#অবেলার_মেঘ
#পর্ব_৮ এবং শেষ পর্ব
#জীহানুর
মার্জিয়া মেঘের কাধেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।মেঘ ওকে খাটে শুইয়ে দিয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।
– এক ছিল আইরিন, আর আছে মার্জিয়া।আইরিনকে নিজের নিজের ভুলের কারণেই হারিয়েছি। কিন্তু মার্জিয়াকে আমি কিছুতেই হারাতে পারবোনা।
সারাটা রাত কেটে যায় মার্জিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে।খুব বেশি দিনের পরিচয় না, তবুও এতো কাছের মনে হয় ওকে। মেঘ নিজের সবটা বিলিয়ে দিতে পারে এই মেয়েটার জন্য।কিন্তু নিজের কথা ভাবতেই ওর ভয় হয়।যদি কখনো ও মেঘকে ছেড়ে যেতে চায় তাইলে হয়ত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে না।কি অদ্ভুত এই ভালবাসা নামের অনুভূতি!শুধুমাত্র ভালবাসার খাতিরেই প্রিয়জনের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হয় নিজের মনের বিরুদ্ধেই।
সকালে সায়লার ডাকে ঘুম ভাঙে মার্জিয়ার ঘুম ভাঙে।
-আফামণি, জলদি চলেন। কারা যেন আইছে ছোট সাহেব রে নিয়া যাইতে।
মার্জিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। আশেপাশে কোথাও মেঘকে না দেখে দৌড়ে নিচে চলে যায় ও। এক ই ইউনিফর্মে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়ানো নিচে। ওদের কথা শুনে বোঝা গেলো ওরা কোনোএক মানসিক হাসপাতালের লোক।ওরা মেঘকে নিজেদের সাথে নিয়ে যাবে।কিন্তু ওর মুখে এই নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।পা’এর পা উঠিয়ে সোফার দুইপাশে হাত মেলিয়া দিয়ে বসে আছে মেঘ।ওদের সাথে যাবে না ও।আর সেখানে কারো সাহস মেঘকে জোর করার। অনেক তর্ক করে বলছে ওরা মেঘকে।কিন্তু ও নিশ্চিন্তে বসে আছে নিজের জায়গায়।
মার্জিয়া কে দেখে বসা থেকে উঠে এগিয়ে যায় ওর দিকে।দুই হাত দিয়ে ওর গাল ধরে বলে-
-ঘুম ভেঙেছে?
-হ্যা কিন্তু উনারা কি বলছেন এসব!তোমায় নিয়ে যাবে তারা??
-কে বলেছে! ওরা আমাকে নিতে পারবেনা।তুমি অস্থির হয়ো না।
এদিকে কোথা থেকে যেন পুলিশের লোকেরা ভিতরে চলে আসলো। তাদের দেখে অন্যান্যরা অবাক হলেও মেঘের মুখে প্রশান্তির ছায়া দেখা যাচ্ছিলো।
-মেঘ মেহমেদ আছেন?
-জ্বী, আমিই মেঘ মেহমেদ। আপনারা আমাকে একটু সময় দিন।আমি আসছি আপনাদের সাথে।
মার্জিয়া ওর মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।মেঘ ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শার্টের পকেট থেকে একটা চিঠি ওর হাতে ধরিয়ে দেয়।তারপর ওর কপালে ভীষণ গভীর অনুভবের সাথে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।আর বলে-
-আমাকে একবারো থামানোর চেষ্টা তুমি করবে না, আমি যাওয়ার পরে চিঠি টা পড়ে নিয়ো। চলি..
এরপর মেঘ নিজে থেকেই চলে যায় পুলিশদের সাথে।একবারও পিছন ফিরে দেখে না। আর মার্জিয়া শুধু ওর যাওয়ার পথটা দেখছিল। বাইরে গিয়ে যতদূর পর্যন্ত গাড়িটা দেখা যাচ্ছিল ও অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছিল। টপটপ করে চোখের পানি বৃষ্টি হয়ে ঝরছিল অথচ মুখে কোনো শব্দ নেই।কিছুই করার নেই, কারণ মেঘ বারণ দিয়েছে।গাড়িটা ওর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে ও হাতের মুঠোয় থাকা চিঠিটা খোলে।
“মার্জিয়া,
আমাকে ছোটবেলায় ই এখান থেকে দূরে পাঠানোর কারণ শুধুমাত্র আমাকে নিয়মকানুন শিখানো ছিল না।এর পিছনে আরো একটা কারণ ছিল। বাবা অত্যন্ত রাগী আর বদমেজাজি মানুষ। কিন্তু সবার সামনে তা কখনো প্রকাশ করেন না।ছোটবেলায় একদিন যখন আমি আমার ঘরে বসে আঁকা-আঁকি করছিলাম তখন হল রুম থেকে খুব জোরে জোরে কিছু মানুষের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে যখন করিডোরে আসি তখন চারটা গুলির শব্দ শুনতে পাই। চোখের সামনেই দেখেছিলাম চারজন মানুষকে বাবার হাতে খুন হতে। বাবা বলছিল ওদের লাশগুলো যেন বাগানে মাটিচাপা দিয়ে দেয়।ভয়তে আমি তারপর থেকে বাবার কাছে যেতাম না, ঘর থেকে বেরোতাম না। মা একদিন অনেক জিজ্ঞেস করায় তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে দিয়েছিলাম সবটা। কিন্তু বাবার কানে যখন খবরটা যায় সে আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।হ্যা, বাগানে আয়রিনের সাথে আরো চারটা লাশ আছে।বাবা আমাকে মানসিক রোগীদের স্থানে পাঠিয়ে দিতে চায়।আজ না হয় কাল সে এই চেষ্টাটা করবেই।কিন্তু আমি তা হতে দেইনি।আমি পুলিশকে সব জানিয়ে দিয়েছি বাবার সম্পর্কে। আর নিজেও নিজের অপরাধ স্বীকার করেছি। আমি তাদের অধীনে থাকলে চাইলেও কখনো তোমার ক্ষতি করতে পারবোনা। খুব ভালোবাসি তোমাকে, তাই নিজেকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি।
তোমার আকাশে অবেলায় মেঘ করেছিল। সেই মেঘ কেটে গেছে। এখন তোমার আকাশ পরিষ্কার।এই অবেলার মেঘকে ভুলে যেয়ো। আর যদি পারো তবে খুব গোপনে ভালবাসা নামের অনুভূতি থেকে আমার নাম টা কেটে দিয়ো..
ইতি
মেঘ…..”
জীবন সেখানে থামেনি।কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। বাগান থেকে মেঘের বয়ান অনুযায়ী সব লাশগুলো বের করা হয়। মেঘের বাবার শাস্তি হয়েছে।মার্জিয়া নিজেকে সামলে নিয়েছে। লেখাপড়া শেষ করে নিজের পা’এ দাঁড়িয়েছে। সফল বিজনেস উইমেন হিসেবে সবাই ওকে চেনে। পরিবারকে একটা সচ্ছল জীবন দিতে পেরেছে।সব ক্ষেত্রে ঠিকঠাকভাবে এগোতে পারলেও, পারেনি মেঘকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে। মেঘকে ভুলে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবেলা ম্যানশনকে ও নিজের করে নিয়েছে।এখানেই থাকে ও। মেঘের ঘরটা যেমন ছিল ঠিক তেমনি রেখে দিয়েছে।ওর বিশ্বাস মেঘ একদিন হয়তবা ফিরে আসবে। অবেলার মেঘ কে ও নিজের আকাশে চিরস্থায়ীভাবে সাজিয়ে রেখেছে…!
#জীহানূর
গল্পটাকে মন দিয়ে পড়ার জন্য সকল পাঠকে ধন্যবাদ জানাই..!