অবশেষে সন্ধি হলো পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

1
1384

#অবশেষে_সন্ধি_হলো
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা:ইনায়া আমরিন

প্রকৃতির পরিবর্তনে দেখতে দেখতে কেটে গেছে চারটি বসন্ত।বদলেছে দিনকাল মাস বছর।বদলেছে পরিবেশ পরিস্থিতি। কিন্তু বদল ঘটে নি কিছু মানুষ আর কিছু মিষ্টি সম্পর্কের। সম্পর্কগুলো এখনো চলে আগের নিয়মে। দু’ষ্টু মিষ্টি খুনসুটি ঝ’গড়া মান অ’ভিমান।আবার সব ভুলে কাছে আসা, ভালোবাসা।এই তো চলছে জীবন।

অফিস থেকে ফিরেছে দীপ্ত। শরীরের প্রতিটা অঙ্গে অঙ্গে ক্লান্তি যেনো চিড়’মিড়িয়ে উঠছে।রুমে ডুকে প্রথমেই চোখ পড়ে বিছানার ওপর থাকা ছোট্ট একটা প্রাণের দিকে।তাকে রুমে ঢুকতে দেখে ছোট্ট প্রাণটি তার বড়ো বড়ো মায়াভরা দুটো চোখ দিয়ে দীপ্তের দিকে তাকায়। খুব আপন মানুষকে দেখে ছোট্ট প্রাণটি ভুবন ভোলানো দন্তহীন হাসি দেয়। ছোট ছোট হাত পা গুলো সমানে নড়া চড়া করে।যেনো বোঝাচ্ছে “আমাকে কোলে নাও।”

সন্তানের এমন দৃশ্য দেখার পর একজন বাবার শরীরে ক্লান্তি থাকে?
দীপ্তের এতোক্ষণের সব ক্লান্তি শে’ষ। ব্লেজার খুলে এক কোণে রাখে।মুখে অপূর্ব এক হাসি নিয়ে তার সাত মাসের ছেলের সামনে যায়। ঝুঁ’কে তাকায় ছোট খাটো মুখটার দিকে।বলে_

“বাবা। আমার বাবা কী করে?খেলা করে?”

তারপর ছোট ছোট হাত ছুঁয়ে বলে_

“আমার বাবা কী খেয়েছে নাকি না খেয়ে খেলা করছে?”

দীপ্ত আর উর্মির ছেলে রাফিদ মাহবুব।যার বয়স মাত্র সাত মাস।নামটা উর্মি দেয়া।যখন সে অ’ন্তঃস’ত্ত্বা ছিলো তখনই দীপ্তকে বলেছে যদি ছেলে হয় তাহলে নাম সে ঠিক করবে আর মেয়ে হলে দীপ্ত।দীপ্তও এক কথায় রাজি হয়ে গেছে।অনেক অপেক্ষার পর তাদের ভালোবাসার ফুল হয়ে এসেছে রাফিদ।বাবা হওয়ার পর দীপ্তের প্রতিদিনই ঈদের মতো আনন্দ লাগে। অফিস থেকে ফিরে উর্মির মিষ্টি হাসি আর ছেলের নিষ্পাপ মুখ দেখলে এক পৃথিবী সুখ অনুভব করে সে।

বাবাকে পেয়ে রাফিদ বার বার হাত পা উঠায়।ছেলে যে কোলে উঠতে চাইছে বুঝতে পারে দীপ্ত।হেসেই বলে_

“বাবা তো এখন কোলে নিবে না।বাবা বাহিরে থেকে এসেছে না?ধূলোবালি লেগে আছে। ধূলোবালি নিয়ে কী রাজপুত্রকে কোলে নেয়া যায়?আগে বাবা ফ্রেশ হবে তারপর কোলে নিবে।ওকে?”

রাফিদ নিজস্ব ভাষায় আওয়াজ দেয়। দীপ্ত মুখে হাসি নিয়ে ওয়াশরুমে যায়।বাবা যেদিকে যাচ্ছে রাফিদও চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেদিক তাকাচ্ছে।

টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয় দীপ্ত।আসার পর থেকে উর্মিকে দেখে নি।তাই জোরে হাঁক ছেড়ে বলে_
“মিসেস রাদিয়া রহমান দি ওনার অব মাই হার্ট। কোথায় আপনি ম্যাডাম?”

“আসছি।” কিচেন থেকে আওয়াজ দেয় উর্মি।

দীপ্ত বিছানা থেকে রাফিদকে কোলে নেয়।বাবার কোলে উঠে রাফিদের খুশির শেষ নেই।মুখ দিয়ে আওয়াজ করে। আঙুল মুখে ঢুকিয়ে চু’ষতে থাকে।

দীপ্ত কিচেনে ঢোকে।উর্মি কিছু একটা বানাচ্ছে।সামনে গিয়ে বলে_
“কী করছো?”

উর্মি এক প্লেট মোমো সাথে সস দিয়ে দীপ্তের দিকে বাড়ায়।মুখে হাসি নিয়ে বলে_
“আপনার জন্য বানিয়েছি।কালকে খেতে চেয়েছিলেন যে।”

দীপ্তের রাতে মোমো খেতে ইচ্ছে করছিলো তাই সে ভেবেছিল ফুডপান্ডাতে অর্ডার করবে। কিন্তু উর্মি দেয় নি। সে বলেছিলো সে খাওয়াবে। দীপ্তের কথা হচ্ছে এতো ক’ষ্ট করে বানানোর দরকার নেই সে অর্ডারই করবে।উর্মিও নাছোড় বান্দা।সে ইউটিউবে রেসিপি দেখে হলেও করবে।আর নিজের হাতে বানিয়ে দীপ্ত খাওয়াবে।আজকে সেটাই করলো।এই প্রথম সে মোমো বানিয়েছে।কেমন হয়েছে জানে না।তাই ভাবলো যার জন্য বানিয়েছে তার কাছেই শুনবে।

মোমোগুলো দেখতে খুবই পারফেক্ট লাগছে।দীপ্ত উর্মিকে বলে_
“তুমিই খাইয়ে দাও।”

উর্মিও একটা মোমো সসে মিশিয়ে দীপ্তের মুখে তুলে দেয়।রাফিদ সেদিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে এগুলো কী?বাবাকে খেতে দেখে সেও খাবে।হাত বাড়িয়ে প্লেটে থাবা দেয়ার চেষ্টা করে। বোঝাচ্ছে “আমিও খাবো,আমাকেও দাও।”

উর্মি হেসে প্লেট সরিয়ে ফেলে। রাফিদের ফুলো ফুলো গালে একটা চুমু খেয়ে বলে_
“এগুলো খাওয়ার বয়স হয়নি এখনো।যখন হবে তখন খাবে কেমন?”

মায়ের দিকে বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে আছে রাফিদ।বুঝে ফেলেছে তাকে এগুলো খেতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সে তো খাবেই।বাবার কোলে থেকেই নড়াচড়া শুরু করে বারবার থাবা দেয়ার চেষ্টা করে।সফল হয় না বাচ্চাটা।

একটা মোমো মুখে দিয়েই স্বাদে চোখ বুজে ফেলে দীপ্ত।বলে_
“উমমম!ট্যু গুড।আরো একটা দাও।”

দীপ্ত যখন উর্মির হাতে বানানো খাবার খেয়ে তৃপ্তি পায়, প্রশংসা করে তখন উর্মির ভেতরটা প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। খুব খুশি হয়।আরো একটা মোমো খাইয়ে দেয়।
বাবার খাওয়ার দিয়ে তাকিয়ে আছে রাফিদ। আবার উর্মির হাতের প্লেটের দিকে তাকায়।ছোট ছোট হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করে।কেউ তাকে দিচ্ছে না।এবার সে ঠোঁট ফুলায়।চোখে মুখে কান্না কান্না ভাব।এটা দেখে দীপ্ত আর উর্মি দুজনেরই হেসে ফেলে।বাবা মায়ের হাসি দেখে রাফিদ সত্যি সত্যি কেঁদে দেয়।তাকে কেনো দেওয়া হলো না?এটাই তার কষ্ট।

ছোট রাফিদ কে নিয়ে পুরো বাসায় চক্কর কা’টে দীপ্ত।এটা সেটা বলে।খেলনা দেখিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে।আস্তে আস্তে সফলও হয়। মোমোগুলোও খুব মজা হয়েছে।তাই উর্মিকে চোখের ইশারায় বলে তাকে খাইয়ে দিতে। কিন্তু রাফিদের সামনে খাওয়া যাবে না।তাই রাফিদকে ভেলকি দেখিয়ে বলে_

“বাবা দেখো তো ওটা কী?”

বাবার ইশারায় জানালার বাহিরে তাকায় রাফিদ।এর ফাঁকে উর্মি আরো এক পিস মোমো দীপ্তের মুখে পুরে দেয়।বাহিরে তেমন কিছু খুঁজে না পেয়ে ছোট রাফিদ আবার বাবার দিকে তাকায়।দীপ্ত মুখের খাবার চাবানো বন্ধ করে।রাফিদ তার ছোট ভ্রুযুগল হালকা কো’চকায়। দীপ্তের ঠোঁটে হাত রাখে।বাবার মুখটা ফুলো ফুলো লাগছে কেনো?দেখার জন্য দীপ্তের ঠোঁট ফাঁক করার চেষ্টা করে। ছেলের এসব দেখে উর্মি খুব ক’ষ্টে হাসিটা কন্ট্রোল করছে।

এমন একটা লোভনীয় খাবার মুখে এতোক্ষণ আ’টকে রাখা যায়? ছেলের জন্য খাওয়াও যাচ্ছে না।তাই উপায় না পেয়ে হ’ঠাৎ করে এক হাত দিয়ে রাফিদের চোখ দুটো আলতো করে ঢেকে ফেলে দীপ্ত।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মুখের মোমোটা শে’ষ করে। তারপর চোখ থেকে হাত সরিয়ে হেসে ফেলে। উর্মি নিজের হাসি আর চেপে রাখতে পারে না। দুজনেই শব্দ করে হাসে।রাফিদের চোখ যায় উর্মির হাতের প্লেটের দিকে।সে আবার বুঝে ফেলেছে।এবার ভুবন কাঁপানো কান্না শুরু করে দেয়।দীপ্ত হাসতে হাসতে বলে_

“আচ্ছা স্যরি স্যরি।আর খাবো না যাও।”
.

মাহমুদা দিদার সাহেব কেউ বাসায় নেই।তারা সাজেক গিয়েছে প্রকৃতির মাঝে কিছু সময় কা’টাতে।সাথে রাবেয়া আর আশফাক সাহেবও আছে।
মূলত পরিকল্পনা ছিলো পুরো পরিবারসহ যাওয়ার। কিন্তু অফিস দীপ্ত সামলায়।এভাবে হুট করে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া রাফিদ ছোট।এতো লম্বা জার্নি বাচ্চাটা নিতে পারবে না।অন্যদিকে আহনাফও অফিস থেকে ছুটি পাবে না।ছেলেরা না গেলে তাদের বউরাও যাবে না।তাই বড়োরা আর যেতে চাইলো না।

কিন্তু দীপ্ত বলেছে তারা যেনো ঘুরে আসে।সবাই মিলে না হয় অন্য সময় যাওয়া হবে। আহনাফও দীপ্তের কথায় সায় দেয়।উর্মি আর অথৈও তাই বলে।একরকম জোর করেই মা বাবাদেরকে পাঠিয়ে দেয়।ঘুরাঘুরির কোনো বয়স নেই এইটাই মূখ্য বিষয়।

একটা সময় রাবেয়া কষ্ট করেছে স্বামী সন্তান সংসার নিয়ে।সারাক্ষণ সংসারের কাজেই ব্যস্ত ছিলো।তাই সেইভাবে ঘুরাফেরা হয় নি।এখন এই বয়সে এসে স্বামীর সঙ্গে ঘোরার মতো এমন সৌভাগ্য হলো তার।যা কখনো কল্পনাও করে নি রাবেয়া।
.

রহমান ভিলা_
প্রায় একবছর আগেই বাড়িটা করেছে আশফাক সাহেব। আহনাফও হেল্প করেছে।বাড়ির কাজ চলাকালীন সময় বাবা ছেলে দুজনে মিলে তদারকি করে সব দেখাশোনা করেছে।পুরো কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার এক মাস পর দীপ্তদের বাসা থেকে নিজেদের বাসায় শিপ্ট হয় তারা।

এখন বাসায় শুধু অথৈ আর আহনাফ আছে। অনেক আগেই আহনাফ আর অথৈয়ের অনুষ্ঠান করে অথৈকে নিয়ে আসা হয়।সেই থেকে অথৈয়ের নতুন সংসার শুরু। দু’ষ্টুমি,রা’গ অ’ভিমান,ঝ’গড়া করে কে’টে যাচ্ছে তার আর আহনাফের ছোট সংসার।

এই যেমন এখন মোটাসোটা ভারি শরীর নিয়ে মুখ গো’মড়া করে দরজার হাতলে এক হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অথৈ।আর তার আরেক হাত আহনাফের হাতে।তাকে আলতো করে টানছে আহনাফ।মুখে বলছে_

“আমি সত্যি ভুলে গেছিলাম।স্যরি বলেছি তো।”

অথৈ সেভাবেই দাড়িয়ে আছে।মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।কী চেয়েছে?বেশি কিছুতো চায় নি।একটু ফুচকা খেতে চেয়েছে।আজকে এক সপ্তাহ থেকে আহনাফকে বলছে তাকে একটু বাহিরে নিয়ে যেতে। ফুচকা খাওয়াতে। কিন্তু আহনাফ কিছুই করছে না।ফুচকাও আনে না। রা’গ হয় না?সে কথাই বলবে না আজকে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে আহনাফ। অথৈয়ের কাছে এসে গালে হাত দেয়।ফুলো ফুলো অ’ভিমানী চেহারাটা নিজের দু হাতের আগলে নেয়। প্রেগনেন্সির কারনে অথৈয়ের শারীরিক গঠন অনেক পাল্টেছে।শুকনো শরীরের মেয়েটা এখন মোটাসোটা তরতাজা হয়ে গেছে।যার জন্য আহনাফ মাঝে মাঝে “গোল আলু” বলে ক্ষে’পায়।

অথৈকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে_
“এসব আনহাইজেনিক খাবার আমাদের বেবির জন্য ভালো না। একটু বোঝার চেষ্টা করো।”

তারপর বেবি বাম্পের ওপর আলতো করে হাত রেখে বলে_
“ও চলে আসুক।তুমি সুস্থ হও। তারপর তুমি যা খেতে চাইবে আমি সব খাওয়াবো,প্রমিস।”

কথাগুলো অথৈ এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছে। নিজের কথায় অনড় সে।বলে_
“আমি এখনই খাবো।”

“কাকে বোঝালাম এতোক্ষণ?” আফসোসের সুরে বলে আহনাফ।অথৈ মুখ ঘুরিয়ে নেয়।যেনো আজকে সে মনোস্থির করেছে ফুচকা খাবেই।

আহনাফ বুঝতে পেরেছে আর বলে লাভ নেই।তাই চলে যায় রান্নাঘরে।এতো রাতে কোনো ফুচকার দোকান খোলা থাকবে না।আর সে অথৈকে বাহিরের খাবার খাওয়াতেও চায় না। দরকার হলে ক’ষ্ট করে সেই বানাবে বউয়ের জন্য।ফোন অন করে ইউটিউব দেখে।প্রায় চার পাঁচ বার করে ভিডিও দেখে ফুচকার রেসিপি মুখস্থ করে নেয়।

অথৈ ভারি শরীর নিয়েই চুপিচুপি আহনাফের কান্ড দেখে।এখন সে ফুচকা বানাবে নাকি? দারুন তো।
অথৈ রান্নাঘরে ঢোকে।ঘুর ঘুর করে আহনাফকে দেখে। কিন্তু আহনাফ একবারও তাকায় না।মুখ গম্ভীর করে ফোনে রেসিপি দেখে মনযোগ দিয়ে।

তারপর শুরু করে দেয় তার কাজ। ফুচকা বানাতে সুজি লাগে। কিন্তু সুজির পটে সুজি খুব কম। আহনাফ তা দিয়েই ফুচকার ডো বানানো শুরু করে তবে আরেকটু সুজি দরকার।কি করা যায়?আটার পটে চোখ পড়ে। বাকিটুকু আটা দিয়ে মেখেই কাজ চালায়।ডো মাখতে মাখতে তার ঘাম ছুটে যায়। অথৈয়ের মায়া হয়। নিজের ওড়না দিয়ে যত্ন করে আহনাফের কপালের ঘাম মুছে দেয়। তারপর মিন মিন করে বলে_

“থাক কষ্ট করতে হবে না।আমি খাবো না।”

আহনাফ উত্তর দেয় না।তার বউ খেতে চেয়েছে তাই সেটা সে করবেই। এক্সপেরিমেন্ট ও হলো বউয়ের খাওয়াও হলো।অথৈ খুশি তো সেও খুশি।
ডো টাকে বড়ো একটা শেপ বানিয়ে একটা গোল ঢাকনার সাহায্য ছোট ছোট পুরি বানায়। তারপর কড়াইয়ে তেল দিয়ে সেগুলো দিয়ে দেয়।কয়েটকা ফুচকা ফুলেছে আর কয়েকটা ফুলে নি।এটা কোনো ব্যাপার নয়। অথৈ বলছে_

“দিন বাকিগুলো আমি ভেজে ফেলি।”

আহনাফ দেয় না। কিন্তু অথৈ জোর করে নেয়।তাই আর কিছু বলে‌ না। সে চলে যায় পরবর্তী স্টেপে।

শুরুতেই দুটো আলু সেদ্ধ দিয়েছিলো। সেগুলো নামিয়ে চামড়া তুলে নেয়।চপিং বোর্ডে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, টমেটো, ধনেপাতা কুচি করে নেয়। এগুলো করতে গিয়ে আহনাফের চোখের পানি নাকের পানিতে একাকার।অথৈ এবার সত্যি সত্যি ক’ষ্ট পায়।তার জন্য এই অবস্থা। সবগুলো ফুচকা ভেজে। আহনাফের কাছে যায়। আবার ওড়না দিয়ে চোখ মুখ মুছে দেয়। কিছু বলার আগেই আহনাফ বলে_

“তোমরা মেয়েরা কীভাবে প্রতিদিন এসব কাজ করো। একদিন করেই তো আমার নাজেহাল অবস্থা হচ্ছে।”

ফিক করে হেসে ফেলে অথৈ। আহনাফও হাসে।আসলে যতোটা সহজ ভাবে দেখে,রান্নাবান্নার কাজ অতোটাও সহজ নয়।আজকে সেটা উপলব্ধি করলো।

সবগুলো উপকরণ মিশিয়ে আলুর সাথে মাখিয়ে সাথে মশলা দিয়ে ফুচকার পুর তৈরি করে। সেকেন্ড স্টেপটাও ডান।

এবার শেষ স্টেপ হচ্ছে টক।ফ্রিজ খুলে তেঁতুলের বয়াম বের করে। সেখান থেকে তেঁতুল বের করে পানিতে দেয়। কিন্তু একি?তেঁতুল তো পানির সাথে মিশে না। আহনাফ আবার ভিডিও দেখে।একটা ভু’ল করে ফেলেছে। মহিলাটা বলেছিলো টকের জন্য তেঁতুল আগে থেকে ভিজিয়ে রাখতে হবে।এখন এটা ভেজা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

তা দেখে অথৈ বলে_
“এতোক্ষণ অপেক্ষা করতে পারলে আরো কিছুক্ষণও পারবো।”

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তেঁতুলগুলো নরম হয়। আহনাফ হাত দিয়ে গুলিয়ে দেখে এবার তারা সুন্দরভাবে পানির সাথে মিশে যাচ্ছে।মুখে হাসি ফোটে তার।এসব ক’ঠিন কাজ হলেও করতে কিন্তু বেশ লাগছে।সব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার স্যাপার।

অবশেষে তেঁতুলের টকও তৈরি করে ফেলে সে। সুন্দর করে একটা ট্রেতে ফুচকা,পুর আর টক সাজিয়ে হাতে করে নিয়ে টেবিলে আসে।

অথৈ গালে হাত দিয়ে বসে অপেক্ষা করছিলো।এখন আহনাফের হাতে এসব দেখে তার খিদে দশগুণ বেড়ে গেলো। আহনাফ ট্রে টেবিলে রেখে বলে_
“নিন আপনার ফুচকা।”

একটা সেকেন্ড সময় নেয় না অথৈ।দ্রুত কুড়মুড় করে একটা ফুচকা ভেঙে পুর ঢুকিয়ে টকের মধ্যে ডুবিয়ে মুখে পুরে ফেলে।

“উমমমম!বেস্ট ফুচকা এভার।”

ননস্টপ খেয়েই যাচ্ছে অথৈ।অনেক অনেক দিন পর তার পেটে ফুচকা পড়েছে।তাও আবার জামাইয়ের বানানো। তাই তৃপ্তি করে খাচ্ছে।

আহনাফ গালে হাত দিয়ে অথৈয়ের খাওয়া দেখছে।ক’ষ্ট হয়েছে একটু তবে অথৈয়ের জন্য সে সবরকমের ক’ষ্ট করতে রাজি।এই মেয়েটার মুখের হাসি যে তার শান্তির কারণ।

অর্ধেক ফুচকা খাওয়ার পর অথৈ একটা ফুচকা আহনাফের মুখের সামনে ধরে। আহনাফ নাকোচ করে বলে_

“আমি খাবো না।”
“আপনি নিজে বানিয়েছেন অথচ টেস্ট করবেন না?”
অথৈয়ের কথা শুনে খেয়ে নেয় আহনাফ।

নাহ ওতোটাও খা’রাপ না।ভালোই হয়েছে। আহনাফের মুখে ভঙ্গিমা দেখে অথৈ আরো কয়েকটা ফুচকা নিজের হাতে খাওয়ায়। আহনাফও না করে না।খেয়ে নেয়।

পেট ভরে ফুচকা খেয়েছে।পেট শান্তি মনও শান্তি।এবার শান্তির ঘুম দিবে অথৈ। আহনাফের বুকে মাথা রাখে।এক হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখে আহনাফও।বলে_
“এবার খুশি?”
“খুউউউব। অনেকগুলো লাভ ইউ।”

আহনাফ হাসে। আলিঙ্গন শ’ক্ত করে।
.

পরদিন শুক্রবার।অফিস বন্ধ।আহনাফ অথৈকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়।অথৈয়ের ডেলিভারি সময় হয়ে এসেছে তাই আহনাফ ওকে নিয়ে বের হতে চাই নি। তবে সারাক্ষণ বাসায় থেকে যে মেয়েটার এক’ঘেয়েমি লাগছে সেটাও বুঝতে পেরেছে।তাই আজকে অথৈকে নিয়ে বের হয়েছে।
দীপ্তকে ফোন করে বলে উর্মি আর রাফিদকে নিয়ে আসতে। দীপ্তরও আজকে ছুটি।তাই ভাবলো হ্যা ঘুরে আসাই যায়।মনও ভালো থাকবে।

সবাই মিলে নদীর পাড়ে আসে।একটা শান্তিপূর্ণ মনোরম পরিবেশ।মন মস্তিষ্ক সতেজ করার জন্য নদীর পাড়ের তুলনা হয় না। চারিদিকে হালকা ঠান্ডা বাতাসে সবার মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে।
এতো সুন্দর জায়গায় এসে রাফিদ তো মহাখুশি।মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।হাত দিয়ে দেখাচ্ছে।

গুলুমুলুটাকে কোলে নিতে খুব মন চাচ্ছে অথৈয়ের। কিন্তু এই অবস্থায় নেয়া ঠিক হবে না।তাই চাইলেও পারছে না। শুধু একটু পর পর রাফিদের নরম টসটসে গালগুলোতে চুমু খাচ্ছে।

আহনাফ অথৈয়ের দিকে খেয়াল রাখছে।ওর ভ’য় লাগছে একটু এদিক সেদিক হলেই বড়ো বিপদ হয়ে যেতে পারে।তাই অথৈয়ের হাত আঁকড়ে ধরে রাখে।
অনেকক্ষণ পার হয়ে যায় নদীর পাড়ে। এখানে ছোট একটা রেস্টুরেন্টেও আছে। সেখানে সবাই গিয়ে হালকা খাবার খায়।

অথৈয়ের হ’ঠাৎ কেমন হাঁ’সফাঁস লাগছে। শরীর ঘামছে। কিন্তু তেমন গুরুত্ব দিলো না। একটুপর পেটে ব্য’থা অনুভব করে।নড়ে চড়ে বসে।

অথৈকে দেখে আহনাফ আস্তে জিজ্ঞাসা করে_
“শরীর খা’রাপ লাগছে?”
অথৈ হালকা হেসে বলে_
“না ঠিক আছি।”

কিছুক্ষণ পর আর মোটেও ঠিক থাকতে পারলো না।পেটে অস’হ্য রকমের ব্যা’থা শুরু হলো।স’হ্য করতে না পেরে চিৎ’কার করে আহনাফকে ডাকে।

অথৈয়ের চি’ৎকার শুনে আহনাফ হৃদপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে।ব্যা’থায় অথৈয়ের মুখ লালচে বর্ণ ধারণ করে।চোখ দিয়ে পানি পড়ে।কান্না করে দেয় মেয়েটা।

আহনাফের মনে হচ্ছে ওর কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
উর্মি রাফিদকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসে।আসে দীপ্তও।

উর্মি এক হাত দিয়ে অথৈকে শান্ত হতে বলে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে_
“ভাইয়া আমার মনে লেবার পেইন হচ্ছে।ওকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে চলো।”

দীপ্ত বলে_
“আমি গাড়ি সামনে নিয়ে আসছি।অথৈকে জলদি নিয়ে এসো আহনাফ।”

অথৈয়ের চিৎ’কার আর কান্না দেখে ছোট রাফিদও কেঁদে ফেলে।ওকে সামলাচ্ছে উর্মি।

আহনাফ অথৈয়ের মাথা বুকে চেপে ধরে। আহনাফের শরীর কাঁপছে। স্বামীর বুকে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ফেলে মেয়েটা।ব্যা’থার তীব্রতা এতো বেশি মনে হচ্ছে নাড়িভুঁড়ি সব ছিঁড়ে যাচ্ছে।এতো ক’ষ্ট।

আহনাফ দেরি করে না।কোলে তুলে নেয় অথৈকে। গাড়িতে গিয়ে বসায়,নিজেও বসে।উর্মিও রাফিদকে নিয়ে সামনে দীপ্তের পাশের সিটে বসে।আর পেছনে আহনাফ আর অথৈ।দীপ্ত দ্রুত গাড়ি স্ট্রার্ট করে।
.

একশো পাচ নাম্বার কেবিন_

ছোট একটা নবজাতক বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে।পাশে অথৈ।মা মেয়ে দুজন ঘুমে।আর আহনাফ তাদের দুজনকে দেখছে,মন ভরে দেখছে। চোখগুলো লাল হয়ে ফুলে আছে।অথৈয়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কতো কেঁদেছে আজকে‌। চোখের পানির দাগ এখনো আছে গালে। হাত দিয়ে গাল ধরে। মুখ বাড়িয়ে চুমু খায় ঘুমন্ত অথৈয়ের কপালে।

তারপর তার মেয়ের দিকে তাকায়।সাদা টাওয়ালে পেঁচিয়ে ছোটখাটো একটা শরীরকে তুলে দেওয়া হয়েছিলো তার কোলে। কী এক অনুভূতি যে ছিলো।
সেই রাগী গম্ভীর আহনাফ রহমান এখন এক কন্যা সন্তানের বাবা।ভাবলেই শরীরের শিরায় শিরায় ক’ম্পন ধরে।

দাদা হওয়ার খুশিতে আশফাক সাহেব আর থাকতে চান না। শুধু উনিই নয়, পরিবারে নতুন সদস্য আসার আনন্দে কেউ আর থাকতে চায় নি।সবাই চলে এসেছে।অথচ আসার কথা ছিলো আরো দুটোদিন পর।

পুরো কেবিন জুড়ে সবাই দাড়িয়ে আছে। আশফাক সাহেব, রাবেয়া, দিদার সাহেব, মাহমুদা, উর্মি,দীপ্ত তার কোলে তার ছেলে রাফিদ। শুধু তাই নয় হোসেন আরাও আসছেন।তিনিও তো নানি হয়েছেন।শুনেই অর্ককে নিয়ে কুমিল্লা থেকে ছুটে আসছেন।বদলি হয়েছেন কুমিল্লার।তাই মেয়েকে চাইলেও সহজে দেখতে পারেন না। কিন্তু এখন নানি হওয়ার আনন্দে কে ধরে রাখে উনাকে।

আহনাফ নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অথৈ মুখভর্তি হাসি নিয়ে বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। সবাইকে দেখছে।

আশফাক সাহেব ভেজা চোখে ছেলেকে আর নাতনিকে দেখছেন।তার সেই ছোট্ট আহনাফও আজ বাবা হয়ে গেছে তিনি হয়ে গেলেন দাদা। সময়ের কতো সুন্দর পরিবর্তন।

রাবেয়ার চোখেও পানি। শেষ এই চোখে পানি এসেছে রাফিদ হওয়ার সময়।নানি দাদি দুটোই হয়ে গেছে।কী সুখ!

মাহমুদা সবাইকে মিষ্টিমুখ করায়। আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে_
“মেয়ের নাম কী রাখবে ঠিক করেছো কিছু?”

আহনাফ হাসে। অথৈয়ের দিকে তাকায়। অথৈও তারদিকে তাকিয়ে হাসে। তারপর দুজনে একসঙ্গে বলে_

“আহানা রহমান ঐশি।”

নামটা সবারই খুব পছন্দ হয়।উর্মি আহনাফের কোল থেকে ঐশীকে নিজের কোলে নেয়।তা দেখে রাফিদ কেঁদে ওঠে। দীপ্তের কোল থেকে হাত পা ছুঁড়ে। তার মায়ের কোলে এই বাচ্চাটা কে?

ছেলের অবস্থা দেখে দীপ্ত তাকে উর্মির সামনে নিয়ে যায়। আঙুল দিয়ে ঐশিকে দেখায়। ছোটখাটো মুখটা বাড়িয়ে রাফিদ দেখে ঐশীকে। কান্না থেমে যায়।হাত বাড়িয়ে ঐশীর মুখটা ছুঁয়ে দিয়ে হেসে ফেলে। একবার ছোয় দুবার ছোয় পর পর কয়েকবার ছোয়।যেনো তার খুব ভালো লাগছে।
সবাই হেসে ফেলে রাফিদের কান্ডে।

ভালোবাসা মায়া মমতায় জুড়ে থাকুক সুন্দর পবিত্র বন্ধনগুলো।যুগ যুগ ধরে জুড়ে থাকুক।

সমাপ্ত

(টেনে ফেললাম সমাপ্তি। আমার লেখা প্রথম গল্প। সত্যি বলতে এই গল্পটা লেখার একটা উদ্দেশ্য ছিলো।তা হলো আমি এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলাম আমি লেখালেখি করার ক্ষেত্রে কতটুকু যোগ্য।সেটা নির্ভর করতো পাঠক প্রতিক্রিয়াতে।আর আমি যতটুকু আশা করেছিলাম তারচেয়ে বেশি সাপোর্ট আপনারা আমাকে দিয়েছেন।আমি অনেক বেশিই কৃতজ্ঞ।এবার গল্পটা কেমন লাগলো জানাবেন প্লিজ?আমি আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।আমি শুধু দেখতে চাই কতটুকু সফল হয়েছি।ভু’ল ত্রু’টি পেলে সুন্দর করে ধরিয়ে দিবেন ।আমি গ্রহণ করে নিজের ভু’লগুলো শুধরে নেবো।সবাইকে অনেক অনেক ভালোবাসা।♥️)

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে