অমানিশা
পর্ব : ২
রাত্রির বাবা ভীষণ রেগে গেলেন। একদিন এসে মুরুব্বিরা মেয়েকে দেখে পছন্দ করে গেলেন। আবার ছেলে রাত্রির ছবি দেখে পছন্দ করেছে। তারপরেও দেখতে এসে বড় মেয়েকে রেখে ছোট মেয়েকে পছন্দ করেছে ছেলে। তার ছোট মেয়ের এখনও বিয়ের বয়সই হয়নি। কি একটা বিশ্রী ঘটনা। সব রাগ উনি ওনার বোনের ওপর ঝাড়লেন,
কিসব ছেলের সম্বন্ধ আনো তুমি রেবু। কত বড় বেয়াদব ছেলে! একজনকে দেখতে এসে আরেকজনকে পছন্দ করে ছবি দেখার পরেও। আর তার ওপর বয়সে এত বড় হয়ে, শিক্ষিত হয়ে একটা নাবালিকা মেয়েকে পছন্দ করেছে!
রাত্রির ফুফু রেবু বলল,
আমার কি দোষ। আমাকেও তো ঘটক খোঁজ দিয়েছে ছেলের। অল্প জানাশোনা দিয়ে কি মানুষের ভেতরটা কেমন তা বোঝা যায় ভাইজান? আমিতো ভালো ভেবেই এগিয়েছি।
এসব ঘটক দিয়ে আসলে হবে না। সব খালি টাকার ধান্দায় থাকে।
তো এখন কি করবেন?
কি করব মানে! এই বেয়াদব ছেলের সাথে আর কোনো কথা নাই। অন্য জায়গায় ছেলে দেখব। তোর ঐ ঘটকের আনা ছেলে আর দেখার দরকার নাই। এবার থেকে নিজে খোঁজ না নিয়ে মেয়ে দেখাবো না আমি।
আমিও সেটাই বলি। নিজেরা খোঁজ নিয়ে এগোতে হবে। এভাবে কতবার আর মেয়েকে ছেলেপক্ষের সামনে বসাব। আমাদের মেয়েতো আর ফেলনা না। ছিঃ ছিঃ! এ যুগেও এমন কেউ করে নাকি। বড়টাকে রেখে ছোটজনকে পছন্দ করেছে। আর তাছাড়া গোধূলি বাচ্চা মেয়ে। বয়স হলে না হয় মানা যেত।
নাজমা বললেন,
উহু বড় হলেও মানা যেতো না। এই ছেলের নিয়ত আসলে খারাপ। ছবি দেখল তারপরেই না দেখতে আসছে। এখানে এসে আরেকজনকে দেখে মত পালটে ফেলল। বিয়ে হলে দেখা যেত পরে আবার অন্য কাউকে দেখে বৌকে আর ভালো লাগছে না।
ঠিকই বলেছো ভাবি। ঘটককে সোজা না করে দিচ্ছি আমি।
হুম তাই দাও। মেয়েতো আর পানিতে পড়েনি যে যার তার সাথে বিয়ে দিতে হবে।
যার মন বেশি খারাপ হবার কথা সেই রাত্রি একদম স্বাভাবিক আছে। ও ভাবল ভালোই হয়েছে। এমনতো হতেই পারে। এভাবে সময় চলে যাক। একটা সরকারি চাকরি পর্যন্ত বিয়েটা আটকে থাকুক। আর গোধূলিকে পছন্দ করেছে এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু না। গোধূলিকে দেখে ওর বয়স সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় না। বয়সটাই এমন যে একটু সাজলেই বড়দের মতো দেখায়।
নাজমা ভাবলেন মেয়ের মনে হয় মন টন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তাই উনি রাত্রির কাছে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
আজ স্কুল যাবি ?
হুম যেতে হবে। কালতো ছুটি নিলাম। কেনো কি হয়েছে?
না,আজ রেস্ট নিতি। তোর ফুফুর ওখানে যা বরং। মন ভালো হবে।
আমার মনতো খারাপ হয়নি। শুধু শুধু ছুটি নিবো কেনো!
আমি জানি তুই ছোট থেকেই এমন। খুব চাপা স্বভাবের। কষ্ট পাসনা মা। ঐ ছেলে আসলে ভালো না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।
হুম। তবে আমি কষ্ট পাচ্ছি না মা। তুমি টেনশন করিও না তো।
নাজমা ভাবলেন মেয়ে হয়তো তার কাছে বলছে না কিন্তু খারাপ তো লাগাটাই স্বাভাবিক। ওকে রেখে ছোট বোনকে পছন্দ করেছে। এটা ভালো লাগার মতো কোনো বিষয় না। বরং অপমানজনক। মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানালেন যে বাজে মানসিকতার এই ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়েটা হয়নি । এটাই ভালো হয়েছে। এরপর থেকে ছেলেপক্ষের সামনে গোধূলিকে যেতে দেবেন না এটাও ঠিক করলেন।
গোধূলিকে গতরাতেই খুব করে বকেছেন নাজমা।
সব দোষ এই মেয়ের। কে বলেছিল আগ বাড়িয়ে ঐ ছেলের সাথে কথা বলতে। আর এতো সাজগোজ করার কি দরকার ছিল। সবসময় সবকিছুতে পাকনামো না করলে হয় না তোমার?
আমি আবার কি করলাম। শুধু শুধু আমাকে কেনো বকছো মা?
শুধু শুধু বকছি? তোর জন্য কত বাজে একটা কাহিনী হলো। তোকে না দেখলেতো এসব কিছু হতো না।
আমাকে আগেই বলে দিতা,তাহলেইতো আমি যেতামনা ওদের সামনে।
সেটাই ভুল হয়েছে আমার।
মায়ের বকা খেলেও গোধূলির মন কিন্তু অতটা খারাপ হলো না। পাত্র যে আপাকে পছন্দ না করে ওকে পছন্দ করেছে এটা বরং ও উপভোগ করছে। বিষয়টা একটু অন্যরকম হলেও গোধূলির কিন্তু বেশ ভালো লাগল। সাব্বির ছেলেটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো। বয়স একটু বেশি কিন্তু এই বয়সের ছেলেরা অন্যরকম সুন্দর। এতদিন যাদের সাথে সম্পর্ক করেছে তারা সবাই ছেলে ছোকরা টাইপ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটু ভারী বয়সে ছেলেদের আসল পুরুষ মনে হয়। এতদিন এইভাবে কখনো ভাবেনি গোধূলি কিন্তু যখন থেকে শুনেছে যে সাব্বির আপাকে না, ওকে পছন্দ করেছে তখন থেকেই সাব্বিরকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।
সাব্বিরের কথা,হাসিমুখ,ওর কাছে কোন ক্লাসে পড়ে সেটা জানতে চাওয়া সবদৃশ্য নতুন করে কল্পনায় দেখছে। আর এখন মনে পড়ছে বেশকয়বার সাব্বির ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। দু’জনের চোখাচোখি হয়েছে। তখন না বুঝলেও এখন বেশ বুঝতে পারছে যে ছেলেটা ওকেই দেখছিল। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো ওর সেসব খারাপ না লেগে ভালো লাগছে। মনের মধ্যে অজানা এক অনুভূতি দোলা দিয়ে যাচ্ছে।
খুব গোপনে ও ভেবেও নিয়েছে যে বাবা বিয়েতে রাজি হয়ে গেছেন। ওর সাথে সাব্বির ছেলেটার বিয়ে হচ্ছে। পুরো বাড়িতে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনে বাড়িটা গমগম করছে। সুন্দর একটা লেহেঙ্গা পরেছে ও। পার্লার থেকে টুকটুকে বৌ সেজে এসেছে।সবাই খুব প্রশংসা করছে নতুন বৌয়ের। সাব্বির বাসর ঘরে ওর ঘোমটা তুলে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আরো অনেক কিছু ভেবে ভেবে ভীষণ ভালো লাগায় শিহরিত হচ্ছে গোধূলি।
অথচ বাসায় সবাই এমন রেগে আছে মনে হয় যেন ওকে পছন্দ করে মহাপাপ করে ফেলেছে ছেলেটা। ও কি পছন্দ করার মতো মেয়ে না। আপার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর ও। বয়স একটু কম কিন্তু আগেকার দিনে তো বর বউয়ের বয়স অনেক কমবেশি হতো। ওর দাদির যখন বিয়ে হয় তখন ওনার বয়স ছিল মাত্র বারো,আর তখন ওর দাদার বয়স ছিল ত্রিশ। তখন যদি এমন হতে পারে তাহলে এখন হলে দোষ কোথায়। আর তাছাড়া ওতো এতোটাও অবুঝ না। সব বোঝে,সব জানে। নারী পুরুষের সম্পর্কের গভীর,গোপন সবটাই জানা ওর। ওর সব বান্ধবীদের কাছেই স্মার্ট ফোন আছে। সেসবে সবকিছুই দেখা যায়। একদিন তনিমা লুকিয়ে ওর ফোন এনেছিল প্রাইভেটে। সেখানে ওরা কয়জন মিলে একটা এডাল্ট সাইটে ঢুকে কিছু ভিডিও দেখেছে।
গোধূলির পড়াশোনাতে একদম মন বসে না। মুখস্থ করতে সবথেকে বেশি বিরক্ত লাগে। ইশ! বিয়ে হলে অন্তত এসব পড়াশুনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। ওর সাথে পড়ত রিয়া নামের এক মেয়েরতো এইট পাশ করেই বিয়ে হয়ে গেলো নিজের চাচাত ভাইয়ের সাথে। রিয়া এখন সংসার করছে। পড়াশোনা আর করছে না। বেশ ভালোই আছে।
আসলে বাবা মার সমস্যা হলো আপাকে পছন্দ করেনি এখানেই। এখন এই ছেলেকে খারাপ বলছে। অথচ আপাকে পছন্দ করলেতো এর সাথেই বিয়ে দিতো আয়োজন করে। সবসময় ওর সাথে এমন হয় এ বাড়িতে।
রাত্রি ভীষণ স্বাভাবিক আছে। গোধূলি ভেবেছিল আপা ওর ওপর রেগে আছে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। সকালে রাত্রি খেতে বসে গোধূলিকে ডেকে বলল,
এই তোর পরীক্ষা কবে? পড়াশোনা কর ভালো করে।
পড়ছি আপা।
কোনো বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে আমাকে বলিস।
ঠিক আছে।
আজ স্কুল নেই?
আছেতো।
চল তোকে নামিয়ে দিয়ে যাব।
আচ্ছা চলো। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
দুই বোনকে একসাথে বেরুতে দেখে নাজমা হাফ ছাড়লেন। যাক সবকিছু ঠিক আছে। ওনার বড় মেয়েটা ভীষণ লক্ষী একটা মেয়ে। কোনো কিছু নিয়ে কখনো অশান্তি করেনা। সুন্দর করে ম্যানেজ করে নেয় । গোধূলি ছোট তাই একটু জেদী। একটু বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। বড় বোনের কাছে কিছু হলেও তো শিখবে দেখতে দেখতে। তিনি মনে মনে বললেন,
আলহামদুলিল্লাহ সবকিছুর জন্য।
গোধূলিকে স্কুলগেটে নামিয়ে হাতে একশ টাকার একটা নোট দিলো রাত্রি।
কিছু খেয়ে নিস টিফিনে।
টিফিন নিয়েছিতো।
আচ্ছা ঠিক আছে। ছুটির পর বাইরে থেকে ফুচকা খাস বন্ধুদের নিয়ে।
ঠিক আছে আপা।
রাত্রি রিকশা নিয়ে চলে গেল। ওর মনটা আজ হালকা লাগছে। এখুনি বিয়ে হলে অনেক নতুন নতুন ঝামেলা পোহাতে হবে। এই মুহূর্তে বাবার বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না ওর। যদিও বাবা মায়ের কথায় বিয়ে করতে রাজি হয়েছে কিন্তু পাত্রপক্ষের সামনে বসলেই কেমন একটা মানসিক চাপ কাজ করে। এই বুঝি সব ঠিক হয়ে বিয়েটা হয়ে যাবে।
ওর জন্য গোধূলি বেচারিকে কাল মায়ের বকা খেতে হলো। ওর নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে। তাই আজ বোনকে সাথে করে স্কুলে দিয়ে গেলো ও। যদিও এখন অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে ওকে। গোধূলির স্কুল একদিকে আর ওর স্কুল অন্য একদিকে।
রিয়াদ স্কুলের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। রাত্রি চলে যেতেই ডাকল গোধূলিকে,
এই গোধূলি,এই।
অন্যদিন হলে গোধূলির ভালো লাগত কিন্তু আজ একটু বিরক্ত লাগল রিয়াদকে দেখে।
রিয়াদ কাছে এসে বলল,
তোমার আপা নামিয়ে দিলো আজ হঠাৎ!
এমনিই এসেছে।
এই আজ স্কুল বাদ দাও। চলো একটা জায়গায় যাব।
আজ না। অন্য একদিন যাব।
আজ কি সমস্যা?
সমস্যা নাই।
তাহলে আজকেই চলো।
গোধূলির একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। ও বানিয়ে বলল,
আপা নিতে আসবে দুই ক্লাস পরে।
কেনো, কোথাও যাবে?
বাসায় একটু কাজ আছে।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে যাও। কাল সময় দিও।
আচ্ছা দেখি।
গোধূলি আর দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি করে গেটে ঢুকে পড়ল।
ক্লাসে গিয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে গতকালের ঘটনা খুব খুশি মনে খুলে বলল। ছেলে যে ভীষণ হ্যান্ডসাম,ওকেই বিয়ে করতে পাগল হয়ে গেছে এভাবে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলল। এটা যে এতো ফলাও করে বলার মতো বিষয় না সেটা ওর মাথায় এলো না। ব্যাগ থেকে সাব্বিরের ছবি বের করে দেখালো বন্ধুদের। রাত্রিকে যেই ছবি দেয়া হয়েছিল ওটা গতরাতে সরিয়ে রেখেছে ও।
সবাই দেখে খুব প্রশংসা করল। একজন বলল,
ওমা! সত্যি তো ছেলেটা হেব্বি দেখতে। কিন্তু বয়স তো বেশি।
আরেকজন বলল,
আরে স্টাবলিশ ছেলেদের বয়সতো বেশিই হবে একটু।
গোধূলির ভীষণ ভালো লাগল। ছুটির পর বাইরে এসে রিকশায় উঠবে এমন সময় পেছন থেকে কারো ডাক শুনে থামল গোধূলি। অবাক হয়ে দেখল সাব্বির একটা বাইকে বসে আছে। মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসছে গোধূলির কাছে।
(চলবে)