ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১১
সাব্বির আজ চট্টগ্রাম যাবে। অফিসের কি একটা কাজ আছে। গোধূলিকে সাবধানে থাকতে বলল। কিছু লাগলে পাশের স্টোর থেকে আনিয়ে নিতে বলল।
এমনিতেও গোধূলিকে মাঝে মাঝেই একা থাকতে হয়। কিন্তু আজকের বিষয়টা আলাদা। এই শহরের বাইরে যাচ্ছে সাব্বির। গোধূলির একটু অস্থির লাগছে। ও বলল,
আমিও যাই আপনার সাথে?
তুমি গিয়ে কি করবে?
না মানে একা থাকতে ভয় করবে।
কি যে বলো,ভয় কিসের? সিকিউরিটি গার্ড আছে, বাড়িওয়ালা আঙ্কেল তো বেশ ভালো। কোনো সমস্যা হবে না আশা করি। আর তুমি তো একাই থাকো মাঝে মাঝে।
আমি গেলে কি সমস্যা?
আমি সারাদিন মিটিং এ থাকব। শেষ হলেই রাতের বাসে উঠব। শুধু শুধু তুমি কেনো জার্নি করতে যাবে বলোতো। একটাইতো দিন।
আচ্ছা ঠিক আছে যান। জলদি চলে আসবেন।
আচ্ছা আসব।
একদিনের কথা বলে গেলেও তিনদিন পেরিয়ে গেল। সাব্বিরের কোনো খবর নেই। তার ওপর আবার ফোনে কল যাচ্ছেনা। ওর নাম্বার ব্লক দেখাচ্ছে। গোধূলি চিন্তায় পড়ে গেল। এমনতো কখনো হয়না।
দু’দিন অপেক্ষার পর গোধূলির আর ভালো মনে হলো না বিষয়টা। কেমন একটা সন্দেহ কুঁড়ে খাচ্ছে ওকে। আজকাল সাব্বির প্রায়ই নিজের বাসায় থেকে যায়। গোধূলির একাই এ বাড়িতে পড়ে থাকতে হয়। ছাদের ওপর এই রুমের একটাই মেইন দরজা। গোধূলির কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, ভীষণ ভয় পায় ও। আর এভাবে ব্লক করার কারণে আরও বেশি খারাপ চিন্তা মাথায় আসছে। সাব্বির কি ওর কাছে আর আসবে না!
তবে ওতো বাসার ঠিকানা জানে। এমন করলে গোধূলি বাসায় গিয়ে হাজির হবে এটাতো সাব্বির জানে। গোধূলি চট করে ঠিক করল এইটাই সুযোগ শশুড় বাড়িতে গিয়ে ওঠার। ফোনে না পেয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে বাসায় চলে এসেছে এটা বলা যাবে সাব্বিরকে।
ও পরনের কাপড় গুছিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী সাব্বিরদের বাড়িতে চলে গেল।
সাবেরা স্কুলে ছিলেন। ফিরে দেখলেন একটা মেয়ে ব্যাগ হাতে মাথায় ঘোমটা দিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গোধূলির নাম শুনলেও কখনো দেখেননি। তাই চিনতে পারলেন না।
কাছে আসতেই গোধূলি সালাম দিল,
আসসালামুয়ালাইকুম।
সালামের জবাব দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
কাকে চাই?
আমি গোধূলি।
এবার বুঝতে পারলেন। তবুও না চেনার ভান করে বললেন,
কোন গোধূলি? রাত্রির বোন গোধূলি?
জ্বি।
তা এখানে কি দরকার?
সাব্বির কি বাসায়? ওনার খোঁজে এসেছি।
নাতো, ওর কাছে কি দরকার তোমার!
উনি আপনাকে কিছু বলেননি?
কি ব্যাপারে?
আমাকে উনি বিয়ে করেছেন।
এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন সাবেরা। তার সন্দেহ আর গুজব সত্যি তাহলে। এই মেয়েকে বিয়ে করেছে তার ছেলে।
সাবেরা চারদিকে তাকালেন। কেউ আবার দেখলো কিনা বুঝতে পারছেন না। নাহ, আশেপাশে কেউ নেই।
কতক্ষণ হয় দাঁড়িয়ে আছো?
আধ ঘন্টা হবে।
আশেপাশের কেউ কিছু জানতে চেয়েছে?
না।
আচ্ছা ভেতরে এসো।
গোধূলি সাবেরার পেছন পেছন ভেতরে গেলো।
ভেতরে ঢুকেই সাবেরা বললেন,
কতদিন হয় বিয়ে হয়েছে?
তিনমাস।
কোথায় বিয়ে করেছ?
চট্টগ্রামে।
রেজিস্ট্রি হয়েছে? কাবিন কত?
গোধূলি বানিয়ে বলল,
দশ লাখ।
কেমন মেয়ে তুমি। বোনের পাত্রের সাথে পালিয়ে গেলে।
উনিইতো আমাকে পছন্দ করল।
অচেনা পুরুষ মানুষ পছন্দ করল আর তুমি পালিয়ে গেলে। বোনের কথা ভাবলেও না একবার।
গোধূলি চুপ থাকল। ভাবল এসব নিয়ে তর্ক করার দরকার নাই।
এখন এই বাসায় কি চাও? নিজেরা বিয়ে করছো যখন তখন একাই থাকতে। এখানে কেনো এসেছ?
উনাকে দু’দিন থেকে ফোনে পাচ্ছি না।
মানে কি, ও তোমার সাথে থাকে না?
থাকেন, দু’দিন হলো চট্টগ্রামে গেছেন অফিসের কাজে।
কাজে গেছে চলে আসবে। তারজন্য বাড়িতে চলে আসতে হবে?
একদিনের কথা বলে গেছেন এখন ফোনে আমার নাম্বার ব্লক করা।
সাবেরা ছেলের এই স্বভাব জানেন। আগে থেকেই কয়েকদিনের জন্য না বলে উধাও হতো ছেলে। তাই তাকে তেমন চিন্তিত দেখা গেলো না। বরং মনে মনে খুশি হলেন। এই মেয়ে সাব্বিরকে আঁচলে বাঁধুক এটা তিনি চান না। দু’দিন গেলেই ঘোর কেটে যাবে। কিন্তু এতগুলো টাকা কাবিন করতে গেলো কেনো!
তিনি বললেন,
তুমি বাসায় ফিরে যাও। এই বাড়িতে তোমাকে মেনে নেবার কোনো ইচ্ছা আমাদের নাই। সাব্বির তোমাকে একা বিয়ে করেছে তাই তোমাকে একাই ওর সাথে থাকতে হবে। তবে আমি বলি কি, যা করেছ করেছ। এখনো তেমন কিছু হয়নি। তুমি বাসায় চলে যাও। আমার ছেলের কতদিন তোমাকে ভালো লাগবে তার ঠিক নেই।
আমাকে বাসায় জায়গা দেবে না।
তাহলে যেখানে ছিলে সেখানে যাও।
উনি আসলেই চলে যাব। ততদিন এখানে থাকব।
সাবেরা বুঝলেন এই মেয়ে ভয় পাবার মেয়ে না। কেমন ঠাস ঠাস করে কথা বলছে। কোনো জড়তা নেই। ইচ্ছা করছে ঘাড় ধরে বের করে দিতে। কিন্তু কি না কি করে বসে। দেখা যাবে বাইরে গিয়ে সাংবাদিক ডেকে অনশন করবে। সেই নিউজ ভাইরাল হবে। মান সম্মান কিছু থাকবে না তখন। আজীবন ছেলের কুকীর্তি লুকাতে হয়েছে তাকে। এবারেও তাই করতে হবে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
আচ্ছা থাকো। তবে সাব্বির এলে সাথে সাথেই চলে যাবে। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। কেউ বললে বলবে আমাদের আত্মীয় তুমি। এখানে কোচিং করতে এসেছ।
আচ্ছা।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে রাত্রি দেখল বসার ঘরে বেশ কয়জন অচেনা অতিথি। মা ডাইনিং টেবিলে নাশতার প্লেট সাজাচ্ছেন । রাত্রিকে দেখে বললেন,
এসেছিস,যাতো মা জলদি ফ্রেশ হয়ে আয়।
কি হয়েছে মা?
হঠাৎ করেই তোকে দেখতে এসেছেন এনারা। ছেলে ব্যবসা করে। অবস্থা ভালো। তোর আব্বার কলিগ রায়হান ভাইয়ের আত্মীয়।
এভাবে না বলে আসবে তাই বলে?
কি করব বল,এসে যখন পড়েছে তাড়িয়ে তো দিতে পারিনা।
রাত্রি বোঝে মায়ের এই অসহায় ভাবের কারণ। বেশ কয়টা ঘর এসেছে রাত্রির জন্য কিন্তু কেউ আগায়নি যখন শুনেছে ছোট বোন পালিয়ে বিয়ে করেছে। কিভাবে যেন রটে গেছে যে রাত্রির প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে গোধূলি। মেয়েকে নিয়ে তাই চিন্তায় আছেন নাজমা। বাবাও অসুস্থ হয়ে ছুটি নিয়ে বাড়িতেই আছেন। রাত্রির বিয়েটা হয়ে গেলে অনেকটাই টেনশন মুক্ত হবেন ওনারা। রাত্রি তাই কথা বাড়ায়না। ঘরে ঢুকে ব্যাগ রেখে বিছানায় বসে পড়ল।
রাত্রির কেনো জানি হঠাৎ আয়ানকে মনে পড়ল। কি আশ্চর্য ওর সাথে কি আয়ানের তেমন কিছু ছিল? অথচ মন খারাপ লাগছে ওর। খুব অভিমান হচ্ছে আয়ানের ওপর। এভাবে কেন চলে গেল ছেলেটা! অথচ থাকারও তো কথা ছিলো না। কি বোকা বোকা অনুভূতি হচ্ছে ওর!
রাত্রি গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলো। কিন্তু মনখারাপ ভাবটা গেলো না ওর। নাশতা নিয়ে ঘরে ঢুকে সালাম দিলো। রাত্রির খালাত ভাই কথা বলছে অতিথিদের সাথে। উনি নাশতার প্লেট নিজের হাতে নিয়ে রাত্রিকে বসতে বলল। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ছেলেও এসেছে। সাথে ছেলের মামা, দুলাভাই,বাবা আর বড় ভাই এসেছে। আরো এসেছে ছোট বোন। ওনারা রাত্রির নাম, পড়াশোনা কোথায় করেছে,এখন কোথায় চাকরি করে এসব জানতে চাইল।
ছেলে একপাশে চুপ করে বসে আছে। রাত্রি একফাঁকে দেখল ছেলেটাকে। শ্যামলা,বেশ স্বাস্থ্য ভালো। রাত্রি উঠে গেল একটু পর। ভীষণ মাথা ধরেছে ওর।
নাশতা করার পর ছেলের সাথে আলাদা করে কথা বলতে হলো রাত্রিকে। বাসার ভেতরের দিকের বড় বেলকনিতে দু’জনের বসার ব্যবস্থা করা হলো।
রাত্রি চুপ করে আছে। ছেলেটাই আগে কথা বলল।
আমি কামরুল, ভালো নাম মোহাম্মদ কামরুল হাসান। আপনার ভালো নাম?
আমার ভালো খারাপ একটাই নাম,রাত্রি।
আগে পরে কিছুই নাই?
জ্বি না।
ইসলামী নাম আছে কত ভালো ভালো। অন্তত মোছাঃ তো থাকতে হয়। শুধু রাত্রি নামটা একটু কেমন যেন। আচ্ছা হোক,আপনিতো স্কুলে মাস্টারি করেন?
জ্বি আমি টিচার।
আমাদের বংশে আবার চাকরি বাকরির বালাই নাই। চাকরি করা পোষায়না। কয়টা আর টাকা চাকরির। আমাদের কাপড়ের বিজনেস আছে।
আচ্ছা।
কাপড়ের ব্যবসা দেখে ছোট ভাবিয়েন না। বিশাল দোকান। একপাশে রেডিমেড, থ্রিপিস,শাড়ি,শার্ট প্যান্ট,আরেকপাশে থানকাপড়। আবার অনলাইন পেইজ আছে একটা। দুইটা বড় গোডাউন আছে।
বেশ ভালো।
দাদার আমলের ব্যবসা। খানদানি ব্যবসা বলতে পারেন।
রাত্রির বিরক্ত লাগছে। এই ছেলে তার দোকানের বাইরে আর কোনো কথাই বলছেনা।
অবশ্য আপনাদের বাসার পজিশন ভালো। এখানেও একটা শোরুমে দিলে ভালো চলবে।
রাত্রি মাথা নাড়ল।
আপনে বেতন কত পান?
কি ম্যানারলেস! বেতনের কথা এভাবে কেউ জানতে চায়? রাত্রি বলল,
এই চলে যায়।
যা ভাবছিলাম, বলার মতো না। মাস্টারির চাকরির আর কত বেতন! যাক,বিয়ের পর আর কষ্ট করতে হবে না। তাছাড়া আমার বাপ ভাইয়েরা মেয়েদের বাইরে কাজ করা পছন্দ করেনা। তাদের কথা হলো মেয়েরা করবে সংসার। আর রাতে স্বামীর মনোরঞ্জন। বাইরে গিয়ে পুরুষ মানুষের গাইগুতা খেয়ে টাকা কামানোর কি দরকার। এসব করবে বাজারি মেয়েলোকেরা। টাকা কামাই করবে পুরুষ লোক। যেই পুরুষ মেয়েদের কামাই করায় হেইডা বেডা না বেইট্যা।
রাত্রির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এ যুগে এসেও কি চিন্তা ভাবনা। রাত্রি বলল,
আপনি ভুল জানেন। ছেলেমেয়ে যেকেউ কাজ করলে সেটা খারাপ কিছু না। এটা আসলে আত্মসম্মানের বিষয়। স্বনির্ভর হবার বিষয়। মেয়েরা শুধু মনোরঞ্জনের খেলনা না।
আইচ্ছা থাক। এটা নিয়ে আলাপ না করি। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েমানুষ ভালো ভালো পোশাক আর গয়না পাইলেই খুশি। আমাদের বাড়ির মেয়েদের জামাকাপড়ের আল্লাহ দিলে বাহার দেখলে বুঝবেন। গাইট খুলে সেরা কাপড় আগে বাড়ির মেয়েরা রাখে। এইদিকে কোনো কিপটামো চলেনা।
রাত্রি হাসল। এই ছেলের জীবন কাপড়ের গাইটে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে নাকি আবার পড়াশোনাও করেছে। অথচ চিন্তা ভাবনায় তার কোনো ছাপ নাই।
ছেলেরা চলে গেল। রাত্রি কিছু বললো না। বাবা অসুস্থ। কোনো কিছু নিয়েই পরিবেশ খারাপ করা যাবে না। যা তার কপালে আছে তাই হবে। তার হয়তো এই ছেলের সাথে বিয়ে লেখা। বাসর রাতে এই ছেলে হয়তো তাকে যে বিয়ের শাড়ি দেয়া হয়েছে সেটার গুনগান করবে। শাড়ির সুতা,পাকারঙ এসব নিয়ে গল্প করতে করতে রাত ভোর হয়ে যাবে।
রাত্রি মনখারাপের মাঝেও হেসে ফেলল একা একা।
রাতে পাত্রের বাড়ি থেকে কল দিয়ে জানাল মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। আগামী শুক্রবার এনগেজমেন্ট করে ডেট ফাইনাল করতে চায় ওরা।
(চলবে)