অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
7

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#অন্তিম_পর্ব

সাদিক মাকে আদ্দোপান্ত সকল ঘটনাই বলেছে। জানে, মা বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করেওনি। তার কাছে ভাতিজা ভাতিজির মূল্য অনেক। সাদিক বিশ্বাস করানোর চেষ্টাও করেনি। শেষে নাতির কথা শুনে বিষ্মিত হলো ফরিদা। তারপর যখন মোবাইলে মাহাদীর হাস্যজ্বল ছবি দেখালো তখন বিস্ফারিত চোখে শুধু ছবিটা দেখেই গেছে। হুবহু সাদিকের ছোটবেলার ছবি৷ ছবির পর সাদিক ব্যাগ থেকে মাহাদীর আর্টের খাতা বের করে সামনে ধরে বলল,
–দেখো মা, আমার ছেলেটা একদম তোমার মতো আর্ট করে। তুমি ওকে পছন্দ না করলেও তোমার গুন পেয়েছে।

ফরিদা বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। শুধু নিজের ছেলেকে দেখতে লাগলো। কি মুগ্ধ চোখে নিজের ছেলের আঁকানো ছবি তাকে দেখাচ্ছে! কি প্রসন্নই না দেখাচ্ছে ওকে! ছেলের সুখ যে এখানে ছিলো, তা কি তিনি বুঝেছিলেন! এসব দেখে হঠাৎই তার নাতিকে দেখতে মন চাইলো। অনেক সাহস সঞ্চয় করে বলল,
–যাওয়ার সময় আমাকে সাথে নিয়ে যাস বাবা। তোর বাবা তো বাড়িতে নাই। নাতিটাকে একটু দেখে আসতাম। নিয়ে তো আর আসলি না। তোর বাবা থাকলে তাও তোর বাবার সাথে যেতে পারতাম।

সাদিক তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল,
–অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ট্রাভেল করা সম্ভব না মা। আর তাছাড়া ওকে আমি আনতামও না।

মাহাদীর অসুস্থতার কথা শুনে চমকে উঠলো ফরিদা। অবাক হয়ে বলল,
–কি হয়েছে ওর?

সাদিক দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল,
–ব্লা’ড ক্যান্সার৷

ফরিদা কিছুক্ষণের জন্য কথাই বলতে পারলো না। বিষ্ময় কাটিয়ে মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগলো। আর্তনাদ করে বলে উঠলো,
–আমাকে একবার নাতিটাকে দেখতে দে বাবা। অসুস্থ নাতিটাকে একবার দেখে আসি।

সাদিক থমথমে মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলল,
–তুমি এমনভাবে বলছো যে মনে হচ্ছে আমার ছেলেটা ম’রে যাবে।

ফরিদা আঁতকে উঠলো,
–কিসব বলছিস তুই?

সাদিক উত্তর দিলো না। হালকা হেসে পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে মায়ের সামনে রেখে বলল,
–তুমি আমার ছেলেকে মারতে যে টাকা দিয়েছিলে, এটা সেই টাকা। আমার ছেলের সব ঋণ শোধ করলাম মা। দোষ তো আমি আর অহনা করেছি। বাচ্চাটা নির্দোষ। অসুস্থ বাচ্চাটার উপর আর রাগ রেখো না মা। আর পারলে আমাদের মাফ করে দিও।

ফরিদা ডুকরে কেঁদে উঠলো,
–ভুল হয়েছে বাবা, খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দে। নাতিটাকে একবার দেখাতে নিয়ে যা বাবা।

ফরিদা সত্যি সত্যি অনুতপ্ত নাকি বোঝা গেলো না। একসময় যেই বাচ্চার একমাত্র অপরাধ ছিলো, সে অহনার গর্ভে জন্মেছিল। আর আজ সেই বাচ্চার অসুস্থতার কথা শুনে এতো কষ্ট পাচ্ছে! এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য!

সাদিক মাথা নেড়ে বলল,
–তুমি ওকে দেখার অধিকার হারিয়েছো মা। আমার বাচ্চাটাকে জন্মের আগেই তুমি মে’রে ফেলতে চেয়েছিলে। একবারও তোমার নিজের ছেলের কথা ভাবোনি।

ফরিদা আহাজারি করে উঠলো। সাদিকের হাত চেপে বলল,
–ভুল তো আমি করেছি বাবা৷ আমার ভুলের শাস্তি আমাকে অন্যভাবে দে। এমন সম্পর্ক ছিন্ন করে শাস্তি দিস না।

–ভুল না মা, অন্যায় করেছো। অনেক বড় অপরাধ করেছো তুমি। বাবা মায়ের অন্যায়ের শাস্তি নাকি সন্তানরা পায়। তোমাদের অন্যায়ের শাস্তির জন্যই বোধহয় আমার ছেলেটার আজ এই অবস্থা। ওর মাধ্যমেই বোধহয় আমাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

ফরিদা আর কথা বলতে পারলো না। ছেলের হাতে কপাল রেখে অঝোর নয়নে কাঁদতে লাগলো। কান্নাকাটি যখন অসহ্য লাগলো সাদিকের কাছে, তখন উঠে ঘরে গেলো। তার সব জিনিসপত্র লাগেজে তুলে, অহনার পাসপোর্ট নিয়ে একেবারে বেড়িয়ে গেলো। মায়ের আর্তনাদ, আহাজারি কিছুই শুনলো না।

সাদিক ফিরতে ফিরতে মাহাদীর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। রক্তে প্লেটলেট কমে যাওয়ায় আবার হিমোগ্লোবিন দেওয়া হচ্ছে। এবারে ভয় পাচ্ছে না মাহাদী। চুপচাপ শুয়ে মোবাইলে কার্টুন দেখছে। সাদিক যখন কেবিনে আসলো তখন অহনা সেখানে ছিলো না। দেখা হলো শুধু ছেলের সাথে। ক্লান্ত শরীরে ছেলেকে দেখে মূহুর্তেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। কাছে যেতেই বাবার চোখে চশমা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মাহাদী। সাদিকের চোখের দিকে আঙুল তুলে নিজের মুখে হাত চেপে হাসতে হাসতে বলল,
–বাবা চশমা পরে, বাবা চোখে দেখে না!

সাদিকও হেসে ফেললো। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ আব্বু, বাবার নজর খুব খারাপ। নাহলে কি আর মাহাদীকে আর মাহাদীর আম্মুকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়!

মাহাদী অতো কিছু না বুঝলেও বাবার আদর বুঝে গলা জড়িয়ে ধরলো এক হাত দিয়ে৷ আরেক হাতে প্লেটলেট দেওয়া হচ্ছে। এক হাতের বাঁধনে উঠতেই দিলো না বাবাকে। সাদিক বেডে ভালো করে বসে মাহাদীর পিঠের নিচে হাত দিয়ে তুলে বুকে জড়িয়ে আধশোয়া হয়ে রইল। অহনা খানিক পর আসলো। মুখ থমথমে। ভেতরে এসে সাদিককে দেখে গোমড়া মুখে বলল,
–বাইরে আপনার কাজিনরা এসেছে।

অহনার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে, তাদের আসা তার একদম পছন্দ হয়নি। সাদিক সবটা বুঝলো। তারপর দ্রুত পায়ে বাইরে চলে গেলো। সকলে দল বেঁধে এসেছে। নিশ্চয় সব জানতে পেরেছে আর তাই নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে চলে এসেছে। সাদিক মহা বিরক্ত হলো। রাগী গলায় বলল,
–কেনো এসেছিস?

সজীব আমতা-আমতা করে বলল,
–তোমার ছেলেকে দেখতে। ফুপি বলল, তোমার ছেলের নাকি ব্লা’ড ক্যান্সার হয়েছে?

ফরিদা আর খলিল সাহেব সম্পর্কে খালাতো ভাইবোন ছিলো। আত্মীয়ের উপর করা এই আত্মীয় বেশ জোড় পাকিয়েছে।
সাদিক কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। সবার চোখে মুখে কি দাপট! মনে হচ্ছে হাতে লাঠি থাকলে এক্ষুনি মা’রামা’রি শুরু করে দিতো। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ আমার চেষ্টা করে বলল,
–যদি খু’ন মাফ হতো তাহলে আই সয়্যার, তোরা কেউ আর বেঁচে থাকতি না। মাথা আর খারাপ করিস না আমার। চলে যা এখান থেকে।

সায়রা এগিয়ে আসলো। নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে বলল,
–সাদিক ভাই, আমরা তো আপনার আর মৌলির ভালোর জন্যই সব করেছি। এখন সব দোষ আমাদের দিচ্ছেন!

মৌলি তেঁতে উঠলো,
–আমার নাম নিচ্ছিস কেন? আমি কি তোদের এসব করতে বলেছিলাম?

সাদিক ক্রোধিত স্বরে বলল,
–আমার যথেষ্ট ভালো করেছিস তোরা৷ তোদের ভালোবাসায় আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা না দিয়ে বিদায় হ তাড়াতাড়ি।

মিরাজ রেগে বলল,
–তুমি ওই মেয়ের জন্য আমাদের অপমান করছো ভাই? তুমি জানো ও কি কি করেছে? চরিত্রহীন মেয়ে ও। নিজেকে না জানি কাকে কাকে..

কথা শেষ করার আগেই সাদিক রেগে মিরাজের কলার চেপে ধরলো। নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর স্বরে বলল,
–আমার স্ত্রীর সম্পর্কে একটা বাজে কথা বলবি তো আস্তো বাড়ি ফিরতে পারবি না। আমি তোদেরও চিনি আর আমি আমার স্ত্রীকেও চিনি।

মিরাজও কম যায় না। রেগে একদম সাদিকের চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অবস্থা বেগতিক দেখে সজীব মিরাজকে ছাড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো। রাগ কমাতে সেখানে কিছুক্ষণ পাইচারি করলো সাদিক। কিছুক্ষণ মাথার চুল আকড়ে, কিছুক্ষণ ঘাড় মালিশ করে আর শেষমেশ মুখ দুই হাতে ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর কেবিনে গেলো। অহনা বোধহয় তারজন্যই অপেক্ষা করছিলো। সাদিক ঘুমন্ত মাহাদীর দিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
–চলে গেছে ওরা।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অহনা। চলে না গেলে ও মাহাদীকে নিয়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলো। নিজের বাচ্চাকে কিছুতেই ওদের সামনে আনতো না। নাহলে ওরা ওকে দেখে না জানি কি না কি করে বসতো। সাদিক অহনার পাশে বসে হাত চেপে বলল,
–বাবা আসতে চাইছে। বলবো আসতে?

অহনা কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। খলিল সাহেব প্রথম দিকে তার খুব খেয়াল রাখলেও পরে তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ওকে তার সামনে মে’রে ফেললেও তিনি কিছুই বলতো না। আর সেই ঘটনার পর কি করলো! দলবল নিয়ে প্রথমে ওর মামার বাড়ি আর তারপর মা আর বোনের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিজ দ্বায়িত্বে সব জানিয়ে এসেছিলো আর বেশ ভালোমতো গন্ডগোলও করেছিলো। সেসব সাদিককে বলা হয়নি। প্রথমবারের মতো চাপে না পরে নিজে থেকে আস্তে করে নির্ভয়ে সবটা বলল। সাদিক মর্মাহত হলো দারুন। তার যে বাবা কখনোই কোনো ঝামেলায় থাকেনি, সেই বাবাই না কি এইসব করে বেড়িয়েছে! সব দিক থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শক্ত করে অহনার কাঁধ চেপে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো সাদিক। বাবাকে মেনে নিলেও তাকে ফেলে বাবা মায়ের এই নিরালা আলাপ তার একদম পছন্দ হয়নি। তাই জেগে উঠেই হাত বাড়িয়ে মায়ের আঁচল টেনে ধরলো। অহনা চমকে উঠে পেছনে ফিরতেই মাহাদীকে জেগে থাকতে দেখে আদুরে হাতে ছেলের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।

এরপরের তিন চার সপ্তাহ মাহাদীর কেমোথেরাপির প্রথম সেশন চললো। এই কয়েকদিনের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে মাহাদীর পাসপোর্টের কাজ আর তাদের দুজনে ভিসার কাজ সম্পূর্ণ করে ফেললো সাদিক। মাহাদীর কেমোথেরাপির প্রথম সেশন দেশে হলেও বাকি সেশন দেশে বাইরে হবে। কাজ শেষ হতে হতেই মাহাদীর প্রথম সেশন বেশ ভালোমতো শেষ হলো। হসপিটাল থেকে বাড়ি আনা হলো তার দুইদিন পরেই।
আগামী সপ্তাহে তাদের ফ্লাইট। অহনা গোছগাছে ভীষণ ব্যস্ত। সাদিকও ব্যস্ত ছিলো কিন্তু তার মাঝেই সময় করে মায়ের সাথে ভিডিওকলে কথা বলতে লাগল। হঠাৎ মাহাদী এসে পেছন থেকে সাদিকের কানে সুরসুরি দিতেই সাদিক তার হাত ধরে মাথা পেছন দিকে ঝুঁকিয়ে আদুরে গলায় বলল,
–মায়ের কাছে ভদ্র বাচ্চা আর বাবার কাছে আসলেই দুষ্টমি!

মাহাদী খিলখিল করে হেসে পেছন থেকে সাদিকের গলা জড়িয়ে ধরলো। সাদিক প্রসন্ন হেসে দুই হাত দিয়ে ছেলের ছোট দুই হাত ধরে মাথা ঘুরিয়ে তার মাথায় চুমু দিলো। মাহাদী থেমে না থেকে হাসতে হাসতেই দুষ্টমি করে বাবার কানে, ঘাড়ে ফুঁ দিয়ে বিরক্ত করতে লাগলো। সাদিক উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। সামনে ল্যাপটপের ভেতর থেকে ফরিদা ছেলের এমন প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বাসিত হাসি দেখে মুগ্ধ হলো। মাহাদী কিছুক্ষণ বাবার সাথে দুষ্টুমি করে আরেকটু ঝুঁকতেই ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। প্রথমটায় ভিডিওকল বুঝতে পারেনি। ভেবেছিলো ভিডিও চলছে। ভিডিওকল বুঝেই নিজেকে সাদিকের আড়ালে নিলো। কিছু মূহুর্ত পর বাবার পেছন থেকে অল্প মাথা বের করে ডাগর ডাগর চোখে ল্যাপটপ স্ক্রিনে তাকাতে লাগলো। ফরিদা তো কিছুই বলতে পারছে না। শুধু নাতিকে দেখছে দুচোখ ভরে। স্পর্শ করার অধিকার নিয়ে নিলেও দেখার অধিকার সাদিক নিলো না। বেশ কিছুক্ষণ এমন চলার পর মাহাদী বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট আড়াল করে ফিসফিস করে বলল,
–এটা তো দাদীমা? তাই না বাবা?

সাদিক মুচকি হেসে বলল,
–হ্যাঁ, কথা বলবে?

মাহাদী সজোরে মাথা নেড়ে এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। এরপর ফরিদা কি বলবে সেটা সাদিক জানে। তাই তাকে কিছু বলতে না দিয়ে বলল,
–আগামী সপ্তাহে আমরা দেশ ছাড়ছি মা। যাওয়ার আগে দেখা করে যাবো। এইটুকুতে আপত্তি নেই আশা করি।

বলে কথা শেষ করে সাদিক কল কেঁটে দিতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো ফরিদা। অন্যপাশে সাদিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না মায়ের কষ্ট দেখতে পারবে আর না তাকে ক্ষমা করতে পারবে। কি দারুন এক যন্ত্রণা!

বিদেশের মাটিতে মানিয়ে নেওয়া সহ কেমো থেরাপির সেই সময়কালটা ভীষণ যন্ত্রণার ছিলো মাহাদীর জন্য আর অহনা, সাদিকের জন্যেও। বিশেষ করে কেমোর পরের অসুস্থতাটা মাহাদীকে বেশ ভুগিয়েছে। অহনা সাদিক দুই হাতে ছেলেকে আগলেছে। মাহাদী কখনও বুঝেছে আবার কখনও তারস্বরে কান্নাকাটি করেছে। বিশেষ করে মাঝের সময়টাতে মেজাজ ভীষণ খিটখিটে হয়ে গেছিলো তার। এরপর আস্তে আস্তে শরীর সব মেনে নেওয়ায় ক্যান্সার হার মানলো। মাহাদীর কেমোথেরাপির লাস্ট সেশন শেষে ডক্টর কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
–মাহাদী, তুমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ। এখন কি করবে?

মাহাদী কিছুক্ষণ ভাবলো। স্কুলে যাচ্ছে দুইবছর হলো৷ সুতরাং মাথায় এখন ভ্যাকেশনের চিন্তা ঘুরছে। বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করার পর বলল,
–আমি, বাবা আর বেবি আপু মিলে ফুলবল ম্যাচ দেখতে যাবো।

ডাক্তার বাঙালি ছিলো। মাহাদীর সাথে তার কথোপকথন বাংলায় হচ্ছে। ডাক্তার হেসে উঠে বলল,
–তোমার মাকে নেবে না?

মাহাদী ডাক্তারের বোকামিতে কপাল চাপড়ে বলল,
–আম্মু না গেলে বেবি আপু যাবে কিভাবে? বেবি আপু তো এখনও আম্মুর টামিতেই আছে।

অহনা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো। যে কথাটা একমাত্র ছেলেকে ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কাউকে জানায়ইনি ,সেই কথাটা ছেলে কি নির্দ্বিধায় বলে দিলো। কতবার করে বুঝিয়েছিলো তাকে যাতে এখনই কাউকে কিছু না বলে। আর ফট করে এমন হাটের মাঝে কাঁঠাল ভেঙে দিলো! সাদিক রাগী দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকাতেই অহনা মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে সামলালো। সাদিক অহনার কানের কাছে মুখ নিয়ে রাগী গলায় ফিসফিস করে বলল,
–বউরা নাকি বরদের টাকা লুকিয়ে রাখে। আর তুমি এইসব লুকিয়ে রাখো! বাড়ি চলো, নিরিবিলিতে ভালো করে শুনবো আর কি কি লুকিয়ে রেখেছো।

অহনা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। এই লজ্জার জন্যই তো কথাটা এখনও বলতে পারেনি। ডাক্তার আর মাহাদীর খোশগল্প চলতেই থাকলো,
–আর কি কি করবে মাহাদী?

মাহাদী আরো ভাবলো। তারপর ফোঁকলা দাঁতে হেসে বলল,
–আমরা সামার ভ্যাকেশনে হলুদ বাড়িতে যাবো। আর সেখানে অনেকদিন থাকবো।

মাহাদীর বয়স এখন সাত। সামনের দাঁতগুলো তার নিজের অস্তিত্ব বিলিন করে নতুনের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। তাই বলা চলে মাহাদী এখন বড় হয়েছে। তবে বড় হলেও তার স্মৃতিতে সেই হলুদ বাড়ি এখনও জ্বলজ্বলে। এতোদিনে আরো অনেকভাবে সেই বাড়ির ডিজাইন সে বানিয়েছে। বর্তমানে সেই বাড়ি এখন দোতলা বাড়ির রুপ ধারন করেছে। যার সামনে রয়েছে বড় রাস্তা আর রাস্তায় ঢালাই করে ফেলে রাখা রঙ আর অনেক ক্যানভাস। গাছের মতো করে রঙের তুলি দাঁড়িয়ে আছে। মাহাদী স্বপ্নে দেখে, সেই হলুদ বাড়ির সামনে বসে গাছের মতো তুলি দিয়ে রাস্তা থেকে রঙ তুলে তুলে আর্ট করবে সে। কল্পনা করেও তার গায়ে কাটা দিয়ে দিয়ে ওঠে।

সমাপ্ত…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে