অমানিশা পর্ব-১০

0
407

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১০

সাব্বির আর গোধূলির সংসার জীবনের একমাস কেটে গেলো।‌ সংসার বলতে গোধূলিকে একা একাই সারাদিন থাকতে হয়। টুকটাক রান্না আর ঐ একটা রুমে খাট,রান্নার হাড়ি পাতিল,কাপড় গুছিয়ে রাখা। সারাদিন আর কোনো কাজ নেই। গোধূলি মোবাইলে সময় কাটায়। ইউটিউবে রান্নার ভিডিও দেখে,নাটক সিনেমা দেখে। সাব্বির কে মেসেজ করে। সাব্বির অনেক দুষ্টুমি করে। মাঝে মাঝে নুড অবস্থায় ওকে দেখতে চায়। তখন গোধূলি দরজা জানালা লাগিয়ে ভিডিও কলে আসে। সাব্বির নেশা নেশা চোখে তাকিয়ে থাকে।

সাব্বির রোজ এই বাসায় থাকে না। যেদিন করে আসে অনেক রাত হয়ে যায়। কোনো কোনো দিনে নেশা করে আসে ও। মাতাল সাব্বির ভীষণ এগ্রেসিভ আচরণ করে বিছানায়। আরো কিছু অদ্ভুত আচরণ করে সাব্বির।‌কিছু পাতলা ফিনফিনে নাইটি এনেছে গোধূলির জন্য। রাতে ওসব পরে থাকতে হয় ওর সামনে। এসব অবশ্য গোধূলির খারাপ লাগে না।

বাড়িতে বিয়ের কথা কিছু বলেনি সাব্বির। মনিকে বারণ করে দিয়েছে কাউকে কিছু বলতে। এর ওর কাছে থেকে বাবা মা শুনেছেন যে গোধূলি নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে আর এর পেছনে তার ছেলের হাত আছে। সাব্বিরের বাবা জামশেদ ছেলেকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করেননি। তার ছেলেটা ছোট থেকেই উচ্ছৃঙ্খল। মুখে মুখে তর্ক করে। স্ত্রীকে বললেন, ছেলের কাছে থেকে ঘটনা কি তা শুনতে। সাবেরা ছেলেকে একদিন বললেন,

গোধূলির ঘটনাটা কি। ও নাকি পালিয়ে গেছে। ঘটক তোর কথা বললেন সেদিন। তুই জানিস কিছু?

নাতো আমি তো কিছু জানি না।

ছেলে এক কথায় না বলে দিল। তবে সাবেরার সন্দেহ দূর হলো না। ছেলে রাতে মাঝে মাঝে বাইরে থাকে। বলে অফিসের কাজে গাজীপুরে যেতে হয়। বিশ্বদ্যালয়ের কি একটা প্রজেক্ট শুরু হবে ওখানে। ওটার জন্যই ওদিকটায় থাকতে হবে মাঝে মাঝে। সাবেরা এটা ভেবে চুপচাপ থাকলেন যে বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়নি। ঐ মেয়েকে অন্তত বৌ করে ঘরে তুলে আনেনি ছেলে। খুব জলদি একটা সুন্দর চাকরি করে এমন মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে করাবেন ঠিক করলেন।

গোধূলি মোটামুটি যেসব না হলেই না সেসব কিছু কিনেছে। তবে আরও কিছু দরকারি জিনিস,ঘর সাজানোর জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে হবে। কিন্তু সাব্বির রাজি হয়না। বলে এখানে এত জিনিস কেনাকাটা করার দরকার নাই। কয়দিন গেলেই তো বাসায় চলে যাব আমরা।

পড়াশোনার বিষয়ে সাব্বির কিছু বলেনি। গোধূলিও চুপ থেকেছে। পড়তে তার ভালো লাগেনা আগে থেকেই। তবে এখন মনে হয় সংসার করাটাও কম ঝামেলা না।

তবে সাব্বির যখন রাতে কাছে টেনে নেয় তখন সব কিছু সুন্দর মনে হয়। এইতো সেদিন এসে একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল,

এটা তোমার জন্য। খুলে দেখো।
গোধূলি প্যাকেট খুলে দেখল একটা সুন্দর শাড়ি আর সাথে ম্যাচিং চুরি, কানের দুল।

এসব পরে আসো। বাইরে ঘুরতে যাব।
গোধূলি সেজেগুজে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেই লজ্জা পায়। ওকে ভীষন সুন্দর লাগছে। সাব্বির ওকে দেখেই বিছানা থেকে উঠে এসে ওয়াও বলে ওঠে। মোবাইলে অনেক ছবি তোলে নানা পোজে। তারপর বলে,

তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো লক্ষী বৌ?

কখনও না।

তোমার কাজলটা দাওতো।

কি করবে?

আহা দাওতো।

তারপর কাজলের পেন্সিল দিয়ে ওর থুতনিতে ছোট একটা দাগ কেটে বলে,

এতো সুন্দর বৌটার যেন নজর না লাগে কারও। কেউ যেন কেড়ে না নেয়।

এভাবেই দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটতে লাগল। সাব্বির ওকে একদিন বলল,

তুমি তো একা একাই থাকো। একটা কিছু করতে পারো তো।

কি করব?

এখানেই পাশে ছোটদের একটা কোচিং সেন্টার আছে। ওখানে পড়াবে? আমার এক বন্ধুর ওটা।

আমাকে নেবে ওখানে?

আমার বন্ধুরতো। বললেই নেবে।

গোধূলি রাজি হয়ে গেল। সারাদিন একা থাকার চেয়ে সময় কাটবে ওখানে গেলে। কিছু হাতখরচাও পাওয়া যাবে।

প্রায় দু’মাস কেটে গেল। সাব্বির সপ্তাহে দু-তিন দিন গোধূলির কাছে আসে। এ বাসায় আরো কয়জন ভাড়াটিয়া আছে। যেতে আসতে দেখা হয়। টুকটাক কথাবার্তা বলে দোতলার এক ভাবী। তবে সাব্বির কারো সাথে বেশি মিশতে নিষেধ করে দিয়েছে।

বাসার ছাদে ভাড়াটিয়াদের ওঠা মনে হয় নিষেধ। বাড়িওয়ালার এক ভাগ্নি আছে সে আসে মাঝে মাঝে। তবে গোধূলির সাথে কথা বলে না তেমন। একদিন গোধূলি নিজ থেকে জানতে চাইল,

আপু,আপনি ক’ তলায় থাকেন?

মেয়েটা বলল,

তিনতলায়। বাড়িওয়ালা আমার মামা।

আর কিছু না বলে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। গোধূলিও আর তেমন কথা বলল না। তবে একদিন সকালে ও ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। সাব্বির যখন অফিসে যায় গোধূলি ছাদের রেলিং এ দাঁড়িয়ে দেখে।

গোধূলি দেখল সাব্বির আর ঐ মেয়ে একসাথে বেরুল। তারপর দাঁড়িয়ে বেশ কিছু সময় কথা বলল দু’জন। সাব্বির কি যেন বলছে আর মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে সাব্বির আগে থেকেই চেনে ওকে। গোধূলির কাছে বিষয়টা কেমন যেন ঠেকল। ওর সাথে সেদিন কথাই বললো না মেয়েটা অথচ সাব্বিরের সাথে কত হেসে কথা বলছে।

একদিন কোচিং থেকে এসে দেখে ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে বাড়িওয়ালার ভাগ্নি বসে গল্প করছে সাব্বিরের সাথে। অথচ এসময়তো সাব্বির আসে না সাধারণত। গোধূলি সাব্বিরকে বলল,

আপনি কখন এসেছেন?

এইতো একটু আগে। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে।

আমিতো এই সময় থাকি না। তা ফোনতো দিতে পারতেন।

না মানে এদিকে একটা কাজ ছিল,জলদি শেষ হয়ে গেল তাই ভাবলাম আজ তোমাকে নিয়ে বাইরে যাব।

অথচ আমাকে না জানিয়ে বসে গল্প করছেন। আর আপনি এখানে? কোনো দরকার ছিল। আমার সাথেতো কথাই বলেন না অথচ আমার বরের সাথে দিব্যি কথা বলছেন একা ঘরে।

না মানে ছাদে এসে দেখলাম সাব্বির ভাই দাঁড়িয়ে তাই এলাম।

অমনি একা ঘরে পরপুরুষের সাথে হাসাহাসি করতে লাগলেন।

সাব্বির ভীষণ রেগে উঠল।

গোধূলি এটা কি ধরণের অসভ্যতা। এভাবে কেউ কথা বলে অতিথির সাথে। সরি বলো।

আমি কেনো সরি বলব। ভুল কিছু তো বলিনি।

মেয়েটা ডিসগাস্টিং বলে রেগে বেরিয়ে গেল।

সাব্বির মেয়েটার পিছনে পিছনে নিচে নেমে গেল।

গোধূলির বিষয়টা ভালো লাগল না। একা ঘরে মেয়েটা কেনোই বা ঢুকবে। আর এত হাসাহাসি করার কি আছে। আর এদিকে গোধূলিকে রেখে ঐ মেয়ের সাথে সাব্বির চলে গেল। ওকে বলল সরি বলতে। বৌয়ের থেকে বাইরের একটা মেয়ে বেশি হলো ওর কাছে!

সাব্বির ফিরল রাত করে। গোধূলি কোনো কথা বললো না। সাব্বির ওরজন্য গোলাপ নিয়ে এসেছে। কিন্তু গোধূলির মুখ দেখে বুঝল রেগে আছে। নিজেই সরি বলল তখনকার বিহেভের জন্য। গোধূলি নরম হলো।

আরো কিছুদিন পরের ঘটনা। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গোধূলি দেখল সাব্বির পাশে নেই। বেলকনিতে খুব আস্তে কারো সাথে কথা বলছে ফোনে। গোধূলি উঠে বসে কান পাতল। কার সাথে যেন রেগে কথা বলছে। গোধূলি উঠতে যাবে এমন সময় ঘরে ঢুকল সাব্বির।

ঘুম ভেঙ্গে গেলো?

হুম,কার সাথে কথা বলছিলেন।

আমার এক বন্ধু কল করেছিল।

ও আচ্ছা।

তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।

আরে না, সমস্যা নাই।

গোধূলি সাব্বিরকে বলল,

আমরা বাড়ি কবে যাব?

কেনো,এখানে কি সমস্যা হচ্ছে?

সমস্যা না তবে একা একা থাকতে ভালো লাগে না।

একটু সময় দাও। মাকে বলেছি বিয়ের কথা। বাবাকে বলা হয়নি এখনও। মা বলেছেন উনি বাবাকে বুঝিয়ে বলবেন। ক’টা দিন যাক।

আচ্ছা ঠিক আছে।

একদিন দুপুরে সাব্বির গোসলে গেছে। এমন সময় ওর মোবাইলে টুং শব্দে মেসেজ আসল পরপর কয়টা। গোধূলি দেখল ওর শাশুড়ি সাব্বিরের মা মেসেজ করেছেন। গোধূলি ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখল একটা মেয়ের ছবি পাঠিয়েছেন উনি।

নিচে লেখা,

এই মেয়েটা কেমন দেখতো। তোর পছন্দ হলে সামনের শুক্রবার দেখতে যাব।

গোধূলি কিছুই বুঝতে পারলো না। উনি তো জানেন যে গোধূলিকে বিয়ে করেছে তার ছেলে তাহলে এভাবে মেয়ের ছবি পাঠালেন কেনো। তাহলে কি সাব্বির বাড়িতে কিছুই জানায়নি। সাব্বির বের হয়ে দেখল গোধূলি ফোন হাতে বসে আছে।

আপনার মা মেসেজ পাঠিয়েছেন।

দাও দেখি।

সাব্বির মেসেজ দেখে গোধূলিকে বলল,

ও আচ্ছা। আমার মামাতো ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। ও আবার বলেছে যে আগে আমি দেখব। আমার পছন্দ হলে তবেই ও দেখতে যাবে। তাই মা আমাকে মেয়ের ছবি পাঠিয়েছেন।

কিন্তু গোধূলির মনে খচখচানি থেকেই গেলো। সাব্বির সত্যি বলছে না মিথ্যা বলছে এটা নিয়ে দ্বিধা থেকে গেল।
এদিকে বাসায় নিয়ে যাবার কোনো চিন্তাও নেই সাব্বিরের। প্রথমে গোধূলি ভেবেছিল এভাবে একার সংসার ভীষণ সুখের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শশুড় বাড়িতে যাওয়া দরকার। এখানে এভাবে পড়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। নিজের অধিকারের জায়গা বুঝে নিতে হবে ওকে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে