অবহেলিত ভালোবাসা
পর্বঃ০১
লেখকঃসাকিফ আরেফিন
__ব্যথা যুক্ত ক্লান্ত শরীর টা ফ্লোরে পড়ে আছে তাসনুভার।আজকেও মার খেয়েছে তার স্বামী নীলের হাতে। তবে আজকের মারের পরিমাণ টা অন্য দিনের চেয়ে অনেক টা বেশিই ছিল।
__আজকে তাসনুভার অপরাধ ছিল সে নীলের বেড চা আর নাস্তা দিতে দেরি করে ফেলেছে। নীল এমন একজন স্বামী যে কিনা ঢাকায় আসার পর এমন কোন দিক বাদ রাখে নাই যেই দিক দিয়ে তাসনুভা কে মারতে পারে।
__প্রতি পদে পদে নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে তাসনুভা কে মারা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তাসনুভা তার স্বামীর এমন আচরণ সব মুখ বোঝে সহ্য করে নেয়। কারণ তাসনুভার প্রতিবাদ করার মতো সেই শক্তি আর সাহস নেই। নীল তাসনুভার উপর প্রতিদিন এমন অত্যাচার করে তার ভালোবাসার মানুষ মাহিরার ইশারায়।
__ বড় লোক বাবার ঘরের মেয়ে মাহিরা।নীল মাহিরা কে ভালোবাসে বিয়ের আগ থেকেই প্রথম যেই সময় ঢাকা আসে। আর মাহিরাও এখন রিলেশন চালিয়ে যাচ্ছে এটা জানা সত্বেও যে নীল বিবাহিত। কারণ তার বিশ্বাস নীলের অত্যাচার সহ্য না করে তাসনুভা হয় তো একদিন মরে যাবে না হয় পালিয়ে যাবে।
__ফ্লোরে শুয়ে থেকে ব্যাথায় ছটফট করতে থাকা তাসনুভা কে দেখার মতো কেউ নেই এই বাসায়। তবে কাজের মেয়ে মীরা এসে সেবা শুশ্রূষা করে যায় যখন নীল এইভাবে মেরে চলে যায়। মীরা খুব অসহায় অল্প বয়সী মেয়ে বয়স চৌদ্দ পনের হবে।
__নীল তাসনুভা কে মেরে ফ্লোরে ফেলে চলে যাওয়ার পর আজও তার ব্যাতিক্রম কিছু ঘটে নি।মীরা দৌড়ে গিয়ে তাসনুভার কাছে যায়। মীরা গিয়ে দেখে তাসনুভা ফ্লোরে পড়ে আছে আর গায়ের ওড়না এক সাইডেই পাশে পরে আছে।নাক মুখ দিয়ে রক্ত পরছে। কপাল বেশ খানিকটা ফেটে গেছে। পুরো শরীর ধরে ভয়ে কাপতে থাকা তাসনুভা কে দেখে মীরা নিজেও কেঁদে দেয়।
__মীরা আসতে করে তাসনুভা কে তুলে খাটে নিয়ে বসায়।তাসনুভার সাদা পরিষ্কার গালে নীলের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা আর রক্ত মিশে এক হয়ে বের হচ্ছে। গাল দুটোতে অনেক থাপ্পড় পড়ার কারণে একেবারে ফুলে গেছে। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনো এভাবে বউ কে মারতে পারে না।তার উপর যদি হয় উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের ছেলে।
___মীরা তাসনুভার হাত মুখ নিজের ওড়না দিয়ে মুছে দেয়। তাসনুভা বলে__মীরা বোন আমার পিঠে খুব জ্বালাতন করছে। লাঠি দিয়ে পিঠে খুব মারছে।কিছু একটা করো।মীরা বলে__ জ্বি আপা তাহলে জামা টা একটু খুলেন বরফ লাগিয়ে মলম দিয়ে দিবো।
__তাসনুভা বলে__ হুম,, আচ্ছা তোমার ভাই কি নাস্তা না খেয়ে চলে গেছে..??মীরা বলে__ আপা আপনি কি বলেন তো..?ঐ অমানুষ টা আপনাকে পশুর মতো মেরে ফ্লোরে ফেলে রেখে চলে গেছে। আর আপনি এতো মার খাওয়ার পরও জিজ্ঞেস করছেন খেয়ে গেছে কি না।আজব একটা মানুষ আপা আপনি।
__তাসনুভা বলে__ মানুষ টা না খেয়ে গেলে খাবে কোথায়..?? মীরা বলে__দূর আপা ঐ অমানুষ টার না খাওয়া নিয়ে আপনার এতো চিন্তা করতে হবে না।অফিস থেকে না হয় হোটেল থেকে নাস্তা করে নিবো নে।
__মীরা বলে__ আপনি একটু জামা টা খুলেন আমি ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আসছি। মীরা বরফ আনতে গেলে তাসনুভা টুকরে কেঁদে দেয়। তাসনুভা শুধু এতোটুকুই চিন্তা করে নিজের বাবা মায়ের কাছে কেমন ছিল আর এখন স্বামীর কাছে কেমন আছে।
___আজ বাবা মায়ের সেই আদরের মেয়ে টা স্বামীর ঘরে এসে অন্য মেয়ের ইশারায় স্বামীর মার খেয়ে জীবন কাটাতে হয়।প্রতিদিন নির্মম অত্যাচার- কষ্ট আর তিক্ত কথা সহ্য করতে হয়।তাসনুভার মুখ দিয়ে তখন একটা কথাই বেরিয়ে আসে।বাবা মা আমাকেও আল্লাহর কাছে নিয়ে যাইতা তোমাদের সাথে। তাহলে তো আজ আমার এতো টা কষ্ট পেতে হতো না।
___এরই মাঝে মীরা বরফ নিয়ে এসে দেখে তাসনুভা সেই ভাবেই বসে আছে। মীরা কাছে এসে বলে__ আপা কিভাবেন..?? তাসনুভা চোখের পানি মুছে বলে না কিছু না।মীরা বলে __আচ্ছা জামা টা একটু খুলেন।জামা টা খুলার পর তাসনুভার এমন ভয়ানক পিঠের অবস্থা দেখে আৎকে উঠে সে।
মীরা ভাবতেও পারেনি জানোয়ার টা মেরে পিঠের এই অবস্থা করবে।পুরো পিঠ একেবারে লাল হয়ে কালো লম্বা দাগ হয়ে গেছে। যেহেতু বেত দিয়ে পিঠে আঘাত করছে এমন ভয়ানক অবস্থা হওয়াই স্বাভাবিক।
__মীরা জামা দিয়ে তাসনুভার বুকটা ঢেকে দেয়। তারপর কিছু সময় ধরে বরফ দিয়ে পুরো পিঠে আসতে আসতে চাপ দিতে থাকে।। এরপর গালে ও কপালে বরফ দিয়ে চাপ দিতে থাকে।তাসনুভার পিঠে মলম লাগাতেই জ্বালাতনে হালকা চিৎকার করে উঠে।
___মীরা বলে __আপা মলম লাগিয়েছি তো।তাই কিছুক্ষণ জ্বলবে।এখন জামা টা পড়ার দরকার নাই। তাসনুভা বলে_ হুম। মীরা বলে__ আপা আপনি এখন একটু শুয়ে থাকেন। আমি বাসার কাজ সব করে নিবো।তাসনুভা বলে__ হুম,, তুমি গিয়ে এখন খেয়ে নাও।মীরা বলে__ আপা আপনি খাবেন না..??তাসনুভা বলে __ নারে বোন আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
___সন্ধ্যার পর মীরা এসে বলে__ আপা আপনি আরাম করেন রাতের রান্না টা আমি করে নেই। তাসনুভা বলে__না মীরা বোন, রান্নায় কোন সমস্যা হলে উনি আবার আমাকে মারবে।পরে তোমাকেও কথা শুনতে হবে।মীরা বলে __ এই শরীর নিয়ে কিভাবে রান্না করবেন.??তাসনুভা বলে __ কি করবো বলো,,মারধর যা-ই করে তিন বেলা খাবার আর থাকার জায়গায় টা তো দেয়। আমার মতো গরীবের মেয়ের এটাই তো অনেক।
__মীরা বলে _ কোনদিন না জানি দেখতে হয় আপনাকে মেরে ফেলে রেখে দিছে।তাসনুভা বলে __আচ্ছা এসব বাদ দাও।কিচেনে চলো আমাকে হাতের কাজে কিছু সাহায্য করো।মীরা বলে __ জ্বী আপা চলেন।
__তাসনুভা ভাবে উনি সকালে কিছু খায় নি। দুপুরেও কোন দিন বাসায় খায় না রাতে এসে তো কিছু খাবে।সেই ভাবেই রাতের জন্য ভালো কিছু রান্না করে।রান্না শেষ করে মীরা কে কিচেন গুছাতে দিয়ে রুমে চলে আসে।ফ্রেশ হয়ে খাটে বসতেই তাসনুভার মনে পরে গেলো বিয়ের আগের সোনালী দিন গুলোর কথা।
__কতো সুন্দর একটা পরিবার ছিল তার বাবা কে নিয়ে।তাসনুভার যখন সাত বছর তখন সে তার মাকে হারায়। মায়ের স্নেহ ভালোবাসা বেশি পায় নি।তার বাবাও তাকে মায়ের অভাব টা কোন দিন বোঝতে দেয় নি। অভাবে থাকলেও দিন চলতো খুব সুখে আর আরামে। গ্রামে খুব সুখে শান্তিতে খুব ভালোই ছিল তাসনুভা।দশম শ্রেণিতে পড়তো তাসনুভা। লেখা পড়ায় খুব ভালো ছিল। বাবা গ্রামের এক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের দপ্তরি ছিল। সেই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক হলেন নীলের বাবা।
__একদিন হঠাৎ করে ঘন্টায় বেল দেওয়ার সময় তাসনুভার বাবা মাটিতে পরে যায়। নীলের বাবা পরে যেতে দেখে দৌড়ে আসে তার কাছে। স্কুলের সব শিক্ষক স্টুডেন্ট এই ঘটনা দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। তাসনুভা তখন স্কুলেই ছিল। তাসনুভা আর শিক্ষকরা মিলে তাকে হসপিটাল নিয়ে যায়। হসপিটাল নেওয়ার পর ডাক্তার বলে তিনি আর বেঁচে নেই। মূহুর্তের মধ্যে সবাই ভেঙ্গে পরে। তাসনুভার চোখ দিয়ে বাদ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো পানি পড়তে থাকে। মেয়ে টা যে এখন বড্ড অসহায় হয়ে গেছে।
__নীলের বাবা চিন্তা করে তাসনুভা কে তার চাচার কাছে রেখে দিবে।তাসনুভা কে দেখে শুনে রাখবে।এবং নিজের মেয়ের মতো ভরনপোষণ দিবে। কিন্তু নীলের বাবা যখন তাসনুভার কথা তার চাচা কে বলে তিনি সরাসরি তাসনুভার ভরনপোষণ দিতে অস্বীকার করে।তিনি জানেন এই মেয়ে কে লেখা পড়া করিয়ে বিয়ে দিতে কতো টাকার প্রয়োজন। তাই তিনি নিজ ভাইয়ের মেয়ের ভরনপোষণ দিতে অস্বীকার করে।তবে তাসনুভার চাঁচি রাজি হয়েছিল তাসনুভা কে নিজের মেয়ের মতো ভরনপোষণ দিতে। কিন্তু তার চাচা বারবার অস্বীকার করে। তাসনুভা খুব অসহায় হয়ে পড়েছিল। কোথায় যাবে কি করবে বোঝে উঠতে পারছিল না।
__ অবশেষে নীলের বাবা তাসনুভা কে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। এবং সাথে সাথে নীল কে ঢাকা থেকে বাসায় আসতে বলে। নীল যখন বাসায় এসে জানতে পারে তার বিয়ে কোন গরীব ঘরের মেয়ের সাথে তখন নীল তার বাবার মুখের উপর না করে দেয়। কিন্তু নীলের বাবা কম জেদি না।তিনি জোর করেই যাচ্ছেন তার বিয়ে এই মেয়ের সাথেই হবে। কারণ তিনি একজন শিক্ষক মানুষ ছেলের জন্য কোন টা ভালো খারাপ সেটা তিনি জানেন।
__নীল তার বাবা কে বলে~ দেখ বাবা,, আমি তোমার জন্য এমন একটা মেয়ে কে বিয়ে করতে পারি না।নীলের বাবা বলে__ তাসনুভা অনেক ভালো মেয়ে তাছাড়া সে আমার ছাত্রী।সে কতো টা ভালো খারাপ সেটা আমি জানি। নীল বলে__বাবা সে ভালো নাকি খারাপ আমি তো সেটাও জানতে চাই না।তাছাড়া আমি একজন শিক্ষিত ছেলে ঢাকায় ভালো একটা চাকরিও করছি। আমারও তো কোন পছন্দ থাকতে পারে.??
__নীলের বাবা বলে–তোর পছন্দ মেয়ে কে যে আমার পছন্দ হবে তা নাও হতে পারে। নীল বলে __তাহলে তোমাদের পছন্দ মেয়ে কে আমার পছন্দ হবে সেটা ভাবলে কি করে বাবা। একটু বোঝার চেষ্টা করো বাবা। আমি এই বিয়ে টা করতে পারবো না।
__নীল তার মা কে বলে__মা তুমি কিছু বলছো না কেন..?? বাবা কে একটু বোঝাও।নীলের মা বলে–আমি তোর বাবা কে কি বোঝাবো।তোর বাবা একজন শিক্ষক মানুষ তিনি কখনো কারো খারাপ চায় না।আমিও চাই না মেয়ে টা অসহায় ভাবে জীবন যাপন করুক।
__নীলের বাবা বলে __আমি সবাই কে কথা দিয়ে আশ্বাস দিয়ে আমার ছাত্রীর দায়িত্ব নিয়েছি।বিয়ে তোকে এই মেয়েকেই করতে হবে।নীল জানে তার বাবা কতোটা রাগী আর কতো টা আদর্শবান।কারণ তার শিক্ষক জীবন টা যে নীল নিজ চোখে দেখেছেন। তিনি কতো টা এক কথার মানুষ।
__নীল এক প্রকার ক্ষুব্ধ আর বাধ্য হয়েই বিয়ে টা করে।আর এ-ও ভেবে রেখেছে বিয়ের পর বউয়ের এমন অবস্থা করবে দ্বিতীয় বার বিয়ে করার স্বাদ মিটে যাবে।
__বাসর ঘরে বউ সেজে বসে আছে তাসনুভা। নীল রুমে এসে সোজা শুইয়ে পরে। তাসনুভা এখনো বসে আছে খাটে। বোঝতে পারে শুইয়ে পড়ার কারণ টা কি কারণ এই বিয়েতে নীল সম্মতি দেয় নি।
__এরই মাঝে নীলের ফোনে কল আসাতে ফোন টা হাতে নিয়ে বাহিরে চলে যায়। কিছুক্ষন পর যখন নীল রুমে আসে তাসনুভা কে এখনো খাটে বসে আছে দেখে হাত ধরে টেনে নিচে ফেলে দেয়। এবং কিছু বিশ্রী ভাষাও ব্যবহার করে।আর নীলের শেষ কথা টা ছিল তুই যদি এক বাপের জন্মের হয়ে থাকিস তাহলে কখনো আমার খাটে ঘুমাতে আসবি না।
চলবে…