অমানিশা পর্ব-০৯

0
398

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৯

আয়ান টিচার্স রুমে বসে একটা বই পড়ছিল। রুহিয়া পাশে এসে বসল।

রাত্রি ম্যামের বাবাকে নাকি দেখতে গিয়েছিলেন,এখন কেমন আছেন উনি?

হুম, আঙ্কেল এখন মোটামুটি সুস্থ আছেন।

শুনলাম রাত্রির প্রেমিকের সাথে ওর ছোট বোন পালিয়ে গেছে,এই চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। কেমন পরিবাররে বাবা! এক ছেলেকে নিয়ে দুইবোনের টানাটানি।

এসব কে বলেছে আপনাকে?

আরে এসব কথা বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। বলতে হয়না। অদ্ভুত সব কাহিনী তো বুঝলেন না!

আমরা মনে হয় টিপিক্যাল বাঙালির মতো গিবত করছি।

আরে না সত্যি ঘটনা বললে দোষের কি? সবার জানা উচিত কে কোন পরিবেশ থেকে এসেছে।

আপনার কি মনে হয়না আপনি অযথাই একজনের নামে কুৎসা রটাচ্ছেন। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে অন্যের পরিবার নিয়ে এ ধরণের উক্তি করা একদম ছোট মনের পরিচয়। আর তাছাড়া যেখানে ওনার ওপর দিয়ে রীতিমত একটা ঝড় বয়ে গেছে। এসময় ওনাকে নিয়ে এমন আলোচনা একেবারেই অমানবিক।আশা করি আপনি আমার সাথে,না ভুল বললাম,অন্য কারো সাথে অন্যের‌ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এমন নিন্দা করে নিজের ছোট মনের পরিচয় দিবেন না।

রাত্রিকে দেখেই আয়ান হাসিমুখে এগিয়ে এলো। রাত্রি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

রাত্রি একটু কথা ছিলো আপনার সাথে।

আমার ক্লাস আছে।

বেশি সময় নেবনা।

দেখুন আয়ান আমার সাথে আপনার এতো কি কথা বলুনতো। আর কারো সাথে তো আপনি এতো গায়ে পড়ে কথা বলেননা?

এতো রেগে আছেন, কি হয়েছে? আর কি বলছেন এসব!

ঠিক বলছি। আপনার এমন গায়ে পড়ে কথা বলার জন্য আমাকে বিব্রত হতে হচ্ছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করুন।

কিন্তু আমিতো,,

আমি আশা করব দরকার ছাড়া আমরা কথা বলবো না। আমি আপনার বন্ধু না আয়ান। আমরা শুধু কলিগ। তাই ফর্মাল বিহেভ করবেন।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল রাত্রি।

আয়ান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

সাব্বিরের কাজিন মনির বর একটা গার্মেন্টসে এজিএম পোস্টে জব করে। মনি পুরোপুরি গৃহিণী। বেশ মিশুক মেয়েটা। এখনও বাচ্চা কাচ্চা হয়নি। এটা নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ মনখারাপ করে থাকে।
বিয়ের চার বছর হয়ে গেছে অথচ এখনও ছেলেপুলে হয়নি বলে শশুড়বাড়িতে কথা বলা শুরু হয়ে গেছে।

মনি গোধূলিকে বলল,

শোনো মেয়ে, তোমার বয়স কম। তবুও বিয়ে যখন করেছ বাচ্চা নিয়ে নিও। কনসিভ করলে এবরশন করাতে যেওনা। আমাকে দেখো, বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে কনসিভ করলাম। তোমার ভাইয়া বলল এত জলদি বেবি নেয়ার দরকার নাই। সে আরও কিছু সময় আমাকে একান্ত করে পেতে চায়। লাইফটা এনজয় করতে চায়। বাচ্চা হলে স্বামী স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়। তাই কাউকে বলতে নিষেধ করল। আমিও বাধ্য বৌয়ের মতো চুপচাপ এবরশন করালাম। আর এখন আর কনসিভ হচ্ছে না।

ভাইয়া কি বলে?

কি আর বলবে। এখনতো সবার সব কথা আমাকে হজম করতে হচ্ছে। ওতো সেসব কথা ভুলে গেছে। নিজের দোষটা স্বীকার করেনা। পুরুষগুলো এমনি। যতক্ষণ তুমি পুরোটা বিলিয়ে দেবে ততক্ষণ ভালো। আর কিছু ঘাটতি হলেই মুখ ফিরিয়ে নিতে সময় লাগে না। গোধূলির মায়া লাগল মনির জন্য।

মনি বেশ গোছানো মেয়ে।‌ পুরো বাড়ি ঝকঝক করছে। অল্প কিন্তু রুচিশীল আসবাব দিয়ে পুরো বাসা সাজিয়েছে। প্রত্যেক রুমে আলাদা আলাদা পর্দা টানানো তার সাথে ম্যাচিং বিছানার চাদর। বোঝা যায় বেশ শ্রম দেয়া হয়েছে বাসা সাজাতে। গোধূলি মনে মনে ভাবে সেও এভাবে বাসা সাজাবে। সারাদিন মন দিয়ে ঘরের কাজ করবে। কোনো কোনো বিকেলে বাইরে ঘুরতে বের হবে দুইজন। রাতে সাব্বিরকে খুব খুব ভালোবাসবে। আর যত দ্রুত সম্ভব বেবি নিয়ে নেবে। পরে যদি আবার সমস্যা হয়।

সাব্বির পরদিন আর এলো না। গোধূলির অস্থির লাগছে। মনি যদিও ওর সাথে গল্প গুজব করছে, কিন্তু ওর বর আসার পর গোধূলি গেস্ট রুমেই কাটালো। লোকটা একটু গম্ভীর। কেমন রাগী রাগী ভাব ধরে থাকে চোখেমুখে। আর সবসময় মনিকে ধমকাতে থাকে।‌অবশ্য রাতে খাবার টেবিলে গোধূলির সাথে হাসিমুখে কথা বলল। কিসে পড়ে, বাসায় কে কে আছে সেসব জিজ্ঞেস করল।

গোধূলির কাছে ফোন না থাকায় সাব্বিরের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে না। একবার মনির ফোন থেকে কথা হয়েছে। গোধূলি ফোন করে বলল,

আপনার আব্বু কেমন আছেন?

তোমার শশুর? হুম ভালো এখন।

আপনি কবে আসবেন?

আজ একটু বিজি। কাল যাব। মনখারাপ করোনা। কোনো সমস্যা হচ্ছে ওখানে?

না।

আচ্ছা আমি দু একটা বাসা দেখেছি। কাল পরশু একটা কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

সাব্বির এলো পরদিন বিকেলে। হাতে মিষ্টি আর নাশতা নিয়ে এলো। ওগুলো মনির হাতে দিয়ে বলল,

একটু চা করে দেতো। আর গোধূলি রেডি হয়ে নাও। বাসা ঠিক হয়ে গেছে। আজকেই ওঠা যাবে।

মনি বলল,

আজকেই চলে যাবি?

হুম, বাসার কিছু কেনাকাটা আছে। ওকে নিয়ে কিনব।

চা নাশতা খেয়ে গোধূলিকে বলল,

তোমার কাছে কিছু টাকা হবে? আসলে এডভান্স করতে হয়েছে বাসাটার জন্য। হাত খালি হয়ে গেছে আমার।

হুম আছে আমার কাছে।

আচ্ছা চলো বেরিয়ে পড়ি।

গোধূলি ওর কাছে থাকা ক্যাশ টাকাটা পুরোটাই সাব্বিরকে দিল। নতুন বাসার জন্য একটা তোশক, দুটো বালিশ, কিছু হাড়ি পাতিল কেনা হলো। রাতে বাইরে খেয়ে বাসায় উঠল ওরা। বাকি টাকা সাব্বির নিজের কাছেই রাখল।

বাসা বলতে একটা তিনতলা বাড়ির ছাদে চিলেকোঠার একটা ঘর। সাথে টয়লেট। রান্নার জন্য আলাদা কোনো জায়গা নাই। ঘরেই একপাশে চুলা বসাতে হবে। সামনে বড় একটা ছাদ। সেখানে বাগান করেছে কেউ।

ঘরটায় রাজ্যের ময়লা চারপাশে। অনেক দিন খালি ছিলো হয়ত। মাকড়সার জাল পুরো ঘরে। টয়লেটও অপরিস্কার। সাব্বির বলল,

একটু পরিস্কার করে নিতে হবে তোমাকে।

গোধূলির ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কেনাকাটা করতে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়েছে। বেশ রাতও হয়ে গেছে। এখন এই ঘর পরিষ্কার করতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগল ওর। ঘুম ঘুম ভাব নিয়েই ঝাঁটা হাতে পরিস্কারের কাজ করতে লাগল। সাব্বির ‘একটু আসছি’ বলে নীচে চলে গেলো। ঘর টয়লেট পরিষ্কার করে গোধূলিকে গোসল করতে হলো। এত রাতে গোসল করাতে ঠান্ডা লেগে গেল। সাব্বির বিছানায় বসে মোবাইল টিপছে। কোনো কাজেই সাহায্য করলো না। শুধু তোশক বিছিয়ে দিলো। গোধূলি চাদর বিছিয়ে দিলো। বিছানায় শরীর দিতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে লাগল ওর। জ্বর আসবে বোধ হয়।

সাব্বির বলল,

আলোটা নিভিয়ে দিলে না?

গোধূলি আবার উঠে আলো নিভিয়ে বিছানায় আসতেই সাব্বির হাত বাড়াল গোধূলির দিকে।

গোধূলি বলল,

খুব শরীর খারাপ লাগছে আমার।
সাব্বির সেদিকে কান না দিয়ে গোধূলির ওপর চড়াও হলো।

গোধূলির এই প্রথম মনে হলো,
বিয়ে করাটাই একটা বিরাট ঝামেলা।

তরফদার সাহেব এর শরীর এখন বেশ সুস্থ। নিজে নিজে খেতে পারছেন, চলাফেরা করছেন। রাত্রির জন্য উপযুক্ত পাত্র দেখতে কিছু নিকটজনদের বলে রাখলেন। মেয়েটাকে খুব দ্রুত বিয়ে দিতে হবে। ছোট বোনের এমন কান্ড করার পর আর দেরি করলে নানারকম কথা রটবে। এমনিতেই নানা কথা বলা শুরু করেছে লোকজন।

রাত্রি স্কুলে গিয়ে দেখল টিচার্স রুমে খাওয়ার দাওয়ার আয়োজন চলছে। আয়া খালা নাশতার প্লেট সাজাচ্ছেন। রাত্রি জানতে চাইল,

কিসের জন্য এতো আয়োজন চলছে?

ঐযে আয়ান স্যার আছেন,উনারতো অন্য খানে ভালো চাকরি হইছে।‌ স্যারতো এই চাকরি ছাইড়া দিছে। তাই তারে বিদায় দেবে আজ।

রাত্রি অবাক হয়ে গেলো। এত বড় একটা খবর অথচ ও জানেই না। আয়ান একবারও তো বললো না ওকে। অবশ্য রাত্রি যে রুড বিহেভ করেছে তাতে করে ওকে না বলাই তো স্বাভাবিক।

তবুও রাত্রির কষ্ট হচ্ছে। আয়ান চলে যাচ্ছে আজ। কি আশ্চর্য ওর চোখ এমন ভিজে যাচ্ছে কেনো। খালা কি মনে করবে। রাত্রি দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলো।

আয়নায় দাঁড়িয়ে চোখেমুখে পানি দিলো রাত্রি। কি আশ্চর্য! এই ছেলের জন্য ওর এমন অনুভূতি কেনো হচ্ছে হঠাৎ! শুধু মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে ও।

চা নাস্তার পর্ব শেষে স্কুলের কমিটির সভাপতি,হেডস্যার সবাই অভিনন্দন জানিয়ে কিছু কথা বলল। আয়ান সবার শেষে সবার কাছে বিদায় নিল। বিসিএস এর প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছে ও। ওর হাতে সবাই টুকটাক কিছু না কিছু গিফট দিচ্ছে। রাত্রি তো জানেই না। ও কিছুই দিতে পারলো না। আয়ান একবারও ওর কাছে এলো না। সেদিনের পর থেকে কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে ছেলেটা। রাত্রির সাথে আর তেমন কথাবার্তা বলেনি। রাত্রি নিজ থেকে কাছে গিয়ে বলল,

অভিনন্দন। আমিতো জানতাম না। তাই কিছু দিতে পারলাম না।

না ঠিক আছে। ভালো থাকবেন।

এটুকু বলেই আয়ান অন্যদিকে চলে গেল।‌সবার‌ সাথে একে একে কথা বলল আয়ান। রুহিয়া হাসিমুখে একটা ফুলের বুকি নিয়ে আয়ানের হাতে দিল। আয়ান হাসিমুখে ওটা নিলো। দু’জন কথা বলল বেশ খানিকটা সময়। রাত্রির খারাপ লাগছে কেনো। ওর কি হিংসা হচ্ছে। ছিঃ এমনতো উচিত না।

রাত্রি ক্লাসে চলে গেল। কি আশ্চর্য! ক্লাসে মন বসলো না ওর। শুধু মনে হচ্ছে ছেলেটা এতো ভাব দেখালো ওর সাথে!

রাত্রি ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো। টিচার্স রুমে এসে দেখল আয়ান নেই।

দপ্তরীর কাছে জানতে চাইল‌,

আয়ান স্যারকে দেখেছেন?

স্যারতো চলে গেছেন।

রাত্রির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে