ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১৮
সাব্বিরকে মারধোর করে ঘন্টা দুই চিলেকোঠায় ফেলে রাখা হলো। লম্বামতো ছেলেটার নাম পরাগ। এই বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় সিক্স বিতে থাকে। ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়াশুনা করে। নওমির প্রতি আগে থেকেই একটু দুর্বল ছিলো।বেশ কয়দিন খাতিরে জমাতে চেয়েছে কিন্তু পাত্তা পায়নি। কেনোনা ততদিনে নওমির সাব্বিরের সাথে সম্পর্ক চলছে। তাই ও পরাগকে এড়িয়ে গেছে। তাছাড়া বেকার ছেলের সাথে সম্পর্ক করলে শুধু শরীরের আনন্দ পাবে কিন্তু গিফট পাবার সম্ভাবনা কম। তাই ওকে এড়িয়ে গেছে নওমি। পরাগও বাড়িওয়ালার ভাগ্নি বলে বেশি ঘাটাতে সাহস করেনি। তবে সবসময় নজরে রাখতে চেষ্টা করেছে। এভাবেই নওমির সাথে সাব্বিরের সম্পর্কের বিষয়টা আঁচ করতে পারে। নিচে দাড়োয়ানের সাথে এটা নিয়ে কথাও বলেছে দু’দিন। তবে বাড়িওয়ালাকে প্রমাণ ছাড়া বলতে সাহস পায়নি। আজ সুযোগমতো একেবারে হাতেনাতে ধরেছে।
গোধূলি প্রায় দু’মাস হলো নেই। একদিন বাড়িওয়ালা একদিন সাব্বিরের কাছে জানতে চেয়েছে,
কি ব্যাপার সাব্বির সাহেব,বৌকে দেখিনা কয়দিন হয়।
চাচা,বৌ বাবার বাড়িতে গেছে। ওর বাবা মারা গেছে। তাই এই মাসটা ওখানেই থাকবে।
ও আচ্ছা।
বাসা ছাড়ার কথা থাকলেও নওমির কথা ভেবে বাসাটা ছাড়েনি ও। ভেবেছিল আর দু একমাস রেখে ছেড়ে দেবে। কিন্তু আজ এভাবে ধরা পড়বে ভাবতেও পারেনি।
সাব্বিরের গলা শুকিয়ে গেছে। ঠোঁট কেটে রক্ত ঝড়ছে। চোখ নাক ফুলে একাকার। মনে হচ্ছে যেন বোলতার কামড় খেয়েছে।
বেশ কয়েকবার পানি চেয়েছে কিন্তু পায়নি।
নওমি একটাবারও আসেনি। ওকেও হয়ত আটকে রাখা হয়েছে।
এরা আসলে কি করতে চাইছে বুঝতে পারছে না সাব্বির। তবে এটুকু বুঝেছে যে এই ঘটনা যেন বাইরে না যায় সেরকম কথা বলেছে বাড়িওয়ালা। বাইরে যখন কথা বলছিল সেটা সাব্বিরের কানে এসেছে। ওকে মারধোর করে ছেড়ে দেবার কথা হচ্ছিল। কিন্তু এখন শুধু শুধু কেনোই বা ফেলে রেখেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ওকে ঘরে বেঁধে ফেলে রেখেই সবাই নিচে নেমেছে।
পরাগ ওর সাথে থাকা আরেকজন ছেলের সাথে কথা বলে ঠিক করল যে সাব্বিরকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। ওর বাসায় জানিয়ে টাকা পয়সা কিছু আদায় করতে হবে। যেহুতু মান সম্মানের ব্যাপার তাই হয়ত পুলিশকে জড়াবে না এরা।
ওপরে এসে পরাগ সাব্বিরকে বলল,
তোর বাসায় কল দেব। তোরে এসে নিয়ে যাক। ফোনের লকটা খোল।
আমার বাসায় কেউ নাই। কেউ আসবে না।
খা*কির পোলা, আবার মিথ্যা বলবি তো এইখানে জবাই করে লাশ বুড়িগঙ্গায় ফালায় দিবো। শিগগির লক খোল। আর বাড়ির লোককে বল হাজার ত্রিশেক টাকা আনতে।
টাকা কেন? আপনারা কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। পুলিশের কাছে অপহরণ মামলা দিব আমি। তখন কিন্তু অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে সবার।
পরাগ কষে একটা লাথি বসাল সাব্বিরের মাজা বরাবর।
আরে শু*রের বাচ্চা,তোর এইসব অপকর্মের ভিডিও যদি নেটে ছাড়ি তখন তোমার কোন পুলিশ ভাই এসে বাঁচাবে শুনি। এই মিলন এর যে ভিডিও আছে ছাড়তো এখুনি। মেয়েসহ ঘরে যে ধরলাম দরজা খোলার থেকে তো ভিডিও করছি।
আচ্ছা দাঁড়ান,বিষয়টা আর বাড়ানোর দরকার নাই। আমি লক খুলে দিচ্ছি।
সাব্বির ফোনের লক খুলে দিয়ে গোধূলীর নাম্বার দিয়ে বলল,
এটা আমার বৌয়ের নাম্বার।
পরাগ গোধূলীর নাম্বারে কল করল।
গোধূলি শশুর বাড়িতেই ছিলো। রাতের জন্য ভাত বসিয়েছিল। সাব্বিরের ফোন দেখেই রিসিভ করল।
হ্যালো।
আপনি কি গোধূলি, সাব্বির সাহেবের ওয়াইফ?
জ্বি।
আপনের জামাই কোথায় আছে কিছু জানেন?
আপনি কে? সাব্বির কোথায়। ওনার ফোন আপনার কাছে কেনো, ওনার কি হয়েছে?
তেমন কিছু হয়নি ম্যাডাম। একটু মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ ফুর্তি করতেছিল। কিন্তু হাতেনাতে ধরা পড়েছে। এখন আমাদের কাছে আছে।
কি বলছেন আজেবাজে কথা।
আজেবাজে না। সত্যি বলছি। আপনার বরের কাছে শুনুন।
সাব্বিরের কানে ফোন ধরল পরাগ।
গোধূলি আমার কথা শোনো। আমি একটা বাজে ঝামেলায় ফেঁসে গেছি। তোমাকে সব বলব। তুমি প্লিজ ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে জলদি আমাদের ঐ ভাড়া বাড়িতে আসো।
কি বলেন, ঐ বাসায় কেন। ওটা না ছেড়ে দিছেন?
তুমি আসো আগে। সব বলব।
কিন্তু এরা কি বলতেছে এসব।
আমি বলব তোমাকে সব। ভুল বুঝিও না সোনা। জলদি আসো। আর পুলিশ এর কাছে যেওনা। আব্বা আম্মাকেও কিছু বলার দরকার নাই।
আচ্ছা আমি আসতেছি। কিন্তু টাকাতো নাই।
তোমার গলার হার আছে না ঐটা আনো।
কিন্তু ঐটাতো আমার হার। আম্মার কাছ থেকে নিয়ে আসছি। ওনার বিয়ের স্মৃতি।
তোমার কাছে আমার থেকে হার বড় হলো। আচ্ছা আমি মরে যাই তুমি তোমার গলার হার নিয়ে থাকো।
গোধূলি শেষমেশ গলার হার নিয়ে রওয়ানা হলো। তবে নতুন গলার সেটের কথা সাব্বির জানে না। ঐটা ভালোভাবে লুকিয়ে রাখল।
গোধূলি বের হতে নিলে সাবেরা বললেন,
এইসময় কোথায় যাও?
মা,আপনার ছেলে কল করেছিল ।এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত আছে। আমাকে একটু এগিয়ে যেতে বলল।
দাওয়াত তো এভাবেই যাবে?
সাজগোজ তো করলা না।
কুলখানির দাওয়াত মা। সাজতে হবে না।
এই রাতে কুলখানির দাওয়াত! আচ্ছা যাও।
গোধূলি একটা উবার নিয়ে চলে গেল।
ঐ বাড়িতে পৌঁছে স্বামীকে দেখে চমকে উঠল।
কি হয়েছে, আপনার এই অবস্থা কেন?
পরাগ গোধূলীকে ছাদে ডেকে নিয়ে বলল,
আপু,উনি বাড়িওয়ালার ভাগ্নির সাথে লটরপটর করছিল এই রুমে। আমরা দেখে আটকেছি। বোঝেনি তো । এত বড় অকাজ করছে এমনি এমনিতো ছাড়া যায় না। পাবলিক সেন্টি খাইলে যা হয় আরকি। দুচারটা কিল ঘুষি খেয়েছেন। তবে আপনার ভাগ্য ভালো যে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেইনি। এলাকার বড় ভাইতো ঘটনা শুনে পাগলা কুত্তার মতো ছুটে আসতে চাইছিল। আমি আটকেছি। নিচে মোড়ের দোকানে এখনো বসে আছে। এখন ওনাকে থামিয়ে রাখতেতো খরচপাতি আছে। তাই টাকা আনতে বলেছি। আপনি টাকাটা দিয়ে নিয়ে যান ভাইয়াকে।
আমি কি ওনার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি?
অবশ্যই। তবে চালাকি করবেন না। ওনার অপকর্মের প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। শেষে ভাইরাল হয়ে সব হারাতে হবে।
গোধূলি সাব্বিরের কাছে গিয়ে বলল,
ছিঃ ছিঃ! এই আপনার চরিত্র।
বিশ্বাস করো আমার দোষ নাই। মেয়েটা চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
কিছু না করলে এমনি এমনি ফাঁসবেন কেনো।
আমি আজ আসতেই ও পেছনে পেছনে এসে দরজা হঠাৎ লাগিয়ে দিলো। আর তারপর এরা হুট করে এসে আমার এই হাল করেছে।
সব মিথ্যা। এই বাসা ছাড়েননি কেনো এখনো। আমাকে তো বলেছেন যে গত মাসেই ছেড়ে দিয়েছেন।
আমি ছাড়তেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার এক কলিগ এখানে উঠতে চেয়েছিল। বলেছিল ফার্ণিচারসহ কিনে নেবে। তোমাকে আর বলা হয়নি পরে।
এসব হচ্ছে আপনার বানানো কথা। আপাও আপনাকে সেদিন দেখেছে এক মেয়ের সাথে। সবাই কি শুধু আপনার সম্পর্কে মিথ্যা বলে।
হুম ঠিক,আমিই খারাপ,মিথ্যুক আমি। আমার এখন বিপদ। সবাই সবদিক থেকে কোনঠাসা করছে। ভেবেছিলাম তুমি পাশে আছো। কিন্তু তুমিও অবিশ্বাস করছো। ঠিক আছে তুমি চলে যাও। আমার ভাগ্যে যা ঘটার ঘটবে।
গোধূলি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সাব্বিরের কন্ঠে এতো আকুতি মাখা ছিল যে মনে হচ্ছে সত্যি ভীষণ অসহায় ও। আবার কখনও মনে হচ্ছে এসব মিথ্যা। ও প্রতারক।
এসব ভাবতে ভাবতে দেখল সাব্বির কাশছে। ঠোঁটে রক্ত শুকিয়ে গেছে।
গোধূলির ভীষণ মায়া হচ্ছে। কোথায় রাগে ফেটে পড়বার কথা অথচ মনে হচ্ছে সাব্বির সত্যি বলছে।
সাব্বির কাতরাতে কাতরাতে বলল,
পানি পানি।
গোধূলি উঠে জগ থেকে পানি ঢেলে খাইয়ে দিলো।
সাব্বির বুঝল ওর মন নরম হতে শুরু করেছে।
চট করে গোধূলীর পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
আমাকে বাঁচাও গোধূলী। একটাবার বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার জন্য পাগল। এসব আমাকে ফাঁসাতে সাজানো নাটক। নওমি শুরু থেকেই আমাকে কাছে পেতে চেয়েছিল কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি তাই শোধ নিতে এমনটা করেছে। কি এমন চেহারা ঐ মেয়ের। তোমার পায়ের নখের যোগ্য না। আর আমি কিনা তুমি থাকতে ওর জন্য এত বড় বিপদ ডেকে আনব!
সাব্বির মনে মনে ভাবল,বজ্জাত মেয়েছেলে,এতো তেল মাখতে হচ্ছে শুধু বিপদে পড়ে। একবার ছাড়া পাই তোর এই এতো দেমাগ এর কি যে করব দেখবি।
গোধূলির মন গলে গেল। একবার শুধু বলল,
আমার প্রিয় গয়নাটা হারাতে হবে। কেন যে এমন উলটা পালটা সিচুয়েশনে পড়লেন।
তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেব জানপাখি বৌ আমার।
গলার হার দিয়ে সাব্বিরকে ছাড়িয়ে বাসায় ফিরল গোধূলী। জিনিসপত্র সব ওভাবেই থাকল। কিছু আর আনতে পারলো না। পরাগ বলে দিলো আর যেন সাব্বিরকে এ বাড়িতে বা এলাকায় না দেখা যায়।
বাসায় ফিরতেই সাবেরা চিৎকার জুড়ে দিলেন,
এমা! একি অবস্থা হয়েছে। কিভাবে হলো?
গোধূলি বলল,
ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম। আপনার ছেলে বীরত্ব দেখাতে গেল,ওরা তখন মারধোর করেছে।
সাবেরা কান্নাকাটি শুরু করলেন।
আমার মনে তখনি কু ডাকছিল এতো রাতে বাইরে যাওয়া দেখে। তাও আবার এই রাতে কুলখানির দাওয়াত। মায়ের ভাবনা মিথ্যা হয়না। কতবড় বিপদ হলো। মেয়েমানুষ কোথায় একটু স্বামীকে ঘরমুখো করবে তা না,স্বামী ডাকল আর উনিও এই রাতে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। এমন অলুক্ষণে মেয়ে থাকলে আরও কত কি যে হবে।
সাব্বির মায়ের চিৎকার শুনে বিরক্ত হলেও চুপ থাকল। গোধূলিকে বকছে বকুক। খুব চ্যাটাং চ্যাটাং করছিল মেয়েটা। সে বিপদে পড়েছে আর উনি উদ্ধার করেছে বলে একেবারে সাপের পাঁচ পা দেখছে। একগাদা কৈফিয়ত দিতে হয়েছে এই বাচ্চা মেয়েকে। পায়ে পর্যন্ত ধরিয়ে নিয়েছে। এবার শুনুক কথা। আর সুস্থ হয়ে নিলে ওর আসল রুপ দেখবে গোধূলী। একে দিয়ে কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। শুধু শুধু ঘাড়ে চেপে বসে আছে।
রাতের খাবার খেয়ে জ্বরের আর ব্যথার ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সাব্বির।
গোধূলির ঘুম এলো না। তখন সাব্বিরের কথায় ভুলেছে ঠিকই কিন্তু এখন এই নিশুতি রাতে ঘুমাতে এসে ওর মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকল।
সত্যি কি সাব্বিরকে ফাঁসানো হয়েছে নাকি ওর চরিত্রে দোষ আছে। সোহান ছেলেটার কাছে নাকি প্রমাণ আছে। ওতো দেখলেই পারত। আবার একবার মনে হচ্ছে হতেওতো পারে। আজকাল এভাবেই তো অনেক মেয়ে পুরুষ মানুষকে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করে। হয়তো ওর স্বামী তেমন কোনো ফাঁদে পড়েছিল। যাক অল্পে রক্ষা পাওয়া গেছে। এসব ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে বাবার বাড়িতে ওর মুখ থাকতো না।
তবে ও ঠিক করল এবার থেকে একটু খোঁজ খবর রাখতে হবে স্বামীর। দিনকাল আসলেই ভীষণ খারাপ।
(চলবে)