ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৩
সাব্বিরের বাবা জামশেদ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। মা সাবেরা হেলথে চাকরি করেন। বাড়িতে সাব্বির তার পছন্দের কথা বলা মাত্রই সবারই মনমেজাজ খারাপ। সাব্বিরের বাবা ছেলেকে কিছু বললেন না। কিন্তু বৌয়ের ওপর রাগ দেখালেন।
কি এক ছেলের জন্ম দিয়েছ। সারাজীবন শুধু মান সম্মান খেলো আমার। সবসময় সবজায়গাতেই ছোট হতে হয় তোমার ছেলের জন্য। সারাটা জীবন শুধু চাকরি চাকরি করেই কাটিয়ে দিলে। ছেলেকে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারলে না।
হুম আমি চাকরি করেতো নিজের একার জন্য সব করেছি। তোমার অল্প আয়ে কিভাবে সংসার চালাতে যদি না আমার বেতনটা হাতে পেতে।
আল্লাহ্ ঠিকই দিন পার করত। কিন্তু টাকা টাকা করে ছেলেটাই মানুষ হলো না। শুধু শিক্ষিত হলেই হয় না, সুশিক্ষিত হতে হয় বুঝলে। ছেলে পড়ালেখা করেছে ঠিকই কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষাটা পায়নি।
হুম এখন সব দোষ আমার। ভালোই বলেছ।
ছেলের জন্য ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বেশ মনকষাকষি হলো। জামশেদ ঘটকের কাছে শুনেছেন মেয়ের বাবা যা তা বলেছেন এইরকম করার কারণে। তিনি যে ফোন করে সরি বলবেন সেটাও করা হয়নি। শুধু শুধু একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো।
সাব্বিরের মায়ের মনটাও খারাপ হয়েছে। ওনার খুব ইচ্ছে ছিল চাকরিজীবি মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে দেবেন। সাবেরার বোনের মেয়ে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তার সাথে বিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সাব্বিরের বাবার একদম মত নেই নিজেদের ভেতর বিয়ে দেবার। ওনার ইচ্ছাতে মেয়ে দেখা শুরু করা হয়েছে।
রাত্রি মেয়েটা খুব একটা খারাপ ছিলো না। ছবিতে দেখেছেন উনি। তাছাড়া মেয়েটা জব করে। সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। ইনশাআল্লাহ সরকারি চাকরি হয়েও যাবে। এমন মেয়ে বৌ হলে সমস্যা ছিল না।
অথচ তার ছেলে কিনা ঐ মেয়ের ছোট বোনকে পছন্দ করে বসে আছে। মেয়ে পড়ে মাত্র টেনে। বিয়ের পরে পড়াশোনা কতদূর কি করবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই মেয়ে বৌ হয়ে আসলে কিভাবে যে এডজাস্ট করবে আল্লাহ জানেন। সবাইকে বড়মুখ করে কি বলবেন বৌমা কি না পড়ে সবে মাত্র ক্লাস টেনে।
বিষয়টা নিয়ে সাব্বিরের সাথে কথাকাটাকাটি হয়ে গেলো সাবেরার।
এইটা কি হলো। এত বড় হয়ে এমন অবিবেচক এর মতো কাজ কেউ করে। তুমি কি সারাজীবন শুধু জালিয়েই যাবে। শেষ বয়সে এসেও একটু শান্তি দিবেনা আমাদের?
এখানে অশান্তির কি হলো মা, বিয়ে করে সংসার করব আমি তাই আমার যাকে পছন্দ তাকেই কি বিয়ে করা উচিত নয়? আর সবসময় খোঁটা দাও কেনো। পুরোনো কাসুন্দি ঘেটে কি শান্তি যে পাও তোমরা! এখন আমি আর ছোট না যে যখন যা খুশি তাই বলবা? একটু বুঝে শুনে কথা বলতে পারো না?
তুমি লোক হাসানো কাজ করবে, আর বুঝেশুনে কথা বলতে হবে আমাকে! বড়বোনকে দেখতে গিয়ে ওর কমবয়সী ছোট বোনকে পছন্দ করেছো। এটা শুনলেতো সবাই হাসাহাসি করবে। তোমার অভিভাবকরা সবাই দেখে এলো । তুমিও ছবি দেখেইতো যেতে রাজি হলে। তাহলে এখন এমন করলে মুখ থাকে? কি ভাবল লোকগুলো! ছিঃ!
এতো কিছু জানি না। আমার ঐ মেয়েকে পছন্দ হয়নি। হয়েছে ছোটজনকে। বিয়ে করলে ঐ ছোট মেয়ের সাথেই হবে। না হলে ওখানে কথা বলার দরকার নাই। আর এবার থেকে তোমরা দেখার আগে আমি মেয়ের সাথে আগে কথা বলব।
এইটা কেমন কথা। এইটুকু একটা মেয়ের সাথে তোমার এডজাস্টমেন্ট হবে? তোমার ভালো চাই আমরা বুঝেছ, তোমার শত্রু না।
এডজাস্টমেন্ট কেন হবে না। তোমার সাথে বাবার কি সংসার হয়নি?
আগের দিনের কথা বাদ দাও। তোমরা এ যুগের ছেলে মেয়ে। আর তাছাড়া মোহে পড়ে কিছু করোনা। বাস্তব জীবনটা অনেক কঠিন।
এতো কথার কি দরকার বলো। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। নিজের ভালো মন্দ বুঝতে পারি। তোমাদের মেয়ে দেখতে বলাটাই ভুল হয়েছে। যা করার আমিই করব। তোমাদের আর আমার বিয়েশাদী নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
কথা শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকে ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে দিল সাব্বির।
সাবেরা বুঝলেন, ছেলের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তার এই ছেলে ছোট থেকেই জেদি। যা বলবে তাই করে ছাড়বে। ছোট থেকেই নানা রকম অঘটন ঘটিয়ে চলেছে। শুধু তাদের চেষ্টায় পড়াশোনা করেছে। তা নাহলে যে কি করে বেড়াত।
সাব্বিরের বাবা বললেন,
সাবেরা,ছেলে বড় হয়েছে। এখন আর জোর করে ওর ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না। যখন শাসন করার সময় ছিল তখন ছেড়ে রেখেছ। লতোমার ছেলে কোন কালে আমাদের কথা শুনেছে । তার থেকে চুপচাপ থাকো। অযথা তর্ক করতে যেও না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে এমনটাই হয়।
সাবেরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কথা সত্য, তিনি সময়মতো ছেলের রাশ টেনে ধরেননি। এখন কিছু হাতে নেই।
সাব্বির ভেবেছিল ঘটককে দিয়ে বলে কয়ে সম্বন্ধটা করতে পারবে। দরকার হল এখন আপাতত আকদ করা থাকবে। পরে পরীক্ষার পর তুলে নেবে। কিন্তু মেয়ের বাবা একেবারেই না করে দিলেন। আর তাছাড়া ওর নিজের বাবা মাও বিষয়টা সহজভাবে নেয়নি।
সাব্বিরের এখন গোধূলির বিষয়টা একটা চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে। পাত্র হিসেবে সে প্রথম শ্রেণীর। তারমতো ছেলে টেনে পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে এটাতো ঐ পরিবারের ভাগ্য। অথচ মেয়ের বাবা সরাসরি না বলে দিয়েছে। শুধু তাই না নানারকম কটু কথাও বলেছে তার সম্পর্কে ঘটককে। ঘটক বলে দিয়েছে এই বাড়িতে আর তার বিয়ের কথা বলা সম্ভব না। অন্য কোনো মেয়ে দেখাবে। কিন্তু সাব্বিরের এখন আরও বেশি জেদ চেপে গেছে। এই মেয়েকে বিয়ে করবে যেভাবেই হোক। তাই আজ গোধূলির সাথে দেখা করতে এসেছে। মেয়েকে একবার বাগে আনতে পারলে আর কাউকে লাগবে না। আর তারমতো ছেলেকে কোনো মেয়ে সহজে রিফিউজ করতে পারবে না।
দেখা করতে এসে সাব্বির গোধূলির মুখ দেখেই বুঝল যে এই মেয়ে রেগে নেই। বরং ওর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। না হলে দাঁড়িয়ে কথাই বলতো না।
সাব্বির গোধূলির কাছে এসে বলল,
কেমন আছো গোধূলি?
আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি এখানে! কোনো সমস্যা?
হুম, সমস্যা তো আছে। বাসায় যাচ্ছো?
না, প্রাইভেট আছে, ওখানে যাব।
আজ না গেলে হবে না? তোমার সাথে একটু বসা দরকার।
কেনো?
তুমি শুনেছো তো আমার কাকে পছন্দ হয়েছে।
গোধূলি লজ্জা পেয়ে গেল। বলল,
জ্বি শুনেছি।
তোমার বাসায় সবাইতো ভীষণ ক্ষেপে আছে আমার ওপর। তুমিও কি রেগে আছো আমার ওপর?
না,আমি রাগ করিনি।
তাহলে চলো কোথাও একটু বসে কথা বলি।
গোধূলি একটু ভেবে বলল,
আচ্ছা চলেন।
বাইকে উঠতে সমস্যা নেইতো?
গোধূলি হেসে সাব্বিরের বাইকে উঠে বসল।
ওর ভালো লাগছে। সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সাব্বির এভাবে দেখা করতে আসবে ও ভাবতেও পারেনি। আজ সাব্বিরকে আরও বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে। একটা সাদা টিশার্ট আর নীল জিন্স পরেছে ও। চোখে সানগ্লাস, চুলগুলো এলোমেলো।
সাব্বির বলল,
কাঁধে হাত দিতে হবে। নাহলে পড়ে যেতে পারো।
গোধূলি আলতো করে সাব্বিরের কাঁধে হাত রাখল।
ওরা বসল একটা কফিশপে। সাব্বির গোধূলির পাশেই বসল। গোধূলিকে বলল,
কি খাবে?
একটা কিছু হলেই হবে।
এখানে ভালো কলিজা সিঙ্গারা বানায়। ওটা বলি?
আচ্ছা।
সাব্বির সিঙ্গারা আর কফি দিতে বলে গোধূলির দিকে ফিরল। কোনো ভনিতা ছাড়াই সরাসরি বলল,
বিশ্বাস করো আমার কোনো দোষ নেই। সেদিন তোমাকে দেখেই আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল।এত মিষ্টি একটা মুখ, তোমার হাসি,চোখ সবটা আমাকে পাগল করে দিয়েছে গোধূলি। আমি জানি তুমি অনেক ছোট। কিন্তু আমার মন সেসব ভাবেনি। আমি শুধু তোমার মাঝে হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। বলো এটা কি আমার দোষ?
সাব্বির এর মুখে এসব শুনে গোধূলির মাঝে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল। ওর ভীষণ ভালো লাগছে। এমন সুপুরুষ কারো মুখে এভাবে নিজের সৌন্দর্যের কথা শুনতে অন্যরকম লাগছে। এই এতো বড় একটা মানুষ কিনা তার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
গোধূলিকে চুপ দেখে সাব্বির বুঝল তার কথায় কাজ হচ্ছে। সে আবারো বলতে শুরু করল,
ন্যায় অন্যায় উচিত অনুচিত কিছুই কাজ করছে না আমার। শুধু তোমাকেই ভাবছি সবসময়। আচ্ছা আমি কি বেশি বুড়ো, তোমার পাশে কি এতোটাই বেমানান?
একটুও না। আপনি অনেক হ্যান্ডসাম।
গোধূলির প্রশ্রয় পেয়ে সাব্বির ওর হাত দুটো ধরল।
প্লিজ গোধূলি,এখন সব তোমার ওপর নির্ভর করছে। তোমার আমার বাসায় কেউ চায় না তোমাকে আমি বিয়ে করি। এখন তুমি বললেই আমরা নিজেরাই কিছু করতে পারি। তুমি যদি বলো তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাব। তোমাকে এতো সুখে রাখব তুমিও শুধু আমাকেই চাইবে।
গোধূলির ইচ্ছে করছে রাজী হয়ে যেতে। কিন্তু এতো সহজেই হ্যা বলাটা ঠিক হবে না। একটু ভাব ধরে রাখতে হবে। তাই গোধূলি বলল,
আচ্ছা আপনি বাসায় এসে বাবাকে সরাসরি বলতে পারেন তো।
উনি মানবেন না। ঘটক আমাকে বলেছে।
তাহলে?
তোমার আমাকে পছন্দ হয়নি?
হয়েছে।
তাহলে সমস্যা কোথায়। চলো আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি।
একা বিয়ে করব!
গোধূলি ইচ্ছে করেই অবাক হবার ভান করল। আসলে সে নিজেও এমন কিছু শুনতে চেয়েছিল।
হুম,তবে আমার বন্ধুরা থাকবে। তোমার কেউ থাকলে তাকেও আনতে পারো।
কিন্তু বাবা কখনো মানবে না। মেরেই ফেলবে। এটা করাটা একদম ঠিক হবে না।
একবার তুমি আমার বৌ হয়ে যাও,তারপর তোমাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না। তখন তুমি শুধু আমার।
আমিতো ছোট। বড়দের না জানিয়ে এত বড় কাজ করা ঠিক হবে না। নিজের ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়নি এখনও।
এবার সাব্বির আর একটু কাছে এসে গোধূলির কানের পাশের চুল সরিয়ে দিয়ে মুখটা কানের কাছে নিয়ে বলল,
একবার কবুল বলো, তোমাকে বড় বানিয়ে দেবার সব দায়িত্ব আমার।
সাব্বির এতো কাছে চলে আসায় গোধূলি কেঁপে উঠল। সাব্বির গোধূলির হাতদুটো তুলে নিয়ে চুমু খেলো আলতো করে।
বাইকে করেই গোধূলিকে বাসায় নামিয়ে দিলো সাব্বির।
একই সময়ে গোধূলির ফুফাতো ভাই তমাল ওদের বাড়িতেই আসছিল। সে গোধূলিকে সাব্বিরের সাথে দেখে ফেলল।
(চলবে)