অভিমান হাজারো অন্তিম পর্ব
আফসানা মিমি
অদিতির বেবি জন্মানোর ছয় দিন পরেই ওকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ওর বাচ্চাদের দেখাশোনা, লালন পালন করার জন্য ওর মাও এই বাসায় আসতে বাধ্য হলো। একমাত্র মেয়েকে বেবি জন্মানোর আগেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত বলার পরেও এ বাসার কেউ রাজী হয়নি। বিশেষ করে আদিল একদমই চায়নি অদিতিকে চোখের আড়াল করতে। তাই অদিতির মা খুব একটা জোর করার সাহস পাননি। মেয়ে যদি শ্বশুরবাড়িতেই ভালো থাকে তাহলে এতো চিন্তার কী আছে!? অদিতির মোটামুটি সেরে উঠতে মাস খানেক সময় লেগেছিল। তারপর থেকে আস্তে আস্তে পুরোপুরি সুস্থ হতে লাগলো। নিজের পছন্দানুযায়ী দুই ছেলের নাম রেখেছে আদনান ইফতিখার এবং আফনান ইমতিয়াজ।
ইয়াসমিন বেগম খুব একটা মনযোগ দিতে পারেন না নাতীদের প্রতি। সময় নিজের গতিতে চললেও তিনি নিজের মেয়ের এভাবে চলে যাওয়াটা আজও মেনে নিতে পারেননি। যদিও লাবণ্যর চলে যাওয়াটা সবাই আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু উনি তো মা! নিজের সন্তানকে কী করে ভুলে যাবেন!? দশ মাস পেটে ধরেছিলেন যে! নিজের নাড়ীর সাথেই যে যুক্ত ছিল এবং উনার রক্ত খেয়েই যে ধীরে ধীরে ছোট্ট প্রাণটা দিনকে দিন তাঁর অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল যে সে আসছে এই পৃথিবীতে। এতো সহজেই একমাত্র কলিজাটাকে কী করে ভুলে যাবেন উনি!? এখনও মনে পড়লে হু হু করে কান্না পায়। তাই বেশিরভাগ সময় একাকীত্বে ঘরে বসেই কাটান। সবকিছুই যেন উনার কাছে বিষাক্ত ঠেকছে।
অদিতির ঘরের একটা ঘর পরেই অতশীর ঘর। তাই আদিল বাসায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ যেতে পারে না বাচ্চাদের দেখতে। সে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেই অতশী বাচ্চাদের কাছে গিয়ে বসে থাকে। নিজেও অনেকটা ভারী হয়ে আসায় বাচ্চাদের বেশিক্ষণ কোলে নিয়ে থাকতে পারে না। একটুতেই কেমন হাপিয়ে যায়। তাই অদিতিও বুঝে অতশীর কাছে বেশি দেয় না। এমন নিষ্পাপ বাচ্চাদের মুখে দিকে তাকিয়ে থাকতে কী যে ভালো লাগে অতশীর। মনে চায় বিরতিহীন ভাবে খালি দেখেই যায় ওদের। বাচ্চাদের আঙুল নাড়িয়ে তাদের আকর্ষণ করানোর চেষ্টা করে। তা দেখে অদিতি হেসে দেয় মাঝেমাঝে। যখন বলে ‘ইশ! আমার বাচ্চাটা পৃথিবীতে কখন যে আসবে! কখন যে মন ভরে আদর করতে পারবো!’ তখন অদিতি একটু হেসে আবারো মুখ গম্ভীর করে ফেলে অতশীর চোখের আড়ালে। আল্লাহ্ তার দোয়াটা কবুল করলেই হয়!
…
আজকাল অতশী ঘুমের মাঝেই কেমন ছটফট করে। যার কারণে স্পন্দনের ঘুম ভেঙে যায়। অস্থির অতশীকে বুকের মাঝে চেপে ধরে আরো অস্থির হয়ে উঠে স্পন্দনের বুকের ভিতরটা। ঘূর্ণিঝড়ের মতো এক দমকা হাওয়া এসে মুহূর্তেই তাকে পুরো এলোমেলো করে দিয়ে যায়। রাতটা যেন কাটতেই চায় না। কোত্থেকে যেন একটা হারানোর করুণ সুর ভেসে আসে স্পন্দনের কানে। যা শুনে বেদনায় নীল হয়ে যায় তার ভিতর বাহির সবটা। ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে যায় তার আকৈশোরে দেখা লালিত স্বপ্নগুলো। মাঝে মাঝে অতশীকে তার ভিতরের বেদনার রঙে নীল হয়ে যাওয়া সব যন্ত্রণাময় শব্দগুলো উগরে ফেলতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে ‘কেন এই ক্ষণকালের জন্য আমার জীবনে এসেছিলে?! আর কেনই বা মায়া বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে স্বার্থপরের মতো চলে যাবে?! এসেছিলেই যদি আর কিছুদিন সময় নিয়ে আসতে পারলে না?! এই কটা দিন যে আমার একদমই পোষায়নি। বুকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছো। অথচ তা নিভানোর উপায় বলে দিয়ে যাবে না?! তুমি তো মরে গিয়ে বেঁচে যাবে। কিন্তু আমি! আমি কী করে বেঁচে থাকবো তুমিহীনা এই পৃথিবীতে?! বেঁচে থেকেও যে ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকবো তা কী তুমি জানো?!’ কিন্তু বলতে পারবে তো কথাগুলো!? সেই সুযোগ দিবে কী আল্লাহ্ তাকে!?
অতশীর ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে স্পন্দন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অবাক হয়ে গেল সে। স্পন্দন এখনও জেগে! ঘুমায়নি ও! এখন রাত কটা বাজে তা দেখার জন্য সিথানের পাশে মোবাইলটা খুঁজে। ওর নড়চড় টের পেয়ে স্পন্দন বলে
—“কী খুঁজছো?”
তার জবাব না দিয়ে বললো
—“কটা বাজে এখন?”
—“কেন?”
—“তুমি ঘুমাওনি এখনও?”
—“হ্যাঁ, ঘুম ভেঙে গেছে একটু আগে।”
—“তো ঘুমানোর চেষ্টা করবে না!”
—“ঘুম আসছে না। পুড়ছে খুব।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচুস্বরে জবাব দেয় স্পন্দন।
অতশী মাথা তুলে চিন্তিত হয়ে জানতে চায়
—“পুড়ছে! কী পুড়ছে? কোথায় পুড়ছে?”
অতশীর মাথাটা ফের বুকে চেপে ধরে বলে
—“এখানটাই পুড়ছে। এভাবেই থাকো চুপচাপ।
অতশীও চুপটি করে বুকের সাথে লেপ্টে রইলো। স্পন্দনের হৃদয়ের কম্পন বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। তা মনযোগ দিয়ে গুণার চেষ্টা করছে অতশী। কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ এতো দ্রুত কম্পিত হওয়ায় তা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ বুকে আঁকিবুকি করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো অতশী। ওর নিঃশ্বাসের গাঢ় ধ্বনি শুনতে পেয়ে স্পন্দন বুঝলো অতশী ঘুমিয়ে পড়েছে। একেকটা নিঃশ্বাসের শব্দ বুকে আছড়ে পড়ায় স্পন্দনের বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। সে নিজেও জানে না এভাবে আর কতদিন অতশীকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে পারবে। ভয়মিশ্রিত একটা অনুভূতি অনুভব করার পর পুরো শরীর তার অবশ হয়ে আসতে লাগলো। অতশীকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরলো বুকের সাথে। যেন বুকের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলবে এভাবে চেপে ধরে। স্পন্দন স্পষ্ট পাঁজর ভাঙার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। সে অতশীর মাথার চুলের ওপর একটা চুমু খেয়ে চোখটা বন্ধ করলো। ভীষণ জ্বলছে চোখদুটো। সেইসাথে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরটা। যে জায়গাটায় অতশীর বসবাস।
স্পন্দনের ঘুম ভাঙলো অতশীর অস্ফুট আওয়াজে। চোখটা কখন লেগে গিয়েছিল টেরই পায়নি। চোখ মেলে তড়াক করে উঠে বসলো সে। নজর ঘুরিয়ে দেখলো অতশী পেটে হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে চোখমুখ কুঁচকে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে স্পন্দন ওকে তুলে বিছানায় বসানোর চেষ্টা করে। কিন্তু অতশী বসা থেকে উঠতে পারে না। স্পন্দনের কাঁধে খামচি দিয়ে ধরে কোনমতে বলে
—“স্পন্দন…. পেটে অনেক পেইন হচ্ছে।”
অতশীর এ অবস্থা দেখে স্পন্দন দিশাহারাবোধ করতে শুরু করে। আচমকা কাঁচা ঘুম ভেঙে অতশীকে এ অবস্থায় দেখবে সে কল্পনাও করতে পারেনি। অতশীকে সামলাবে কী! তার নিজেরই হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে আগাম পরিস্থিতির কথা ভেবে। একটা অজানা ভয় এসে কলিজায় কামড়ে ধরার সাথে সাথেই টনক নড়ে ওকে যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে নিতে হবে।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
বিধ্বস্ত অবস্থায় মাথানিচু করে হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে স্পন্দন। পাশে তার মা-ও চিন্তিত মুখে বসে আছে। মনে মনে উনি আল্লাহর নাম জপ করছেন একাধারে। অতশীকে হাসপাতালে আনার পর ডাক্তার চেক করে ওর অবস্থা দেখে বলেছিল কন্ডিশন বেশি ভালো না অতশীর। পেট শক্ত হয়ে যাওয়ায় সিজারিয়ানের মাধ্যমে বেবি ডেলিভারি করতে হবে। অতশীকে অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে নেওয়া হয়েছে ঘন্টা দেড়েক হলো। টেনশনে স্পন্দনের ঘাম ঝরছে কুলকুল করে। বিয়ের প্রথম প্রথম অতশীর সাথে বেশ বাজে বিহেভ করেছিল স্পন্দন। যার কারণে এখন তা মনে করে অপরাধবোধে ভুগছে সে। শত সহস্রবার মনে মনে একটা কথা-ই জপ করে যাচ্ছে। একটা সুযোগ, শুধুমাত্র একটা সুযোগ যাতে আল্লাহ্ তাকে দেয় অতশীর কাছে তার সকল অপরাধের ক্ষমা চাওয়ার জন্য। নয়তো সে কোনদিনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।। আর না পারবে অতশীর কাছ থেকে ক্ষমা না পেয়ে বেঁচে থাকতে। এ বেঁচে থাকাটা মরে যাওয়ার চেয়েও অধম মনে হবে তার কাছে।
বেশ কিছুক্ষণ হলো অয়ন এসেছে স্পন্দনের কাছে। অতশীর খবর শুনে আফরাও আসার জন্য জেদ ধরেছিল। কিন্তু ওর অবস্থাও মোটামুটি শোচনীয়। তাই অয়ন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে বাসায়ই রেখে এসেছে অরুনিমার দায়িত্বে। বলে এসেছে যেন বেশি টেনশন না করে। ফোন করে অতশীর খবর তাকে জানানো হবে। স্পন্দনের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রাখলো অয়ন। তার দিকে ফিরে তাকানোর পর চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল টেনশন না করতে। আল্লাহ্ ভরসা।
আরো মিনিট ত্রিশেক পার হওয়ার পর অটির লাইট বন্ধ হয়ে গেল। স্পন্দন সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। তাই লাইট বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই সে সেদিকে দৌড় লাগালো। ততক্ষণে ওর পিছন পিছন বাকি সবাইও এসে দাঁড়ালো। ডাক্তারের বিষণ্ণ মুখটা দেখেই যেন স্পন্দনের হৃৎপিণ্ডটা অজানা একটা ভয় এসে খামচে ধরলো। এলোমেলোভাবে জিজ্ঞাসা করলো
—“ডক্টর… ডক্টর অতশী কেমন আছে? ও… ও ঠিক আছে তো ডক্টর?”
ডাক্তার স্পন্দনের দিকে প্রথমে তাকিয়ে বাকি সবার দিকে তাকালো। তারপর আবার স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বললো
—“য়্যুর ওয়াইফ হ্যাজ গিভেন বার্থ টু আ ডটার।”
ডাক্তারের কথাটা যেন স্পন্দনের কানে যায়নি। তেমন বিধ্বস্ত অবস্থায়ই আবারো ব্যতিব্যস্ত হয়ে ধরা গলায় বললো
—“আমার স্ত্রী কেমন আছে ডক্টর?”
ডাক্তার একটা দীর্ঘশাস ফেললো। তাদের মন খুব শক্ত রাখতে হয় এই পেশায়। কেননা রোগী মারা গেলে অবলীলায় বলতে হয় ‘শী ইজ নো মোর।’ এখনও তাকে অবলীলায় এই কথাটা বলতে হবে। একবার স্পন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথানিচু করে বললেন
—“বাট স্যরি, উই কুডন্ট সেভ য়্যুর ওয়াইফ। শী ইজ নো মোর। বিকজ শী হ্যাড আ ব্রেইন টিউমার। দ্যাট’স্ হোয়াই…”
ডাক্তার আর বাকিটা বলতে পারলো না। বিস্ফোরিত চোখে ডাক্তারের দিকে কয়েকটা ক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরমুহূর্তে ঝড়ের গতিতে অটির ভিতর ঢুকে গেল। ইয়াসমিন বেগম কথাটা শুনেই পড়ে যেতে নিচ্ছিলেন। অয়ন সাথে থাকায় সাথে সাথেই ধরে ফেললো উনাকে। বিড়বিড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন
—“অয়ন… অয়ন ডাক্তার কী বললো?! অতশীর ব্রেইন টিউমার ছিল? এটা কী সত্যি অয়ন? বলো তুমি জানতে অতশীর ব্রেইন টিউমার ছিল?”
অয়ন নিজেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। অতশীর ব্রেইন টিউমার ছিল! কই স্পন্দন তো বললো না একদিনও। অবাকের ঘোরটা না কাটতে কাটতেই কোনমতে জবাব দিল
—“না খালাম্মা, আমি কিছুই জানতাম না এ ব্যাপারে। স্পন্দন আমাকে কিচ্ছু বলেনি। আমিও মাত্রই শুনলাম।” একটু ধাতস্থ হয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো “খালাম্মা স্পন্দনকে সামলাতে হবে। ওর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।”
অতশীর নিথর দেহের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পন্দন। চোখটা জ্বলছে তার। তবুও একটু কাঁদতে পারছে না। বুকের ভিতর ভাঙচুর হচ্ছে খুব। তবুও সেই যন্ত্রণায় কান্না আসছে না তার। শুধু বুকের ভিতর জমে থাকা জমাট বাঁধা কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে যেন গলায় এসে আটকে পড়েছে। না পারছে গিলতে, না পারছে উগরাতে। নিঃশ্বাস নিতেও যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঝুঁকে গিয়ে অতশীর কপালে একটা চুমু খেলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো কয়েকটা মুহূর্ত। অস্ফুটস্বরে আওড়াতে লাগলো
—“শেষবারের মতো কেন একটা সুযোগ দিলে না আমাকে ক্ষমা চাওয়ার? কেন এতো তাড়াতাড়িই স্বার্থপরের মতো এই পৃথিবীতে আমাকে একা ফেলে চলে গেলে? আর কটা দিন কেন আমাকে দিলে না তোমার সান্নিধ্যে থাকার জন্য? কেন আমাকে এভাবে ঋণী বানিয়ে রেখে চলে গেলে? এই ঋণ আমি কী করে শোধ করবো অতশী? আমার যে অনেক কথা বলার ছিল তোমাকে। সেসব না শুনেই কেন তুমি চিরতরে চলে গেলে? কেন? কেন? কেন? এতোসব কেন’র উত্তর আমি কই খুঁজে পাব? তুমি প্লিজ উপায় বলে দিয়ে যাও অতশী। এই নিঃস্ব আমিকে আরও নিঃস্ব বানাতে কেন আমার জীবনে এভাবে এসেছিল। আবার কেনই বা এভাবে হারিয়ে গেলে?”
ইয়াসমিন বেগম এসে স্পন্দনকে দু’হাতে আগলে ধরেন। ছেলের মনের অবস্থাটা তিনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন। যেখানে তিনি শাশুড়ী হয়েই ভেঙে পড়েছেন। সেখানে স্পন্দনের তো নিজের ভালবাসার মানুষ, নিজের অর্ধাঙ্গিনী, নিজের সন্তানের মা। কথাটা মনে হতেই তিনি আশেপাশে একবার চোখ বুলান। দেখেন দোলনায় তোয়ালে প্যাঁচানো একটা ফুটফুটে বাচ্চা। দেখলেই কেমন মায়া লেগে যায়। স্পন্দন এখনও বিড়বিড় করে কী যেন আওড়ে যাচ্ছে। অয়নকে ইশারা করলো স্পন্দনকে ধরার জন্য। কেননা সে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করার মতো অবস্থায় নেই। ওকে ধরার পর বাচ্চাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। ভালোমতো খেয়াল করে দেখলেন মুখের আদলটা একদম অতশীর মতো। ওকে দেখেই আবারো উনার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এক অতশী চলে গেল আরেক অতশীকে জন্ম দিয়ে। আলগোছে কোলে তুলে কপালে একটা চুমু খেলেন। কেমন শান্ত দীঘির মতো নিশ্চুপ হয়ে আছে। এক ফোঁটা পানি বাচ্চাটার গালে পড়লো বোধহয়। নিস্তব্ধতা ভেঙে গুঁড়িয়ে হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠলো বাচ্চাটা।
বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও যখন বাচ্চাটার কান্না থামানো যাচ্ছিল না তখন ইয়াসমিন বেগম ওকে নিয়ে স্পন্দনের কোলে দিলেন। বিস্ময়করভাবে স্পন্দনের কোলে নেওয়ার সাথে সাথেই বাচ্চাটির কান্না একদম থেমে গেল। চোখ মেলে তাকে দেখছে ফুটফুটে বাচ্চাটা। স্পন্দন যেন ওকে ধরে রাখতে পারছিল না। তার কোলে দেওয়ার সাথে সাথেই পা ভেঙে নিচে বসে পড়লো। বাচ্চাটিকে বুকের সাথে চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো। যা কিনা এতোগুলো বছরেও তার দ্বারা সম্ভব হয়নি আজ সেই অসাধ্যটা সাধন হলো। পরমুহূর্তে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠলো স্পন্দন। যে চিৎকারের আওয়াজে আজ নভোমণ্ডল এবং তাতে যা কিছু বিদ্যমান আছে সবকিছুই যেন কাঁপতে লাগলো।
পরিশিষ্টঃ পাঁচ বছরের ফুটফুটে পরীর মতো মেয়েটা তার বাবার তর্জনী ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কবরস্থানের দিকে। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সে এই জায়গাটায় এসেছে। এখানে আসলেই কেমন জানি প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় বাচ্চা মেয়েটার ভিতরটা। ইমতি আর ইফতি ভাইয়া বলে মানুষ কবরস্থানে আসলে নাকি ভয় পায়। কিন্তু তার তো ভয় লাগে না। উল্টো আরো শান্তি শান্তি লাগে যতটা সময় এখানে থাকে। একটা কাঠগোলাপ গাছের কাছে এসে তারা দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ে। তার বাবা বলে এটা নাকি ওর মায়ের কবর। এ জায়গাটার পুরোটা জুড়ে কাঠগোলাপগুলো একদম বিছিয়ে পড়ে আছে। যেন কেউ সাজিয়ে রেখে গেছে তারা আসার আগে আগেই। মাথা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার বাবা কেমন ছলছল আঁখি মেলে এক দৃষ্টিতে কবরটার দিকে তাকিয়ে আছে। চশমার ফাঁক দিয়েও চোখের নোনাপানিগুলো ঠিক ঠিক চোখে পড়লো স্পর্শীর। বাবার হাত ধরে ঝাঁকি দেওয়ার পর অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে চোখের পানিটা মুছে চশমাটা চোখে লাগাতে লাগাতে বসে বললো
—“কী হয়েছে আমার সোনা আম্মুটার?”
—“আব্বু, আর য়্যু ক্রায়িং?”
—“না আম্মু, একধ্যানে তাকিয়ে থাকার কারণে চোখে পানি জমেছে।”
—“আমার মাম্মামকেও কী এটাই বলতে?”
স্পন্দন কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল
—“তোমার মাম্মামের সামনে তো কখনো চোখে পানি আসেনি তাই বলারও প্রয়োজন হয়নি।”
মন খারাপ করে স্পর্শী বললো
—“আব্বু, মাম্মাম আমাদের সাথে থাকে না কেন? ইফতি আর ইমতি ভাইয়ার মাম্মাম আর বড়আব্বু তো ওদের সাথে থাকে। তাহলে আমার সাথে শুধু তুমি থাকো কেন? মাম্মাম কেন থাকে না?”
—“কারণ তোমার মাম্মামকে আল্লাহ্ তাঁর কাছে নিয়ে গেছেন।”
—“কিন্তু মাম্মামকেই কেন নিল?”
—“আল্লাহ্ যাকে বেশি পছন্দ করেন তাকেই তাঁর কাছে তাড়াতাড়ি নিয়ে যান। তাই তোমার মাম্মামকে নিয়ে গেছেন।”
—“আমিও মাম্মামের কাছে চলে যাব। মাম্মামকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে আমার। অনেক অনেক আদর নিব মাম্মামের কাছ থেকে।”
স্পন্দন নিজের মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ভেজা গলায় বলেন
—“এসব বলে না আম্মুটা। তুমি চলে গেলে আমি যে একেবারেই একা হয়ে যাব। খুব কষ্ট পাব আমি। তোমার মাম্মাম তো আমাকে ছেড়ে চলেই গেল। তুমিও চলে গেলে আমি থাকবো কী করে? তুমি কী চাও তোমার আব্বু কষ্ট পাক?”
—“না আব্বু, একদমই চাই না।”
—“তাহলে এসব কথা আর কখনোই বলবে না, ঠিক আছে?”
—“ঠিক আছে আব্বু।” এক গাল হেসে উত্তর দেয় স্পর্শী।
মেয়েটার হাসির দিকে তাকালেই অতশীর কথা মনে পড়ে। শরীরের রঙ পেয়েছে স্পন্দনের। কিন্তু মুখের গড়ন পুরোটাই অতশীর। যতবার মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়, ততবারই অতশীর হাস্যজ্জল মুখাবয়টা ভেসে উঠে তার চোখের তারার স্বচ্ছ আবরণে। অতশীকে যতটা অবজ্ঞা সে করেছিল, তার চেয়েও বেশি ভালবেসে বড় করবে অতশীর রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিটাকে। যতদিন তার দেহে প্রাণ থাকে, ততদিন একটা ফুলের টোকাও পড়তে দেবে না ওর শরীরে।
মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসার পথে পিছন ফিরে তাকালো একবার স্পন্দন। অতশীর কলকল হাসির আওয়াজ যেন তার কানে আসছে। মিহি চিকন মিষ্টি কণ্ঠে অতশী যেন তাকে ডাকছে। আর বিরতিহীনভাবে বলে চলেছে ‘ভালবাসি ভালবাসি ভালবাসি।’
সমাপ্ত
Seriously comment na kore parlam na,golpota pore ak onno rokom valo laga kaj korchilo. Allah jeno sobar moner manusher sathe sobar sara jibon thakar sujog dey. Golpota khub sundor hoyeche. thank you so much for the story.