#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
রষ রহস্যের ৩৯:
সময়টা পৌষের প্রথম সপ্তাহ। আড়মোড়া ভেঙে শীত তখন উপস্থিত কুয়াশার চাদর জড়িয়ে। শুনশান নিরবতায় চারপাশ হতবিহ্বল। নন্দা বসে আছে মানুষ খেঁকো মাগুর মাছ অবস্থান করা তাদের খুব গোপনের কৃষ্ণচূড়ায় আচ্ছাদিত সেই বাগানে। জলের মাঝে মিহি স্রোত। ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে মাগুর মাছ গুলো আনন্দে লাফাচ্ছে। কিসের আনন্দ তাদের! হয়তো নতুন খাবার পাবে সে আনন্দ।
নন্দার বিপরীতেই বসে আছে বিহারিণী। তার চোখে-মুখে বরাবরের কুটিল হাসি। আজ আবার তার মুখের ভেতর পান পাতা শোভা পেয়েছে। ইদানীং সে প্রচুর পান খাচ্ছে। পান খেয়ে ওষ্ঠ লালভ করে রাখছে। হাঁটা চলায় এসেছে ভিন্নতা। পরিবর্তন গুলো খুব ধীরে ধীরে হলেও দৃষ্টি এড়ায়নি নন্দার। বিহারিণী আশপাশে তাকিয়ে শুধাল,
“এখানে নিয়ে এলে যে?”
“ভাবছি তোমার সাথে একটু সুখ-দুঃখের আলাপ করব।
আজ বিকেলটা সুখ-দুঃখের আলাপের জন্য দারুণ মানানসই।”
নন্দার কথায় বিহারিণী ভ্রু কুঞ্চিত করল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আজকাল যার প্রতি বড্ড অনীহা জন্মেছে তাকে সুখ-দুঃখের আলাপ শোনাবে। এমন ভীমরতির কারণ কী, অলকানন্দা?”
“কী করবো বলো, ভাই! বিহারিণী মহলের ব্যাপারে তুমি যতটুকু জানো, ততটুকু কী কেউ জানে বলো? তাই তোমার সাথেই একটু আলাপ-আলোচনা করতাম।”
বিহারিণীর হাসি-হাসি মুখটা কিছুটা চুপসে এলো। কপাল কুঁচকালো নিজ গতিতে। বার কয়েক চোখের ভারী পল্লব ঝাপটে বলল,
“ঐ মহলের ব্যাপারে আর কিইবা বলবে? শুনলাম জমিদারি সব শেষ। নিলামে গিয়েছে মহল। সবাই তীর্থক্ষেত্রে গিয়েছে। এটার ব্যাপারে আর কী বলবে?”
“তোমার মায়া হচ্ছে না একটুও? আমি তো কেবল একমাস থেকেছি, তাতেই এত মায়া হচ্ছে। আর তোমার তো ভালোবাসার স্থান ছিল। এমনকি, তোমার নামে খোদাই করে বাড়িটার নাম রাখা হয়েছিল।”
নন্দার কথার প্যাচে যে খুব ভালো করে জড়িয়েছে বিহারিণী, তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। সে দৃষ্টি ঘুরালো। আমতা-আমতা করে বলল,
“ওরা আমাকে কষ্ট দিয়েছিল।”
“আমাকেও কম দেয়নি।”
বিহারিণীর কথা থেমে গেল। সে কূল-কিনারা হাতড়েও বোধহয় কথা খুঁজে পেল না। এবার নন্দার মুখে হাসি। হাসির ঠিকানা স্থানান্তর হয়েছে। নন্দা পুকুরের দিকে দৃষ্টিপাত করল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধাল,
“জানো? আমি নবনীলকে খুব বিশ্বাস করতাম। এতটা বিশ্বাস বোধহয় আমি এ অব্দি কাউকে করিনি। কিন্তু সে আমার বিশ্বাস ভেঙেছে। আচ্ছা, বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কী হতে পারে?”
“শাস্তির কথা বলে কী লাভ? সে তো আশেপাশে কোথাও নেই।”
বিহারিণীর কথায় নন্দার হাসি প্রশস্ত হলো। উত্তর দিল,
“নেই কে বলেছে? সে আছে। আমাদের আশেপাশেই হয়তো আছে।”
নন্দার কথায় সামান্য ভড়কে গেল বিহারিণী। কণ্ঠ স্বর খাদে নামিয়ে কিছুটা মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“আশেপাশে মানে? কোন আশে-পাশে? কোথায় সে?”
“সে কোথায় তা পরে বলছি। আগে তার কিছু গুণগান শুনে নেও। শুনবে?”
নন্দার মুখ জুড়ে রহস্য খেলা করছে। ঘামছে বিহারিণীর স্বত্তা। সে জবাব দেয়নি। আর সে যে জবাব দিবে না এটাও নন্দার ভালো করে জানা ছিল। নন্দা জবাবের অপেক্ষাও করল না। বরং চঞ্চল স্বরে বলল,
“নবনীল প্রথম আমার জীবনে অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে এসেছিল। মানুষটাকে আমি বিশ্বাস করতাম। যেমন করে ভক্ত বিশ্বাস করে তার ভগবানকে ঠিক তেমন করে। আমার স্বামী মা রা গেলেন, পরিস্থিতি আমার বিপরীতে। জানো? আমার খুব সাধের চুল ছিল, সেগুলোও আমাকে ফেলে দিতে হয়েছিল। তারপর আমার খুড়োশ্বশুর এবং পিসিমা কতকিছু বলেছেন। তখনও আমি এত ঘাত-প্রতিঘাতের জন্য তৈরি ছিলাম না। কিন্তু আমার পাশে দাঁড়ায় আমার শাশুড়ি, প্রসাদ ঠাকুর জামাই আর নবনীল। এবং এরপর আমি লড়াই করার আত্মবিশ্বাস পাই। বলা যায় নবনীলের সাহায্যে একে একে আমি নিজের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করি। এই শক্ত হওয়ার মাঝে প্রথম বিপর্যয় ঘটে আমার জীবনে আমার বোনের তীব্র ক্ষতির মাধ্যমে। তার জিহ্বা কেটে দেওয়া হয়, সম্মানও নষ্ট করা হয়। ভাবলাম, সাহেবরা করেছেন। সাহেবদের তো নাকি ছুঁকছুঁকানি থাকে। বোনকে শহরে পাঠালাম। নিজেও গেলাম। ফিরে এসে শুনি নবনীল কোনো একটা কাজে চলে গিয়েছে। আমার তখন দিক হারা অবস্থা। তবুও শক্ত রইলাম। গ্রামের সমস্যা শক্ত হাতে মেটানোর চেষ্টা করলাম। নবনীলকে চিঠিও লিখলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এরপর একে একে ধ্বংস শুরু। অতঃপর সবশেষে চরিত্রহীন হয়ে গ্রাম ছাড়লাম। কেউ বিশ্বাস করেনি আমাকে জানো? তবুও যার মাধ্যমে সতী হবো ভেবেছিলাম তাকেও হারালাম। এই যে আমার বিপর্যয় গুলো, এগুলোর সময় একবারও নবনীল পাশে ছিল না। আমার তখন মনে হতো উনি পাশে নেই বলেই বিপদ হচ্ছে, হয়তো পাশে থাকলে হতো না। অথচ, দেখো আমি কী বোকা! আমি একবারও ভাবিনি, কেন সে যাওয়ার পরই এত সমস্যার সৃষ্টি হবে? তবে সে-ই হয়তো সমস্যার সৃষ্টিকর্তা! নবনীলের কথায় আমি ভালোবাসা দেখতাম। ভাবতাম লোকটা হয়তো ভালোবাসে আমাকে, কিন্তু……. সব ভুল, সব মিথ্যে।”
নন্দার কথা থামল৷ একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য বোধহয় এই বিরতি। বিহারিণীর বিহ্বল দৃষ্টি তার দিকেই। হয়তো পরবর্তী জানার আকাঙ্খা। নন্দার বিরতি শেষ হলো, কণ্ঠে আবার প্রতিধ্বনিত হলো শব্দ,
“পরে তো সেদিন জানলেই, আমার এমন একটা খারাপ তকমার পেছনে নবনীল দায়ী। কিন্তু কেন সে এটা করেছিল, সেটা কী জানো? আর এভাবে সে উধাও হয়ে কোথাই বা গেল সেটাও তো সকলের অজানা তাই না?”
বিহারিণীর কণ্ঠ কাঁপছে, তবুও শুধাল, “হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমি জানি। এই সবই আমার জানা, তাও বহুদিন ধরে।”
বিহারিণী যেন আর স্থির হয়ে বসতে পারল না। তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়াল। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“কী বলছ! তুমি জানো? কীভাবে জানো? মজা করছ তাই না?”
”মজা করব কেন? এখানে কী মজার কথা হচ্ছে? তুমি উঠে যাচ্ছ কেন? বসো।”
বিহারিণী বসল না। কেমন ভয়ার্ত মুখভঙ্গি তার। তার ভেতর এখান থেকে যাওয়ার তাড়া দেখা গেল। কিন্তু নন্দা নাছোড়বান্দা, হাসতে হাসতে বলল,
“এমন করছো কেন? বসো।”
বিহারিণী বসল। নন্দা আবার বলতে শুরু করল,
“জানো, আমার নবনীলকে প্রথম সন্দেহ হয় পিসিমা মা রা যাওয়ার পর। পিসিমা নাকি মা রা যাওয়ার আগের দিন আমাদের এই বাড়ির সামনে এসেছিলেন। এই খবর পেয়ে আমি ভেবেছিলাম হয়তো উনি মানে সাহেব কিছু করেছেন। তাই তার প্রতি রাগ আরও বাড়ে। প্রথমে আমার বোনকে তারপর পিসিমার মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করি আমি। কিন্তু এরপর পেলাম অন্য খোঁজ, পিসিমা আমাকে চিঠি দিয়ে গেছেন একটা ধাঁধা। তুমিই বললে তার পানের বাটায় খোঁজ করতে। করলামও…..কিন্তু…..”
নন্দা আবারও থামল পর পর ভেসে এলো দীর্ঘশ্বাস। বিহারিণী থামল। তাকে স্থির দেখা গেল। সে নিশ্চুপ চোখে চাইল। বলল,
“কিন্তু কী?”
“সেদিন খোঁজ পেলাম। চিঠিও পেলাম। কিন্তু তেমন কিছুই পেলাম না। কেবল পুরো চিঠি জুড়ে মনে হলো সকল দোষ সাহেবের। এমন একটা চিঠি পিসিমা কেন লিখবে! কিন্তু আমাকে সাহায্য করল তরঙ্গিণী। উনি জানালেন এটা পিসিমার হাতের লিখা না। পিসিমার লিখা গোছালো আর সুন্দর। আমরা দু’জন মিলেই চিঠির খোঁজ শুরু করলাম কিন্তু ফলাফল শূন্য। যখন হতাশ হয়ে ফিরবো তখন নবনীলের ঘরে আমি উঁকি দেই এবং কি মনে করে যেন সেখানে খোঁজ করি। এবং অবাক করা ব্যাপার হলো আমরা সত্যিকারের চিঠিটা পেয়ে গিয়েছিলাম। কী লিখা ছিল জানো?”
বিহারিণী থমকে গেল। হতভম্ব স্বরে বলল,
“পেয়ে গিয়েছিলে মানে? কীভাবে পেলে!”
“পাওয়ার কথা ছিল না বুঝি?”
নন্দা ভ্রু-দ্বয় কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করল। বিহারিণী অস্থির। এখান থেকে পালিয়ে গেলে যেন বাঁচে। আর সেই সুযোগও খুঁজছিল। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল নন্দা। খুব আলগোছে শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলে মেয়েটাকে। বিহারিণী বিস্মিত, কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বাঁধছো কেন? ছাড়ো আমাকে। ছাড়ো বলছি।”
“আজ যে কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না। এবার শোনো, পিসিমা’র সে চিঠিতে জানতে পারলাম তোমার কথা। বিহারিণীর মতন অবয়ব সে দেখেছে এই মহলে এসে। এতেই সে ভীত হয়েছিল। এবং সে ধারণা করেছিল তার কোনো ক্ষতি হতে পারে। এবং সেটা তার সন্তানের হাতেই। মানুষটার ধারণা ঠিক। নবনীলই তাকে মেরেছে। কীভাবে মেরেছে জানো? বালিশ চাপা দিয়ে। আর এই কথা নবনীল নিজে স্বীকার করেছে। আর এই যে আমার বোনের জিহ্বা কা টা র ব্যাপারটা, সেটাও নবনীল করেছিল। কেন জানো?”
বিহারিণী জানতে চাইল না উত্তর। পরাজিত মানুষের ন্যায় বসে রইল। বেশ অনেকক্ষণ, অনেকটা ক্ষণ পর কেমন অদ্ভুত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “নবনীলকে তুমি মেরেছ?”
#চলবে…..
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
[৪০]
শীতের গাঢ়তায় জুবুথুবু প্রকৃতি। ঘন কুহেলী রহস্যের ধাঁধা বেঁধেছে অখিলের অস্বচ্ছতায়। একটি অলস দিনের সুপ্রভাতের শুভারম্ভ হয়েছে অমলিন প্রেমের মাধুর্যতায়। স্টিফেনের বিশাল বারান্দার আরাম কেদারায় বসে আছে নন্দা। পড়নে লাল রঙের শাড়ি শোভা পাচ্ছে। বাহু ছুঁইছুঁই কেশ গুচ্ছ ছড়িয়ে আছে পিঠ জুড়ে। কপালে সিঁথির সৌন্দর্যতা বর্ধন করে প্রশস্ত অবস্থানে লেপেছে সিঁদুর। ঘন কাঁজলে মাখামাখি গভীর দিঘির ন্যায় অক্ষি যুগল। বারান্দার বাহিরে থাকা স্বল্প দূরের আঁধার, আবছা বাগনটার দিকে তাকিয়ে হাসছে সে। বিহারিণীর করুণ পরিণতিতে তার ওষ্ঠ কোণে নব্য জ্যোতি ছড়ানো অংশুমালীর ন্যায় হাসি। যে হাসি পরিচয় দেয় উপহাসের। যে হাসি জানায় তুমুল তাচ্ছিল্য।
“আজ প্রকৃতিও বোধকরি নিজেকে ধন্য মনে করিবে তোমার রূপ দেখিয়া।”
নন্দার মুগ্ধ নেত্রের পল্লব পড়লো। হাসির মায়া লুকায়িত হলো আকস্মিক উচ্চারিত পুরুষালী কণ্ঠে। সে কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল সেই কণ্ঠের মালিকের দিকে। স্টিফেনের হাসি হাসি মুখ দৃষ্টিগোচর হলো তৎক্ষণাৎ। সে হাসির বিপরীতে ফিরিয়ে দিলো হাসি। শুধাল,
“সকাল সকাল বের হয়ে যাচ্ছেন! আপনি যন্তর নাকি?”
“যন্তর নয়, সানশাইন। ইহাকে বলা হয় যন্ত্র। উচ্চারণ সঠিক করিবে, কেমন?”
নন্দা মারাত্মক ভুল হয়ে গিয়েছে ভাব করে জিব কাটল। অতঃপর ফিক করে হেসে বলল,
“ভুল হয়ে গিয়েছে।”
“তোমার মুখে ভুলটাও দারুণ মানায়াছে।”
নন্দা হাসল। লোকটার মুগ্ধ করার পদ্ধতি অনেক জানা আছে। সেই পদ্ধতির সামনে নন্দা খুবই অপটু। ভোরের কুয়াশা এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নন্দার শরীর। সেই শীতল শরীরে ভারী সুতোর কাজ করা চাদর আলগোছে জড়িয়ে দিল স্টিফেন খুব যত্নের সঙ্গে। নন্দা চমকালো এবারও। স্টিফেন লোকটা সবসময় তার প্রয়োজন গুলো এত নিখুঁত ভাবে কীভাবে জেনে যায় সে বুঝে উঠতে পারে না। নন্দাকে চাদর জড়িয়ে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটল স্টিফেনের ঠোঁট জুড়ে। নন্দা সে হাসিতে বার কয়েক যেন মুগ্ধ হলো। এত রকমে, এত প্রকারে কেউ ভালোবাসতে পারে, তা স্টিফেনকে না দেখলে সে বুঝত না।
_
স্টিফেনের সাথে নন্দা বেরিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছুই তার জানা নেই। তবে সে এতটুকু জানে— লোকটা তাকে হয়তো আরেকটা খুশির সান্নিধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটার আর কাজ কী? এক মনে ব্রত হয়ে কেবল নন্দাকে চমকে দেওয়া এবং খুশি করা ছাড়া?
শীতের কুয়াশা ঠেলে নন্দাদের গাড়ি এসে থেমেছে তাদের গ্রামেরই পূর্বদিকের একটি জায়গায়। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো, শুধাল,
“এখানে কেন?”
“আরেকটি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে আসিয়াছি আমরা, নন্দা। একসময় তোমার সবটুকু ভালোতে হাসি দিয়া এবং সবটুকু আঘাত থেকে বুক দিয়া যে তোমাকে আগলে রাখিয়াছে তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো আমাদের দায়িত্ব।”
নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। ঠিক বুঝে উঠতে পারল না কার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে এসেছে তারা। তার মুখে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। স্টিফেন হাসল। নন্দার হাত ধরে একটি সদ্য উঠা বিরাট দালানের কাছে মাঠে উপস্থিত হলো। সেখানে উপস্থিত হয়েই নন্দার চক্ষু চড়কগাছ। তারা আসার আগ থেকেই এখানে বহুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত। নন্দা কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইল। স্টিফেনের মুখে চওড়া হাসি। সে উপস্থিত হতেই উঠে দাঁড়ালো সবাই। স্টিফেন এগিয়ে গেল। মধ্যমনি হয়ে দাঁড়াল সকলের সামনে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নন্দা। যে এখনো এসব বুঝে উঠতে পারছে না। স্টিফেনের কণ্ঠ গম্ভীর হলো, সে সকলের উদ্দেশ্যে ঝঙ্কার তুলে বলল,
“আপনাদের এখানে আসিতে বলিয়াছি একটি বিশেষ দরকারে। আশা রাখি, আমার বিশেষ দরকার আপনারা বিশেষ ভাবেই গ্রহণ করিবেন?”
উপস্থিত জনসমাগম নিশ্চুপ। তাদের নিশ্চুপতায় যেন সকল উত্তর দিল। স্টিফেন সেই উত্তর সাদরে গ্রহণ করে আবার বলতে শুরু করল,
“আমি এখানে একটি বিদ্যালয় করিবার সিদ্ধান্ত নিয়াছি। যেই বিদ্যালয়ে আমাদের প্রতিবেশী গ্রাম এবং এই গ্রামের ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়েরা পড়িবে। এই বিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচাবলি আমিই প্রদান করিব। এবং এই বিদ্যালয়ের সকল সিদ্ধান্ত নিবে আমার স্ত্রী, মানে আপনাদের— সাহেব বধূ।”
স্টিফনের কথা থামতেই চারপাশে গুঞ্জন শোনা গেল। হয়তো মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাবা-মায়ের যে কুণ্ঠাবোধ, সেটাই গুঞ্জনের মূল বিষয়বস্তু। স্টিফেনের মুক্ত কণ্ঠ ভাসল,
“সকলের সন্তান বিদ্যালয়ে আসিবে, এটা নির্দেশ। এবং এই নির্দেশ অমান্য করিলে তাকে শাস্তি প্রদান করা হইবে। এবং এই বিদ্যালয়ের পরিচালনার ভার দেওয়া হইয়াছে একজন আর্দশ শিক্ষককে।”
নন্দা চাইল। তার বুকের কম্পন বাড়ছে। আদর্শ শিক্ষককে দেখার আকাঙ্খা তাকে শান্তি দিচ্ছে না। তন্মধ্যে স্টিফেন ঘোষণা করল,
“এই বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষক হইলেন শ্রদ্ধেয় মুমিনুল ইসলাম। এবং বিদ্যালয়ের পরিচালনাকারী তিনিই। তিনিই সঠিক ভাবে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করিবেন।”
মুমিনুল ইসলামের নামটি ঘোষণা করতেই কুয়াশার ঘন অবয়ব ভেদ করে একটি বৃদ্ধকে আসতে দেখা গেল। যার ব্যাক্তিত্বের উচ্চতা পাহাড়কেও হার মানায়। যার চোখে হিমালয় হাসে। যার কন্ঠে সমুদ্রের গর্জন। নন্দা অপলক তাকিয়ে থাকলো তার শিক্ষকের দিকে। যেন বহু বছর পর দেখা হচ্ছে তাদের। চোখ দুটো আনন্দে টলমল করে উঠলো। সে ছুটে প্রণাম করতে যাওয়ার জন্য উদত্য হতেই দেখল একটি সুঠামদেহী পুরুষ মুমিনুল ইসলামের পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। নন্দা থামল, চমকালো, বিস্মিত চোখে দেখলো স্টিফেন এই কাজটি করছে। নন্দা আরেক ধাপ মুগ্ধ হলো৷ মুমিনুল ইসলাম দু’হাত ভোরে আশীর্বাদ করছে স্টিফেনকে।
_
নন্দার আজকে আনন্দের সীমা নেই। পুরো গ্রামবাসীর সামনে সে ঘোষণা দিয়েছে মেয়েদের অন্তত পক্ষে দশম শ্রেণী অব্দি পড়াশোনা করতে হবে। এর আগে কোনো মেয়ে বিয়ের আসনে বসতে পারবে না। আর যদি কোনো মেয়ে দশম শ্রেণীর পরও পড়তে চায় কিন্তু তার পরিবার খরচ চালাতে না পারে তবে সেই মেয়ের দায়িত্ব নন্দা নিবে। নন্দার চোখ অশ্রুতে টইটুম্বুর। এইতো, কয়েকমাস আগ অব্দি যে মেয়েটার নিজস্ব কোনো ঠিকানা ছিল না সে মেয়েটাই আজ এত বড়ো বড়ো দায়িত্ব পালন করছে। যার একসময় আশ্রয়স্থলের অভাব ছিল, সে-ই এখন মানুষের আশ্রয় হচ্ছে।
নন্দার ভাবুক চোখের অশ্রু খুব গোপনে একটি পুরুষালী হাত মুছে দিল। নন্দা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল হাসছে স্টিফেন। নন্দার বাহুতে আলতো ছুঁয়ে বলল,
“কাঁদিতেছো কেন, সানশাইন?”
নন্দার অল্প বয়সের কাঠিন্যতা এই মানুষটার কাছে এসে কোমল হয়ে গেলো। হুট করেই জড়িয়ে ধরল মানুষটাকে। অস্ফুটস্বরে বলল,
“আপনি এত ভালো কেন?”
“আমি তো ভালো নই। কেবল তোমায় ভালোবাসি বলিয়া ভালো হইয়া গিয়াছি।”
“কেন এত ভালোবাসলেন বলুন তো?”
“কারণ এই পৃথিবীতে তোমার একজন প্রকৃত ভালোবাসার মানুষের প্রয়োজন ছিল। তবে একজনের জায়গায় দু’জন পাইয়া গিয়াছ, এটা সৌভাগ্য তোমার।”
স্টিফেনের কথায় রহস্যের আভাস। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। বলল,
“দু’জন কীভাবে হলো?”
নন্দার কথা শেষ হতেই গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। স্টিফেন উত্তর না দিয়ে নেমে দাঁড়াল এবং তাকেও নামতে বললো। নন্দা নেমে দাড়ানোর সাথে সাথে গেটের সামনে দাঁড়ানো পাহারাদার নন্দার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিল। নন্দা চিঠির উপর ললিতা নাম দেখতেই থমকে গেল। চিঠি খুলতেই ললিতার সাবধান বাণী চোখে পড়ল,
“নন্দু, দেশ ভালোবাসলে বুকে পাথর বাঁধো,
আর সংসার ভালোবাসলে স্বামীকে আগলো রাখো।”
অন্যদিকে অ্যালেন হন্তদন্ত হয়ে স্টিফেনকে খবর দিল। উপর মহল থেকে খবর এসেছে, কর না নেওয়ার কারণ হিসেবে স্টিফেনকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
#চলবে