#অবেলায়_তোমার_আকাশে
#পর্ব_৪
#লেখিকা_N_K_Orni
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি বুঝতে পারল সারা বাড়িতে হইচই পড়ে গেছে। কেনই বা হবে না? আজকে যে সায়েরার গায়ে হলুদ। মিসেস সানিয়া সকাল থেকে বাড়ির কাজে ব্যস্ত। ব্যস্ত হবেই তো। তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে। তাও আবার তার পছন্দের ছেলের সাথে। বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ভাবতেই তার খুব খুশি লাগছে। যদিও তার স্বামীর অনেক আছে। তবুও তার তিন চতুর্থাংশই বৃষ্টির নামে যা তার একদমই পছন্দ নয়। সে সবসময়ই চায় এই পুরো সম্পত্তির মালিক সে আর তার মেয়ে হোক।
একে একে বাসায় প্রায়ই সকল আত্মীয়রা আসছে। সবাইকে এখন কি বলবে সেটাই ভাবছে মিসেস সানিয়া? রাদিব সাহেবের কঠোর আদেশ ভুলেও যেন তিনি বৃষ্টির বিষয়ে না বলেন। তাহলে তার থেকে খারাপ কেউ হবে না। কিন্তু মিসেস সানিয়া চান সবাইকে এই বিষয়ে বলতে। এখন তিনি কি করবেন সেটাই ভাবছেন? তিনি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন মিসেস রায়া এই দিকেই আসছেন। ওনাকে আসতে দেখেই ওনার চোখ মুখ কুচকে গেল। বিয়ের পর থেকেই তিনি মিসেস রায়াকে খুব একটা দেখতে পারেননা। মিসেস রায়া মিসেস সানিয়ার কাছে এসে বলে উঠলেন,
— বিয়ে যে মেয়ের সাথে দিচ্ছো, সবাই জিজ্ঞাসা করলে কি বলবে?
— সে তখন কিছু একটা বলা যাবে।
— দেখো আবার ভুল করে ওসব কথা বলে ফেলো না।
— আরে না না। আমি কি এসব বলতে পারি? বৃষ্টি তো আমারও মেয়ে।
মিসেস সানিয়ার কথা শুনে মিসেস রায়া মনে মনে বলে উঠল,
— উউউহ ওনার মেয়ে! তুমি যে বৃষ্টিকে কি ভাবো তা আমার ভালো করেই জানা আছে? সবসময় বৃষ্টির ক্ষতি চাও।
— সেটা তো জানি। তবুও বলছি একটু খেয়াল রেখো।
বলেই মিসেস রায়া ওখান থেকে বেরিয়ে গেলেন।
—————–
দুপুর গিয়ে বিকাল হতে শুরু করেছে। পুরো বাড়িতে মানুষের সমাগম। সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। একটু পরেই সায়েরার গায়ে হলুদ শুরু হবে। সবাই কাজকর্ম, আনন্দে ব্যস্ত থাকলেও বৃষ্টি তার রুমেই বসে আছে। এতো লোকজন, হইচই সবটা ওর কাছে বিষের মতো লাগছে। এই বিষাক্ত পরিবেশে ও ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ছে।
বৃষ্টি তার রুমের বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। তখনই বৃষ্টির ফুফি মিসেস রায়া রুমে প্রবেশ করলেন। বৃষ্টি একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। তাই মিসেস রায়া যে রুমে ঢুকেছেন এটা বৃষ্টি খেয়াল করে না। মিসেস রায়া গিয়ে বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এতে বৃষ্টির ঘোর কেটে যায়। সে মুখ উপরে তুলে মিসেস রায়াকে দেখতে পায়। সে সাথে সাথে মিসেস রায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মিসেস রায়া বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল,
— তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না রে? আমি বুঝেছি। আজকে তোর জায়গায় তোরই ছোট বোনের সাথে তোর ভালোবাসার মানুষের সাথে। একটা কথা ভেবে দেখ যদি তোর বিয়ের পর আসিফ এটা জানতে পারত। তখন যদি ও তোকে ছেড়ে দিত? তখন কি করতি? আরও বেশি কষ্ট পেতি। প্রেমিক হারানোর চেয়ে স্বামী হারানো বেশি কষ্টের। প্রেমিকের প্রতি ভালোবাসা থাকে কিন্তু প্রেমিকের চেয়ে স্বামীর প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা থাকে। একটা আলাদা টান। সেই সম্পর্ক যে পবিত্রতার সম্পর্ক। সে সম্পর্ক ভাঙলে বেশি কষ্ট হয়। আল্লাহ হয়তো চান না যে আসিফ তোর জীবনসঙ্গী হোক। হয়তো তোর জীবনে আরও ভালো কেউ আছে।
মিসেস রায়ার কথা শুনে বৃষ্টি মুখ তুলে তাকায়। মিসেস রায়া এবার বৃষ্টির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে তার পাশে গিয়ে বসেন। তারপর তার কাধে হাত রেখে বলেন,
— শোন মা আল্লাহ কখনো কারো খারাপ চান না। একটা বার ভেবে দেখ যার জন্য তুই কষ্ট পাচ্ছিস। সে কি একবারও তোর কথা ভেবেছে? তোর জন্য কষ্ট পেয়েছে? সে তো নিজে খুশি মনেই এই বিয়েটা করছে। তাহলে তুই কেন তার জন্য কষ্ট পাবি?
মিসেস রায়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলেন,
— একটা কথা সবসময় মনে রাখবি। যার কাছে নিজের কোনো গুরুত্ব নেই, তাকেও নিজের জীবনে বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। আর হ্যাঁ কখনো কারো ওপর নির্ভরশীল হবি না। আর কাউকে এতোটা গুরুত্ব দিবি যাতে সে চলে গেলে তোর কষ্ট হয়। নিজেকে কারও সামনে কখনো দূর্বল প্রমাণ করবি না আর কাউকে নিজের দূর্বলতা সম্পর্কে বলবি না। কারণ আমাদের সমাজের সবাই অন্যের দূর্বলতা কাটাতে নয় বরং সেই দূর্বলতায় আঘাত করতে ভালোবাসে।
বৃষ্টি অবাক চোখে তার ফুপির দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে যে সে ভুল করেছে। সে কেন কষ্ট পাবে আসিফের জন্য?
— আচ্ছা বৃষ্টি তুই তো এবার এইচএসসি দিলি? রেজাল্টও ভালো হয়েছে। তা এরপর কি করার ইচ্ছা আছে?
বৃষ্টি কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা নিচু করে বলল,
— আমার তো ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন মনে হয় না কখনো পূরণ হবে।
— কেন পূরণ হবে না?
— আমি তো কোনো জায়গাতেই এডমিশন টেস্ট দেইনি।
বলেই বৃষ্টি ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগল। মিসেস রায়া তার চোখের পানি দুই হাত দিয়ে মুছে দিয়ে বলে উঠলেন,
— ওহহ এই ব্যাপার। তুই এতো চিন্তা করিস না। এডমিশন টেস্টের দরকার নেই। আমাদের বাসার কাছেই একটা মেডিকেল কলেজ আছে। তোকে নাহয় আমিই ওখানে ভর্তি করিয়ে দিব। তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে ডাক্তারি পড়াবোই।
বৃষ্টি বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলে উঠল,
— সত্যি বলছ?
— হ্যাঁ সত্যি বলছি।
বৃষ্টির মুখে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই মুখে কালো মেঘের আধার নেমে এলো। সে নিচু স্বরে বলে উঠল,
— যদি বাবা মানা করে দেয়?
— আমি আছি তো। আমি ঠিক ভাইয়াকে বোঝাব। তবে আমার মনে হয় না ভাইয়া না করবেন।
বৃষ্টি এবার তার ফুফি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
— ফুফি তুমি অনেক ভালো। মায়ের পর তুমিই আমাকে একমাত্র বোঝ। আর কেউ বুঝতেই চায় না।
মিসেস রায়া বৃষ্টির দুই গালে হাত রেখে বললেন,
— এই তো আমার ভালো মেয়েটার মুখে হাসি ফুটেছে। আর ওই সব বাজে লোকদের জন্য কাঁদবি না।
বৃষ্টি মিষ্টি হেসে বলে উঠল,
— আচ্ছা।
— এখন চল তোকে সাজিয়ে দেই। তুই সায়েরার গায়ে হলুদে যাবি।
— কিন্তু?
— কোনো কিন্তু নয়। তুইও সুন্দর করে সেজে সায়েরার গায়ে হলুদে আনন্দ করবি। ওদের দেখিয়ে দিবি তুইও ভালো আছিস। তোর ভালো থাকার জন্য ওসব লোকদের প্রয়োজন নেই। বুঝেছিস?
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলল,
— হুম।
মিসেস রায়া এবার বৃষ্টিকে একটা হলুদ শাড়ি পড়িয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন। তারপর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
— মাশাল্লাহ্ আমার বৃষ্টি আম্মুকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।
বৃষ্টি একটা মলিন হাসি দিল। মিসেস রায়া এবার বৃষ্টিকে অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল। বৃষ্টিকে ওখানে দেখে মিসেস সানিয়া আর সায়েরার অবাকের শেষ সীমানায় চলে গেল। বৃষ্টিকে তারা এখানে আসা করেনি। তবুও তারা সবাইকে সেটা বুঝতে দিল না। এদিকে এখানে এসে বৃষ্টির খুবই খারাপ লাগছিল। তবুও সে যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। সবকিছু ঠিকভাবে সম্পন্ন হলো। মিসেস রায়া এবার তার ভাইয়ের রুমে গেলেন। মিসেস রায়াকে দেখে রাদিব সাহেব বলে উঠলেন,
— শুনলাম তুই নাকি বৃষ্টিকে নিয়ে ওখানে গিয়ে ছিলি? ওকে কেন ওসবের মধ্যে টানছিস? এমনিতেই ওর মন খারাপ?
— ওসবে থাকলে ও ভালো থাকবে। যাইহোক একটা কথা বলতে চাই।
— কি বল?
— বৃষ্টিকে আমি আমার ওখানে রেখে পড়াতে চাই।
চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। )