ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১
আজ ছেলেপক্ষ আসবে রাত্রিকে দেখতে। ছেলেপক্ষ বলতে ছেলে তার দু’জন বন্ধু সহ আসবে। ছেলের বাবা, বড় বোন, দুলাভাই,মামা আগে একদিন এসে দেখে গেছে । মেয়ে পছন্দ হয়েছে ওনাদের। ছেলে সেবার ছুটি পায়নি বলে আসতে পারেনি। আজ ছেলে মেয়ে দু’জন দু’জনকে দেখে নিলে কথা এগোবে। দিনতারিখ ঠিক করা হবে।
ছেলে অবশ্য বাইরে কোথাও বসতে চেয়েছিল। কিন্তু রাত্রির বাবার সেসব পছন্দ না। উনি মেহমানদের বাড়িতেই আসতে বলেছেন। মা গতকাল রাতে যখন রাত্রিকে বললেন,
কাল ছুটি নিস। কাল সাব্বির আসবে তোকে দেখতে।
রাত্রি অবাক হয়ে বলল,
কোন সাব্বির?
আরে ঐযে তোর বিয়ের কথাবার্তা চলছে যার সাথে।
ছেলের নাম যে সাব্বির এটাই রাত্রি জানতো না। একবার শুনেছে কিন্তু ওর মনেই নেই। এদিকে মা এমন করে নাম ধরে বলছেন মনে হয় কতদিনের চেনা এই ছেলে।
রাত্রি মাথা নেড়ে শুধু বলেছে,
ও আচ্ছা,আচ্ছা ছুটি নেব।
এই মুহূর্তে বিয়ে নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই রাত্রির।
একটা নামকরা বেসরকারি স্কুলে ম্যাথের টিচার হিসেবে জয়েন করেছে মাস তিনেক হলো। মাস্টার্স শেষ হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করছে। এর মাঝেই বাসা থেকে বিয়ের জন্য ছেলে দেখা চলছে। এ পর্যন্ত চারবার পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হয়েছে। নানা কারণে সেসব সম্পর্ক এগোয়নি। বাসায় সবাই চাইছে বিয়েটা দিয়ে দিতে। বয়স বেড়ে চলেছে। এই দেশে মাস্টার্স পাস করলেই মেয়েদের বুড়ি মনে করা হয়। রাত্রির মাস্টার্স শেষ হয়েছে প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। ওর ইচ্ছে একটা ভালো কোনো জব হলে তারপর বিয়ের কথা ভাববে। কিন্তু মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছে । জীবনে কখনো মা বাবার ইচ্ছের বাইরে কিছু করেনি । মা বাবার লক্ষী মেয়ে হিসেবে বরাবরই ভীষণ আদরের ও।
এই সম্বন্ধটা এনেছে রাত্রির ফুফু। এই পাড়ার উত্তর দিকে বড় রাস্তার ওপাশেই ওর ফুফুর বাসা।
রাত্রির বাবা তরফদার হোসেন একজন কৃষি কর্মকর্তা। তার চাকরি প্রায় শেষ দিকে। মা নাজমা হোসেন গৃহিণী। রাত্রিরা দু’বোন, রাত্রি বড়। ছোট বোন গোধূলি ওর নয় বছরের ছোট। নাটোর জেলা শহরে প্রায় আট শতাংশ জমি কিনে তিন বেডরুমের একটা একতলা বাসা করেছেন তরফদার হোসেন। পেনশনে গেলে দোতলার কাজে হাত দেবেন। মেয়েদের বিয়ের জন্য আলাদা করে টাকা রাখা আছে ব্যাংকে। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার।
আজ যেই ছেলেটা আসবে সে একটা বেসরকারি কলেজের একাউন্টেন্ট। দেখতে শুনতে বেশ ভালো।
ঘটকের দেয়া ছবি দেখেছে রাত্রি। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগার মতো দেখতে।
অবশ্য রাত্রিও দেখতে বেশ মিষ্টি। হাইট ভালো। আজকাল বাঙালি মেয়েদের হাইট এতো ভালো হয় না।
নাজমা হোসেন রান্নাঘরে ব্যস্ত। মেহমানদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতে হবে। শুধু নাশতা পানি দিয়ে মেহমান বিদায় করতে নারাজ উনি। ওনার কথা হলো বিয়ে হোক বা না হোক সেটা পরের কথা। ওনারা মেহমান। ওনাদের যেন আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি না হয়।
রান্না মোটামুটি শেষ। শুধু পোলাওটা বাকি আছে। মেহমান আসলে পরে ওটা বসাবেন।
গোধূলিও আজ বাড়িতে আছে। মুখে চন্দন লাগিয়ে ঘুরছে। রাত্রির থেকেও ওকে বেশি খুশি মনে হচ্ছে। লেখাপড়ার থেকে সাজগোজের দিকে বেশি ঝোঁক গোধূলির। যেকোনো ছুতো পেলেই হলো।
গোধূলি ক্লাস টেনে উঠেছে এবার। একেবারেই পেছনের সারির ছাত্রী। পড়াশোনায় একদম অমনোযোগী। বান্ধবী তরীর কলেজ পড়ুয়া বড় ভাই রিয়াদের সাথে রিলেশন চলছে আজকাল । সিরিয়াস কিছু না। ঐ যে আজকাল একটা রিলেশনে থাকতে হয় সেইরকম কিছু। এর আগে দু’জনের সাথে ব্রেক আপ হয়েছে।
নাজমা বেগম এর মাঝেই দু’বার ধমক দিয়েছেন মেয়েকে।
তোকে এত সাজতে কে বলেছে। এসে আমার সাথে একটু কাজ কর।
গোধূলি মুখ বাকায়ে বলেছে,
বাসায় লোকজন আসবে আর আমি কি ফকিরের মতো ঘুরব নাকি?
তোমাকে দেখতে তো আসছে না। খালি পাকনামো। আর আজকে ওসব জিন্স ফিন্স পরবি না বলে দিচ্ছি। একটা ভদ্র মতো কিছু পরবি।
জিন্স অভদ্র পোশাক তোমাকে কে বলল।
শুধু মুখে মুখে কথা। যা বলছি তাই কর।
নাজমা বেগমের মেজাজ খারাপ হলো। কিন্তু চুপ করে গেলেন। মেজাজ খারাপ হলে ওনার রান্না খারাপ হয়। তার এই মেয়ে হয়েছে অন্যরকম। সবসময় তিনি যা বলবেন তার বিপরীত কিছু করাই যেন গোধূলির কাজ। তিনি যদি ডানে বলেন তো মেয়ে যাবে বামে। বড় মেয়ের বেলায় এত ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কিন্তু এই মেয়ে তাকে জ্বালিয়ে মারছে।
নাজমা বেগম রান্নায় মন দিলেন।
গোধূলির মুড খারাপ হয়ে গেল। ছোট থেকেই মা রাত্রি আপুকে বেশি ভালোবাসে। এ বাড়িতে সবসময় বড় আপার গুনগান চলে। কোনো কিছু করতে গেলেই বাবা বড় আপার মত নেয়। অথচ ওকে কেউ দাম দেয় না। নিজের পোশাকটাও ইচ্ছে মত কিনতে পারে না গোধূলি। পড়াশোনায় না হয় একটু খারাপ তাই বলে সবসময় ওকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কেনো সবাই। বড় আপার সাথে তুলনা করে ওকে বোঝানো হয় যে ও একটা অপদার্থ।
যাকগে এসব নিয়ে মনখারাপ করে থেকে লাভ নেই। গোধূলি বড় আপার কাছে গেল।
আপা তুই সাজতে যাবি না?
কোথায় যাব?
পার্লারে।
কি যে বলিস। পার্লারে যেতে হবে কেনো!
এখনতো সবাই যায়। হালকা মেকআপ নিলে ভালো লাগবে।
শোন,আমি যেমন তেমনটাই যদি পছন্দ হয় সেটাই ভালো না? শুধু শুধু কৃত্রিম ভাবে সুন্দর সেজে কি লাভ,আমিতো স্টার জলসার সিরিয়ালের মতো রাতদিন সাজগোজ করে বেড়াবোনা বিয়ের পর। তাছাড়া সেজেগুজে কাউকে ইমপ্রেস করতে আমার মন সায় দেয়না।
গোধূলির ইচ্ছে ছিল আপার সাথে পার্লারে গিয়ে ও একটু মেকাপ করবে। তারপর কোনো একটা ছুঁতোয় ঘন্টাখানেকের জন্য রিয়াদের সাথে ঘুরতে বের হবে। এভাবে সেজে কখনো দেখা করেনি। সবসময় স্কুল এর পোশাক পরেই বের হয়েছে। রিয়াদ অবশ্য এমনিতেও ওর জন্য পাগল। একটু খাই খাই ভাব আছে। সেজে সামনে গেলে আরও পাগল হবে। এসব ভালোই লাগে গোধূলির। ছেলেটা অবশ্য একটু ছোঁক ছোঁক স্বভাবের। শুধু শরীরে হাত দিতে চায়। ওর অবশ্য খারাপ লাগে না সেসব। বরং আরো বেশি কিছু ইচ্ছে করে।
দেখতে দেখতেই বিকেলে হয়ে গেল। রাত্রি একটা তাঁতের শাড়ি পরল। হালকা কাজল আর পাউডার দিয়ে নিলো। এটুকুই ব্যস।
সাব্বির ওর দুই বন্ধুসহ এসেছে। রাত্রির ফুফুও এসেছে একটু আগে। নাশতা পর্ব শেষ করে ফুফু বললেন,
তোমরা বসে কথা বলো। আমি দেখি খাওয়া দাওয়ার অবস্থা কতদূর কি হলো।
সাব্বির আর ওর বন্ধুরা, গোধূলি আর রাত্রি রয়ে গেল বসার ঘরে। নামধাম জিজ্ঞেস করার পর টুকটাক আলাপ চলতে লাগল। সাব্বিরের বন্ধুরাই এটা ওটা জানতে চাইছে। আর সাব্বির আড়চোখে বেশ কয়বার রাত্রিকে দেখতে গিয়ে গোধূলির দিকেই চোখ গেল। বেশ চটপটে মেয়েটা। পোশাক আশাকেও বেশ স্মার্ট । রাত্রি ভীষণ চুপচাপ। কিন্তু সাব্বিরের একটু চটপটে মেয়েই বেশী পছন্দ। এরা বেশ মিশুক হয়। সব জায়গায় মাতিয়ে রাখতে পারে।
একটু পর খাবার টেবিলে ডাক পড়লে সবাই ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। খাওয়া শেষ হলে সাব্বির হাত ধুতে যাবে এমন সময় গোধূলি বলল,
আসুন আমার সাথে।
সাব্বির উঠে গোধূলির পিছে পিছে গেল।
বেসিনে হাত ধুতে ধুতে সেখানে টুক করে বলল,
আপনি কিসে পড়ছেন?
এমা! আপনিতো কিছুই শোনেননি তাহলে। একবার বললামতো।
ও খেয়াল করিনি। সরি।
না ঠিক আছে। ক্লাস টেনে এবার। আর আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।
আচ্ছা। কোন স্কুল?
পি এন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
ওহ।
খাওয়া শেষে আর কিছু সময় বসে ওরা বেরিয়ে পড়ল।
রাতে ঘটক ফোন করে জানালো ছেলে রাত্রিকে নয়, গোধূলিকে পছন্দ করেছে।
(চলবে)