ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব: ২০
আলেয়ার নাম্বার জোগাড় করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি সাব্বিরের। শশুর বাড়িতে এসে থাকার সময় সুযোগ বুঝে নাজমার ফোন থেকে নাম্বারটা টুকে নিয়েছিল। আসলে ও চায়নি এই মুহূর্তে রাত্রির বিয়ে হয়ে যাক। নতুন জামাই আসলে তখন সেই ছেলে সব বিষয়ে নাক গলাবে। আর তাছাড়া আয়ান সব দিক থেকেই তার চেয়ে এগিয়ে আছে। চাকরি, বাড়ির অবস্থায় তুলনামূলক ভাবে আয়ান বেটার। সবসময় তাকে ছোট হয়ে থাকতে হবে, কমপ্লেক্সে ভুগতে হবে। আর তাছাড়া নতুন জামাই হলে এসব জমিজমার ভাগ নিতে গেলেও সমস্যা করতে পারে। তাই আলেয়ার নাম্বারে কল করে রাত্রি সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে বাজে কথা বলেছিল। এসব বলার পরে কোনো বাবা মাই ছেলের জন্য এমন মেয়েকে বৌ করে আনতে চাইবেনা। তবে তেমন কিছুই হলো না।
এদিকে আয়ান সাব্বিরের নাম দেখেও চুপচাপ থাকল। ছেলেটা যে সুবিধার না সেটা আগেই বুঝেছে। কিন্তু এতোটা ক্রিমিনাল মাইন্ডেড তা আশা করেনি। তবে রাত্রিকে এখন এসব কিছুই জানালো না। বিয়ের মতো এই শুভকাজে ওদের বোনে বোনে মনকষাকষি হোক এটা সে চায় না। এমনিতেই পরিবারটার ওপর অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে। পরে এসব নিয়ে ভাবা যাবে।
সাব্বিরের দিনগুলো একঘেয়েমি কাটছে। অফিস- বাসা,বাসা- অফিস করে। গোধূলির ভয়ে সে যে এমন করছে তা নয়। এসব ভয়টয় সে কখনো পায়না। তবে গোধূলীর কাছে নিজেকে আবার পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ করতেই তাকে এটা করতে হচ্ছে। ওর বাবার বাড়ির সম্পত্তির টাকাটা হাতে পেতেই এই অভিনয়। টাকাটা পেলে কিছু দিন বিন্দাস কাটানো যাবে। অনেক দিন হলো বাইরে কোথাও টুর দেয়া হয়না। টাকা পেলে ঘোরাঘুরি করে আসবে। নতুন কোনো শরীরের স্বাদ নেয়া দরকার। গোধূলির সাথে কেমন বোরিং লাগে আজকাল। কিন্তু নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সাব্বির দাঁতে দাঁত চেপে দিন পার করছে। গোধূলিকে বেশি বেশি সময় দিতে হচ্ছে।
নওমিকে একদিন কল করেছিল। কিন্তু রিসিভ করেনি। পরে আবার কল দিতে গিয়ে দেখে ওকে ব্লক করে দিয়েছে। ভেবেছিল ওকে বাইরে ডেকে কোনো হোটেলে বা পার্কে গিয়ে সময় কাটাবে। কিন্তু সেটা আর হলো না।
সাব্বির মনে মনে গালি দিলো,
শা* খা*কি।
সাব্বির অফিস শেষে সোজা বাসায় চলে আসে। গোধূলিকে নিয়ে বাইরে যায়। ওর পছন্দের খাবার খায়। শপিং করে টুকটাক। কমদামি কিছু কিনে দিলেই ও খুশি হয়। আহ্লাদে গলে পড়ে।
গোধূলি এখন খুশিতেই আছে। সাব্বির এখন বাসায় সময় দেয় গোধূলিকে। যখন তখন ওকে ঘরে ডেকে দরজা লাগিয়ে একান্ত সময় কাটায়। একটা কাজের লোক ঠিক করেছে সাব্বির। ওর শাশুড়ি অবশ্য বাঁধা দিতে চেয়েছিল। কাজের লোকের কথা শুনে ছেলেকে বলল,
এই কয়জন লোক, তারজন্য আবার কাজের লোক কেনো। গোধূলি তো সারাদিন শুয়ে বসেই থাকে। কাজের লোক সব করলে ও কি করবে বসে থেকে।
ও কি করবে মানে! ও ছোট মানুষ। এতো কাজ করবে কিভাবে। আর ওকেতো দাসিগিরি করতে আনিনি। এনেছি আমার জন্য। আমাকে সময় দিবে।
ছেলের এমন কথায় সাবেরা মুখ কালো করে ঘরে চলে গেলেন।
তবে গোধূলি খুশি হলো । এই প্রথম সাব্বির ওরজন্য এতোগুলো কথা শোনালো মাকে। আগেতো এসব নিয়ে কিছু বলতো না। এখন ওরমনে হচ্ছে নওমির সাথে এমন একটা কান্ড হয়ে ভালোই হয়েছে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
ওর মনে হয় সব দোষ ছিল নওমির। প্রথম থেকেই মেয়েটাকে ভালো লাগেনি ওর। কেমন ছেলেঘেষা স্বভাবের।
যাইহোক,সাব্বিরের এই ঘরমুখো মনোভাব ও উপভোগ করছে। সারাদিন সেজেগুজে থাকে গোধূলী। সাব্বির এসব পছন্দ করে। রাতে সাব্বিরের পছন্দের রাতপোশাকে নিজেকে আবেদনময়ী করে তোলে। মনে মনে ভাবে সাব্বিরকে ও ওর রুপে পাগল করে রাখবে। বাইরের কাউকে যেন মনে না ধরে ওর।
তবে মাঝে মাঝে খটকা লাগে। কখনো কখনো ফোন এলে সাব্বির ওর কাছ থেকে উঠে গিয়ে আড়ালে কথা বলে। এইতো কয়দিন আগে ওরা বাইরে খেতে গেছিল। খাবার অর্ডার করে বসে আছে। এমন সময় গোধূলি খেয়াল করল সাব্বিরের ফোনে একটা কল আসল। নাম্বার দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল, তারপর রিসিভ না করে কেটে দিলো। একটু পরে গোধূলী খেয়াল করল মোবাইলে আলো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। তারমানে ও ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে। গোধূলি বলল,
কল আসছে আপনার ফোনে,কে কল করেছে?
অফিস থেকে।
রিসিভ করেন।
না থাক। অযথা বকবক করবে।
গোধূলি উঠে ওয়াশরুমে গেল। এসে দেখল সাব্বির ফোনে কার সাথে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ রেগে আছে। গোধূলি টেবিলে আসার আগেই ফোন রেখে দিলো।
গোধূলির মন খচখচ করতে লাগল। কে এমন ফোন করেছে যে গোধূলীর সামনে রিসিভ করলো না।
আজ গোধূলী নতুন একটা নাইটি পরেছে। সাব্বির ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলো। গোধূলি গিয়ে টেবিলের একপাশে হেলান দিলো। সাব্বির চোখ তুলে দেখল। যদিও এখন আর গোধূলি ওকে টানেনা ,তবুও ল্যাপটপ সরিয়ে গোধূলিকে টেনে কোলে বসিয়ে নিলো। ও জানে এই মেয়েকে কিসে বশ করা যায়।
উদ্দাম আদর শেষে গোধূলিকে জড়িয়ে ধরল সাব্বির। আদুরে কন্ঠে বলল,
তুমি আমাকে কতটা জাদু করেছ সেটা কি জানো?
উমম।
তুমি এতো সুন্দর। কত ভালোবাসো আমাকে অথচ দেখো আমি আমার সুন্দরী বৌয়ের জন্য তেমন কিছু করতে পারছি না। ইচ্ছা করে তোমাকে নিয়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই। দামি দামি শাড়ি গহনা কিনে দেই। আলাদা একটা ছিমছাম ফ্লাটে সংসার পাতি। কিন্তু চাকরির টাকায় কুলাতে পারছি না।
গোধূলির এসবে লোভ আছে। এমন হাইফাই জীবন ভালো লাগে ওর। কিন্তু মুখে বলল,
আপনি চেষ্টা করেন। অবস্থা একসময় বদলে যাবে।
আমিও তো চাই নিজেকে তোমার যোগ্য করে তুলতে। একটা ব্যবসা দাঁড় করালে সব স্বপ্ন পূরণ হতো।
গোধূলি চুপ করে থাকল।
জমিটার কি করবে কিছু ভেবেছো? মাকে চাপ দাও। যত জলদি আমরা ব্যবসা শুরু করব তত জলদি অবস্থার পরিবর্তন হবে।
গোধূলি নড়েচড়ে উঠল। ঘুরেফিরে সাব্বির জমির কথাতে এসেছে। তবে গোধূলীর মন আজকাল আর সায় দেয়না এতে। জমি বিক্রি করে সাব্বিরকে একটা টাকাও দিতে রাজি না ও। কিন্তু এসবতো আর বলা যায় না। তাই বলল,
বলেছিতো আমি। কিন্তু উনিতো রাজী না। মা চায় না বেঁচে থাকতে জমি বিক্রি হোক। আপার বিয়েটা হোক। পরে দেখা যাবে।
আরে বোকা মেয়ে বিয়ে হয়ে গেলে তখন তোমার বোনের জামাই সব বিষয়ে নাক গলাবে।
এতো সহজে নাকি। উনি নাক গলানোর কে?
তখন উনিই তোমার মায়ের প্রিয় হবে দেখিও। আমি বলি কী, ভালো ক্রেতা নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেই। সম্পত্তি তোমার। মাকে এতো মানানোর কি আছে। তোমার বোন চাইলে ঠিক রাজী হয়ে যেতো। ঐ এলাকার প্রভাবশালী একজন জমিটা কিনতে রাজি আছেন। আমার পরিচিত একজন কথা বলেছে। ওনার কাছে বিক্রি করে দেই। ভালো দাম দেবেন ভদ্রলোক।
আচ্ছা ভেবে দেখব।
সাব্বির বোঝে গোধূলীর তেমন আগ্রহ নেই জমি বিক্রি করতে। ও গোধূলীর গলায় আদর করতে করতে বলে,
তোমার ভালোর জন্য আমি এভাবে বারবার বলছি সোনা। তুমি আবার ভেবো না আমি তোমার সম্পত্তি নিতে এমন করছি। তোমার টাকা তোমার নামেই ব্যাংকে রাখব। আর অল্প কিছু টাকা দিয়ে তুমি ঘরে বসেই অনলাইনে বিজনেস করলে। আজকাল দেখোনা লাইভে জামাকাপড় বিক্রি করে মেয়েরা কত আয় করছে।
গোধূলির অবশ্য এই বিষয়ে আগ্রহ আছে। ও দেখেছে অনলাইনে এসব জামাকাপড় দারুণ বিক্রি হয়। লাইভ হতে না হতেই ড্রেস স্টক আউট হয়ে যায়। এসব দেখতে ভালোই লাগে। তবে এসব করলেও ও নিজেই করবে। প্রসঙ্গ পালটাতে ও বলে,
আমার হার কবে বানিয়ে দিবেন?
আরে দেবোতো। এতো উতলা হচ্ছো কেনো? আমিতো পালিয়ে যাচ্ছি না। তোমার গোলাম হয়েই আছি পাগলি।
আপার বিয়েতে কি পরব আমি।
আজকাল সিটি গোল্ডের কত সুন্দর সুন্দর জিনিস আছে। সোনার থেকেও সুন্দর। বোঝাই যায় না সোনা নাকি সিটিগোল্ড। তোমাকে কিনে দেব একটা।
গোধূলি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
আমার গলারটা নেবার সময় কিন্তু এমন কথা বলেননি। বিয়েতে আমি ফকিরের মতো সিটি গোল্ড পরে ঘুরব?
সাব্বিরের মেজাজ খারাপ হয়।
নিজেকে সামলে রেখে বলে,
সময় হোক বানিয়ে দেব।
গোধূলি বুঝে ফেলে সাব্বির ওর কাছে থেকে শুধু নিতেই থাকবে। দেবার বেলায় এমন কথায় ভোলাবে।
পরের শুক্রবার আয়ানের সাথে রাত্রির আকদ্ হয়ে গেল ছোটখাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে। দু’বাড়ির কাছের লোকজন ছিলো। গোধূলি আসবেনা বললেও শেষ মুহূর্তে এসেছে। তবে সাব্বির আসেনি। মনে মনে সে ভীষণ বিরক্ত হয়ে ভেবেছে,কি বেহায়া পরিবাররে বাবা। মেয়েটার সম্পর্কে এতো বাজে কথা শোনার পরেও বিয়ে দিতেই হবে। ও ঠিক করে খুব দ্রুত জমি বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
গোধূলি অনুষ্ঠানে থাকলেও তেমন কিছুই করেনি। সেজেগুজে নিজের ঘরেই বসে ছিল। কোনো কাজে হাত লাগালো না। আপার শশুর পক্ষের লোকজনের আদিখ্যেতা দেখে রাগে শরীর জ্বলেছে ওর। আপার জন্য সবার কি টান এখন থেকেই। ওদের বাড়ি থেকে দারুণ একসেট গহনা দিয়েছে আপাকে। আর ও রাত্রির যেই নতুন গহনাটা দোকান থেকে তুলে নিয়েছিল ওটাই পরেছে । সাথে সিটি গোল্ডের একটা সীতাহার। অনুষ্ঠান শেষ হতেই বাড়িতে চলে গেল গোধূলি।
আকদ্ শেষে আয়ানদের চলে যাবার কথা ছিল। বেরুতে যাবে তখন রাত্রির এক ভাবি বলল,
আয়ান থাকুক আজ। কাল সকালেই তো চলে যাবে চট্টগ্রাম। ওরা নিজেদের মধ্যে একটু সময় কাটাক।
আয়ান মনে মনে চাইছিল থাকতে। কিন্তু বলতে পারছিলো না। ভাবি থাকতে বলাতে খুশি হলো মনে মনে।
সব ঝামেলা শেষ করে দু’জন একলা হতে রাত বারোটা পেরিয়ে গেল। রাত্রি ঘরে এসে দেখল আয়ান নেই। এ ঘরেই তো ছিলো। কোথায় গেলো।
বাইরে বেরিয়ে দেখল রান্নাঘরে আয়ানের গলা পাওয়া যাচ্ছে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল আয়ান চা করছে। নাজমা পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন,
কি লজ্জার কথা। আমি করে দিচ্ছি তুমি ঘরে যাও বাবা।
আয়ান বলছে,
আপনি চুপ করে দেখুন মা। আমার তৈরি চা খেলে আপনি তখন সবসময় আমাকে চা করতে বলবেন। আমার অভ্যাস আছে।
আয়ানকে দেখে কেউ বলবে না ও এই বাড়ির নতুন জামাই। আজকেই ওর প্রথম দিন এ বাড়িতে। কি সুন্দর সহজ হয়ে কথা বলছে, চলাফেরা করছে।
রাত্রি আর ওদের মাঝে না গিয়ে ঘরে চলে এলো। ও সারাদিনের সাজপোশাকেই আছে। একটা মিষ্টি বেগুনি রঙের কাতান সাথে হালকা সাজ। চেঞ্জ করবে কিনা বুঝতে পারছে না। আয়ান যদি মনখারাপ করে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছে খুব। সেই সকালে উঠেছে আজ। টেনশনে কাল রাতেও ঘুম হয়নি। মাথা ভীষণ ব্যথা করছে।
আয়ান নাজমাকে চা দিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল।
এই যে মিসেস আয়ান। আপনার চা।
আমাকে বললেই তো হতো।
কেনো আমার চা কি খুব খারাপ হবে খেতে?
তা নয়। আপনি জামাই মানুষ। চা করলেন।
তো কোথায় লিখা আছে জামাইরা চা বানাতে পারবে না।
বুঝেছি আপনার সাথে কথায় পারবো না আমি।
হুম,বাই দা ওয়ে তোমাকে সত্যিই বৌ বৌ লাগছে।
তো, আমিতো সত্যিই বৌ।
আয়ান হেসে বলল কি জানি আমিতো এখনও বুঝতে পারছি না যে আমি বর, আর তুমি এখন আমার বৌ।
রাত্রি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো।
তো মিসেস আয়ান আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি।
রাত্রি লজ্জাবনত চোখে হাত বাড়িয়ে দিলো।
আয়ান একটা ছোট চৌকোনা বক্স বের করে রাত্রির হাতে একটা সুন্দর রিং পরিয়ে দিলো।
রাত্রির হাত ধরে চুমু খেলো। রাত্রি কেঁপে উঠলো অজানা এক ভালো লাগার অনুভূতিতে।
আয়ান রাত্রির একদম কাছে চলে এলো। আয়ানের গরম নিঃশ্বাস রাত্রির মুখে চোখে এসে পড়ল। চোখ বন্ধ করে ফেলল রাত্রি। আয়ান রাত্রির চিবুক ধরে মুখটা তুলে কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,
তোমাকে ক্লান্ত লাগছে। শুয়ে পড়ো। আজ অনেক ধকল গেছে।
রাত্রি মনে মনে কৃতজ্ঞ হলো। সত্যি চোখ ভেঙে ঘুম আসছে ওর।
পরদিন সকালে আয়ান চট্টগ্রামে চলে গেলো। আয়ান থাকতে বোঝেনি। কিন্তু ও চলে যাওয়া মাত্র কেমন একা একা লাগতে শুরু হলো ওর।
গোধূলির আগ্রহ না থাকলেও সাব্বির হাল ছাড়ে না। ইনিয়ে বিনিয়ে ব্যবসার কথা বলতে থাকে। জমিটা বিক্রির কথা ওঠায়। ওর শাশুড়িও সাব্বিরকে উসকে দিতে এটা ওটা বলে। এক রাতে খাবার টেবিলে সাব্বির বলে,
এই চাকরি করতে গিয়ে মাথাটাই নষ্ট হবে। সারাদিন এতো হিসাব করতে হয়। একটা ব্যবসা করার মতো টাকা থাকলে বেঁচে যেতাম।
সাবেরা জানেন ছেলে তার বৌকে শোনাতেই কয়দিন থেকেই এই গান শুরু করেছে। উনি বললেন,
তোর ছোট খালার ছেলে বাঁধন আছে যে ওকেতো শশুড় বাড়ি থেকে ব্যবসার জন্য পনেরো লাখ টাকা দিয়েছে। ছেলেটার ভাগ্য ভালো। কত সুন্দর বৌ পেয়েছে আবার এতোগুলো টাকা।
হুম, আজকাল সবাই শশুর বাড়ি থেকে ভালো হেল্প পায়। আমার বন্ধুরা সবাই বিয়ে করে শশুরের কাছে কত হেল্প পাচ্ছে।
হুম হেল্পতো করবেই। শশুরের মেয়েকে সারাজীবন পুষবে জামাই,তাহলে হেল্প করলেতো ওনার মেয়েই সুখে থাকবে। একদিক থেকে চাকরি করা বৌই ভালো। সংসারের বোঝা স্বামীর সাথে ভাগ করে নিতে পারে।
গোধূলি মা ছেলের কথার ধারা বুঝতে পারল। ওকে উদ্দেশ্য করেই এসব বলা হচ্ছে। সাব্বির আজকাল সবসময় এই কথাগুলোই বলে। গোধূলির জমি বিক্রি করে টাকাগুলো নেয়াই যেন সাব্বিরের লক্ষ্য।
গোধূলির আজকাল একটু একটু আফসোস হচ্ছে। কেনো যে বাড়ি থেকে পালাতে গেলো। ভীষণ অনুতাপ হয়। কাউকে মনখুলে সবকিছু বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাড়িতে মা বা আপার কাছে এসব কথা জানাতেও পারে না। কোথায় যেন আটকায়। ওরা তো ওকেই দোষ দেবে শেষমেষ।
সাব্বির কি ওকে ভালোবাসে না ! তাহলে এতো করে জমি বিক্রি করতে চাপ দিচ্ছে কেনো। ও যদি জমি বিক্রি না করে তবে সাব্বির কি করবে?
সাব্বির আর সাবেরার এসব কথাবার্তা আরও কিছু সময় চলল। গোধূলি অল্প খেয়ে ঘরে চলে আসল। কিছুক্ষণ পর সাব্বির এলে বলল,
শুনুন,আমি এখন জমি বিক্রি করবো না। মা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন ওটা থাকুক। যত দিন যাবে জমির দাম বাড়বে। আর আমি ব্যবসা করতে চাইনা। পড়াশোনা শুরু করতে চাই।
সাব্বির অবাক হয়ে বলল,
কি বলো, এতোদিন গ্যাপ পড়ে গেছে। এখন কি পড়াশোনা শুরু করবে।
গ্যাপ হয়েছে তো কি হয়েছে। তাছাড়া খুব বেশি গ্যাপতো হয়নি। কয়টা মাস মাত্র ।আমি কাভার করতে পারব।
আরে,পড়বে পড়। কিন্তু আজকাল চাকরির যে বাজার। পড়াশোনা করেও তেমন কিছু হবে না। তার থেকে বিজনেস করাই বেস্ট অপশন। পড়াশোনার সাথে অনলাইন বিজনেসটাও করো।
ওসব পরে ভাবব। এখন আপাতত পড়া শুরু করতে চাই। কোচিং এ ভর্তি হব।
সাব্বির হঠাৎ রাগ হয়ে গেল। একটু জোরেই বলল,
হুম বিয়ের সময়তো বলছিলা মন দিয়ে সংসার করবা। এখন আবার পড়ার ইচ্ছা জাগল কেনো। ঐ বাড়িতে মা বোন ভালোই ব্রেইন ওয়াশ করেছে দেখছি।
ওরা কেনো ব্রেইন ওয়াশ করবে। এসব কি কথা। আর পড়াশোনা কি খারাপ কিছু।
পড়াশোনা তো খারাপ না। এই বাহানায় বাইরে যাওয়া আসা, ছেলেদের সাথে লটরপটর শুরু করাটা খারাপ।
একদম বাজে বকবেন না।
ঐ,আমি বাজে বকতেছি। তুমি কেমন মেয়ে মানুষ আমি জানি না! দুইদিন এর কথায় আমার সাথে ঘোরাঘুরি করছো। বিয়ের আগেও তো পারলে শুয়ে পড়ছো। এখন আর আমাকে ভালো লাগতেছে না। নতুন ভাতার লাগবে এখন।
ছিঃ নিজে উল্টা পাল্টা কাজ করে এখন আমাকে আজেবাজে বলতেছেন। আপনার চরিত্র কেমন সেটা ভাবেন আগে।
কিহ,আমি চরিত্রহীন! আরে পুরুষ মানুষ আবার চরিত্রহীন হয় নাকি। আমরা একশ জনের সাথে শুলেও শরীর ক্ষয়ে যায়না। কিন্তু তুমি মেয়ে হয়ে কি করেছ সেটা ভাবো। নিজের বোনের সাথে যার বিয়ের কথা তার হাত ধরে বাইরে চলে আসছ। আসলে জন্মের ঠিক নাই।
খবরদার বাবা মা তুলে গালি দিবেন না। ভালো হবে না একদম।
সাব্বিরের রাগ মাত্রা ছাড়ালো। তুই তোকারি শুরু করল এবার।
কি করবি তুই,আ। বেশি বাড় বাড়ছে না?
এখুনি মজা দেখাচ্ছি।
সাব্বির গোধূলীর চুলের মুঠি ধরে বিছানায় ফেলে বুকে ঘুষি দিতে লাগল অনবরত। গোধূলি চিৎকার করে উঠল। সাব্বির ওর মুখে চেপে ধরে আরো কয়েকটা কিল ঘুষি মেরে ছেড়ে দিলো।
গোধূলি কাঁদতে কাঁদতে ওখানেই শুয়ে রইল। শরীরের আঘাত যতটা তার থেকেও বেশি মনটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।
আজ বুঝতে পারছে বাবা মাকে ঠকিয়ে কি বড় ভুলটা করেছে ও। এই ভুলের মাশুল সে কিভাবে দেবে। চারপাশে শুধু অন্ধকারে ছেয়ে আছে।
(চলবে)