ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব ২১
সাব্বির সারাদিন বাইরে কাটাল। গোধূলিকে একটাবারও কল করেনি। মনমেজাজ আসলেও খারাপ হয়ে আছে ওর। ভেবেছিল গোধূলিকে ম্যানেজ করে একটা ভালো এমাউন্ট হাতে আসবে কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ এমন পলটি নেবে বোঝেনি। এদিকে হাতেও তেমন টাকা নেই। নেশার পেছনে বেতনের প্রায় পুরোটাই চলে যায়।
বেশ কিছু ধার দেনা হয়ে আছে। তার ওপর নওমির পেছনে অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে একটা হ য ব র ল অবস্থা।
অফিসে থাকতেই বন্ধু চয়ন ফোন দিলো। চয়নের বৌ থাকে বাবার বাড়িতে। ওখানে চাকরি করে। চয়ন দুই রুমের একটা বাসা নিয়ে থাকে। ওর বৌ আসে ছুটির দিনে। ঐ বাসাতেই আড্ডা দেয় ওরা। কিন্তু বেশ কিছু দিন হলো যায় না সাব্বির। আগের দু’বারের নেশা করার টাকা পায় চয়ন। তাই ফোন রিসিভ করলো না। একটু পর চয়নের মেসেজ এলো।
দোস্ত আজ বাসায় আসতে পারবি? টাকা পয়সা নিয়ে ভাবিস না। একজন ট্রিট দেবে।
মেসেজ পেয়ে সাব্বির কল করল।
বন্ধু তোর টাকাটা সামনের মাসে পাবি।
আরে দিসতো, আজকে আয় আগে।
কে ট্রিট দেবে?
আমার এক কাজিন।
আচ্ছা ছুটির পর আসছি তাহলে।
চয়নের ওখানে একজন মেয়েকে দেখে একটু চমকালো সাব্বির। মেয়েটার ঠোঁটে সিগারেট। পরনে জিন্স আর টি শার্ট। বয়স ২৩/২৪ হবে।
দোস্ত এর কথাই বলছিলাম । এই সুন্দরী হলো আমার কাজিন রামিসা। আজকের পার্টির হোস্ট।
রামিসা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
হাই,আমি রামিসা। চয়ন বাদরটা একটু বেশি বেশি বলে।
হ্যালো,আমি সাব্বির। আপনি কিন্তু সত্যি অনেক সুন্দর।
তাই না!
সাব্বির মুগ্ধ হয়ে গেলো। এমন একটা মেয়ে এখানে থাকবে ও ভাবতেই পারেনি। রামিসা একটু সরে গিয়ে সাব্বির কে পাশে জায়গা করে দিলো।
বসুন। আপনার জন্য আসর থেমে আছে। চয়ন বলছে দুইজনে ঠিক জমে না। তাই আপনার জন্য অপেক্ষা। এবার তবে শুরু করা যাক।
চয়ন ফয়েল পেপার এগিয়ে দিলো। রামিসা ছোট একটা গোলাপী বড়ি ফয়েল পেপারে রেখে লাইটার জালালো। অনেক দিন পর কোনো মেয়ের সাথে নেশার আসরে বসা হলো। ওর মনটা চনমনে হয়ে গেলো। একে একে তিনজনই নেশা করল।
তিনজনের বেশ নেশা হয়ে গেছে। চয়ন রামিসার গায়ে হেলে পড়ছে। ওর হাত রামিসার শরীর জুড়ে ঘুরছে। রামিসা উপভোগ করছে বোঝা যাচ্ছে। চয়ন ওকে জড়িয়ে চুমু খেলো। তারপর দু’জনে পাশের ঘরে চলে গেলো।
সাব্বির সবটা দেখল। চয়নকে ভীষণ হিংসে হচ্ছে ওর। পাশের ঘরের আওয়াজ এঘর পর্যন্ত আসছে। রামিসার নেশাতুর চিৎকার সাব্বিরের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
বেশ খানিকটা সময় পরে চয়ন বেরিয়ে আসল। টেবিলে রাখা রামিসার পার্স থেকে বেশ কয়েকটা হাজারের নোট সরিয়ে ফেলল।
সাব্বির বুঝল রামিসাকে ভালোই ভাঙাচ্ছে চয়ন।
রামিসা আরও কিছু সময় পর বের হলো। চয়ন বলল,
আজ থেকে যেতে পারতি।
নারে,বাসা ছাড়া রাতে ভালো লাগে না।
আচ্ছা যা। সাবধানে যাস।
সাব্বির বলল,
আমিও উঠব।
রামিসা বলল,
আপনি কোথায় যাবেন?
মালিবাগ।
ও আমিও তো ঐদিকে যাচ্ছি। আমার সাথে গাড়ি আছে। আপনাকে ড্রপ করে দেব।
সাব্বির খুশিই হলো। রামিসাকে কিছু সময় একা পাওয়া যাবে।
যেতে যেতে রামিসার কথা জানল। চয়ন ওর দূর সম্পর্কের কাজিন। রক্তের কেউ না। বাসা এক এলাকায় এই সূত্রে পরিচিত।
রামিসা চৌধুরী। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। একবার বিয়ে হয়েছিল সেই ঘর টেকেনি।
এখন বাবার দেয়া ফ্লাটে একাই থাকে। দেদারসে টাকা ওড়ায়, নেশা করে,নাইট ক্লাবে যায়। জীবনটা এনজয় করছে পুরোদমে।
সাব্বির মনে মনে ভাবল এমন একজন পার্টনারই তো সে খুঁজছিল। এভাবে পেয়ে যাবে ভাবেনি। তবে চয়নের কাছ থেকে রামিসাকে আলাদা করতে হবে। নামার সময় হেসে বলল,
আবার কি দেখা হবে?
রামিসা এক ঝটকায় তুমিতে নেমে এলো।
দেখা হোক সেটা চাও?
এমন সুন্দরীকে আবার না দেখলে আফসোসে মরে যাব।
আচ্ছা তোমার নাম্বার দাও।
সাব্বির নাম্বার দিয়ে বলল,
তোমারটা?
আমারটা লাগবে না। আমিই কল দেব তোমাকে।
সাব্বির একটু হতাশ হলো। যদি কল না দেয় এটা ভেবে।
বাড়িতে ফিরে দেখল গোধূলী বাসাতেই আছে। সাব্বির ভেবেছিল হয়ত বাবার বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু যায়নি। আজ তেমন কথা বলছে না। সাব্বির কিছু খেলো না। মা বাবা শুয়ে পড়েছে। গোধূলি কিছু খেয়েছে কিনা জানতেও চাইলো না।
দরজা লাগিয়ে আলো নিভিয়ে দিলো।
শুয়েই গোধূলিকে কাছে টানল। গোধূলি ছাড়িয়ে নিতে চাইল নিজেকে। কিন্তু সাব্বির সেসবের পরোয়া করলো না। জোর করল ও। রামিসাকে ভেবে ভেবে মাথা গরম হয়ে আছে ওর। গোধূলি অন্য দিনের মতো সাড়া দিলোনা। কিন্তু সাব্বির সেসব খেয়াল করলো না। নিজের দরকার মিটিয়ে সরে গেলো।
রামিসা কল করল পাঁচ দিন পর। সাব্বির বাসায় ছিল। একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসল। রিসিভ করতেই রামিসা বলে উঠল,
এটা কি হ্যান্ডসাম সাব্বিরের নাম্বার?
সাব্বির রামিসার কন্ঠ শুনে পুলকিত হলো।
জ্বি রামিসা ম্যাডাম। এটা সেই সাব্বিরের নাম্বার যে আপনাকে দেখার পর পাগল হয়ে গেছে।
আচ্ছা,কতটা পাগল হয়েছো দেখতে চাই।
কখন দেখবে?
কাল বিকেলে সময় হবে?
কি যে বলো। তুমি ডাকছো আর আমার সময় হবে না মানে?
চয়নের ওখানে?
এই না না,অন্য কোথাও। তোমার সাথে একা দেখা করতে চাই।
আচ্ছা আমার বাসায় এসো।
ঠিকানা টেক্সট করে দিও।
হুম।
সাব্বির পরদিন বিকেলেই পৌঁছে গেলো রামিসার দেয়া ঠিকানায়।
গার্ডকে বলাই ছিলো। সাব্বিরের ঢুকতে সমস্যা হয়নি। নাম বলতেই দারোয়ান বলল,
সেভেন বি। লিফটের ডানে স্যার।
আলিশান এক ফ্লাটে একাই থাকে রামিসা। ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। রামিসাকে আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে। ইচ্ছা করেই ফিনফিনে শিফনের শাড়ি পরেছে,সাথে ডিপ নেকের ব্লাউজ। সাব্বির হা করে তাকিয়ে আছে,চোখ সরাতে পারছে না। রামিসা বুঝতে পারল। চোখ দিয়ে ইশারা করল। সাব্বির ঠোঁট চাটল।
কি হলো, সমস্যা?
হুম,বিরাট প্রবলেম।
রামিসা মিষ্টি হেসে সাব্বিরের হাত ধরে বেডরুমে নিয়ে গেলো।
রামিসার সাথে সম্পর্ক ভালোই চলছে সাব্বিরের। যখন তখন ওর ফ্লাটে চলে যায়। মাঝে মাঝে রাতেও থেকে যায়। চয়নের ওখানে আর যাওয়া হয় না। রামিসার নতুন পার্টনার এখন সাব্বির। মেয়েটার দারুণ খরচের হাত। নেশা, ঘোরাঘুরি সব টাকা নিজেই খরচ করে। সাব্বিরকে এর মাঝেই বেশ কয়বার কেনাকাটা করে দিয়েছে। এমন একটা সম্পর্কই চেয়েছে সাব্বির। এতোদিন পর মনের মতো একটা জায়গা হলো ওর। গোধূলি এখন চুপচাপ হয়ে গেছে। সাব্বিরও ওকে ঘাটায়না।
সামনে রামিসার জন্মদিন। ওকে দামি কিছু দেয়া দরকার। ভালো কিছুর জন্য কিছু ইনভেস্ট করতে হয়। সাব্বির ভাবছে কি দেবে,টাকা কোথায় পাবে। ঠিক এমন সময় ভাগ্য ওর সহায় হলো। আলমারিতে একটা টিশার্ট খুঁজতে গিয়ে একটা সোনার গলার হার পেয়ে গেলো। এটা গোধূলির। রাত্রির আকদ্ এর দিন পরেছিল। সাব্বির ছবিতে দেখেছে। ও ভেবেছিল সিটি গোল্ডের হয়তো। কিন্তু এভাবে কাপড়ের ভেতর থেকে পেয়ে সন্দেহ হলো। নিশ্চয়ই এটা স্বর্ণের। তা না হলে এভাবে লুকিয়ে রাখতো না গোধূলী। ভীষণ সেয়ানা মেয়ে। একটা আস্ত সোনার হার লুকিয়ে রেখেছে।
জিনিসটা সরিয়ে ফেলল ও। জুয়েলারিতে ওজন করিয়ে দেখল আসলেই সোনার। সোয়া দুই ভরি আছে। সাব্বিরের মন খুশি হয়ে গেলো। ভালো দামে বিক্রি করে দিলো ওটা।
সকালে আলমারি খুলে গোধূলির একটু খটকা লাগল। সবকিছু কেমন অগোছালো হয়ে আছে। কিন্তু আলমারি তো গোছানো ছিল। এলোমেলো করল কে!
ও যেখানে গলারটা রেখেছিল সেখানে খুঁজে দেখল। হারটা নেই।
গোলাপি শাড়ির ভাঁজে রেখেছিল। শাড়িটা বের করে ঝাড়া দিল। সব কাপড় বের করে নিচে ফেলতে লাগল। হারটা পেলো না।
সাব্বির বিছানায় ঘুমুচ্ছে।
গোধূলি ধাক্কা দিয়ে বলল,
এই যে শুনছেন। উঠুনতো।
কি হলো। এভাবে ডাকছ কেনো সকাল সকাল।
আপনি আলমারি ধরেছিলেন?
হুম। কেনো আলমারি ধরা কি নিষেধ।
আমার একটা জিনিস পাচ্ছি না।
তো আমি কি করব,খুঁজে দেখো পাবে।
খুজেছি, কোথাও নেই।
কি সেটা?
আমার গলার একটা সেট।
ঐদিন যে কিনলাম সেটা?
না, সোনার হার।
সাব্বির অবাক হবার ভান ধরে বলল,
তুমি সোনার হার কোথায় পেলে?
মা দিয়েছিলেন আপার বিয়েতে পরতে।
বলোনিতো। আমি দেখিনি। তুমি কোথায় রেখেছ মনে করে দেখো।
আমার মনে আছে। আলমারিতে রেখেছি।
তাহলে ওখানেই আছে।
উহু,নেই। আপনি সত্যি করে বলেন কি করেছেন আমার হার।
কি বলতে চাইছো?
আপনি নিয়েছেন ওটা।
সাব্বির উঠে বসল।
কি বলতে চাও,আমি চোর?
এত কিছু জানি না। আপনি ভালোয় ভালোয় বের করে দেন নাহলে কিন্তু খারাপ হবে।
এই কি বলতে চাইছিস মা*।
মুখ খারাপ করবেন না। যেটা নিয়েছেন বের করেন জলদি।
না দিলে কি করবি?
পুলিশের কাছে যাবো।
কি, আমার খেয়ে আমার পরে আমার সাথে শত্রুতা করছিস?
খবরদার গায়ে যদি হাত দিছেন তো সত্যি পুলিশের কাছে যাব। নারী নির্যাতন এর মামলা করব।
সাব্বির একটু দমে গেলো। এমনিতেই হারটা সরিয়েছে। এখন আর বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। ও নরম হয়ে বলল,
আমি নেইনি। আমিতো জানিই না তোমার হার আছে।
গোধূলি কি বলবে বুঝতে পারছে না। ও নিশ্চিত যে হারটা সাব্বিরই নিয়েছে। কিন্তু স্বীকার করছে না। গোধূলি দুহাতে মাথা চেপে বসে পড়ল। অন্যায়ভাবে ও নিয়েছিল ওর বোনের হার,সেটা সেভাবেই হারিয়ে ফেলল।
(চলবে)
ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব: ২২
রাত্রি চুপচাপ বসে আছে। আয়ানের সাথে আজ সারাদিন কথা হয়নি। রাত্রি মেসেজ দিয়েছে কিন্তু আয়ান সিন করেনি। সন্ধ্যা থেকে কয়েকবার কল দিলো। কিন্তু প্রতিবার কেটে দিয়েছে আয়ান।
রাত্রির মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। গতকাল থেকেই এমন করছে আয়ান। গতরাতে রাত্রি ফোন দিলো নিজ থেকে। আয়ান একটু কথা বলেই বলল,
আচ্ছা রাখছি ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।
রাত্রি সাথে সাথেই কেটে দিয়েছে। ও যে অভিমান করে কেটে দিল অথচ আয়ান সেটা বুঝলোই না। কল ব্যাকও করেনি।
রাত্রির মনটা একটু বেশি খারাপ কারণ আজ ওর জন্মদিন । ও ভেবেছিল আয়ান দিনটা খেয়াল করবে। কিন্তু ও একবার কথাও বললো না ঠিক করে।
মা আজ সকালে পায়েস করেছেন। দুপুরে পোলাও ,রোস্ট। আজ ছুটি নিতে বলেছিলেন,রাত্রি নেয়নি।
গোধূলিকে ডেকেছিল রাত্রি কিন্তু ও আসেনি। আজকাল একদম আসে না মেয়েটা। এলেও আগের মতো আর ঝগড়া করে না। চুপচাপ বসে থাকে। কিছু একটা হয়েছে ওর। রাত্রি ঠিক করল এবার গোধূলী এলে ওর সাথে খোলাখুলি কথা বলবে। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে গোধূলীর।
স্কুলে সারাদিন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটল। এফবিতে অনেকেই উইশ করেছে ওকে। কি আশ্চর্য আয়ান তো ওর সাথে এড আছে। ও কি খেয়াল করেনি।
স্কুলে কলিগরা উইশ করল। রাত্রির মনটা ভালো হলো কিন্তু পুরোপুরি উপভোগ করতে পারলো না। কোথায় যেন একটা মনখারাপ ওকে আচ্ছন্ন করে রাখছে।
প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজে। আয়ান একটা মেসেজ দিয়েছে।
কি অবস্থা?
রাত্রি জবাব দেয়নি রাগে। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে পোলাও খেয়েছিল একটু। পেটটা ভরেই আছে। রাতে আর তেমন কিছু খেলো না ও। বারান্দায় বসে বাইরের জোসনা দেখছিল। হঠাৎ কানের কাছে একটা ছোট ফু দিলো যেন কেউ। রাত্রি একটু চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখল লাল টকটকে গোলাপের ইয়া বড় একটা তোড়া হাতে আয়ান দাড়িয়ে আছে। হাসিমুখে বলল,
শুভ জন্মদিন মাই ডিয়ার ওয়াইফ।
রাত্রির চোখে পানি চলে আসল।
এই যে, এখন আবার কি কান্না করবা। উহু,একদম কান্না হবে না। আমরা বের হবো এখন।
কোথায়?
চলোইনা। গেলেই দেখবে। আর এই শাড়িটা তোমার জন্য।
খুব সুন্দর একটা ময়ূরকণ্ঠী রঙের মসলিন এর শাড়ি এনেছে আয়ান। রাত্রির ভীষণ পছন্দ হলো।
রাত্রি রেডি হলো। আয়ানের দেয়া শাড়িটা পরল। সাথে খোঁপায় বেলির মালা দিলো। মালাও আয়ান এনেছে। নাজমাকেও যেতে বলল আয়ান কিন্তু নাজমা বললেন,
তোমরা যাও বাবা। আমি এখন আর বাইরে যাবো না।
রাত্রিকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল আয়ান। ওখানে আয়ানের কাজিনরা সব আগে থেকেই আছে। একটা ফ্লোর বুকিং করেছে। সুন্দর করে ডেকোরেট করা হয়েছে। রাত্রির জন্মদিন উপলক্ষ্যে পার্টি রেখেছে আয়ান।
রাত্রি কেক কাটল। সবাই উইশ করল ওকে। গান বাজনার একটা দল আনা হয়েছে। চমৎকার কিছু গান গাইল ওরা। আয়ান নিজেও গাইল।
আনন্দে রাত্রির চোখে পানি চলে আসল।
দারুণ একটা সন্ধ্যা কাটল ওর। আগে কখনও এত চমৎকারভাবে জন্মদিন উদযাপন করা হয়নি।
আয়ান বলল,
তুমি কি ভেবেছিলে আমি ভুলে গেছি?
হুম।
আমার কি মাথা খারাপ। আমার একমাত্র বৌয়ের জন্মদিন ভুলে যাব!
কাল থেকে তো কথাই বললেন না।
আমি পুরোনো হয়ে গেছি।
কিহ! এখনো তো বাসর করা হলো না। এখনো তুমি একদম নতুন আমার কাছে।
তারমানে পরে পুরোনো হয়ে যাব।
একদম না। দুষ্টুমি করেছি। এসব নতুন পুরাতন কি ? তুমি আমার জীবনসঙ্গী। আজীবন আমার প্রিয়।
আয়ান আর রাত্রিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওর কাজিনরা সব চলে গেল।
নাজমার জন্য বাইরে থেকে খাবার প্যাক করে এনেছে। নাজমাকে নিজে বসে থেকে খাওয়ালো আয়ান।
রাতে শোবার আগে রাত্রি গোসল করে নিল। ঘরে ঢুকে দেখল আয়ান চোখের ওপর হাত দিয়ে শুয়ে আছে। ও ভাবল
বেচারা ক্লান্ত। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত্রি ভেজা চুল মুছে আয়ানের পাশে এসে বসল। কাথাটা নিয়ে আয়ানের গায়ে দিয়ে দিল। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পেলো আয়ান। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। একটানে রাত্রিকে বুকে টেনে নিল।
ওর ভেজা চুল সরিয়ে কানের নীচে ঠোঁট ছোয়ালো। রাত্রি কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে আয়ানকে আঁকড়ে ধরল। দুটো মনের ভালোবাসা মন থেকে শরীর ছুঁলো এই প্রথম।
চয়নকে রামিসা পাত্তা দিচ্ছে না আজকাল। বাসায় ডাকে না। টাকা পয়সাও দেয়না। ফোন দিলে কেটে দেয়।
চয়ন তাই আজ রামিসার বাসায় চলে এসেছে।
কিরে আজকাল কোথায় থাকিস, তোকে পাওয়াই যায়না।
এইতো বাসাতেই তো।
ফোন দিলে ধরিস না।
একটু প্যারায় আছি। কি খবর বল।
অনেক দিন হয় আসর হয় না। আজ হবে নাকি?
নারে। আজ না।
চয়ন উঠে গিয়ে রামিসার কাছে বসে। একহাতে জড়িয়ে চুমু খেতে যায়।
রামিসা সরে গিয়ে বলে,
আজ না। শরীর খারাপ লাগছে।
তুই কি কোনো কারণে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস?
আরে দূর। সত্যিই খারাপ লাগছে। তুই বস। আমি নাশতা দিতে বলছি।
রামিসা উঠে ভেতরে গেলো। ফোনটা রেখে গেছে। একটু পরেই কল এলো। চয়ন উঁকি দিয়ে দেখল সাব্বির এর নাম আর নাম্বার ভেসে আছে স্ক্রিনে।
কল বেজে বেজে কেটে গেল।
রামিসা ঢুকল নাশতার প্লেট হাতে। নুডুলস করে এনেছে। সাথে জুস।
আবার কল এসেছে।
রামিসা ফোন নিয়ে ঘরের সাথে লাগোয়া বেলকনিতে চলে গেল।
চয়ন কান পেতে রইল।
হুম, আচ্ছা কাল বিকেলে চলে এসো।
চয়নের রাগ লাগল। তারমানে সাব্বিরের সাথে সময় কাটাচ্ছে রামিসা।
চয়ন সুন্দর মতো নাশতা করল।
রামিসাকে বলল,
কিছু টাকা হবে? হাতটা খালি যাচ্ছে।
রামিসা ভেতরে গিয়ে একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলো।
চয়ন মনে মনে ভাবল,
খাল কেটে নিজেইতো কুমির এনেছে।সাব্বিরকে পেয়ে এখন এই চয়নকে ফকিরের ভিক্ষা দেয়া হচ্ছে। আমিও দেখি কতদিন থাকে এই সম্পর্ক।
চয়ন জানে রামিসার মতো মেয়েকে চার্জ করে লাভ নেই। বড়লোকের উড়নচণ্ডী মেয়ে। যখন যেটা ভালো লাগে করে। চয়ন ওর কাছে কিছুই না।এক পুরুষে আটকে থাকা স্বভাববিরুদ্ধ ওর। ওর সাথে লেগে পেরে উঠবে না চয়ন। সাব্বিরের ওপর মেজাজ খারাপ হয়। এভাবে ওকে ওভারটেক করে বল নিজের কোর্টে নেবে সেটা চিন্তাও করেনি। কিন্তু সাব্বিরকে কিছুই বলে না। ও জানে এখন কিছু বলে লাভ নেই। সোনার ডিম পাড়া হাঁস পেলে কে আর বন্ধুর কথা ভাবে।
চয়ন গোধূলির নাম্বার জোগাড় করে মেসেজ দিলো।
আপনার স্বামী সাব্বিরের রামিসা নামের একজনের সাথে অবৈধ সম্পর্ক চলছে। হাতেনাতে ধরতে চাইলে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এই ঠিকানায় চলে আসবেন।
গোধূলি ওয়াশরুমে ছিল। ফিরে এসে দেখল ফোনে একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।
ওই নাম্বারে কল করল। কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে।
রামিসা নামের একজনের সাথে সাব্বিরের সম্পর্ক চলছে। এটা অসম্ভব কিছু না। সাব্বির কেমন এতদিনে ও বুঝে গেছে। এখনতো মনে হচ্ছে নওমির বিষয়টাও সত্যি ছিলো। ওর সাথেও অবৈধ রিলেশন ছিল।
গোধূলির ইচ্ছে করে এসব ছেড়ে চলে যেতে মায়ের কাছে। কিন্তু একটা দ্বিধা ওকে আটকে রাখে। ওদের যদি সব বলে দেয় নিজেই তো ছোট হয়ে যাবে। সাব্বির গায়ে হাত তোলার পর দু’দিন ঐ বাসায় গিয়ে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। নিজের ভুল স্বীকার করাটা বেশ কঠিন লাগে ওর জন্য। আপার কাছেও হেরে যেতে মন চায় না। আজ না হোক কাল ওরা ঠিকই খোঁটা দেবে,
যেমন নিজে নিজে বিয়ে করেছ,তেমন উচিত শিক্ষা হয়েছে।
কিন্তু আজকের এই মেসেজ পেয়ে গোধূলির মন অন্য কথা বলছে। ও ঠিক করেছে এই ঘটনা সত্যি হলে সব ছেড়ে ছুড়ে বাবার বাসায় ফিরে যাবে। মা বোনের কাছে দরকার হলে ক্ষমা চাইবে।
সাব্বির আজকেও ফিরল বেশ রাত করে। তবে আজ গোধূলীর সাথে তেমন কথাবার্তা বললো না। অবশ্য বেশ কিছুদিন থেকেই এমন চলছে। সাব্বির এখন ওকে তেমন কাছে টানে না। কথাও বলে খুব কম। হয়তো অন্য কারো সাথে ইনভলভ বলেই এমন আচরণ করছে।
ফোনেও সবসময় কি যেন করে। কার সাথে চ্যাটিং করে। ফোনটাও লক করা। চাইলেও গোধূলি চ্যাটলিস্ট দেখতে পারে না। একদিন ফোন চাইলে সাব্বির দিল। কিন্তু মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে আবার আলাদা করে লক করা। তাই কিছু দেখতে পায়নি।
এই মেসেজ কে পাঠিয়েছে। সত্যি কি এই ঠিকানায় গেলে সব জানা যাবে। নাকি ও কোনো বিপদে পড়বে। আজকাল কতরকম ঘটনাই তো ঘটে। এমন নাতো যে ওকে এভাবে ওখানে নিয়ে গিয়ে আটকে দেবে কেউ। এমন নানারকম দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটল ওর।
পরদিন বিকেল যত এগিয়ে আসল গোধূলী ততই অস্থির হয়ে পড়ল। ওখানে যাবে কি যাবে না একটাই ভাবনা। বিকেলে সাব্বিরকে কল করল,
দুবার রিং হবার পর ও কল রিসিভ করল।
হ্যালো,কি হয়েছে?
আপনি কোথায়?
কেনো কি হয়েছে?
আজ একটু বের হতাম আপনার সাথে।
আজ হবে না। জরুরী একটা কাজ আছে আমার।
কি কাজ?
আজবতো, তোমাকে কি সব বলতে হবে এখন? বাইকে আছি। পরে কল দেব।
সাব্বির কেটে দিলো।
গোধূলি ঠিক করল ও ঐ ঠিকানায় যাবে।
সাব্বির রামিসার বাসায় পৌঁছে দেখল রামিসা খুব সেজেছে আজ। ওকে শাড়িতে কখনো দেখেনি। আজ শাড়ি পরেছে। সাব্বির একেবারে হামলে পরল ওর ওপর। কোলে নিয়ে সোজা বেডরুমে চলে গেলো।
মেসেজে দেয়া ঠিকানায় পৌঁছাতে ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেলো। গোধূলি পৌঁছে দেখল বিশাল এক এপার্টমেন্ট। গেটে দাড়োয়ান দাঁড় করিয়ে নাম পরিচয় জানতে চাইল।
গোধূলি বলল,
রামিসা ম্যাডাম আসতে বলেছেন।
দাড়োয়ান লোকটা ইন্টারকমে কল করল। কিন্তু কেউ মনে হয় রিসিভ করলো না।
গোধূলি বলল,
আমাকেতো আসতে বলেছিলেন এই সময়। ওনার পরিচিত আমি। আপনি না হয় চলুন আমার সাথে।
দাড়োয়ান বলল,
কিন্তু গেটতো খালি রেখে যাওয়া যাবে না।
গোধূলি একটু ভেবে বলল,
একটু আগে যে সাব্বির নামের লোকটা এসেছে উনি আমার কাজিন।
অনুমানে কথাটা বলল ও। যদি কাজ হয় আর কি।
ও আচ্ছা। আপনি তাহলে সাব্বির সাহেবের কাজিন। আচ্ছা সমস্যা নাই,যান।
গোধূলি লিফটে উঠে নির্ধারিত ফ্লোরে নেমে বেল টিপল।
বেশ কিছু সময় পর গেট খুলে দিলো রামিসা।
ভীষণ সুন্দরী একটা মেয়ে। যেমন দেখতে তেমনি সুন্দর ফিগার। ছেলেদের মাথা নষ্ট করতে যথেষ্ট। গোধূলি ওর তুলনায় কিছুই না।
রামিসার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল।
কাকে চাই?
সাব্বির আছে?
আপনি কে?
আমি ওর ওয়াইফ।
রামিসা বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
ও।
তারপর নাম ধরে সাব্বিরকে ডাকল,
এই সাব্বির ,এদিকে এসোতো।
সাব্বির পিছে এসে উপস্থিত হলো।
গোধূলিকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
তুমি এখানে কিভাবে এলে?
আপনি কি ভেবেছিলেন আপনি যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবেন আর আমি জানবো না।
জেনেছ তো কি হয়েছে । তাই বলে এখানে চলে আসতে হবে। তোমার এতো সাহস হয় কিভাবে এখানে আসার?
আমি কি অপরাধী যে ভয় পাবো।
এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে একজন উঁকি দিলো।
রামিসা বলল,
তোমার বৌকে চিৎকার করতে নিষেধ করো। এটা ভদ্রলোকেদের জায়গা।
ওরে আমার ভদ্রলোক। তা এতোই যখন ভদ্রলোক তখন অন্য একজনের স্বামীকে নিয়ে বাসায় তুলেছেন কেনো!
খবরদার কোনো সিনক্রিয়েট করবা না। এখুনি চলে যাও।
চলেতো যাবোই। আপনার এসব নোংরামি দেখব নাকি বসে বসে? ঘরে বৌ থাকতে এসব বাজে মেয়েদের সাথে সময় কাটাতে লজ্জা করেনা?
সাব্বির এই মেয়েকে থামাও শিগগির। হাউ ডেয়ার শি টকস লাইক দ্যাট!
আমার বরকে নিয়ে শোবার সময় লজ্জা করে না,এখন কথা শুনতে খারাপ লাগছে নাকি?
শোনো মেয়ে নিজের স্বামীকে ধরে রাখার মুরোদ নেই তোমার। আমাকে কেনো দোষ দিচ্ছো।
আপনার মতো কালনাগিনীরাইতো বিষাক্ত করে ফেলে পবিত্র সম্পর্ক।
সাব্বির এবার হাত ধরে ওকে ভেতরে টেনে নিয়ে বলল,
শোন মাগি তোকে আর আমার একটুও ভালো লাগে না। রামিসার পায়ের নখের যোগ্য তুই না। ওর বাসায় এসে ওকে অপমান করার সাহস হলো কিভাবে! আর একটা কথা না বাড়িয়ে এখানে থেকে চলে যা। আমার যা খুশি আমি করব। বাঁধা দিতে আসলে তোকে লাথি দিয়ে বের করে দেব।
এত সহজ! আমি আপনার বিয়ে করা বৌ। আমার সাথে এমন প্রতারণা করতে পারেন না। ঘরে বৌ রেখে বাইরে এসে ঢলাঢলি করছেন কিভাবে!
রামিসা বলে উঠল,
বুলশীট!
সাব্বির বলল,
কিসের বিয়ে, কিসের বৌ। কোনো প্রমাণ আছে তোর কাছে যে তুই আমার বৌ।
ধর্ম সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়েছে আমাদের।
ধর্ম ধুয়ে পানি খা তুই। কাগজপত্র আছে নাকি। বিয়েতো রেজিস্ট্রেশন হয়নি।
এতো বড় ধোঁকাবাজ আপনি! আমি মামলা করব আপনার নামে।
আমি ধোঁকাবাজ না। তুই নিজেই আমাকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করেছিস। তোকে বিয়ে করে আমি ফেসে গেছি।একটুও যদি বাড়াবাড়ি করছিস তো তোর যেসব ছবি ভিডিও আছে সব ছড়িয়ে দিব।
কিসের ছবি ভিডিও! আপনার কাছে আমার এমন কিছুই নেই। মিথ্যা ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না।
সাব্বির হো হো করে হাসতে থাকল।
এই বুদ্ধি নিয়ে আমার পেছনে গোয়েন্দা গিরি করতে এসেছিস তুই? তোর মতো মেয়ে যেকোনো সময় নেকামি করতে শুরু করবে এটা বুঝেই আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছি। এই দেখ।
মোবাইল এগিয়ে দিলো সাব্বির।
গোধূলির মাথা ঘুরে উঠল। নগ্ন অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে সেসময়ের,গোসলের সময়ের কিছু ভিডিও আর ছবি। অজান্তে এসব কখন করেছে শয়তান টা।
এখন চুপচাপ এখান থেকে চলে যাবি আর আমার বাসায় যাবি। বাবার বাড়িতে ভুলেও যাবি না।
এখুনি বের হয়ে যা। খুব খারাপ কাজ করছিস আজ এখানে এসে। এই ভুলের মাশুল তোকে দিতে হবে।
গোধূলি বুঝল এখানে থাকলে শুধু ক্ষতিই হবে। এদের তো মান সম্মান নেই। আর গোধূলীর সম্মান এখন সাব্বিরের হাতের মুঠোয়।
গোধূলির চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। এ কোন ফাঁদে পড়ল ও। ভেবেছিল সব ছেড়ে মায়ের কাছে ফিরবে কিন্তু সাব্বির নামের বহুরূপী ওকে কোন ঝামেলায় ফেলবে আল্লাহ জানে।
ও রাস্তায় নেমে আসল। কিছু সময় এলোমেলো হাঁটল তারপর একটা কীটনাশকের দোকানে গিয়ে ইঁদুর মারা বিষ নিয়ে বাড়ি ফিরল।
(চলবে)