। নন্দন মশাই আর ব্রাহ্মণ ঠাকুর ড্যাবড্যাব করে কেবল তাকিয়ে রইলো। অলকানন্দার হাসি যেন প্রকৃতিতে ঝঙ্কার তুলেছে। গা শিরশির করে প্রবাহিত হচ্ছে কেমন ভয়ঙ্কর অনুভূতি! তাদের এমন ভীত অবস্থা দেখে অলকানন্দাই প্রথম কথা বলল,
“কি পিসিমা, পোড়াবেন না আমায়?”
লক্ষ্মী দেবী সংশয় নিয়ে চাইলো অলকানন্দার পানে। বিড়বিড় করে বললেন,
“বউ, তুই এত রাত্তিকালে এখানে কী করিস?”
“ওমা আপনারা এত সমাদার করে আমাকে পোড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন আমি না এলে কেমন বাজে দেখায় না? তাই এলুম।”
অলকানন্দার কথায় থতমত খেলো ওরা সকলে। লক্ষ্মী দেবী আমতা-আমতা করে বললেন,
“কী সব বলছিস, বাছা! এগুলো তোরে কে বললো?”
“আপনি আমাকে খুঁজতে গেলেন অথচ এখন এসব বলছেন পিসিমা? মিথ্যে কথা বলা কিন্তু পাপ। চলেন পিসিমা, আমি বেধবা দেখে আমাকে পোড়াতে চাচ্ছেন, আপনিও তো বেধবা। চলুন আজ দু’জন একসাথে পুড়বো। আসেন পিসিমা, আসেন। আজকে কাকাবাবু আর ঠাকুর মশাইয়ের সব পূন্য করে দিয়ে যাবো। আসুন।”
লক্ষ্মী দেবী ভীত হলেন। দ্রুত ছুটে চলে গেলেন। আজ অলকানন্দাকে ভীষণ ভয় লাগছে তার। মেয়েটা যেমন, যা তা একটা কিছু করে ফেলতে পারে।
অলকানন্দা ব্রাহ্মণ ঠাকুর আর নন্দন মশাইয়ের দিকে তাকাতেই তারা গম্ভীর পায়ে হেঁটে চলে গেলেন। অলকানন্দার এতক্ষণে ঠোঁটে খেলতে থাকা হাসির রেখা হ্রাস পেলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। আজ সে জেগে ছিল বলে বেঁচে গেল, যদি ঘুমিয়ে থাকতো তবে তো তার এ ঘুম আর কখনোই ভাঙতো না! নিজের এত সৌভাগ্য দেখে কান্না পেল অলকানন্দার। দৈর্ঘ্যের হিসেবে ছোটো জীবনটার দুঃখের প্রস্থতা এত বেশি কেন! অলকানন্দার দীর্ঘশ্বাস কেবল গাছপালাকে নিবিড় ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিলো। এছাড়া আর তেমন কোনো হেলদোল হলোনা বোধকরি। বিধবা তো, তাদের আবার কষ্ট গুলো কাউকে স্পর্শ করতে পারেনা। প্রকৃতি সে অধিকার দেয়নি।
_
সকাল হতেই শুদ্ধ বস্ত্র পড়ে তৈরী অলকানন্দা। আজ সে স্কুল যাবে। আজ থেকে তার পরীক্ষা শুরু। যদিও সে জানেনা আদৌও তাকে যেতে দেওয়া হবে কি-না তবুও সে অনির্দিষ্ট একটা আকাঙ্খা নিয়ে তৈরী হলো। জীবনে এগুতে হলে এটার বিকল্প যে নেই!
অলকানন্দার শুভ্র দেহে শুভ্র শাড়িখানা বেশ সুন্দর লাগছে। তার উপর কপালের মাঝ বরাবর একটা চন্দনের ফোঁটা আঁকা। যেন নীল আকাশের বুকে প্রকৃতির ভুলে চাঁদ উঠেছে। ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট নয়নযুগলে সবসময় যেন খেলা করছে একটা কৌতুক হাসি। ঠোঁট জুড়ে গোলাপি আভা। যেন দীপ্তি ছড়াচ্ছে তার শরীর!
অলকানন্দার ঘর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেই ঘরে উপস্থিত হলো মনময়ূরীর স্বামী প্রসাদ। সাদা পাঞ্জাবি পড়া লোকটাকে খারাপ লাগছে না দেখতে। বরং ভীষণ সুন্দর লাগছে। সে ঘরে প্রবেশ করেই গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“সব পড়েছিলেন তো?”
অলকানন্দা আঁচল টেনে ঘোমটা দিলো। উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“পড়েছি।”
“পারবেন? না পারলে আমি আছি।”
‘আমি আছি’ কথাটার মাঝে অলকানন্দা যেন ভরসা খুঁজে পেলো। অনুভব করলো খুব কাছের কেউ তাকে আশ্বস্ত করছে। মানুষটাকে বড্ড আপন আপন লাগে কেন? এই এত আপন লাগার কারণ কী! অলকানন্দা উত্তর খুঁজে পায়না। উত্তর খুঁজতেও চায়না। পরিবেশের বিপরীতে থাকা অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়া জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাপ।
“সাদা শাড়ি আপনার পড়তেই হয়? এটা পরে নিজেকে বিধবা নামক দুর্বল খোলসে আটকে রাখার কোনো কারন কী আছে?”
প্রসাদের এত গাম্ভীর্যের সঙ্গে করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না অলকানন্দা। সাদা শাড়ি পড়তে একবারেই তার খারাপ লাগছে তেমনটা না। যার মন বিষাদে আক্রান্ত তার কাছে লাল আর সাদা দু’টোই কেবল রঙ মাত্র। তাদের বিশেষ কোনো সত্তা নেই।
কিন্তু প্রসাদের প্রশ্নের বিপরীতে ঘরের দরজা থেকে একটা গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“সাদা কী কেবল বিধবাই বোঝায়? অথচ পবিত্রতার প্রতীক সাদা! মাস্টারমশাই কী সেটা জানেনা? মাস্টারমশাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির বদল প্রয়োজন। অলকানন্দাকে বিধবা নামক শেকল আঁকড়ে ধরতে পারবে না কখনো, তাই সাদাটা তার জন্য কেবল শান্তি আর পবিত্রতাই বহন করে। ভাবনা বদলালেই তো বাঁচা যায় তবে কেন অশান্তি?”
অলকানন্দাসহ অবাক হলো প্রসাদ। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলা বর্ণের মায়া মুখের একজন পুরুষ। ঠোঁট জুড়ে হাসির রেখা। অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো। সে নিজের মস্তিষ্কে অনেক জোর প্রদান করেও মনে করতে পারলোনা এই পুরুষের ঠিকানা, পরিচয়। প্রসাদ অবাক কণ্ঠে বললো,
“নবনীল যে!”
নবনীল নামের ছেলেটা হেলতে দুলতে ঘরে প্রবেশ করলো। অলকানন্দার অবাক দৃষ্টির বিনিময়ে বলল,
“আমায় চিনছেন না তো রমণী? আমি আপনাকে দেখেছিলাম লাল টুকটুকে নতুন বউয়ের আবরণে। সেদিনও আপনার কপালে চন্দন লেপটানো ছিলো। তারপর কেটে গেলো বায়ান্ন দিন। আজ আপনার লাল সাজ আর রঙিনতা সাদায় ঢেকেছে। তবে আজও কপালে চন্দন আঁকা! সেদিনও মুগ্ধ হয়েছে ছিলাম আজও মুগ্ধ হলাম।”
#চলবে
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
৯.
“বিহারিণী মহলে” যতটা বি স্ফো রণ ঘটার কথা ততটা বি স্ফো রণ ঘটলো না। অলকানন্দার স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটা বড্ড স্বাভাবিক ভাবেই নিল যেন সকলে। কোনো হৈচৈ হলো না, ঝামেলা হলো না। যেন অলকানন্দার পরীক্ষা দিতে যাওয়াটা স্বাভাবিকই। নন্দন মশাইয়ও আজ বাড়িতে নেই কোথাও একটা গিয়েছেন তাই বোধহয় লক্ষ্মী দেবীও তার গলা উঁচুতে তুললেন না। আরও একটা কারণ বোধহয় ছিল যেটা অলকানন্দার অজানাই রইল। স্কুলের দেরি হচ্ছে বিধায় সে শাশুড়ি ও কাকি শাশুড়ির পা ছুঁয়ে প্রণাম করে প্রসাদের পাশাপাশিই বেরিয়ে গেল। দূর হতে মনময়ূরী বিরস মুখে দেখল সবটা। তার বুক কাঁপে। তার বিয়ে হয়েছে কত দিনই হলো? চার কিংবা পাঁচ মাস! অথচ এ অব্দি স্বামীর মন পেল না। একটা মেয়ের কাছে স্বামীই তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অলংকার অথচ তার এই অলংকারেই নড়বড়ে। এই ঘরের কথা কী বাহিরের কারো কাছে বলা যায়? নিজের এই গোপন ব্যাথা যে সদা গোপনই রাখতে হয়। মানুষ জেনে গেলেই যে সমস্যা!
অলকানন্দার সাদা আঁচলের ঘোমটা খানা হালকা বাতাসে একটু হেলেদুলে উঠল। প্রসাদ সে দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাল, বিভোর হয়ে বলল,
“আপনি এত সুন্দর কেন অলকানন্দা?”
অলকানন্দার ভীষণ অস্বস্তি হলো। যতই হোক প্রসাদকে সে বড্ড সম্মানের চোখে দেখে। মেয়েটাকে চুপ থাকতে দেখে প্রসাদ হাসলো, বুকের মাঝে চেপে রাখা মোটা বইটাই বিজ্ঞ ভঙ্গিতে চোখ বুলিয়ে বলল,
“সকালে যে কথা বলেছ সেটা কে ছিল বলুন তো?”
অলকানন্দার হুট করেই সকালের সেই পুরুষটার কথা মনে পড়ল। চোখ উল্টিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কে?”
প্রসাদ উত্তর দেওয়ার আগেই তারা স্কুলের সামনে পৌঁছে যায়। পরিচিত সহকর্মীদের পেয়ে প্রসাদ গম্ভীর মুখে সেখানে এগিয়ে যায়। সে স্কুল আর বাড়িকে কখনোই এক করেনা।
অলকানন্দাও মাথা নত করে নিজের শ্রেণিকক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। তাদের গ্রামের খুব অল্প সংখ্যক মেয়েই স্কুলে পড়ে। তার মাঝে ওদের ক্লাসে সবচেয়ে কম। কারন এতটুকু অব্দি কেউ পড়াশোনা করেনা। অলকানন্দা ক্লাসে ঢুকতেই সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বেশ তাজ্জব দৃষ্টিতে সকলে তার দিকে তাকিয়ে রইল। যে মেয়েটার স্বামী শোকে ঘরের এক কোণায় বসে জীবনকে তুচ্ছ ভাবার কথা, সে মেয়েটাই কি-না জীবনকে মূল্যবান করতে স্কুল এসেছে! এর চেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা যেন পৃথিবীতে দু’টি নেই।
সকলকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অলকানন্দার খানিক অস্বস্তি হলো। সে মাথার কাপড় কিছুটা টেনে দিয়ে নিজের এক মেয়ে সহপাঠীর সঙ্গে গিয়ে বসল। কিন্তু তখনই ঘটলো অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা। অলকানন্দার মেয়ে সহপাঠীটা তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল, প্রায় নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
“ছিঃ ছিঃ নন্দা! তুমি বেধবা মেয়ে মানুষ হয়ে আমার সাথে বসেছিছ কেন? আক্কেল জ্ঞান কী সব বিসর্জন দিলে নাকি! তোমার না অশৌচ? আমাকে দিলে তো অশুদ্ধ করে।”
অলকানন্দা সহপাঠীর এমন আচরণে হতভম্ব প্রায়। বিস্মিত নয়ন জোড়া নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কিছু বলার ভাষা তার হারিয়েছে যেন। অলকানন্দাকে চুপ থাকতে দেখে মেয়েটা গলার স্বর আরেকটু উঁচু করল,
“এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন ভাই? এইখান থেকে সরে দাঁড়াও বলছি। কী বিরক্তিকর অবস্থা!”
এবার অলকানন্দার মস্তিষ্ক ব্যাপারটা আয়ত্তে আনল। ভীষণ অপমানে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল অলকানন্দার। চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“আমি সরবো না, এখানেই বসবো প্রতিমা। তোমার ভালো না লাগলে তুমি অন্য কোথাও গিয়ে বসো। যাও।”
অলকানন্দার শক্ত কণ্ঠের দাপটে প্রতিমা নামের মেয়েটা কিছুটা হোঁচট খেলো ঠিকই কিন্তু দমে গেল না। বরং এতক্ষণের যতটুকু কোমলতা তার ভেতর অবশিষ্ট ছিল সেটুকুও উড়িয়ে দিয়ে হয়ে উঠল হিং স্র। প্রায় তেড়ে এসে চেঁচিয়ে বলল,
“তোমার লজ্জা করে না এমন বলতে? কই স্বামী মরেছে তার অশৌচ পালন করবে তা না, তুমি কি-না আমাকে অশুদ্ধ করে দিয়ে আবার বড়ো বড়ো কথা বলছো? এমন মেয়ে মানুষের মুখে থুথু ফেলি।”
শেষের বাক্যটা অলকানন্দার গায়ে ঘৃণিত অনুভব হতেই সপাটে এক চ ড় বসিয়ে দিল মেয়েটার গালে। পুরো রুম তখন স্তব্ধ। এতক্ষণ সকলে চাপা উত্তেজনা নিয়ে এই কান্ড দেখলেও এখন সেই উত্তেজনার জায়গায় ধারণ করেছে বিস্ময়। অলকানন্দার চোখ তখন তেজস্বিনী। আরেকটা কথা কেউ বললে যে তার ফলও খারাপ হতে পারে সেটা বুঝতে বাকি রইল না কারো। ইতিমধ্যে তাদের হৈচৈ-এ শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরাও ছুটে এলেন। সেই দলে প্রসাদও ছিল। অলকানন্দার চোখ-মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা অগ্নি লাভা প্রসাদের বড্ড পরিচিত। নন্দন মশাই কিংবা তার ছেলের সাথে যখন আপোস করে না অলকানন্দা তখনই তার চোখ মুখের এমন পরিবর্তন থাকে। তবে বর্তমানে কী হলো সেটা ভেবেই তার চিত্ত চঞ্চল হচ্ছে।
স্কুলের বৃদ্ধ শিক্ষক মুমিনুল ইসলাম এগিয়ে এলেন। চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা। কন্ঠের গাম্ভীর্যের যেন জবাব নেই বৃদ্ধার। সে-ই প্রথম গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“হচ্ছেটা কী এখানে?”
মুখ খুলল প্রতিমা,
“মাস্টার মশাই, এই এই নন্দা আমাকে চ ড় মেরেছে।”
“শুধু শুধু চ ড় মেরেছে নন্দু তোমাকে?”
মুমিনুল ইসলামের প্রশ্নে জবাব দিল শ্রেণীকক্ষের আরেকজন মেয়ে,
“হ্যাঁ মাস্টার মশাই, ও শুধু শুধু মারল প্রতিমাকে। আমরা দেখলুম তো তা-ই।”
“নন্দাকে দেখে আমি ভারী অবাক হচ্ছি! মেয়েটা তো আমাদের গ্রামেরই, ভালো ভেবেছিলাম কিন্তু স্বামী মরতেই ওর কত রূপ বদল দেখছি!”
উপস্থিত একজন শিক্ষকের কথায় অলকানন্দার উঁচু মাথা নিচু হয়ে গেল। বাবার মতন শিক্ষক কি-না ভালোমন্দ না জেনেই তাকে বিচার করে ফেলল? মুমিনুল ইসলাম হাসলেন উপস্থিত শিক্ষকের কথায়। সেই এখানে সকলের বড়ো। সেই সুবাধেই সে উক্ত শিক্ষকের নাম ধরে বলল,
“তা বিষ্ণু, কী কী রূপ বদল দেখলে?”
মুমিনুল ইসলামের প্রশ্নে কিছুটা হতভম্ব হলো বিষ্ণু নামের শিক্ষকটি। অবাক কণ্ঠে বলল,
“কোনে মুমিনুল দাদা, আপনি শুনেননি অলকানন্দা কী কী করেছে? শুনেছি ও চুল কাটতে চায়নি, রঙিন বস্ত্র পরেছে, আপনি তো জানেন বিধবাদের এসব করা অনুচিত কাজ।”
“কেন অনুচিত? বিধবাদের কী বাঁচা নিষেধ?”
মুমিনুল ইসলামের প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পেলেন না বিষ্ণু। তা দেখে হাসল প্রসাদ। মুমিনুল ইসলাম স্নেহের চোখে তাকালেন অলকানন্দার দিকে, অতঃপর শুধালেন,
“তুই ওকে কেন চ ড় মেরেছিস নন্দু?”
অলকানন্দা সব ঘটনা পরপর খুলে বলল। মুমিনুল ইসলাম নিরব শ্রোতা হয়ে শুনলেন সবটা। তারপর ভরাট কণ্ঠে পুরো ক্লাসের উদ্দেশ্যে বললেন,
“নন্দু এই শ্রেণীকক্ষেই পরীক্ষা দিবে। এতে কার কার সমস্যা আছে?”
“আমাদের আপত্তি আছে মাস্টার মশাই। নন্দার এখন অশৌচ, ওর সাথে একই জায়গায় বসলে আমাদের পাপ হবে। আমরা মাছ, মাংস খেয়ে আসি, এতে নন্দার অশৌচ অশুদ্ধ হবে।”
“কিসের অশৌচ? ওর স্বামী মারা গিয়েছে, সেটা তো কোনো ব্যাধি না।”
“মাস্টার মশাই, আমাদের ধর্ম মতে বিধবাদের অশৌচ মানতেই হয়। আর ওদের সাথে একসাথে ওঠবস করাও পাপ, অমঙ্গল।”
“তোমাদের ধর্ম মতে! তা, তুমি কোন ধর্মের কথা বলছ? মানুষ হয়ে যে মানবধর্ম ভুলে যায়, তার আর বাস্তবিক অর্থে কোনো ধর্ম থাকার কথা না।”
মুমিনুল ইসলামের একটা কথায় জব্দ হয়ে গেলো এতক্ষণ কথা কাটাকাটি করা মেয়েটা। সঠিক জবাব আর খুঁজে পেল না সে। মুমিনুল ইসলাম গলা উঁচুতে তুললেন, বজ্রকণ্ঠে বললেন,
“কেউ যদি নন্দুর সাথে বসতে না চায় তবে ও একা পরীক্ষা দিবে তবুও ও পরীক্ষা দিবেই। তোমাদের কারোই বসার প্রয়োজন নেই।”
“মাস্টার মশাই, আমি বসব ওর সাথে।” কথাটি বলেই এগিয়ে এল পুরোহিতের পুত্র দ্বৈপায়ন যাকে সবাই দিপু বলে ডাকে। তার দেখাদেখি রুমের বাকি ছেলেরাও গলা মেলালো। তারা জানাল, তাদের কোনো অসুবিধা নেই অলকানন্দার সাথে এক রুমে পরীক্ষা দিতে। মুমিনুল হাসলো। বিষ্ণুসহ এমন মন-মানসিকতার বাকি শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে বেশ প্রশংসা করেই বললেন,
“দেখেছ তোমার ছাত্রদের সাহস! পাপের কোনো ভয় নেই এদের? যাদের শিক্ষকরাই শিক্ষিত হতে পারল না অথচ তারা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে গেল! কী অদ্ভুত তাই না?”
মুমিনুল ইসলামের কথার তাৎপর্য বুঝতে বাকি রইল না কারো। না চাইতেও তারা মাথা নত করে ফেলল। আর কেউ কোনো কথা বলল না, সাড়াশব্দ করল না। তারা হয়তো বুঝে গিয়েছে এখানে আর কোনো কথা বলে লাভ নেই। প্রসাদের মুখের হাসি তখন প্রসস্থ। অলকানন্দার মন খারাপের মেঘ তখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তার বুক ভার ভার ভাবটাও কমল। তার এতক্ষণ মনে হয়েছিল বিধবা হওয়াটা অভিশাপ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা বড়ো আশীর্বাদ। অতঃপর থেমে গেল কোলাহল, সকলে ব্যস্ত হল নিজ নিজ কাজে।
_
মনোহর নিজের ঘরে বসে পা দুলাচ্ছে। কৃষ্ণপ্রিয়া তখন কেবল চা নিয়ে ঘরে এসেছে। সন্ধ্যাবেলা মানুষটা আবার চা ছাড়া কিছু বুঝেনা। হৈচৈ করে চা না হলে। আজ একটু দেরি হয়ে গিয়েছে অবশ্য। সেই ভয়ে বুক কাঁপে কৃষ্ণপ্রিয়ার। মনোহর পান থেকে চুন খসলেই তার গায়ে হাত তুলে। এত যন্ত্রণা দিয়ে মারে! মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে যায় কৃষ্ণপ্রিয়া। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। কৃষ্ণপ্রিয়া চায়ের পেয়ালাটা মনোহরের দিকে এগিয়ে দিতেই মনোহর গরম চা ছুঁড়ে মারে তার শরীরে। অতিরিক্ত উত্তাপে চেঁচিয়ে উঠে কৃষ্ণপ্রিয়া। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুর দল। কৃষ্ণার চিৎকার হয়তো শোনা গেলো পুরো মহলে অথচ ছুটে এলো না কেউ। এই ঘটনা তো আর নতুন কিছু না। পুরুষের হাতে নারীর দেহ পুঁড়বে সেটাই বোধকরি এ সমাজে স্বাভাবিক।
মনোহর ক্রন্দনরত কৃষ্ণপ্রিয়াকে জোরে লাথি মেরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সেগুন কাঠের মোটা খাটটার কোণায় লেগে মেয়েটার গালটাও প্রায় কেটে গেলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে কৃষ্ণা। যে স্বামীর স্নেহতলে স্বর্গ খুঁজে পাওয়া যায় বলেছে মা, সে স্বামীর পদতলে যে নরক যন্ত্রণা, সেটা কেন বলেনি তাকে!
তরঙ্গিণী প্রায় কিছুক্ষণ পরই ছুটে এলো৷ হন্তদন্ত কণ্ঠে বলল,
“কী হয়েছে কৃষ্ণা? কী হয়েছে! ওমা ভিজে আছিছরকেন? গালটাও তো কেটে গেছে!”
কথাটা বলেই তরঙ্গিণী যখন কৃষ্ণাকে ছুঁতে যাবে ঠিক তখনই মেয়েটা আরেকটু সরে বসল। তা দেখে ভ্রু কুঁচকালো তরঙ্গিণী, বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“ওমা, সরছিস কেন? আমাকে দেখতে দে ব্যাথাটা। আমি দেখি কতখানি কেটেছে।”
কৃষ্ণপ্রিয়ার কোমল কণ্ঠ কঠিণ হয়ে গেলো। সে শক্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“না, তুমি আমাকে ছুঁইয়ো না। তোমার মতন মেয়েমানুষ আমাকে ছুঁয়ে দিল পাপ লাগবে।”
“পাপ!” তরঙ্গিণীর চোখে-মুখে তুমুল বিষ্ময়।
কৃষ্ণা প্রায় খেঁকিয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ, পাপ। যে মেয়েমানুষ পরপুরুষের বিছানায় শোয় তার ছোঁয়া তো পাপই হবে।”
তরঙ্গিণী প্রথমে হতভম্ব হলেও ঠিক কিছুক্ষণ পর হেসে লুটোপুটি খেল। তুমুল হাসির দাপটে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল। হাসতে হাসতেই সে বলল,
“ওমা! তোদের ভগবানের মতন স্বামীরা আমাদের ছুঁয়ে দেয় বলেই না আমরা খারাপ মেয়ে মানুষ হই। অথচ ওরা তোদের কাছে চির পবিত্র আর আমরাই কি-না পাপী! সমাজ ছাড়ি, সতীত্ব ছাড়ি, চরিত্রও হারাই আমরা তার বিনিময়ে কিনা শুনতে হয় আমরা পাপী! তা আমি তোর কাছে কেন পাপী হলাম, কৃষ্ণা?”
“তুমি আমার ভাসুর ঠাকুরের সাথে শুয়েছো, সে খবর কী কারো অজানা! পর পুরুষদের সাথে যারা শোয় তাদের কী বলে জানো তো?”
“বে শ্যা?”
“হ্যাঁ।”
“ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করেছি বলে যদি আজ আমি বে শ্যা হই তবে পৃথিবীতে যারা ভালোবেসেছে, বিশ্বাস করেছে তারা সকলেই বে শ্যা। তুই সেই দলের বাহিরে না কৃষ্ণা। তুইও তো ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিস।”
কৃষ্ণপ্রিয়া তরঙ্গিণীর কথার বিপরীতে আর কথা খুঁজে পেল না। তার মা’ই তো বলেছিল, তরঙ্গিণীর সাথে মিশতে না এমনকি অলকানন্দা দিদির সঙ্গেও যেন ভাব না জমায়। বিয়ের বয়স পাড় হওয়া মেয়ে এবং বিধবা মেয়ে দু’টোই স্বামীর জন্য বিপদজনক। আগুনের কাছে ঘি যেমন!
_
“ওহে নারী, আমি কী আপনার এই ছোট্টো ঘরে আসিতে পারি?”
হাস্যোজ্জ্বল পুরুষ কণ্ঠ শুনতেই অলকানন্দার ধ্যান ভাঙল। বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে দরজার পানে তাকাল। তার ঘরের দু দুটো হারিকেনের আলো এবং অন্দরমহলের বড়ো ঘরটা থেকে কিছু কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে একটি হাসি মাখা পুরুষের মুখমন্ডল। যারা হাসির বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়ছে অলকানন্দার ঠোঁট জুড়েও।
অলকানন্দা কিছুটা হাসিমুখেই উত্তর দিল,
“আসুন।”
নবনীল উত্তর পেতেই আর অপেক্ষা করল না, তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করল ঘরে। অলকানন্দার থেকে কিছুটা দূরের মেঝেতে সে বসল। হাসি মুখটা তখনও ভীষণ মায়া মায়া দেখাচ্ছে এবং চকচক করছিল।
অলকানন্দার কিছুটা অস্বস্তিও হচ্ছিল যেহেতু ছেলেটা তার স্বল্প পরিচিত তবুও সে ঠোঁটে হাসি বজায় রাখল। নবনীল অলকানন্দার বইয়ের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল,
“এটা কী বই?”
“বাংলা।”
“বাহ্, দারুণ বই। আচ্ছা, আপনি কী জানেন আমি যে অনেক জাদুবিদ্যা জানি?”
নবনীলের প্রশ্নে অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। ঠোঁট উল্টে বলল,
“না।”
“জানেন না? আচ্ছা চলুন, আপনাকে একটু অবাক করা যাক।”
“কীভাবে?”
“আপনার কোনো গোপন কথা বলে। যে কথা সহজে কেউ জানেনা অথচ আমি বলে দিতে পারব।”
নবনীলের কথায় অলকানন্দার আগ্রহ বাড়ল, অবাক কণ্ঠে বলল,
“সেটা আবার কোন কথা?”
“এই যে, আপনি বিয়ের দু’দিনের মাথায় এ বাড়ির পেছনের আমগাছ থেকে আম চুরি করে খেয়েছিলেন সেটা।”
অলকানন্দা এবার গুরুতর চমকে গেল। তার এই গোপন কথাটা কারো জানার কথা না। কিন্তু এমন লজ্জাজনক গোপন কথা অপরিচিত পুরুষের মুখ থেকে শুনে তার লজ্জার অন্ত রইল না। সে মাথা নিচু করে ফেলল তৎক্ষণাৎ। তা দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠল নবনীল। নিজের একগাছি কোঁকড়া চুল আলতো টেনে বলল,
“লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, এ কথা কেউ জানবে না।”
“আচ্ছা চলুন আরেকটা গোপন কথা বলি? ধরুন ভবিতব্য।”
অলকানন্দা আবার কপাল কুঁচকে শুধালো, “কী?”
“আপনার আমাকে কেমন মানুষ মনে হচ্ছে?”
“খুব মিশুক।”
“কিন্তু একটু পর আপনি আমাকে অনেক বেশি অপছন্দ করবেন এবং আমাকে ভয় পাবেন। কথাটা সত্যি কি-না দেখবেন?”
অলকানন্দার এবার বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল মনোহরের করা আচরণ গুলো। অলকানন্দা অস্বাভাবিক ভাবে ঘামতে শুরু করে যা দেখে হেসে লুটোপুটি খেলো নবনীল।
#চলবে