অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
769

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২৯.

“আমার প্রিয় কৌটায় সোনালী আস্তরণে রয়েছে কত গীতিকাব্য বন্দী।”

এই একটি কথার ছদ্মবেশে নন্দার যেন ঘুম হারাম হয়েছে। লক্ষ্মী দেবীর এই কথাটায় কী বুঝিয়েছে? সে কী নন্দার জন্য কোনো প্রমাণ রেখে গিয়েছে কোথাও? নন্দা এসব ভাবতে ভাবতেই বিহারিণী মহলে উপস্থিত হলো। বাড়িটা আজকাল বড়ো নীরব। আগে লক্ষ্মী দেবীর কণ্ঠ বড়ো রাস্তা থেকেও শোনা যেত অথচ আজ একটি কালো কুচকুচে কাকের কণ্ঠ ছাড়া আর কোনো শব্দই পাওয়া যাচ্ছে না।

নন্দা আলগোছে বাড়িটার পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল। গেইটের পাহারাদারকে পাঠালো তরঙ্গিণীকে ডেকে আনার জন্য। এই বাড়িটার পুকুর পাড় সবসময় সুন্দর এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতো। অথচ আজ পুকুরে পড়েছে শুকনো পাতার ঢল। চারপাশেও বহু আগাছা পরে আছে। আগাছা গুলেই যেন বলে দিচ্ছে অযত্নের গল্প গুলো। নন্দা ছোটো একটি শ্বাস ফেলল। সে যখন বাড়ির বউ হয়ে এলো তখন এ বাড়ির ভাব, সাজই ছিল অন্যরকম। কোনো রাজপ্রসাদের চেয়ে কম নয় তা। বিলাসিতায় চারপাশ থৈ থৈ করছিল। অথচ আজ সেই চাকচিক্য নেই, বিলাসিতা নেই। দু’দিন পর হয়তো বাড়িটা অন্য কারো হয়ে যাবে।

নন্দার ভাবনার মাঝেই পুকুর পাড়ে উপস্থিত হলো তরঙ্গিণী। পড়ণে তার বরাবরের মতনই হালকা রঙের শাড়ি। বিশাল চুল গুলো কোমড় ছাড়িয়ে গেছে। বাতাসের মৃদু তালে উড়ছে আঁচল। তরঙ্গিণী বোধহয় এই মুহূর্তে এখানে নন্দাকে মোটেও আশা করেনি। তাই তো বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আরে! অলকানন্দা যে!”

নন্দা ঘাড় ঘুরিয়ে তরঙ্গিণীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। কোমল কণ্ঠে বলল,
“আপনি সুন্দর হয়ে গেছেন যে!”

তরঙ্গিণী হাসল, নন্দার কাছে এসে ঘাটের একদিকে বসে বলল,
“সত্যি নাকি!”

“তিন সত্যি। অন্যরকম সুন্দর লাগছে আপনাকে। কেন বলেন তো?”

“তেমন কিছুই নয়। তুমি হুট করে দেখেছো তাই এমন লাগছে। তা আছো কেমন?”

“আছি ভালো। আপনি ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ ভালো আছি। তা বাড়ির ভেতরে না গিয়ে এখানে বসে আছো যে? ভেতরে চলো।”

তরঙ্গিণীর প্রস্তাবে নন্দা ব্যস্ত কণ্ঠে প্রত্যাখ্যান করে বলল,
“না, বাড়ির ভেতরে যাবো না। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”

তরঙ্গিণী নন্দার কথায় ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আমার সাথে! কী কথা, বলো?”

“এই বাড়ির নাম ‘বিহারিণী মহল’ কবে রাখে হয়, জানেন আপনি?”

তরঙ্গিণী কপাল কুঁচকে ফেলল নন্দার প্রশ্নে। নন্দা খেয়াল করল তরঙ্গিণীর মুখভঙ্গি আলাদা রকমের পরিবর্তন ঘটেছে। নন্দার মনে খটকা লাগে। সে আবার শুধাল,
“আপনি জানেন নিশ্চয়। একটু বলবেন দয়া করে?”

“হুট করে এই প্রশ্ন কেন করছ?”

“একটু প্রয়োজনেই করেছি। আপনি বলুন না, দয়া করে।”

তরঙ্গিণী মুখ ঘুরিয়ে ফেলল, শক্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“আমি জানিনা।”

“অথচ আপনার মুখ বলছে, আপনি জানেন।”

তরঙ্গিণী তপ্ত শ্বাস ফেলল। তার দীর্ঘশ্বাসে যেন ভারী হলো প্রকৃতি। অস্বাভাবিক রকমের শীতল কণ্ঠে সে বলল,
“আজ থেকে ছয় বছর আগে কোনো এক জৈষ্ঠ্যমাসে, এই বাড়ির লোহার গেইটের পাশে মার্বেল পাথরে খোদাই করে একজন পুরুষ অনেক ভালোবেসে বাড়ির নাম রেখেছিল বিহারিণী মহল।”

নন্দার চোখে-মুখে সন্দেহের ভাব৷ সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“পুরুষ! কে সে?”

“শুনলে কষ্ট পাবে না তো? কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো নয় কি?”

তরঙ্গিণীর কণ্ঠে হেয়ালি আর কেমন যেন রহস্য। নন্দা আগ্রহী স্বরে বলল,
“সত্যি জানতে কষ্ট কিসের? আর সত্য সর্বদাই সুন্দর হয় তাভ তাকে সুন্দর ভাবেই মেনে নেওয়া সকলের কর্তব্য।”

“সকল সত্যি সুন্দর নাও হতে পারে।”

“তবুও আমি শুনবো, বলুন। কোন পুরুষ এ নাম রেখেছিল আর কেনই বা রেখেছিল?”

তরঙ্গিণী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, অতঃপর রাশভারি কণ্ঠে বলল,
“সুদর্শন, তোমার স্বামী রেখেছিল এই নাম।”

নন্দার চোখে-মুখে বিস্ফোরিত বিস্ময়। অস্ফুটস্বরে বলল, “কী!”

“হ্যাঁ। যা শুনেছো সেটাই বললাম। কেন এই নাম, কিসের জন্য এই নাম এতকিছু জানিনা। কেবল এতটুকু বলবো, এই নামের মানুষ একজন বিশ্বাসঘাতক।”

নন্দা আরও প্রশ্ন করতো কিন্তু তরঙ্গিণীর দিকে পূর্ণদৃষ্টি দিতে সে থমকে গেল। ভূত দেখার মতন চমকেও উঠলে। দপ করে জ্বলে উঠল তার চিত্ত। আশ্চর্যান্বিত হয়ে শুধাল,
“আবারও কারও ঘর ভাঙছেন!”

নন্দার কথা যেন বিদ্যুৎ বেগে পৌঁছে গেল তরঙ্গিণীর কাছে। দু’কদম পিছিয়ে গেল সে। দ্রুত আঁচল ঘুরিয়ে এনে কাঁধ ঢাকল, আমতাআমতা করে বলল,
“অদ্ভুত কথা বলছো, অলকানন্দা।”

“আর সেই অদ্ভুত কথাটা সত্যি, তাই না?”

তরঙ্গিণী চোখ ঘুরিয়ে ফেলল। আশেপাশে তাকিয়ে যেন নিজের দোষ হালকা করতে চাইল। বলল,
“বোকা কথা কেন বলছ!”

“কথা আমি বলিনি, কথা বলেছে আপনার গলায় গাঢ় হয়ে পড়ে থাকা দাগটা। কারো গোপনীয় আদরের চিহ্ন বহন করছে সে দাগ। আবারও ঘর ভাঙছেন! একটি মেয়ের ঘর ভাঙা আর মন্দির ভাঙা সমান, তা কী আপনি জানেন না?”

“তালি তো এক হাতে বাজে না। সেটাও কী তোমার অবগত নয়?”- কথাটি বলেই ক্রুর হাসি হাসল তরঙ্গিণী। চোখে-মুখে তার মোহ রঙ্গ খেলে গেল। তার আকর্ষণীয় মুখমন্ডল জুড়ে কেমন রহস্যের হাসি! অলকানন্দা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাতাশার স্বরে বলল,
“আপনি তো তেনাকে ভালোবাসতেন, কই গেল ভালোবাসা?”

“চিতায়। সে তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে, আমার গতি কী? তোমার আবারও বিয়ে হয়েছে অথচ সকলে তোমাকে প্রথম পরিচয় হিসেবে চেনে সুদর্শনের বউ। অথচ তুমি তাকে ভালোও বাসোনি কখনো। আর আমি এত ভালোবেসে, তার শয্যাসঙ্গী হয়েও কী পেলাম? ‘বে শ্যা’ উপাধি ব্যাতিত? আমার ভালোবাসায় কী খাঁদ ছিল?”

“আমি যদি বলি, আপনার ভালোবাসায় ভালোবাসারই অভাব ছিল, আপনি মানবেন?”

নন্দার প্রশ্নে থেমে গেল তরঙ্গিণী। থেমে গেল তার ক্রুর হাসি, থেমে গেল তার রহস্য। থেমে গেল তার চঞ্চল স্বত্তা। সে বিবশ কণ্ঠে বলল,
“আমার ভালোবাসায় খুঁত ছিল বলছো?”

“কেবল খুঁত নয়, কখনো ভালোবাসতেই পারেননি।”

তরঙ্গিণী শক্ত কথার মানুষ হলেও আজ কোনো জবাব দিলনা বরং খুব নিরবে সে স্থান ত্যাগ করল। নন্দা সেই যাওয়ার পানে তাকিয়ে চুপ করে রইল। যেন খুব মাথা উঁচু করে রাখা গাছটা আজ তুমুল সত্যের ভারে মুখ লুকিয়ে ভেঙে পরেছে। অলকানন্দা হাসল। মানুষ কেন সত্য মানতে পারে না? কেন তারা সত্যকে এত ভয় পায়! বুক চিরে বেরিয়ে এলো তার দীর্ঘশ্বাস। মাথায় আবারও খেলে গেল বিহারিণীর ভাবনা। কেন তরঙ্গিণী বলল বিহারিণী নামের মানুষটা বিশ্বাসঘাতক? আর তার স্বামী সুদর্শনের সাথেই বা কী সম্পর্ক ছিল ঐ বিহারিণীর! প্রশ্নের স্তূপে ভার হলো নন্দার মস্তক।

_

নন্দা দাঁড়িয়ে আছে তার বর্তমান শাশুড়ি মায়ের ঘরে। মহিলা বেশ আনন্দিত মনে তার সাথে গল্প করছে। স্টিফেনের ছোটোবেলার গল্প। নন্দা চুপ করে সবটাই শুনছে। কাদম্বরী দেবী কত উৎফুল্লতার সাথে নিজের সন্তানের গর্ব করছে! যেন এমন সন্তান পেলে যেকোনো বাবা-মা ই যেন ধন্য হয়ে যাবে। নন্দা হাসল। সারাদিনের ছুটোছুটিতে তার শরীর ক্লান্ত কিছুটা। শরীরের তাপমাত্রাও অসহ্য রকমের বেড়ে যাচ্ছে। কাদম্বরী দেবী কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বললেন,
“জানো নন্দু, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ কে, আমি নির্দ্বিধায় বলবো- আমার স্টিফেন।”

মহিলার কণ্ঠে পুত্রের যেন গর্ব। নন্দা হেসে, ক্ষীণ স্বরে বলল,
“এতটা ভালোবাসেন আপনার ছেলেকে?”

“ভালোবাসতে হয়, নন্দু। পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে, আমরা যাদের ভালো না বেসে পারিনা। আমার ছেলে তাদের মাঝে একজন।”

“অথচ, আমি কিন্তু আপনার ছেলেকে দিব্যি ভালো না বেসেই আছি।”

নন্দা ভেবেছিল তার এমন একটা কথায় কাদম্বরী দেবীর হাসি হাসি মুখ উবে যাবে, হয়তো নিমিষেই সে রেগে যাবে, নন্দাকে শক্ত কথা বলবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না। বরং কাদম্বরী দেবীর হাসি আরও প্রশস্ত হলো। নন্দাকে অবাক করে দিয়ে সেই নারী হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি বজায় রেখে নন্দার থুতনি ধরে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“কেন ভালোবাসোনি? সে কেন তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়?”

“কারণ আপনার ছেলের নিষ্ঠুরতা বেশি।”

“অথচ আমার ছেলের কোমলতা পুরো পৃথিবী মাত।”

নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। বলল, “পৃথিবী মাত! কীভাবে?”

“আমার ছেলেটা অনেকটা বেশিই ভালো। কিন্তু তুমি তখনই দেখবে যখন দেখার দৃষ্টি বদলাবে। প্রতিটা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ যে থাকে, নন্দু। খারাপটা দেখার পর কখনো ভালোটা দেখতে চেয়েছিলে বলো? চাওনি, তাই পাওনি। এই যে অ্যালেন, সে কী হয় আমার স্টিফেনের বলো তো?”

“বন্ধু।”

নন্দাে উত্তরে কাদম্বরী দেবীর হাসির রোল বাড়ল। নন্দার বাহুতে মৃদু চাপর দিয়ে বলল,
“ভুল কথা, মাই গার্ল। তুমি নিশ্চয় জেনেছো আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী আমি? আমার স্বামীর প্রথম স্ত্রী ছিলো যিনি, তার আর তার প্রেমিকের পুত্র কিন্তু অ্যালেন।”

কাদম্বরী দেবীর কথায় বিস্ফোরিত নয়নে তাকাল নন্দা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“কী!”

“হ্যাঁ, শুধু তাই নয়। আমার পুত্র আমার কলঙ্কও মোচন করেছিল। আমি যখন….”

কাদম্বরী দেবী কথা সম্পূর্ণ করতে পারেনা, তার আগেই ঘরে প্রবেশ করল স্টিফেন। মাকে দেখেই শক্ত পুরুষ মুখে ঝুলিয়েছে মিষ্টি হাসি। স্বচ্ছ কণ্ঠে বলে,
“প্রিয় মা, ভালোবাসি।”

বিদেশি পুরুষের কণ্ঠে কত শ্রুতিমধুর ঠেকে সে বাক্য! যদিও স্টিফেনের নিত্য স্বভাব এটা। কাদম্বরী দেবীও বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ছেলের কপালে ‘চাঁদ মামার’ মতন আদুরে চুম্বন এঁকে বললেন,
“আমিও ভালোবাসি, মাই সন।”

কথাটা বলেই তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘরে বসে রইল নন্দা। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীরের তাপমাত্রাও যে ধীরে ধীরে বাড়ছে তা আর বলার অপেক্ষা করছে না।

স্টিফেন ভ্রু কুঁচকালো, ঠাট্টার স্বরে বলল,
“বাহ্! আজিকে একজন দেখিতেছি ঘর ছাড়িয়া বাহির হইতেছে না! সূর্য কোন দিকে তার অস্তিত্ব জানান দিয়াছিল শুনি!”

নন্দা কথা বলল না। চুপ করে বিছানার এক ধারে বসে রইল। স্টিফেন হেলেদুলে এগিয়ে এলো হাসিমুখেই। কিন্তু নন্দার চোখ-মুখ দেখে সে হাসি আর স্থায়ী হলো না। বরং সে ছুটে এলো, বিচলিত কণ্ঠে বলল,
“হেই সানশাইন, হোয়াট হ্যাপেন ডিয়ার? এমন ফ্যাকাসে লাগিতেছে কেন, সুইটহার্ট? কী হইয়াছে তোমার?”

নন্দা কেমন অদ্ভুত ভাবে ভ্রু কুঁচকালো। নন্দার থুঁতনিতে থাকা স্টিফেনের হাতটা কিছুটা বল প্রয়োগ করেই সে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, অথচ স্টিফেন তা করতে দিল না। বরং রাশভারি আর চিন্তিত কণ্ঠে ধমক দিয়ে বলল,
“আর কিছু করিবে না, চুপ একদম। তোমার টেম্পারেচার কতটা বাড়িয়া গিয়াছে ধারণা আছে তোমার? এতটা জ্বর বাঁধাইলা কী করিয়া?”

“আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না, সরুন।”

নন্দার জরিয়ে জরিয়ে আসা কণ্ঠের কথা স্টিফেন দূরে না গিয়ে বরং আরও এগিয়ে এলো, শান্ত কণ্ঠে বলল,
“একদম কথা বলিবে না। আমার সানশাইনকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার তোমার নাই।”

অতঃপর নন্দার জ্বর গুরুতর ভাবে বাড়তে শুরু করল এবং থেমে গেল তার বাক্য। ক্লান্ত স্টিফেন পত্নী সেবায় ব্যস্ত হয়ে উঠল ভীষণ। নন্দার শরীর মুছিয়ে দিল, মাথায় দিয়ে দিল জলপট্টি। সাহেবী ডাক্তার ডাকাল। মুহূর্তেই এলাহী কান্ড সব। নন্দা ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় সবই দেখল। বুক ফেটে তার কেমন কান্না পেল। বাবা-মায়ের সংসারে তিন মেয়ের মাঝে একটি মেয়ে ছিল সে। বাবা-মায়ের ছেলে ছিলনা বলে ছোটোবেলা থেকেই তারা অবজ্ঞার পাত্রী ছিল। জ্বর এলে যে আহ্লাদ করে কেউ তা তারা কখনো অনুভব করেনি। অথচ আজ! তার অপ্রিয় মানুষটাকে তাকে সুস্থ করার জন্য কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছে! কাদম্বরী দেবী এমনকি অ্যালেনও থেকে থেকে এসে তার খোঁজ নিচ্ছে। স্টিফেন কেবল মরিয়া হয়ে পায়চারী করছে এবং থেমে থেমে বলছে,
“তুমি চিন্তা করিও না, সানশাইন। তুমি দ্রুত সুস্থ হইয়া যাইবে। আমি আছি তো!”

‘আমি আছি তো’- বাক্যটার অভাবে নন্দা জীবনে কতকিছুই করতে পারেনি। অথচ আজ তার ভরসা হয়ে একজন মানুষ আছে। যাকে সে ভালোবাসতে পারছে না। এই ভালো না বাসতে পারার যন্ত্রণা তার ভেতরে ছেয়ে গেলে। কেঁদে উঠল সে অস্ফুটস্বরে। স্টিফেন কান্নার শব্দে ছুটে এলো, ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“কী হইয়াছে, সানশাইন? কষ্ট হইতেছে? কই হইয়াছে, বলিবে তো?”

নন্দা ঠোঁট উল্টে ফেলল, কেমন অসহায় কণ্ঠে বলল,
“আমি কেন আপনাকে ভালোবাসতে পারছি না, ভিনদেশী সাহেব?”

এমন সময়ে নন্দার এমন কথায় স্টিফেন হতভম্ব। অসুস্থ অবস্থায় মানুষের মস্তিস্ক খুব ধীরে কাজ করে। তাই তারা উলটোপালটা বলে। স্টিফেন জানে, তবুও মুচকি হেসে বলল,
“তোমার ভালোবাসিতে হইবে না, সানশাইন। আমাদের সম্পর্কের জন্য, আমার ভালোবাসাই বেশি হইবে। তোমার ভাগের ভালোবাসাও নাহয় আমি বাসিবো। তুমি কেবল আমার হইয়া থাকিও?”

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩০.

একটি তরতাজা প্রাণে স্পন্দন জাগানো ভোর। সতেজ আলোয় ভরে গেছে আঙিনা। নন্দার চোখে-মুখে ভোরের সূর্য চুম্বন এঁকে দিচ্ছে প্রেমিক বেশে। বেশ আদুরে চুম্বন। মিষ্টি মুখের চারপাশে যেন পাঁকা আমের রঙ মাখিয়ে দিয়েছে সূর্য। নন্দার ঘুম হালকা হলো। ভারী চোখের পাতা টেনে জেগে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু মাথা ব্যাথার নিবিড় অস্বস্তি তার শরীরে কেমন মেজমেজে অনুভূতি দিল। শরীরে কোনো বল পেল না জেগে উঠার জন্য। মৃদু স্বরে ‘আহ্’ করে উঠতেই কোথা থেকে যেন একটি ভরসার বলিষ্ঠ হাত এগিয়ে এলো, ভরসা হলো নন্দার টলতে থাকা শরীরে। শক্ত-পোক্ত হাতটা নন্দাকে যত্ন করে বসিয়ে দিল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“আমার সানশাইনের ঘুম হইয়াছে তো?”

নন্দা আধো ঘুম, আধো জাগরণের চোখে চাইল, ঘাড় ব্যাথাও অনুভব করতে পারছে মৃদু। কণ্ঠ বসে এসেছে। তবুও ক্ষীণ স্বরে জানাল,
“হয়েছে।”

“অবশেষে সানশাইন মানলো, সে আমার?”

স্টিফেনের ঠোঁট জুড়ে অগণিত হাসির রেখা উলোটপালোট হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নন্দাও কিছুটা থতমত খেলো সেই কথায়। মুখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি ফেরালো জানালার দিকে। স্টিফেন এগিয়ে এলো, আলতো হাতে নন্দার কপাল স্পর্শ করল। আজ নন্দা সরে গেলো না কিংবা প্রতিবাদও করল না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কেবল বসে রইল। স্টিফেন তাপমাত্রা পরিমাপ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,
“জ্বর নেই। সুস্থ হয়ে গিয়াছ।”

নন্দা এবারও কিছু বলল না। স্টিফেন তা দেখে স্মিত হাসল। নন্দার চুলের ভাঁজে স্নেহের স্পর্শ করে বলল,
“দ্রুত সুস্থ হইয়া উঠিও, সানশাইন। আগুনের তেজ না থাকিলে যে মোটেও ভালো লাগিতেছে না।”

“অতি তেজে কিন্তু ছাই হয়ে যায় সব, জানেন তো?”

নন্দার অসুস্থ কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। স্টিফেনের হাত আগের মতনই চুলের ভাঁজে স্নেহের স্পর্শ দিতে ব্যস্ত। সেই কাজেই সে মগ্ন হয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আবার অনেককিছু পুড়িয়া খাঁটিও হয়। তুমি কেনো আমাকে ছাই ই করিতে চাও? খাঁটি করিয়া নাহয় নিজের কাছেই রাখিয়া দিতে। কি এমন বড়ো ক্ষতি হইয়া যাইবে, সানশাইন? তোমাকে ধরিয়া কেহ যদি বাঁচিতে চায় তাহলে দোষ কোথায়?”

নন্দার শক্ত চোখের ভারী পল্লব যুগলে অশ্রুর ভার৷ কিঞ্চিৎ কেঁপেও উঠলো বোধহয় খুব গোপনে। কিন্তু তা অগোচরেই রইল স্টিফেনের।

স্টিফেন মিঠে স্বরে তাড়া দিল,
“উঠিয়া পরো, সূর্য জাগিয়া যাওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর সকল শুভ শক্তি জাগিয়া ওঠে। তবে আমার সানশাইন কেন জাগিবে না শুনি?”

ভালোবাসার তৃষ্ণায় এতদিন হাহাকার করতে থাকা নন্দা হুট করে এত ভালোবাসা পেয়ে যেন খেঁই হারাল। আনমনে বলল,
“ব্যাথা পাবেন জেনেও কেন বুক পেতে দিচ্ছেন?”

“প্রেমের বিষে মরিলে কইন্যা, হয়তো দেহ মরিবে তবে আত্মা বাঁচিয়া থাকিবে। মরিয়াও শান্তি, প্রেমের জ্বালা যে বড়ো জ্বালা গো, সাহেব বধূ, সহে না আমার এই অন্তরে।”

স্টিফেনের কথায় নন্দার শরীরের লোমকূপ যেন কেঁপে উঠল। ভালোবাসায় শিহরিত হয়ে গেল যেন শরীরের সকল অঙ্গ গুলো।

_

মায়াপুরী গ্রামের পাশেই রয়েছে বিশাল একটি বিল। সুন্দর, স্বচ্ছ বিলের জল। লোকে তাকে ‘রূপসী দিঘি’ বলেই ডাকে এবং প্রতি পূর্নিমার রাতে এই বিলে একদল কিশোরী স্নান করতে নামে। গ্রামের লোক বিশ্বাস করে যে- এই রূপসী বিলে যখন পূর্নিমার চাঁদের আলো এসে পড়ে, তখন যদি এই বিলে স্নান করা যায় তবে নারীর শরীরের রঙ উজ্জ্বল হয়। নন্দা জানতো না এই অদ্ভুত নিয়ম-নীতির কথা। আজ জেনেছে। কারণ তাদের বাড়ির বেশিরভাগ নারী গৃহ ভৃত্যরা ছুটি নিয়েছে। সকলের একসাথে ছুটি নেওয়ার কারণ জানতে চাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেই এমন চাঞ্চল্যকর একটি গল্প জানতে পারল সে। নিজের আগ্রহ, কৌতূহলকে দমিয়ে রাখতে না পেরেই সে সারাদিন অপেক্ষা করেছে আজকের পূর্নিমার রাতের জন্য। এমনকি সে তাদের একজন পাহারাদারকে শহরে পাঠিয়েছে জরুরী তলবে ললিতাকে গ্রামে আনার জন্য।

সন্ধ্যা হতেই ললিতা এসে পৌঁছালো নন্দাদের বাড়িতে। সেই চিরপরিচিত পোশাক পরিহিতা হাস্যোজ্জ্বল নারী। শুধু ললিতা আসেনি, সঙ্গে শতাব্দও এসেছে। মহলে প্রবেশ করেই নন্দাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে,
“খালি ললিতাই তোমার বন্ধু হলো? আমি বুঝি কেউ না! এতটা পর ভাবলে আমাকে?”

নন্দা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলেও আপ্রাণ চেষ্টা করে শতাব্দের কথাকে ভুল বলে ঘোষণা করল। তা নিয়ে কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টাও হলো তাদের। স্টিফেন বাড়িতে নেই। বেশিরভাগ সময়ই সে বাড়িতে থাকে না। তবে অ্যালেন বাড়িতে ছিল। এবং আপ্রাণ চেষ্টা করেছে অতিথিদের আথিতেয়তায় যেন ত্রুটি নাহয় সেটার জন্য।

পূর্বের আকাশে সূর্যের ঈষৎ থেকে ঈষৎ চিহ্ন মিলিয়ে যেতেই আবহাওয়া শীতল হয়ে এলো। সুপারির বন হেলে পড়ল পরম আয়েশে। বাতাসে তখন মৃদুমন্দ আহ্লাদের আবরণ। নন্দা তার শাশুড়ীকেও যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা গেলেন না। বরং বেশ আন্তরিকতার সাথেই পুত্রবধূর ঝামেলা বিহীন যাত্রার ব্যবস্থা করে দিলেন। নন্দা খুশি হলো। রওনা দিল রূপসী দিঘির পাড়ে।

চারদিকের মশালের আলোয় অন্ধকার গুটিয়ে নিয়েছে নিজের আঁধার। হলুদ আভায় চারপাশ যেন ঝলমল করে উঠছে। ঢাক বাজছে বিরতিহীন ভাবে। নন্দাদের গাড়ি এসে থামল বিলের কিছুটা দূরে। নন্দার পড়নে লাল টকটকে মসলিন শাড়ি। জড়োয়া গহনায় রূপ বেড়েছে দ্বিগুণ, তিনগুণ অথবা বলা যায় চারগুণ। তাদের সাথে সাহেবদের কিছু দেহরক্ষী এবং অ্যালেনও এসেছে। গ্রামের মানুষ দ্রুত জায়গা করে দিল নন্দাদেরকে প্রবেশ করার।

গ্রামবাসী সকলে হৈচৈ আর আনন্দ উন্মাদনায় একাকার। বিভিন্ন ধরণের গান নাচে চারপাশ মুখরিত। নন্দারাও সেই অনুষ্ঠানে বেশ আগ্রহ নিয়েই অংশগ্রহণ করেছে। কুমারী মেয়েরা দিঘির জলে নেমে স্নান করছে। আবার গঙ্গাপূজাও হচ্ছে। অনুষ্ঠান যখন জমে উঠেছে তখন কিছুটা দূর থেকেই চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে এলো আবছা ভাবে। গ্রামবাসীরা তেমন একটা গুরুত্ব দিল না সেই শব্দে। যেন তারা জানেই কিসের চিৎকার। কিন্তু তা সন্দেহের ঠেকল নন্দার কাছে। সে উঠে দাঁড়াল। দেহরক্ষীর মাঝে একজনাে ডাকও দিল,
“রামু দা, কিসের চিৎকার এটা?”

রামু নামক লোকটা কিয়ৎক্ষণ আমতা-আমতা করে উত্তর দিল,
“হয়তো কারো স্বামী মারা গিয়েছে, সাহেব বধূ।”

নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিজস্ব অতীত, নিজস্ব ব্যাথা। এইতো স্রোতের তালে ভেসে যাওয়া কিছু মাস আগে, এই আর্তনাদ তো তার কণ্ঠেও ছিল। একটু বাঁচতে চাওয়ার আর্তনাদ, একটু উড়তে চাওয়ার আর্তনাদ। অথচ তাকে কেউ বাঁচতে দিতে চায়নি, উড়তে দিতে চায়নি। তার শখের চুল গুলোও মানুষের স্বার্থপরতায় হারাতে হয়েছিল। প্রিয় রঙ লাল, জীবন থেকে মুছে ফেলতে হয়েছিল। এমনকি চরিত্রহীনার তকমাও শরীরে মেখে নিজের প্রিয় গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। এই আর্তনাদের ভাষা যে তার জানা। বড়ো ভয়ঙ্কর সে ভাষা।

নন্দা আর স্থির থাকতে পারল না। মুহূর্তেই বলল,
” আমি যাব সেখানে। নিয়ে চলুন আমাকে।”

ললিতাও সাঁই দিলো। রামু নামক লোকটা তখন বিলের বিপরীত দিকে থাকা শ্মশানটার দিকে তাদের নিয়ে গেলেন।

বিলের একদিকে আনন্দ অনুষ্ঠানে রমরমা ঠিক অপরদিকে বিষাদের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে এক নারী। নন্দা আসতেই দেখল তার বয়সী একটা নারীর সদ্য স্বামী মারা গিয়েছে। সেই মেয়েটার মৃত স্বামীর সাথে তাকেও দাহ্য করা হবে বলে মেয়েটা এমন চিৎকার করেছে। মেয়েটাকে লাল টকটকে একটি বেনারসি শাড়ি পড়ানো হয়েছে। নববধূর সাজে সজ্জিত করানো হয়েছে। নন্দা ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল, মেয়েটা আর কেউ না, তার সহপাঠী প্রতিমা। যে একদিন নন্দার সাথে পরীক্ষা দিতে বসতে চায়নি একমাত্র নন্দার স্বামী মারা গিয়েছিল এবং তার অশৌচ পালন না করেই পরীক্ষা দিতে চলে গিয়েছিল বলে। প্রতিমার চোখ মুখে ভীতি, আকুতি। বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছায় মেয়েটা চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ গ্রাহ্য করছে না সেটা।

প্রথম কথা বলল ললিতাই,
“এই এই, আপনারা কী করছেন?”

পুরোহিতসহ আরো কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক সেখানে উপস্থিত ছিল। ললিতার কথায় তারা ঘাড় বাঁকিয়ে চাইল। যেই-না নন্দা, অ্যালেনকে দেখলে তারা থতমত খেয়ে গেলো। ব্যস্ত হয়ে পড়ল সমাদারে,
” সাহেব বধূ, সাহেব আপনারা! আপনারা এখানে এসেছেন যে? কোনো প্রয়োজন?”

“কী করিতেছেন আপোনারা?”

অ্যালেনের কণ্ঠেও একই প্রশ্ন শুনে তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কারণ নন্দার সাথে ঘটা ঘটনা তাদের অগোচরে নেই। এসব যে ইংরেজি সাহেবরা পছন্দ করেন না তাও তাদের অবগত। তাই একজন বয়োজ্যেষ্ঠ চতুরতার সাথে উত্তর দিল,
“আমাদের পুত্র মারা গিয়েছে। আর পুত্রবধূ তার স্বামীর সাথে এক চিতাতেই উঠতে চাচ্ছে। সেটারই আয়োজন করেছি।”

“কীহ্!”

ললিতা কথা বলার সাথে সাথেই প্রতিমা চিৎকার শুরু করল। বার বার মিনতি করে বলছে,
“না, না। আমি মরতে চাই না। আপনারা বাঁচান আমাকে।”

ললিতার আর বুঝতে বাকি রইল না যে তাদের ভুল বুঝানোর চেষ্টা করছে লোক গুলো। যেই না সে প্রতিমাকে ধরার জন্য এগিয়ে গেল তৎক্ষনাৎ একজন লোক হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“একদম আসবেন না। ওকে আমাদের ছেলেদের সাথে দাহ্য করা হবে। আপনারা আপনাদের কাজ করুন।”

ললিতা থামল না। বরং আরও দ্রুত গিয়ে প্রতিমার বাহুতে শক্ত করে ধরল। কঠোর স্বরে বলল,
“কীভাবে আপনারা ওকে দাহ্য করেন আমিও দেখবো।”

লোকগুলো মুহূর্তেই রেগে গেল। ললিতার দিকে তেড়ে যেতে নিলেই শোনা গেল নন্দার বজ্রকণ্ঠ,
“একদম ওদের গায়ে হাত দিবেন না কেউ। না হয় আপনাদের সাথে কী হতে পারে আপনারা ভাবতেও পারেন না।”

লোকগুলো আর আগানোর সাহস পেলো না। তবে আমতাআমতা করে বলল,
“সাহেব বধূ, আপনি এসবে না এলেই ভালো হয়। আপনি নিজেই কত অনাসৃষ্টি করেছেন তা আমাদের অজানা নয়।”

কথাটা যেন বড়ো আঘাত দিল নন্দার সুপ্ত হৃদয়ে। কী এক বিশ্রী ইঙ্গিত ছিল সেই কথার আড়ালে! নন্দার গা ঘিন ঘিন করে উঠল। অ্যালেন হুঙ্কার দিতে উদ্যত হতেই তাকে থামিয়ে দিল নন্দা। কানের মাঝে প্রতিধ্বনিত হলো স্টিফেনের বলা কিছু কথা। ‘সব জায়গায় রানীর মতন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে যেন সে কঠোর দৃঢ়তা দেখে পাহাড়ও মাথা নামাতে বাধ্য হয়’- আজ নন্দার সেই কথা রাখার দিন। নন্দা সকলের অগোচরেই দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলল। অতঃপর তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আমি অনাসৃষ্টি করেছি? তা কোন অনাসৃষ্টির কথা বলছেন? আমার বাঁচতে চাওয়াই কী অনাসৃষ্টি? বৈধব্য তো কোনো রোগ কিংবা অপরাধ নয়, তাহলে কেন আমাদেরকে শাস্তি পেতে হবে? মারা তো গেছে ওর স্বামী তবে কেন ওরে পুড়তে হবে? ও কী এমন ক্ষতি করেছে সমাজের যে ওর বেঁচে থাকা কেঁড়ে নিবেন?”

“বিধবা মেয়ে বেঁচে থাকলেই অন্য পুরুষদের মাথা ঘুরাবে রূপ দিয়ে। সমাজে পাপ তৈরী হবে।”

“তাহলে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্বামীকে কেন মেরে ফেলা হয় না? পাপ কী তবে মেয়েরাই সৃষ্টি করে? ছেলেরা কী চির পূর্ন বান? হাহ্! অথচ শাস্ত্র নারীকে দেবীর স্থানে বসিয়েছে, ধর্ম বলেছে নারী ছাড়া উদ্ধার নাই, সংসার বলেছে নারীই মাতা। আর নিছক মানুষ হয়ে কি-না আপনারা নারীকেই কোনঠাসা করছেন! বড়োই হাস্যকর।”

পুষ্পকাননের কোল ঘেঁষে বৈরী সমীরণ ছুঁয়ে দিচ্ছে মানবদেহ অথচ সুচালো অনুশোচনা ছুঁতে পারেনি ঘূণেধরা মস্তিষ্ক গুলো। উন্মাদ মস্তিষ্কের মানুষ গুলো দীর্ঘ কুসংস্কারে আবৃত জীবনে যেন বেশ মানিয়ে নিয়েছে নিজেদের। সেই জীবন ছেড়ে তারা বেরিয়ে আসতে চায় না যার ফলস্বরূপ নন্দার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর গুলোও তাদের কাছে কেবল আর কেবল মাত্র নারীদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বলে বোধ হলো। আর তারা সেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির বিপরীতে সচেতন মানুষ হয়ে প্রতিবাদ করা কোনো ভাস্কর্য। নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবনায় আঘাত করার জন্য নন্দার উপর ক্ষ্যাপে গেল সকলে। তাদের মাঝে একজন বলল,
“আপনি এত কথা বলছেন, লজ্জা করেনা সাহেব বধূ? আপনার রাত কাটানোর ঘটনা আমরা সকলেই জানি। এই, তোমরা তোমাদের কাজ করো। আমাদের পুত্রবধূর আজই দাহ্য হবে।”

নন্দার তীক্ষ্ণ সত্তায় ধারালো আঁচড় কাটতেই সে হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় রূপ লাভ করল। উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় গর্জন করে অ্যালেনের উদ্দেশ্যে বলল,
“ঠাকুরপো, এখুনিই দারোগা সাহেবদের ডাকান। সতীদাহকে সঠিক বলা প্রত্যেককে যেন কারাগারে বন্দী করা হয় তার ব্যবস্থা করুন। আর পুরো গ্রামে কালই এই বার্তা ছড়িয়ে দিবেন যে, ভুলেও কেউ যদি নিজের বাড়ির বউকে দাহ্য করতে চায় তবে তার শাস্তি কারাগার হবে না, হবে মৃত্যুদন্ড। জনসম্মুখে তাকেই দাহ্য করা হবে। দ্রুত এবার ব্যবস্থা করুন।”

নন্দার নির্দেশ পেতেই সে মোতাবেক কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পরে অ্যালেন। চারপাশে বাতাসের বেগ বাড়ছে। প্রতিমা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে নন্দাকে। মশালের আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। সকলের চোখে-মুখে ভয়। যুগ বদলের কবিতা তখন ছন্দ তুলতে ব্যস্ত। সুর তুলেছে পরিবর্তনের গান। নারীর হাত ধরে সমাজ বদলানোর গল্প মানুষ হতভম্ব হয়ে দেখছে।

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩১.

হেমন্তের ধানে ভরা যৌবন লাভ করেছে প্রকৃতি। ঝুম বরষার মৌসুম নয় তবুও ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে বজ্রপাত। আকাশের গম্ভীর গর্জনে কাঁপছে ধরণীর সত্তা। প্রতিমার মাথায় বিভিন্ন ব্যাথা নাশক প্রলেপ লেপা হচ্ছে। মেয়েটার জ্বরে শরীর লাল হয়ে আসছে। স্টিফেন সাহেব চিকিৎসক এনেছে। নন্দা ব্যস্ত হাতেই সেবা করছে প্রতিমার। তাকে সাহায্য করছে ললিতা। সদ্য ভোরের কোনো চিহ্ন গগন আবরণে নেই। মনে হচ্ছে যেন মধ্য রাত। প্রকৃতির কারণেই সময় বুঝা যাচ্ছে না।

স্টিফেন গম্ভীর দৃষ্টিতে চাইল, রাশভারি কণ্ঠে বলল,
“উনার মাথার ক্ষতটা কিসের? কীভাবে এটা হইয়াছে?”

“খুব সম্ভবত ভারী কিছু দিয়ে ওর শ্বশুর বাড়ির মানুষ ওর মাথার পেছনটাতে আঘাত করেছিল জ্ঞান হারানোর জন্য। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইন-কানুন জারি করলেও বিভিন্ন জায়গায় এখনো সেই পরিবর্তন পৌঁছাতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ এটা এখনো প্রচলিত। কিন্তু দেখা যায় ইদানীং অধিকাংশ নারী এই প্রথা মানতে চায় না, বিশেষ করে অল্প বয়সী নারীরা যাদের বিয়ে হয়েছে বেশ কিছুদিন হয়না অথচ স্বামী মারা গিয়েছে। তাদের কাছে দেখা যায় স্বামীর প্রতি টানের চেয়ে নিজের জীবনের মায়া বড়ো হয়ে দাঁড়ায় আর তাই তারা স্বামীর সাথে একই চিতায় উঠতে চায় না। তাই বাঁচতে চাওয়ার জন্য অনেক হইচই এবং কান্নাকাটি করে তারা, যেটা তাদের শ্বশুর বাড়ির পরিবারের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কারণ এই খবর দারোগা সাহেবদের কাছে গেলে তাদের জেল হতে পারে। তাই ইদানীং যেই নারীকে দাহ্য করবে ভাবে, তাকে আগে আফিম বা নেশা জাতীয় কিছু দিয়ে বেহুঁশ করা হয় কিংবা মাথার পেছনে আঘাত করা হয় জোরে যেন তাদের জ্ঞান হারিয়ে যায়। এটাই হয়তো হয়েছে এই প্রতিমার সাথে।”

ললিতার কথা উপস্থিত সকলে মনোযোগ সহকারে শুনল। এই তথ্য সকলের অবগত নয় যার ফলস্বরূপ সকলেই বিস্মিত হলো। স্টিফেন মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“আপনি এত কিছু জানিয়াছেন কী করিয়া?”

ললিতা হাসে। আনমনেই তপ্ত এক শ্বাস ফেলে বলে,
“জানতে হয় আরকি। আমি এই সতীদাহ প্রথার বিপরীতে কাজ করতে চাচ্ছি। সুন্দর, পুষ্পের ন্যায় প্রাণ গুলো অকালে ঝরে যাবে তা আমার যে সহ্য হয় না। তাই যত পারছি সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি।”

“ইন্টারেস্টিং! তবে এসব কুসংস্কার তো নারীদের জন্য ক্ষতিকারক। সানশাইনও স্বীকার হইয়াছে। আমি জানিনা কেন ধর্ম এসব করিতে বলিয়াছে।”

“ধর্ম কখনো এসব করতে বলেনি। বেদ, পুরাণ, গীতা, উপনিষদ ইত্যাদির কোথাও এমন কোনো ধর্মীয় বিধির বিধান দেওয়া নেই। এটার সৃষ্টি হয়েছে ভ্রান্ত ধারণা থেকে। একবার পার্বতী দেবীর বাবা ভরা আসনে পার্বতী দেবীর স্বামী শিবকে অপমানিত করেছিলেন যা মানতে পারেনি সতী স্ত্রী। তাই তিনি সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজেই আগুনে নিজেকে আহুতি দেন যেটার নামকরণ সতীদাহ রাখা হয়। এবং পরিবর্তিতে কিছু নারী স্বামীর গত হওয়ার শোক সামলাতে না পেরে স্বামীর সাথে নিজেকে আহুতি দিতেন। এবং সেই দাহ্যকে পবিত্রতা ধরা হতো। মানা হতো স্বামীর সাথে তার বিধবা স্ত্রীকে দাহ্য করা হলে সেই পরিবার স্বর্গবাসী হবে। আর তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির লোক বিধবা পুত্রবধূকে বোঝার ন্যায় মনে করেন যার ফলস্বরূপ তারা এই প্রথাকে অবশেষে নিয়ম বলে প্রচলন করা শুরু করেন।”

পুরো ঘর নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সকলে ললিতার কথা শুনছে। শতাব্দ প্রশংসা করে বলল,
“তুই তো অনেককিছু জানিস! কাহিনী কী? কীভাবেই বা জানলি এতকিছু?”

ললিতার ঠোঁটের কোণে খামখেয়ালির হাসি। কথাটা কেমন ঝেরে ফেলার ভঙ্গিতে বলল,
“আগ্রহ থেকেই জেনেছি। সেসব বাদ দিয়ে এবার প্রতিমার দিকে নজর দে। মেয়েটাকে সুস্থ করতে হবে।”

বাহিরে ঝড় তখন ধ্বংসাত্মক রূপ লাভ করেছে, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানোর আভা ছুঁয়ে দিচ্ছে ঘরের চারপাশটা। নন্দার হুট করে বিহারিণীর কথা মনে পড়ল। মানুষটা তো ছাঁদে একা আছে, এই ঝড়ে একা থাকতে পারবে আদৌও! নন্দা আগ-পিছ না ভেবেই দ্রুত ছুটে গেল ছাঁদের উদ্দেশ্যে। তার পিছু পিছু ললিতা যেতে নিলে তাকে থামিয়ে দিল স্টিফেন। মুচকি হেসে বলল,
“আমি যাইতেছি, আপনি এই ঝড়ে ভিজিয়া যাইবেন। সানশাইনের জন্য তার স্টিফেন আছে।”

প্রকৃতিতে তখন ভরা বর্ষা, চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। বড় বড় তালগাছগুলো আকাশ ছুঁয়ে যেন ওলট-পালট করে রেখেছে চারপাশ। কমলা এবং কালো মেশেলে এক ধরনের রং পুরো আকাশ জুড়ে খেলা করছে। দূর হতে ভেসে আসছে পশুপাখির হাহাকার, কাঁদছে মানুষ নিজের সবটুকু অসহায়ত্ব দিয়ে। প্রকৃতির এই অশান্ত রূপে স্তম্বিত অলকানন্দা। ছাদের রুক্ষ মেঝেতে পা রাখতেই সে থমকে গেল। এ কেমন অপরিচিত আকাশ এ কেমন অপরিচিত চারপাশ! নন্দা চেনেনা এই অশান্ত প্রকৃতি আবহাওয়া। মুহূর্তে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে দিল তার লতার মতন অঙ্গখানি। ভিজে গায়ের সাথে লেপটে গেলো মূল্যবান সেই মসলিন শাড়ি। জড়োয়া গহনা তখন বিদ্যুতের সাথে তাল মিলিয়ে এক নতুন আলোর সৃষ্টি করছে। নন্দা আনমনে চারপাশ ফিরে তাকালো। ছাদের শেষ কিনারার ঘরটা ফাঁকা। কেউ নেই সেই ঘরের আশেপাশে। মুহূর্তে চমকে গেল নন্দা। জল জ্যান্ত মানুষটা গেল কোথায়? মরিয়া হয়ে উঠল তার বক্ষ পিঞ্জিরার প্রাণ পাখিটা। আজ ছাদের কিনার থেকে রবীন্দ্র সংগীত ভেসে আসছে না। ভেসে আসছে না কারো আকুতি মাখা গানের কন্ঠ। কোথায় হারিয়ে গেল সেই কন্ঠের অধিকারিণী! নন্দার চিত্ত বিচলিত, ঘনঘটা আঁধার হাতরে সে চিৎকার করে ডাকল,
“বকুল ফুল তুমি কোথায়? বকুল ফুল তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?”

প্রতিত্তোরে কোনো শব্দ ভেসে এলো না বরং আকাশের অনবরত গভীর ডাকের সাথে সেই শব্দটা মিশে আরো ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করল। সামনে ভেসে উঠলো বিহারীণির সাথে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্ত। যে মুহূর্তগুলো স্মৃতিতে ভেসে উঠলে খিলখিল হাসিতে ভোরে উঠে চারপাশ। তন্মধ্যেই কারো হাতের স্পর্শ বাহুতে অনুভব করতেই ভয়ে ছিটকে উঠলো সে। অস্ফুটস্বরে শুধাল,
“কে! কে!”

আকাশ থেকে তখন বিদ্যুতের রুপোলি আলোয় ঝলমল করে উঠলো স্টিফেনের সিক্ত মুখোবয়ব। মায়া মায়া নীল আঁখিদুটিতে অপারগ মুগ্ধতা। ঠোঁটে লেপটানো মিষ্টি হাসি। ছোটো কণ্ঠে শুধাল,
“বকুল ফুল বুঝি তোমার বড়ো প্রিয়?”

নন্দার ভীত মস্তিষ্ক স্থির হলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে চাইল। স্টিফেনের থেকে নজর ঘোরানোর মিছে প্রচেষ্টা আর কি। ওই মায়াময় নজর গুলো যে তাকে চরম সর্বনাশের আভাস দেয়। নন্দাকে চুপ থাকতে দেখে স্টিফেন আবার জিজ্ঞেস করল,
“বকুল তোমার প্রিয়?”

নন্দা দায়সারা উত্তর দিল, “হ্যাঁ “।

“পৃথিবীতে সবাই তোমার প্রিয় একমাত্র আমি ছাড়া। আমার এমন শাস্তির কারণ কি? আমি কি জানিতে পারি? তোমাকে ভালোবাসার অপরাধেই কি আমার এই শাস্তি? তবে তাও খুশি, তোমাকে ভালোবাসা যদি অপরাধ হয় তবে আমি সেই অপরাধের শাস্তি চিরজীবন মাথা পাতিয়া নিতে রাজি।”

নন্দার ভীষণ মায়া হল স্টিফেনের জন্য। লোকটা কেন এত ভালোবাসার কাঙালি! বারবার তাড়িয়ে দেওয়ার পরও কেন ভালোবাসার আবদারের ঝুলি নিয়ে হাজির হয় নন্দার দোরে! মনে হয় কত দিনের ভালবাসার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত সে। নন্দা চেয়েও সে তৃষ্ণা মেটাতে পারে না কোন সে দায়ে! কিসের এত বাধা নিষেধ? কিসের এমন বিরাট দেয়াল! যে দেয়াল ভেদ করে ভালোবাসা পৌঁছাতে পারেনা স্টিফেনের হৃদয় আঙিনা অব্দি। নন্দার জানা নেই সেই উত্তর তবুও মন চায় কিছুটা ভালোবাসা উজার করতে এই মানুষটার নামে।

নন্দা কে চুপ থাকতে দেখে স্টিফেন বলল,
“চিন্তা নেই সানশাইন, আপনার বকুল ফুল সুরক্ষিত আছে। সে তার স্নিগ্ধতায় জড়াইয়া আছে। আপনার প্রিয় কিছুকে কখনোই আমি মূর্ছা যাইতে দিবোনা। তাইতো…… ”

নন্দা আড় চোখে চাইল। স্টিফেনের কণ্ঠ অনুসরণ করে প্রশ্ন করল,
“তাইতো কী?”

স্টিফের রহস্যময় হাসলো। গগণ সীমানায় চোখ রেখে ঠাট্টা করে বলল,
“তাইতো তোমার প্রিয় পুরুষ এখনও বাঁচিয়া আছে। নাহয় কবেই সে এই পৃথিবীর বক্ষে হারাইয়া যাইত!”

“আমার প্রিয় পুরুষ! কে সে?”

নন্দার বিস্মিত কণ্ঠস্বরের প্রশ্নে স্টিফেনের বিস্তৃত মাখা হাসির প্রশস্ততা কমলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
“অবুঝ সাজিতেছ সানশাইন! মানুষ সব ভুলিতে পারে কিন্তু প্রেম…. তা কখনো ভুলিয়া যাইত পারেনা। তবে হ্যাঁ, তুমি যদি আমাকে খুশি করিবার জন্য ভুলিয়া যাওয়ার অভিনয় করিয়া থাক তবে আমি ধন্য। অন্তত তোমার কণ্ঠ হইতে বের হওয়া অন্য পুরুষের নাম আমার সহ্য হইবে না। এত ভাবনার মাঝে, আমার পছন্দ নিয়া ভাবিয়াছ বলিয়া আমি ধন্য বোধ করিতেছি। চলো যাওয়া যাক।”

কথাটা বলেই স্টিফেন আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল। যেন তার প্রগাঢ় অভিমান সে নন্দাকে দেখাতে চায় না। অবশ্য যে অভিমানের মূল্য দেয় না তাকে অভিমান দেখানোটা বোকামি। তখন কষ্ট বাড়ে, দুঃখ বাড়ে। প্রিয় মানুষটার প্রিয় না হওয়াটা যে পৃথিবীর সর্ব কষ্টের মাঝে অন্যতম কষ্ট। আর যাইহোক, এই কষ্ট বুকে নিয়ে ভালো থাকা যায় না। আর স্টিফেন বরাবরই বুদ্ধিমান, সে ভালো থাকতে জানে। হোক সেটা বাস্তবে কিংবা কল্পনা।

_

একটি নতুন দিন গান শোনালো ব্যথার, যন্ত্রণার, দুঃখের ও হাহাকারের। কৃষক জমিতে ফসলের পরিমাণ ডুবিয়ে দিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত জল। কয়েকদিনের অতিরিক্ত বর্ষায় ভেসে গেছে সোনার ফসল গুলো। ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসব এখন পরিণত হয়েছে তুমুল দুঃখে। সোনার ফসল ঘরে তোলার আগেই সৌভাগ্য নিয়েছে বিদায়। হাহাকারে হাহাকারে ভারী হয়েছে প্রকৃতি। একটা ভীত মস্তিষ্ক বারবার কৃষকদের জানান দিচ্ছে তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজদের করের বোঝা শোধ করবে তারা কোন উপায়ে! শখের ধান তাদের সকল শোধের হিসাব নিয়ে বিদায় নিয়েছে। তাদের জীবন আরো ভয়াবহ কিছুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

নন্দা আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। বিহারিণী মহল থেকে তার পরিচিত একজন দাসী এসেছে তার জন্য একটি জরুরী খবর নিয়ে। নন্দা ঘুম ঘুম চোখে সেই দাসীর খবর পেতেই ছুটে গেল। আকাশ তখনো ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে, ক্ষণে ক্ষণে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ, পুরো গগন বক্ষে নৃত্য করছে গম্ভীর ডাক যা মানুষের সত্তা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নন্দা ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করল, পরিচিত দাসীকে দেখে শুধালো,
“এখানে কি কাজ? কে পাঠিয়েছে তোমাকে?”

চির পরিচিত দাসী মালতি কিছুটা এধার ওধার চাইল। মনের মাঝে কেমন তার বোধহয় খুত খুত ভাব। কিছু একটা গোপন করার তীব্র প্রচেষ্টা। তার অঙ্গভঙ্গিতে কিছু গোপন করার চেষ্টা বেশ ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। নন্দা চোখগুলো ছোট ছোট করে চাইল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“আড়ালে কিছু বলতে চাও?”

নন্দার এহন প্রশ্নের অপেক্ষাতেই যেন ছিল মহিলা। তৎক্ষণাৎ মাথা নড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, গোপন কথা আছে। আড়ালে চলুন। আপনার বাড়ির কিছু বিশ্বাসঘাতক গোপন কথা প্রচার করে দিবে।”

“আমার বাড়িতে বিশ্বাসঘাতক! কে সে? নামটা বল একবার।”

মালতি ভীতু দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল ভীতু ভীতু কণ্ঠে বলল,
“এখন এত কিছুর সময় না। আপনি জানেন বিহারিনী মহলের অবস্থা কি?”

মালতির কন্ঠ স্বরে নন্দার কৌতুহল সৃষ্টি হলো। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“কী অবস্থা?”

“আপনাদের বাড়ির তরঙ্গিনী পালিয়েছে। এবং কার সাথে পালিয়েছে জানেন? আপনার ননদিনী মনময়ূরীর স্বামী প্রসাদের সাথে। ওরা দুজন গত পরশু রাতে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। মনময়ূরী পুরো ভেঙে পড়েছে। তাকে সামলানো যাচ্ছে না। বাড়ির মাঝে কান্নাকাটির রোল। আপনি আসার সাথে সাথে নাকি লক্ষী বিদায় নিয়েছে সে বাড়ি থেকে– সকলের মুখোমুখি এই কথা। আপনার শাশুড়ি সুরবালা দেবী ভেঙে পড়েছেন অনেকটা। আপনাকে ভুল বোঝার দায়ে নাকি তার কপাল পুড়েছে। এই অনুশোচনায় মানুষটা দিন দিন কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে।”

অলকানন্দা কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। প্রসাদ নামের যেই লোকটাকে সে এত শ্রদ্ধা করতো সে কিনা অবশেষে এমন রূপ বদলালো! আর যাই হোক মনময়ূরীর স্ত্রী হিসেবে স্বামীভক্তি সব সময়ই ছিল। এমন একটা মেয়েকে ঠকানো মোটেও উচিত হয়নি। মেয়েটা যে স্বামীকে বড্ড ভালোবাসতো। তাইতো তার স্বামী বুঝি নন্দার প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছে ভেবে নন্দাকে কতই না ছোট বড় কথা বলেছিল!

নন্দার খারাপ লাগল। চোখের উপর ভেসে উঠলো সেই সাজানো গোছানো বাড়িটি। যার দেয়ালের কোল ঘেঁষে নন্দা বুনে ছিল সুখে থাকার স্বপ্ন। যা আজ গাংচিল হয়ে উড়ে গেছে বহুদূর। শকুনের এক ধ্বংসাত্মক থাবা ছিঁড়ে ফেলেছে সেই রঙিন স্বপ্ন। ছোট্ট নন্দার ভালো থাকার সেই স্বপ্ন আজ শুয়ে আছে পরিত্যাক্ত কোনো ইচ্ছে দাফনের কবরে। নন্দার বুক চিরে হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো যৌথ এই সোনার সংসারের দুর্দশা তার কাছে বড় যন্ত্রণা ঠেকলো। যতই হোক এক সময় সে ওই সংসারে আপন হয়ে ছিল।

ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে নন্দা হতাশার শ্বাস ফেলল। ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিল,
“আমি যাব ওই বাড়িতে, তুমি এখন যাও।”

মালতি চলে যেতেই নন্দা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বুকটা তার ভীষণ ভারী লাগছে। চোখের সামনে সুরবালা দেবীর আদরের সেই মায়াময় চেহারা ভেসে উঠলো। মানুষটা একদিন তাকে মায়ের স্নেহ দিয়েছিল। এই মানুষটার বিপদে না দাঁড়ালে যে বড় স্বার্থপর লাগবে নিজেকে।

ভাবনাটুকু ভেবে যেইনা নন্দা অলস ভঙ্গিতে পিছনে ঘুরল তৎক্ষণাৎ বিহারিণীর হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা দৃষ্টিগোচর হল তার। মেয়েটার মুখে লেপ্টে আছে কি সুন্দর হাসি! তবে এই হাসির ধরন ভিন্ন। যেন কাউকে অবলীলায় তাচ্ছিল্য জানাচ্ছে। নন্দার চোখে চোখ পড়তেই বিহারিণী হাসতে হাসতে বলল,
“এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল। পাপ যে নিজের বাপকেও ছাড়ে না।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”

নন্দার প্রশ্নে কোন ভাবাবেগ হলো না বিহারিণীর। বরং সে ফিসফিস করে বলল,
” কোথাও পড়েছিলাম– ‘আমার প্রিয় কৌটায় সোনালী আস্তরণে রয়েছে কত গীতিকাব্য বন্দী।’ তা এই ধাঁধার কোন উত্তর পেলে?”

নন্দা ডান-বামে মাথা নাড়াল। স্মিত কণ্ঠে বলল,
“নাহ্।”

“তোমার পিসি শাশুড়ি তো অনেক পান খেতে ভালোবাসতেন। তার কৌটার রং কি বলতো?”

বিহারিণীর খেয়ালী কথায় নন্দা চমকে উঠলো। হুট করেই তার আবছা স্মৃতির আস্তরণে ভেসে উঠলো পিতলের কারুকার্য শোভিত পানের কৌটা খানি। যা লক্ষ্মী দেবীর বড় পছন্দের ছিল। বিহারিণী কি এটাই বুঝাইতে চাইলো!

ততক্ষণের বিহারিণী তার মেঘের মতন অঙ্গখানি দুলাতে দুলাতে প্রস্থান নিয়েছে। নন্দাকে আর প্রশ্ন করার সুযোগও দেয়নি।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে