#অবশেষে_সন্ধি_হলো
#পর্ব :১৪
#লেখিকা : ইনায়া আমরিন
বিবাহিত জীবনের বারোটি সপ্তাহ পেরলো। পরিবার,সংসার আর দীপ্তকে নিয়ে দারুণ সময় যাচ্ছে উর্মির।বাবা মা ভাইকে ছেড়ে নতুন পরিবারে এসে উর্মির মানিয়ে নিতে তেমন অসুবিধা হয় নি।দীপ্ত এখন তার বন্ধুর মতো। দুজনের মধ্যে যতো দ্বিধা সংকোচ ছিলো তা অনেকটাই কেটে গেছে।সকালে যখন দীপ্ত অফিস যায় তখন সবসময় উর্মিকে বলে তার চুল ব্রাশ করে দিতে,টাই বেঁধে দিতে,ব্লেজার পরিয়ে দিতে, নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে দিতে। উর্মিও খুব যত্ন নিয়ে সব করে দেয়।তার খুব ভালো লাগে এসব কাজ করতে।প্রথমে দীপ্ত বললেও এখন বলার আগেই সব করে উর্মি।প্রথম প্রথম রাতে দীপ্ত তাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতো।এখন দীপ্ত বলার আগেই সে নিজেই দীপ্তের বুক দখল করে নেয়। দীপ্তকে আঁকড়ে পরম শান্তিময় ঘুম দেয়। অফিস যাওয়ার পর কয়েকঘণ্টা পর পর দীপ্তের কল আসে।রিসিভ করতে সময় নেয় না উর্মি। তাদের কথা চলতে থাকে অনেকক্ষণ। মাঝে মধ্যে দীপ্ত তাকে নিয়ে ঘুরতে যায়।কখনো নদীর পাড়ে কখনো গ্রামের পাশের মনোরম পরিবেশে কখনো খোলা আকাশের নিচে হেটে আবার কখনো বা স্ট্রেট ফুড ডেটে।
সারাদিন দীপ্ত বাসায় থাকে না সেই সময়টা উর্মি ঘরের কাজ করে আর শাশুড়ির সাথে সময় কাটায়।
শাশুড়ি হিসেবে মাহমুদা যথেষ্ট আন্তরিক।মেয়ে সন্তানের সুখ পান নি। সেই নিয়ে অবশ্য উনার আফসোস নেই। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন দীপ্তের বউ হবে উনার মেয়ে।তাকে একদম মেয়ের মতো আদরে যত্নে রাখবেন। করছেনও ঠিক তাই।
মায়ের মতো করে উর্মিকে অনেক কিছু শেখান। রান্নাবান্না সবই মোটামুটি জানে উর্মি।এই রান্নাবান্নাকে আরো সুস্বাদু করার জন্য বা কিছু একটু উল্টো পাল্টা হলে সেটা ঠিক করে নেওয়ার মতো দারুন দারুন ট্রিক্স শিখিয়ে দেন।তিনি খুব ভালো সেলাইয়ের কাজ জানেন।যেটা উর্মি জানে না। উর্মি শাশুড়ির কাছে আবদার করেছে সেও শিখতে চায়। উর্মির মধ্যে নতুন নতুন কাজ শিখতে চাওয়ার মনোভাব মাহমুদার ভীষণ ভালো লাগে।তিনি নিজের হাতে প্রতিদিন বিকেল বেলা এক ঘন্টা সময় দিয়ে উর্মিকে সেলাই শেখান। মাঝে মাঝে উর্মির চুলে তেল দিতে দিতে নিজের যুবতী বয়সের ফেলে আসা স্মৃতি শুনিয়ে গল্প করেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সংসার সম্পর্কে অনেক জ্ঞান বুদ্ধি দেন উর্মিকে। উর্মিও মনোযোগ দিয়ে শাশুড়ির সব কথা শোনে।
উর্মি প্রতিদিন পাঁচতলায় যায়। বাবার মায়ের সাথেও সময় কাটিয়ে আসে।প্রথমে আহনাফের সাথে কথা বলে নি। আহনাফ বুঝতে পারে বোনের অ’ভিমানের কারণ।এটা সেটা বলে বোনের অ’ভিমান ভা’ঙিয়ে হাসানোর চেষ্টা করে।সফলও হয় দ্রুত। উর্মি বেশিক্ষণ কারো সাথে রাগ করে থাকতে পারে না।আর তার আপন কেউ হলে তো আরো আগেই না।
রাবেয়া ভালো কিছু রান্না করলে উর্মিদের জন্য নিয়ে যায়। বিশেষ করে মাহমুদার জন্য। মাহমুদা ভীষণ ভর্তা পছন্দ করেন। রাবেয়া ভর্তা করলেই মাহমুদার জন্য নিতে ভুলে না। মাঝে মধ্যে দুই পরিবার একসাথে ডিনার করে। দীপ্ত আর আহনাফ দুজনেই কর্মজীবী মানুষ। দিনে তাদের সময় হয় না।তাই সবাই রাতেই একসাথ হয়।একসাথে বসে নানারকম আড্ডায় মেতে খাওয়া দাওয়া সম্পূর্ণ হয়।
দীপ্ত আর উর্মির বিয়ে পর আশফাক সাহেব আর দিদার সাহেবের মধ্যে অসাধারণ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন বিকেলে দুই বেয়াই মিলে হাঁটতে বের হয়।পুরো এলাকা ঘুরে আসে। মাঝে মধ্যে দোকানে বসে চা খেতে খেতে সমবয়সীদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে আলাপ আলোচনায় মত্ত হন।
আশফাক সাহেব একটা জমি কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন।সেই ব্যাপারটা দিদার সাহেবের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। যেহেতু উনি অনেক বছর দেশে ছিলেন না।তাই এই ব্যাপারে জানাশোনা কম।দিদার সাহেব নিজ অভিজ্ঞতা থেকে ভালো পরামর্শ দিয়েছেন।কী করলে ভালো হবে?কোন জায়গায় জমির দাম কেমন এসব ব্যাপারে ধারণা দিয়েছেন।উনার চেনা জানা অনেকের সাথে পরিচয় করিয়েও দিয়েছেন।যাতে কাজটা আশফাক সাহেবের জন্য সহজ হয়। ছোটখাটো সহযোগিতা ভালো পরামর্শ আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্ধন দিন দিন প্রগাঢ় হচ্ছে তাদের।
.
অথৈয়ের পরিক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে মাসখানেক আগেই। পরিক্ষা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আহনাফ একবারের জন্যও তার সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি।বলেছে আগে মন দিয়ে পড়ে পরিক্ষাটা দিতে।
অথৈও আহনাফের কথা ওপর কিছু বলে নি।সেই কয়দিন ভালোভাবেই পড়ে পরিক্ষা দিয়েছে। রেজাল্টও পাবলিশ্ট হয়ে গেছে। অথৈয়ের এ গ্রেড এসেছে।এই নিয়ে তার কোনো আফসোস নেই বরং সে মহা খুশি।আহনাফকে ফোন করে প্রচ’ন্ড উচ্ছাস নিয়ে রেজাল্ট জানিয়েছিলো।রেজাল্টের কথা শুনে আহনাফ বলেছিল_
“সারাবছর যদি ভালো করে পড়াশোনা করতে তাহলে ঠিকই এ+ আসতো।”
অথৈ মুখ কালো করে।জেদ দেখিয়ে বলে_
“যা পেয়েছি সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন।আমি যে ফেইল করিনি তার জন্য আপনার উচিত দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা।”
আহনাফ তর্ক করে না।জানে তর্কে সে জিতবে না।অথৈ নিজের মনগড়া অযৌক্তিক কথা বলে নিজের কথা উপরে রাখবে।তার ধারণা সে যা বলে সেটাই ঠিক আর আহনাফ যা বলে সব ভুল।তার বক্তব্য অনুযায়ী আহনাফের উচিত তার কাছে ক্লাস করা।তাহলে যদি কিছু শিখতে পারে।
কিন্তু আজকে অনেকমাস অথৈ আহনাফের সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু আহনাফ দেখা করে না।দেখা করার জন্য আহনাফের বাসায়ও গিয়েছিলো। কিন্তু তখন আহনাফ অফিসে থাকে। শুধু রাবেয়া আর উর্মির সাথে দেখা করে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এসেছে।যার জন্য গেলো তার দেখাই পেলো না।আজ কতোগুলো দিন সে আহনাফকে দেখে না।কষ্ট হয় না?
পরশু রাতে এ নিয়ে আহনাফের সাথে অথৈয়ের ছোট খাটো একটা ঝগড়া হয়।ঝগড়াটা অথৈই করছিলো। আহনাফ শুধু হু হা করেই অথৈয়ের চিল্লাফাল্লা শুনছিলো। এরজন্য তখন অথৈ সিরিয়াস রাগ করে বসে। মানে তাকে পাত্তাই দেয় না লোকটা? তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দামই নেই।এটা ভালোবাসা?এটা ভালোবাসা হলে এমন ভালোবাসা তার চাই না।
কিছু কড়া কড়া কথা শুনিয়ে ফট করে লাইন কেটে দেয় অথৈ। সত্যি সে মনে কষ্ট পেয়েছে।সে আর কথাই বলবে না আহনাফের সাথে।চরম প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়েছে।ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। অ’ভিমানে চোখ ছলছল করে উঠে।ধুম করে বালিশে মাথা ফেলে বির বির করে। আহনাফকে ব’কাব’কি করছিলো বোধহয়।এভাবে ব’কাব’কি করে শান্তি পায় না। পার্টনার দরকার।চলে যায় মায়ের রুমে। হোসনে আরা স্কুলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র দেখছিলো।তখন মেয়ে অভিমানী মুখ করে ঘরে আসতে দেখে বুঝতে পারে এখন আবার নালিশ করবে।আর কার নামে নালিশ করবে সেটাও জানে।ভেবে হেসে ফেলে।হেসেই বলে_
“শুরু করো,আমি শুনছি।”
অথৈ মায়ের কোলে মাথা রেখে বলতে থাকে। আহনাফ এই, আহনাফ সেই।ভালোবেসে সে ভুল করেছে।আরো নানা কথাবার্তা। হঠাৎ খেয়াল করে তার মাও কাজে ব্যস্ত।তার কথা শুনেও যেনো শুনছে না। মায়ের ওপরেও অ’ভিমান হলো। ঠোঁট উল্টে ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায় ভাইয়ের রুমে। সেদিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠে হোসনে আরা তারপর আবার কাজে মন দেয়। ভাইয়ের রুমে এসে দেখে সেও পড়ছে।অথৈ ভাবলো পড়ার ডিস্টার্ভ হবে তাই ভেতরে গেলো না। নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো।দু হাত ছড়িয়ে দিলো দুপাশে।
মেয়েরা যখন অ’ভিমান করে তখন স্বভাবতই সে চায় তার প্রিয় মানুষটা তার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করুক।প্রিয় মানুষের একটা ডাকে মেয়েদের অ’ভিমান পানির মতো গলে যায়। কিন্তু তারা সেটা সাথে সাথে প্রকাশ করে না।প্রিয় মানুষটা যখন বার বার অ’ভিমান ভাঙানোর চেষ্টা,তাকে মানানোর চেষ্টা করতেই থাকে এই দৃশ্য মেয়েদের কাছে খুব আনন্দদায়ক।সেটা মন ভরে উপভোগ করা শেষ হলেই তারপর তারা স্বাভাবিক হয়।
কিন্তু এসব অথৈয়ের কাছে স্বপ্ন।সে যে রাগ করেছে এটাই তো বুঝে না, মানানোর চেষ্টা করা তো দূরের কথা। একটা নিষ্ঠুর লোককে ভালোবেসে ফেললো।বড়োই আফসোসের বিষয়।
ছাদের দেয়ালে তাকিয়ে অ’ভিমানী কন্ঠেই বলে_
“আমি আপনার সাথে আর কখনো কথা বলবো না।কখনো না। হা’র্টলেস কোথাকারে।”
.
সত্যি সত্যি অথৈ আর ফোন ধরে নি। আহনাফ যতোবার ট্রাই করে রিসিভ করে না।মেসেজ দিলেও সিন করে না।আহনাফ জানে অথৈ রাগ করেছে। তবে অথৈ রাগ করে আবার নিজেই ফোন দেয়, খোঁজ নেয় আহনাফের।এমন খুব কম হয়েছে যে অথৈ রাগ করেছে আহনাফ রাগ ভা’ঙিয়েছে। এবার হয়তো সত্যি সত্যি কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।পাওয়াটাই কী স্বাভাবিক না?ভাবে আহনাফ।
অনেকক্ষণ ধরে ভেবে একটা ডিসিশন নেয়।চলে যায় মায়ের কাছে।
রাবেয়া রান্নাঘরে রান্না করছিলো তখন আহনাফ আসে।মুখ বাড়িয়ে দেখে কী রান্না হচ্ছে।ছেলেকে দেখে মুচকি হাসে। আহনাফও হাসে। তারপর গলা খাঁকারি দেয়।কোথা থেকে শুরু করা যায় সেটাই ভাবছে। রাবেয়া নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। আহনাফ একটু রয়ে সয়ে বলে_
“তোমার রান্না করতে খুব কষ্ট হয় তাই না আম্মু?”
রাবেয়া ভ্রু কুঁচকে হাসে। খুন্তি দিয়ে তরকারি নাড়তে নাড়তে বলে_
“কষ্ট হবে কেনো? রান্না করতে তো আমার খুব ভালো লাগে।”
আহনাফ আবার বলে_
“না মানে ঘরের সব কাজ একা করো। আবার রান্নাও করো।কাজ তো কম নয় তাই না?তোমার মনে হয় না একটা হেল্পিং হ্যান্ড দরকার।”
রাবেয়া হাসিমুখেই উত্তর দেয়_
“এখনো ওমন বুড়ি হয়ে যাই নি যে সংসারের কাজ করতে পারবো না।আর আমার কাজ করতে ভালোই লাগে। কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলে মনও ভালো থাকে।তাই হেল্পিং হ্যান্ডের প্রয়োজন বোধ করি না।”
নিচের পাটির দাঁত কামড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে আহনাফ।তার মা তো বুদ্ধিমতি। ছেলের কথার মানে বুঝতে পারছে না? এবার কীভাবে বোঝাবে আহনাফ?মাথায় তো কিছুই আসছে না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর আবার বলে_
“আচ্ছা আম্মু, উর্মির তো বিয়ে দিয়ে দিয়েছো। তোমার একা একা লাগে না?”
খুন্তি নাড়ানো আস্তে আস্তে থামায় রাবেয়া। সেকেন্ডের মাথায় ছেলের কথার মর্মার্থ বুঝে ফেলে। আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার?
আবার কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে রাবেয়া বলে_
“একা লাগবে কেনো?তুমি আছো। তোমার বাবা আছে।আর উর্মির তো দূরে নয়।দু তলা নিচেই তো থাকে।যখন তখন যেয়ে দেখে আসতে পারি।মেয়েও আসে আমার কাছে।একা লাগার তো প্রশ্নই আসে না।”
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আহনাফ।ছোট করে বলে_
“ওহ,ভালো।”
তারপর বলে,”ঠিক আছে তুমি কাজ করো,আমি রুমে যাই।”
এখানে এসে লাভের লাভ কিছুই হলো না।মুখ ভার করে নিজের রুমে ফিরে যেতে নেয়।
তখন রাবেয়া বলে_
“যাওয়ার আগে বলে যাও অথৈদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে কবে যাবো?”
থম মেরে দাঁড়িয়ে যায় আহনাফ।তড়িৎ বেগে ঘুরে তাকায় মায়ের দিকে। রাবেয়া ছেলের কান্ড দেখে হাসে। রাবেয়া বুঝেছে ভালো কথা তবে অথৈ পর্যন্ত বুঝে ফেলবে আহনাফ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি। মুখের সামনে হাত নিয়ে হালকা কেশে ওঠে।
তারপর বলে_
“আব্ অথৈ মানে?তুমি কী মিন করছো আম্মু?”
রাবেয়া সন্ধানী চোখে তাকিয়ে থেমে থেমে বলে_
“তুমি কী ভেবেছো তোমার মা ঘাসে মুখ দিয়ে চলে?”
তারপর চুলার আঁচ কমিয়ে আহনাফের সামনে এসে দাড়ায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে_
“আমার গম্ভীর রাগী ছেলেটা যে চঞ্চল মেয়েটার চঞ্চলতায় পিছলে গেছে তা কী বুঝিনি ভেবেছো।”
আহনাফ ইত’স্তত ভঙ্গিতে হালকা মাথা চুলকে তাকায়।
“এখন কবে যাবে বলো?”
“তোমার ইচ্ছে।” ছোট করে উত্তর দেয় আহনাফ।
“কালকে যাই?”
“অলরাইট।”কাঁধ ঝাঁকিয়ে মায়ের কথায় সায় দেয়।
বিনিময়ে মুখে হাসি টানে রাবেয়া। রান্নার কাজে মন দেয়। ফুরফুরে মেজাজে রুমে ফিরে যায় আহনাফ।আর একটা দিন।কালকের অপেক্ষা মাত্র।
.
অথৈ সোফায় বসে চিপস খাচ্ছে।টিভি চলছে কিন্তু তার টিভির দিকে মন নেই।পাশে ফোন রাখা। চিপস খাচ্ছে আর পাঁচ সেকেন্ড পর পর ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। আহনাফ কালকে থেকে তাকে আর ফোন দেয় না মেসেজও দেয় না।সে তো এখনো রাগ করে আছে তাহলে থেমে গেলো কেনো? ধৈর্য শেষ?
ভালোলাগছে না কিছু। হাতের চিপস্ টা পাশে রেখে ফোন হাতে নেয়।তখনই কলিং বেল বাজে। হোসনে আরা বেগম কিছুক্ষণ আগে স্কুল থেকে ফিরেছেন। আর অর্ক গোসলে।
তাই অথৈই গেলো দরজা খুলতে।
রাবেয়া আর আশফাক সাহেব দাড়িয়ে আছে।সাথে আহনাফ উর্মিও আছে। কতোদিন পর সে আহনাফকে সরাসরি দেখলো।
সবাইকে দেখে ভড়কায় অথৈ।দ্রুত গায়ের ওড়না মাথায় দেয়।মুখে হাসি টেনে বলে_
“আসসালামুয়ালাইকুম আন্টি আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল।”
তারপর ভেতরে আসতে বলে।রাবেয়া মুচকি হেসে অথৈয়ের গালে হাত বুলিয়ে চুমু খায়। আশফাক সাহেব ফুরফুরে মনে অথৈকে জিজ্ঞাসা করে_
“কেমন আছো মামনি?অনেকদিন পর দেখলাম তোমায়।”
অথৈ মাথা নাড়িয়ে নমনীয় কন্ঠে বলে_
“ভালো আছি আঙ্কেল। আপনারা বসুন না।আমি আম্মুকে ডেকে আনি।”
মাথা নাড়ায় আশফাক সাহেব।সবাই সোফায় বসে। শুধু উর্মি অথৈয়ের কাছে আসে।অথৈ চিন্তায় মগ্ন। হঠাৎ সবাই হাজির?উর্মির দিকে তাকিয়ে দেখে সে মিটিমিটি হাসছে।ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অথৈ বলে_
“কী ব্যাপার?”
উর্মি মুখে হাসি বজায় রেখেই বলে, “কোনো ব্যাপার না।”
অথৈ আহনাফের দিকে তাকায়।সে ফোন নিয়ে ব্যস্ত।বাহ!তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মতো সুখী পৃথিবীতে কেউ নেই।আর অথৈ যে তার ওপর রেগে আছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।সেও তাকাবে না। একদম তাকাবে না। মুখ ভার করে মায়ের রুমে যায়।
সোফায় বসে কথা বলছে আশফাক সাহেব রাবেয়া আর হোসনে আরা।সাথে আহনাফও আছে। চারজন কথা বলছে।এর মধ্যে অর্ক চলে এলো। সে বসে বসে আহনাফের সাথে টুকটাক গল্প করছে।
কিন্তু উর্মি ঘরে অথৈকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। হয়রান হয়ে বলে_
“একটু সুন্দর করে দাঁড়া।শাড়িটা পরিয়ে নিই।
অথৈ কোমরে দুই হাত দিয়ে বলে_
“আগে আমাকে বোঝা আমি এখন শাড়ি কেনো পরবো?”
বড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলে উর্মি বলে_
“আচ্ছা আগে শাড়িটা পরে নে তারপর বলছি।”
অথৈ সন্ধানী চোখে তাকায়।তার খুব খটকা লাগছে। মাথায় অনেক কিছু আসছে কিন্তু উর্মিকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে পারছে না।কোনো উপায় না পেয়ে উর্মির হাতে শাড়িটা পরে নেয়।
শাড়ি পরা শেষে উর্মি নিজের হাতে হালকা একটু সাজিয়ে দেয় অথৈকে। অথৈয়ের বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ এমন করার কোনো মানে হয়? ঠিক করে কিছু বলছেও না কেউ।
“হয়ে গেছে এবার চল।”
চোখ মুখ কুঁ’চকে তাকায় অথৈ। বলে _
“এবার তো অন্তত বল?”
“আমি কিছু বলবো না।নিজের চোখে দেখে নিস।”
অথৈ কিছু বলার আগেই উর্মি হাত টেনে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলো।দীপ্তও এসেছে সাথে একজন হুজুরও আছেন। অথৈয়ের এতোক্ষণের করা ধারণাটা তাহলে সত্যি?ভেবেই কেঁপে ওঠে।
সবাই কথা বলছে এমন সময় অথৈকে আসতে দেখে হোসেনে আরা নিজে এগিয়ে মেয়েকে নিয়ে এসে সোফায় বসালো।নিজেও বসলো।উর্মি যেয়ে দীপ্তের পাশে দাঁড়ালো।দীপ্ত এক হাত উর্মির কাঁধে রেখে একপাশ থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।
“কাজি সাহেব এবার সবাই উপস্থিত হয়েছে।বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।বর আহনাফ রহমান আর কনে সিদরাতুল অথৈ।”
আশফাক সাহেব কথাটা বলে সবার দিকে তাকালেন। রাবেয়া হাসিমুখেই আহনাফ আর অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।মূলত আজকে এখানে এসে বিয়ে নিয়ে আলাপ আলোচনা করার কথা ছিলো। কিন্তু আহনাফের কথা সে সোজা বিয়ে করবে।ব্যাপারটা জটিল লাগলো রাবেয়ার।রাতেই হোসেন আরার কাছে ফোন করে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দুজন কথা বলে সাথে আশফাক সাহেবও ছিলেন।কথা বলে রাবেয়া জানতে পারে হোসনে আরা সবই জানে।অথৈ মায়ের কাছে সব বলেছে।আর উনার কাছে উনার মেয়ের সুখ সবচেয়ে বড়।তাই তার দিক থেকে আ’পত্তি থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। আহনাফের কথা অনুযায়ী তখনই ঠিক হয় বিয়ের ব্যাপারটা। কিন্তু এই ব্যাপারটা যেনো অথৈ না জানে সেটাও সবাইকে বলে দিয়েছে আহনাফ।
হ’ঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত চমক পেয়ে অথৈ কথা বলতে ভুলে গেছে। একদিন আহনাফ তাকে বিয়ে করবে।তার আর আহনাফের একটা ছোট সংসার হবে।এমন অনেক স্বপ্ন দেখতো অথৈ।তবে স্বপ্নটা যে এতো দ্রুত পূর্ণ হবে তা কল্পনাও করে নি। বুকের ভেতর টালমাটাল অবস্থা। আজকে তার আর আহনাফের বিয়ে।ভাবলেই গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠছে।
.
ঘরোয়া ভাবে আহনাফ অথৈয়ের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো একবছর পর অনুষ্ঠান করে অথৈকে নেয়া হবে। ততোদিন সে মায়ের কাছেই থাকবে।তবে আজকে আহনাফ এখানে থাকবে।
খাওয়া দাওয়া শেষে হোসনে আরা বার বার সবাইকে অনুরোধ করছিলো আজকের রাতটা অন্তত তাদের কাছে থেকে যেতে। কিন্তু রাবেয়া সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছে অন্য একদিন অবশ্যই থাকবে। যেহেতু এখন নতুন সম্পর্ক হয়েছে।আসা যাওয়া তো হবেই।
অথৈকে এমন থম মেরে বসে থাকতে দেখে উর্মি যাওয়ার আগে অনেক কথা বলে মজা নিয়েছে।
সবাই চলে গেছে,থেকে গেছে শুধু আহনাফ। হোসনে আরা বেগম অনেকক্ষণ বসে আহনাফের সাথে গল্প করেছেন।মূলত অথৈয়ের করা কাজকর্মে কথা আহনাফকে শোনাচ্ছেন। আহনাফের নামে উনার কাছে নালিশ করে সবই বলেছেন।
মায়ের ওপর রাগ লাগছে অথৈয়ের। আড়চোখে আহনাফের দিকে তাকায় আবার মায়ের দিকে তাকায়।এসব কিছুর মধ্যেও তার খুব নার্ভাস লাগছে। হঠাৎ করে কেমন গরম লাগছে।
অনেকক্ষণ আড্ডার পর হোসনে আরা অথৈকে বলে আহনাফকে ঘরে নিয়ে যেতে। তারপর আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে_
“যাও বাবা ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো।”
অর্কর পরিক্ষা চলছে এজন্য সে চাইলেও আহনাফের সাথে আড্ডা দিতে পারছে না।এখন পড়া রেখে গেলে নিশ্চিত মায়ের বকুনি খাবে।তাই নিজের ঘরে পড়াশোনায় মগ্ন।
মায়ের কথা শুনে অথৈয়ের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। এতোদিন বিয়ের জন্য লাপিয়েছে এখন যখন সত্যি সে আহনাফের বউ তখন এমন লাগছে কেনো? না’র্ভাসনেসের জন্য তো বার বার গলা শুকিয়ে আসছে।
আহনাফ উঠে দাড়ায়।তা দেখে অথৈ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।ছোট ছোট পা ফেলে নিজের রুমে চলে যায়। পেছন পেছন আসে আহনাফও।তার ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাঁসি।
রুমে এসে আহনাফ দরজা বন্ধ করে অথৈয়ের দিকে তাকায়।অথৈ কেমন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আহনাফ ঠোঁট কা’মড়ে হেসে ফেলে।অথৈ সামনে এসে দাড়ায়। আহনাফের এতো কাছে দেখে নিঃশ্বাস আটকে আসতে চায় অথৈয়ের।সরে যেতে নিবে কিন্তু আহনাফ দেয় না। দেয়ালে এক হাত রাখে।অথৈ অন্যপাশ দিয়ে যেতে নিলে সেই পাশেও হাত রেখে আটকে ফেলে।কী করবে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না অথৈ। আহনাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বউয়ের দিকে।মুখে হাসি।অথৈ মুখ তুলে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হেসে বলে_
“ভালো আছেন?”
হ’ঠাৎই তার মনে পড়ে সে আহনাফের সাথে রাগ করে ছিলো।চোখ মুখে বি’ষ্ময় ঢেলে বলে_
“এইইই আমি তো আপনার সাথে রেগে ছিলাম।আর আপনি আমার রা’গ ভাঙান নি।একটা স্যরিও বলেন নি।আমার তো উচিতই হয় নি কবুল বলা।আমি আপনার সাথে কথা বলছি কে..!”
মাঝপথে থেমে যায় অথৈ।তার কপালে আহনাফের গভীর ভালোবাসার পরশ পড়েছে।ব্যাপারটা বোঝা মাত্র মুখ বন্ধ হয়ে যায়। কেঁপে ওঠে অথৈ।
আহনাফ দু তিনবার অথৈয়ের কপালে চুমু খায়। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলে_
“Welcome to my life Mrs Rahman.”
নিভু নিভু চোখে আহনাফের দিকে তাকায় অথৈ। আহনাফ অথৈয়ের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে_
“আহনাফ খুব ভালোবাসে অথৈকে।তাই নিজের নামে করে নিয়েছে।অথৈ কী খুশি?”
কপাল থেকে সরে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে অথৈ। ফোঁপানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।অথৈ কাঁদছে। আহনাফের মুখে কখনো এমন কথা শোনে নি সে।তাই এখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।
আহনাফও আঁকড়ে ধরে।মুখে বলে_
“এখন থেকে হাসি কান্না মান অভিমান রাগ জেদ যা দেখানোর সব আমার বুকে থেকেই দেখাবে।এই জায়গাটা তোমার। সারাজীবন থাকবে।”
চলবে…