অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৩

0
8

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৩

শেষরাতের দিকে ক্ষিদের জ্বালায় ঘুম ভাঙে অহনার। সহ্য করতে না পেরে হাত পেটে চেপে দেয়াল ঘেষে বসে পরে। সেখানে দয়া দেখানোর কেউ ছিলো না। ভোরের দিকে খলিল সাহেবের ঘুম ভাঙে। তিনি মসজিদে যাওয়ার জন্য বের হতেই অহনাকে বসে থাকতে দেখেন। মেয়েটার অবস্থা দেখে আফসোস হয়। তিনি ভেবেছিলেন, অন্তত সাদিক নিজের ঘরে নিয়ে যাবে। সাদিকের ঘরের দরজা বন্ধ। অহনাকে সোফায় বসিয়ে কিছু খাবার এনে দিলেন। সামান্য ইতস্তত করে পুরো খাবারটাই শেষ করলো অহনা। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করলেন খলিল সাহেব। খাওয়া শেষ হতেই সাদিকের ঘরে নক করলেন। ফুলো চোখে ঘর খুললো সাদিক৷ সামনে বাবাকে দেখে থমথমে মুখে বলল,
–কিছু বলবে বাবা?

খলিল সাহেব রুষ্ঠ গলায় বললেন,
–মেয়েটা সারারাত বাইরে ছিলো। সামান্য সেন্স নেই তোমার? বিয়ে যখন করেছো, দ্বায়িত্ব নিতেই হবে। ভুলে যেও না, তুমিই ওকে এই বাড়িতে এনেছো।

সাদিক ঠান্ডা চোখে শুনলো। তারপর হনহন করে হেঁটে অহনাকে টেনে তুলে একদম বাড়ির বাইরে বের করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। হতভম্ব হয়ে গেলেন খলিল সাহেব। এতো বড় ছেলের গায়ে হাতও তোলা যায় না। সাদিক বাবার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
–আমার দ্বায়িত্ব শেষ। এবার যে দরজা খুলে ওকে ভেতরে আনবে, তার উপরই ওর দ্বায়িত্ব থাকবে।

বলেই আর দাঁড়ালো না। ছেলের দুঃসাহসে ব্যথা পেলেন তিনি। কিছু না করেও অপরাধীর মতো অহনাকে ভেতরে আনলেন। লজ্জায়, ভয়ে অহনা মাটিতে মিশে যেতে লাগলো। চোখের পানিও বাঁধ মানছে না। একটু খাবার দিয়ে এতো অপমান! বাকি অপমানের জন্য ফরিদা ছিলো। ঘুম থেকে উঠেই আবার চেঁচামেচি শুরু হলো। খলিল সাহেব পরিস্থিতি সামলালেন। পুনরায় সাদিককে ডাকা হলো। বাবার সাথে খারাপ ব্যবহারে অপরাধবোধ কাজ করছিলো তার। তাই এক ডাকেই চলে এসেছে। তারপর যখন শুনলো অহনা তার ঘরেই থাকবে তখন সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। ফরিদা রাগী গলায় বলল,
–এই মেয়ের জন্য আমার ছেলেকে কি এখন বাড়ি ছাড়া করবো?

খলিল সাহেবের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। একদিকে সামলালে আরেকদিকে গন্ডগোল হচ্ছে। আবার নতুন আসা এই মেয়ের সামনে স্ত্রীকে ছোট করতেও চাইছেন না। খানিক নরম গলায় বললেন,
–তাহলে গেস্টরুম খুলে দাও। ওখানেই আপাতত থাকুক।

ফরিদা থমথমে গলায় বলল,
–আত্মীয়স্বজন এসে কোথায় থাকবে? তাছাড়া ওই ঘরের সব কিছুই দামী দামী। কোন কিছু নষ্ট করলে তখন?

–তাহলে তোমার কাছে থাকুক। এমনিতেই আমি চলে যাবো আজকে।

খলিল সাহেব বাইরে চাকরি করেন। মাসে কিংবা সপ্তাহে একবার বাড়ি ফেরেন। ফরিদা বিরক্ত হয়ে বলল,
–তাহলে তুমি এসে কোথায় থাকবে?

–আমি তো সারাজীবনের কথা বলছি না।

ফরিদা বিরক্ত হয়ে বলল,
–যা হয় হোক। যদি থাকারই হয় তাহলে স্টোররুম ফাঁকা আছে। ছোট একটা খাটও আছে। একটা টেবিল ফ্যান দিয়ে দিলেই হয়ে যাবে।

ফরিদার এক কথায় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল৷ এই ছোট ফ্ল্যাটে ছোট ছোট তিনটে ঘর আর বড় ড্রয়িংরুম। একটা ছোট কিচের আর তার সাথেই লাগোয়া ডাইনিং এরিয়া। আর একটা ঘর আছে। সব থেকে ছোট ঘর। সেটাকে স্টোররুম বানানো হয়েছে। অহনার থাকার জায়গা সেখানেই হলো। চুপচাপ সেখানে গেল সে। শান্ত আর বাধ্য মেয়ে বলেই পরিচিত সে। প্রতিবাদ করার ভাষা কোনকালেই তার নেই। মা বলেছে, মাথার উপর ছাদ না হারাতে। বউয়ের অধিকার না পেলো, মাথার উপর ছাদ থাকলেই হলো।
স্টোররুমের অবস্থা খুব খারাপ। চারপাশে ধুলোয় ঢাকা। জিনিসপত্রের মধ্যে আছে পুরোনো বাক্স, ভাঙা শোকেস, আর মরিচা ধরা একটা লোহার খাট। তার উপর অনাদরে অবহেলায় একটা ছেড়া চাদর পরে আছে। খাটের ঠিক পাশে একটা ছোট জানালা আছে। দীর্ঘদিন না খোলায় সেটাতেও মরিচা পরে আটকে আছে। বহু কষ্টে সেই জানালা খুলে আলোর ব্যবস্থা করলো সে। বিছানার চাদর পেতে বসেও পরলো। তার সবসময় নিজের ঘরের শখ ছিলো। তাদের ছোট সেই বাড়িতে বাবা মা আর ভাইয়ের আলাদা ঘর ছিলো। শুধু সে আর তার বোন নাফিজা একসাথে থাকতো। পুরো ঘরে বোনের জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই করা ছিলো। তার জিনিসপত্র শুধু একটা ঝুড়িয়ে রেখেছিলো। মনে মনে হাজারবার কল্পনা কর‍তো, যখন নিজের ঘর হবে তখন সেগুলো সুন্দর করে বাইরে সাজিয়ে রাখবে। নাফিজার দুপুরে ঘর অন্ধকার করে ঘুমানোর অভ্যাস ছিলো। অহনার ভালো লাগতো না মোটেও। তার শখ ছিলো, দুপুরে না ঘুমিয়ে পুরো ঘর আলোকিত করে রাখবে। আবার চাইলে সারারাত আলো জ্বালিয়ে একাজ সেকাজ করবে। কারন রাত এগারোটার পর নাফিজা আর এক মিনিটও আলো জ্বালিয়ে রাখতে দিতো না। ইচ্ছা হলেও কিছু করতে পার‍তো না সে। ইচ্ছা চাপা রাখলে নাকি হারাতে হয়। সে হারাতো সব। তবে আজ পেয়েছে। একদম কানায় কানায় পেয়েছে একটা ঘর। এখানে সে নিজের মতো থাকবে। তার সাথে কি ঘটেছে তা মূহুর্তের জন্য ভুলে গেলো। মনে পরলো যখন ফরিদা এসে দয়া করে তার কিছু পুরাতন শাড়ি ওর মুখের উপর ছুড়ে মারলো তখন। ধ্যান ভেঙে মিনমিন করে বলল,
–একটা ঝাটা লাগতো। ঘর পরিষ্কার করতে হবে।

ফরিদা খেঁকি দিয়ে উঠলো,
–তোমার তো সাহস কম না, তুমি আমাকে হুমুক করছো?

মাথা নিচু করে ফেলল অহনা। এবারেও দয়া করলো ফরিদা। দপাদপ পা ফেলে ঝাটা এনে সরাসরি অহনার মুখের উপর ছুড়ে মারলো।

****
অহনার জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলো। হাতে স্যালাইন চলছে। চোখ পিটপিট করে সম্পূর্ণ সজাগ হতেই দেখে সাদিক ঠিক ওর সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। মাঝে মাঝে হাতে আপেলে কামড় দিয়ে খাচ্ছে। দৃষ্টি সম্পূর্ণ ওর দিকেই স্থির। সেই দৃষ্টি সরানোর নাম গন্ধও ওর মাঝে নেই। অহনাই চোখ সরিয়ে নিলো। চোখ সরাতে দেখে মৃদু হাসলো সাদিক। মুখে থাকা আপেলের টুকরো গিলে বলল,
–তোমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা পাঁচটা আপেল দিয়ে গেছে। আর দুইটা বাকি আছে৷ ওই দুইটা খাবে নাকি খাবো?

অহনা চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। এতো নির্লজ্জ কোন মানুষ হয়! এখন কত ফ্রী হচ্ছে। অথচ আগে! মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–আমি খাবো না। খেয়ে ফেলুন।

–গুড।

বলেই বাকি দুটোও নিমেশে শেষ করে ফেলল। সরকারি হাসপাতালের কোন খরচ নেই। এটাতে একটু নিশ্চিত হলেও বাড়ি ফিরবে কিভাবে সেই টেনশনে পরে গেলো অহনা। ব্যাগে আছে মাত্র আড়াইশো টাকা। ট্রেনে পুরো পথ গেলে স্টেশন থেকে বাড়ি যেতে মাত্র পঞ্চাশ টাকা লাগতো। এখন তো হাজার টাকার ফাঁড়া। টেনশনে ঘেমে উঠলো। সাদিক বিরক্ত হয়ে বলল,
–কিডন্যাপ তো করিনি। তাহলে এতো টেনশন কিসের?

অহনা উত্তর না দিয়ে স্যালাইনের দিকে তাকালো। স্যালাইন শেষের দিকে। মিনিট দশেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। একবার ভাবলো, ফোন দিয়ে টাকা চাওয়া যাক। মাথা নেড়ে সেটাও বাতিল করে দিলো। সাদিকের থেকেও নেবে না। তবে যদি জোর করে তাহলে অন্য কথা। সে নাহয় ফিরে গিয়ে টাকা ফেরত দেবে।
সাদিক জোর করলো না। হসপিটাল থেকে বের হয়েই গাড়িতে চেপে বসলো৷ সাদিকের নিজস্ব গাড়ি৷ ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগে ছিলো সাদিক। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ট্রেনের পিছু পিছুই এসেছিলো৷ অহনা হাত মুঠ করে নিজেকে শক্ত করে গাড়িতে চেপে বসলো৷ দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে মোহাম্মদপুরের সেই ছোট বাসায় আসতে আরো তিন সারে তিন ঘন্টা লেগে গেল।
মাকে দেখেই মাহাদী দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরলো। অহনা ছেলেকে কোলে নিতেই নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাকে। ঘাড়ে মুখ গুজে অভিযোগ করে বলল,
–এতো দেরি করছো কেন? আমি অনেকক্ষন ধরে বসে আছি।

অহনা মৃদু হেসে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
–তুমি না বাবা বাবা করতে। তোমার বাবাকে এনেছি।

মাহাদী মাথা তুলে অবাক হয়ে মায়ের সাথে আসা লোকটাকে দেখলো৷ পরক্ষণেই আবার মায়ের কাঁধে মুখ গুজে দিলো৷ অহনা চিন্তিত স্বরে বলল,
–কি হলো? খারাপ লাগছে?

মাহাদী মুখ না তুলেই ঘাড় নাড়লো৷ অহনা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
–তাহলে বাবার কাছে যাও।

মাহাদী এবারে জোরে জোরে ঘাড় নাড়লো। বাবা তার পছন্দ হয়নি। অহনা ছেলেকে শক্ত হাতে চেপে সাদিকের দিকে ফিরলো। অসহায় স্বরে বলল,
–সবে দেখছে তো তাই লজ্জা পাচ্ছে। একটু পর দেখবেন কোলে উঠে বসে আছে।

সাদিক কাঁধ নাচালো। এতো বড় ছেলের বাবা হয়ে যাওয়া সহজ কথা তো না। ভালো করে মাহাদীকে দেখলোও না সে আর না মাহাদী মায়ের কাঁধ থেকে মুখ তুলল। দুজনেই দুদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো। খুব ক্লান্ত লাগছে সাদিকের। ক্লান্ত গলায় বলল,
–আর কতক্ষণ লাগবে? খুব টায়ার্ড আমি।

অহনা সাদিকের নির্লিপ্ত ভাব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির ভেতর গেলো৷ দুই রুমের ছোট একটা বাসা। বড় বারান্দার এক পাশে বড় কিচেন আর সাথেই একটা ছোট খাবার টেবিল রাখা৷ ভেতরে ছোট একটা বসার ঘর আর দুই পাশে দুই দরজা দিয়ে দুই ঘরে যাওয়ার পথ। ভেতরে একজন ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। অহনাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে রাগ দেখিয়ে বললেন,
–তোর ছেলেকে এরপর পিঠের সাথে বেঁধে নিয়ে যাস। আমি আর কোন দ্বায়িত্ব নেবো না।

অহনা মৃদু হাসলো৷ তার পেছনে সাদিককে দেখে তাড়াহুড়ো করে তিনি বললেন,
–ফ্রীজে সব খাবার রাখা আছে৷ একটু গরম করে নিস।

অহনা মাথা হেলিয়ে সায় জানাতেই ভদ্রমহিলা চলে গেলেন৷ সাদিকের দিকে ভুলেও তাকালেন না৷ অহনা সাদিকের জন্য ঠিক করা ঘরের দিকে ইশারা করে বলল,
–ওটা আপনার ঘর। আর এটা ওয়াশরুম।

বসার ঘরের কোনের একটা ছোট দরজার দিকে ইশারা করে কথা শেষ করল সে। সাদিক একপলক সেদিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো৷ খাট, আলনা আর টেবিলে সাজানো ঘরটা দেখে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার৷ বহু বছর আগের কিছু স্মৃতি আবছা মনে পরলো৷ ধুলোমাখা ঘর, মরিচা ধরা খাট, ইদুর দেখে চিৎকার দিয়ে বেড়িয়ে আসা আর প্রথম চোখে চোখ পড়া। সবটাই কি ভীষন তেতো ছিলো!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে