#অবশেষে_সন্ধি_হলো
#পর্ব:১২
#লেখিকা: ইনায়া আমরিন
আহনাফ ফোন হাতে নিয়ে স্ত’ব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অথৈ তাকে আনফ্রেন্ড করে দিলো? শুধু আনফ্রেন্ডই নয় সবজায়গা থেকে ব্ল’কও করেছে?এও সম্ভব?
আহনাফের বুক দ্রুত গতিতে উঠানামা করে। ছোট একটা ঢোক গিলে।এই ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছে না।নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে তা না হলে অথৈ এটা করবে কেনো?
যেই মেয়েটার পা’গলামি দিয়ে তার দিন শুরু হতো আজ মাস পেরিয়ে গেলো অথচ তার চোখের দেখাটাও পায় নি আহনাফ।সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে সে উধাও।ভালোলাগা কী শে’ষ?
কিন্তু এতো সহজে ছাড় দেওয়ার পাত্র তো আহনাফ নয়।কাল উর্মির বিয়ে।অথৈ নিশ্চই আসবে।সব বোঝাপড়া কালই করবে আহনাফ।তার বুকে আ’গুন জ্বা’লিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মানে কী সেটা জানতে হবে তো।
চোখে মুখে রা’গ ফুটিয়ে ঘুমোতে যায়।রাত হয়েছে অনেক।কাল তার বোনের বিয়ে।ভাই হিসেবে তারও অনেক দায়িত্ব আছে।তাই একটু বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু শরীর বিশ্রাম চাইলেও মন মস্তিষ্ক তো অন্যের দখলে।চোখ বুঝলেই এক মানবীর ছোট্ট খাটো শুভ্র মুখোশ্রী ভেসে আসছে।তার তোতাপাখির মতো বলা কথাগুলো মনে পড়ছে খুব। হ’ঠাৎই আহনাফের তোতাপাখিটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার জন্য কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
.
অবশেষে এলো সেই শুভক্ষণ, শুক্রবার।আজ উর্মি আর দীপ্তের বিয়ে। অনুষ্ঠানে খুব কাছের কিছু মানুষকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। দীপ্তদের নিকটবর্তী আত্মীয় স্বজন আর উর্মিদের কয়েকজন মিলে ছোট পরিসরে অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ করা হবে।এটা দুই পরিবারের মতামত।
জুমার পর পরই কাজি আসবে তারপরই বিয়ে পড়ানো হবে।
উর্মি নিজের রুমে বসে আছে।পরনে লাল টকটকে কাঞ্জিভরম শাড়ি।মাথায় ওড়না খুব সুন্দর করে আ’টকানো। হালকা গয়না সাথে হালকা সাজ।ভারি সাজ সে নিবে না বলে জানিয়েছে তাই কেউ জোর করে নি।এইটুকুনিতেই হুরপরী লাগছে।তার পরনের সবকিছু দীপ্তেরই দেওয়া। পছন্দ আছে মানতে হবে। দীপ্তের কথা মনে পড়তেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে উর্মি।এইতো আর একটু পরেই দীপ্ত তার স্বামী হয়ে যাবে।তারা একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে।ভেবেই নিঃশ্বাস কেমন ভারি হয়ে আসছে।
এই এক সপ্তাহ তাদের কোনো কথা হয় নি।না দেখা হয়েছে। দুজনেই বৈধতার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর না হয় সব হবে।
উর্মি ফোন হাত নেয়।দেখে এক ঘন্টা আগে দীপ্ত তাকে মেসেজ পাঠিয়েছে।সে তো খেয়াল করে নি। সাজগোজে ব্য’স্ত ছিলো খেয়াল হবে কী করে।
“Can’t wait to see you as my wife.”
মেসেজ দেখে হেসে ফেলে উর্মি। হাসি মুখেই এই প্রথম দীপ্তের মেসেজের রিপ্লাই করে।
“আর কিছুক্ষণ মাত্র।এইটুকু অপেক্ষা করে নিন,স্যার।”
মেসেজ পাঠিয়ে ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে বড়ো একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে।মুখে মিষ্টি হাসি লেগেই আছে,আজ আর সরছে না।
“মাশাআল্লাহ।কী সুন্দর লাগছে তোকে উর্মি।”
অথৈয়ের কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকায় উর্মি।সাথে সাথে চোখ মুখ শ’ক্ত করে ফেলে।অথৈ মুখে হালকা হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে।
উর্মি কন্ঠে রা’গ নিয়ে বলে_
“তুই আমার সাথে কথা বলবি না খবরদার। মেহমানের মতো এসেছিস,খেয়ে তারপর আবার মেহমানের মতোই চলে যাস।”
অথৈ হেসে ফেলে।উর্মিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে_
“আমি তো আমার বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে এসেছি। বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে মেহমান হতে যাবো কেনো?”
অথৈকে দুহাত দিয়ে সরিয়ে উর্মি কৌতুক সুরে বলে_
“যাক এই কথাটা তাও আপনার মনে..।”
কথার মাঝে থেমে যায় উর্মি।অথৈয়ের মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে। মেয়েটার মুখ কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।চোখের নিচে কালো দা’গ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে উর্মি।যার জন্য ফর্সা মুখটা বিবর্ন লাগছে। এতো আকাশ পাতাল তফাৎ।সেই চ’ঞ্চল অথৈ আর তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অথৈর কোনো মিল নেই।উর্মি চিন্তিত হয়ে বলে_
“কী হাল করেছিস নিজের?এ অবস্থা কেনো?ঠিক আছিস তুই? শরীর খা’রাপ নয় তো?”
পাওডার কী কম দিয়েছে অথৈ? চোখের দা’গ, মুখের দা’গ ঢাকতে তো আজ পরিমাণের চেয়েও বেশি দিয়েছে তাও উর্মি ধরে ফেলেছে। চোখ এপাশ ওপাশ করে কোনো রকম হেসে বলে_
“আরেহ না।আসলে রাত জেগে পড়াশোনা করি তো।তাই চোখে মুখের এই অবস্থা।আমি ঠিক আছি।”
কিন্তু উর্মি বিশ্বাস করলো না।সে আরো ভালো করে অথৈকে পর্যবেক্ষণ করছে।মেয়েটার চোখে মুখে আগের চ’ঞ্চলতা নেই,কেমন মনম’রা লাগছে।।মনে হচ্ছে মেয়েটা কতো দিন শান্তিতে ঘুমায় না।
উর্মিকে এভাবে তাকাতে দেখে অথৈ অ’প্রস্তুত হয়।না,মনের অবস্থা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।তাই হাসিমুখেই বলে_
“চল,আমরা একসাথে ছবি তুলি।”
উর্মি সে কথায় কান দেয় না।তার রুমে এখন কেউ নেই।অথৈয়ের হাত টেনে বিছানায় বসায়,নিজেও পাশে বসে।
“সত্যি করে বল,কী হয়েছে তোর?”
অথৈ উর্মিকে একটা অজুহাত দেখিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুমে ঢোকে রাবেয়া।তাড়া দিয়ে বলে_
“কাজি সাহেব চলে এসেছে।অথৈ মা, উর্মিকে নিয়ে এসো।”
অথৈয়ের সুবিধাই হলো।উর্মির প্রশ্নবান থেকে তো রক্ষা পেলো।এবার ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেলে সে এক ফাঁকে এখান থেকে চলে যাবে।
.
একটা সোফায় বসানো হয়েছে দীপ্ত আর উর্মিকে।উর্মিকে যখন নিয়ে আসা হচ্ছিল দীপ্ত পলকহীন তাকিয়ে ছিলো।মনে মনে আওড়ালো “মাশাআল্লাহ”
যখন তার পাশে বসানো হলো তখন উর্মির গা ঘেঁষে ফিসফিস করে বলে_
“চোখ ধাঁ’ধানো সুন্দর বোধহয় একেই বলে।”
উর্মিও এক পলক তাকায় দীপ্তের দিকে।অফ হোয়াইট শেরওয়ানি তার পরনে।সেটা তার মেদহীন শরীরে সেটে আছে,ঠিক রাজপুত্রের মতো লাগছে না আজকে?
চোখ ফেরায় উর্মি। সবার সামনে এভাবে তাকিয়ে থাকা উচিত নয়।ঠিক তখনই দীপ্ত আস্তে করে বলে_
“আপাতত একটু সবর করো, সুন্দরী।বিয়ে করে নেই, তারপর সারাক্ষণ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকবো।ওকে?”
না চাইতেই হেসে ফেলে উর্মি। দীপ্তের মতোই আস্তে করে বলে_
“চুপ করুন।”
.
উর্মি আর দীপ্তের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। চুপচাপ শান্ত হয়ে। দীপ্তের আর উর্মির কিছু কথা তার কানে এসেছে। স্বচক্ষে এমন সুন্দর একটা দৃশ্য দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। কিছুক্ষণের জন্য সব দুঃ’খ যেনো ছুটি দিলো।উর্মির এই সুন্দর হাসি মুখটা দেখে তার মুখেও হাসি ফুটলো।মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করে সারাজীবন যাতে দুজনে একসঙ্গে সুখে শান্তিতে থাকে।
দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে অথৈ। কিন্তু খেয়াল করলো না,ঠিক তার বিপরীতে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ব্যা’কূল দৃষ্টি তার শুকনো ফ্যাকাশে মুখে বিচরণ করে চলেছে।
অথৈকে অনেক আগেই দেখেছে আহনাফ।ওকে দেখে দুমিনিট বিমূ’ঢ় হয়ে ছিলো।এ কী হাল মেয়েটার?
কথা বলারও সুযোগ পাচ্ছে না।আর মেয়েটা তাকাচ্ছেও না একবারও।কেমন শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অথৈকে এভাবে দেখে স’হ্য করতে পারছে না সে।
হ’ঠাৎ অথৈ সামনে তাকায়।তার চোখ পড়ে আহনাফের দিকে। আহনাফ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এতোগুলো দিন পর প্রিয় পুরুষকে দেখে বুকটা মোচ’ড় দিয়ে ওঠে।চোখ জ্বা’লা করছে।বি’দ্যুৎ গতিতে চোখ ফিরিয়ে নেয় অথৈ।
অথৈ ইগনোর করায় বুকে তীর লাগার মতো ব্যা’থা অনুভব করলো আহনাফ। মেয়েটা বড্ড বেশি জ্বা’লাচ্ছে তাকে। দা’বানলে পু’ড়িয়ে মজা নিচ্ছে।সব কিছু হিসেব কড়ায় গন্ডায় উশুল করবে আজ।
অথৈ দাড়িয়ে থাকে না।দ্রুত স্থান ত্যা’গ করে।চলে যায় উর্মির রুমে।রুম সম্পূর্ণ খালি তাই আপাতত এখানেই থাকবে। আহনাফের সামনে সে পড়তে চায় না।বিয়ে শে’ষ হলেই সে চলে যাবে।
অথৈয়ের এমন কাজে রা’গ হয় আহনাফের।হাতে মুঠো হয় শ’ক্ত। পেছন পেছন সেও যায়।যখন দেখলো অথৈ উর্মির রুমে গেলো তখন আর পা বাড়ালো না।এভাবে রুমে যাওয়া ঠিক হবে না। কেউ তাদেরকে একসাথে দেখলে বা’জে পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।সেই চিন্তা করে সরে আসে।
.
খুব ছোট করে অল্প মানুষের সাক্ষীতে সুন্দরভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বেশিরভাগ মেয়েরা কবুল বলতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলে। কিন্তু উর্মি হাসিমুখেই কবুল বলেছে।সে চায় না নতুন জীবন কান্না দিয়ে শুরু করতে।
দীপ্তকে যখন কবুল বলতে বলা হয় তখন সে উর্মির দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়েই কবুল বলে।
তাদের এই কর্মকান্ডে উপস্থিত অনেকের মনে হয়েছে এটা লাভ ম্যারেজ।আদতে তো এমন কিছুই নয়।
শেষ বিকেলের দিকে_
এবার উর্মিকে নিয়ে যাওয়ার পালা। খুব বেশি দূর নয়,তিন তলায়। কিন্তু যেখানেই হোক আজ তো মেয়েকে সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দিতে হচ্ছে।তিন তলা থেকে পাঁচ তলার দূরত্ব খুব বেশি না।যখন মন চাইবে গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতে পারবে।মেয়েও তার বাবা মায়ের কাছে আসতে পারবে। কিন্তু ওনারা তো সারাজীবন এই বাসায় থাকবে না।যতোই হোক বাড়িওয়ালার বাড়িওয়ালির সম্পর্ক এখন বেয়াই বেয়াইনে পরিনত হয়েছে। তাদের বাসায় ভাড়া থাকাটা মানুষ অন্য চোখেও দেখতে পারে।ভাবে,ভেবে দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে রাবেয়া।
উর্মিকে নিয়ে যাওয়ার সময় কোথাও আহনাফকে দেখা যায় নি।সবাই খুঁজেছে,ডেকেছে কিন্তু সে নেই। উর্মি নিজে ফোন দিয়েছে কিন্তু সে ধরে নি।পুরোটা সময় ছিলো এখন সে চলে যাচ্ছে অথচ তার ভাই নেই?মনে মনে অ’ভিমান হয়। ভাইয়ের ওপর অ’ভিমান করেই চলে যায়। আবার যখন আসবে তখন কথা বলবে না ভাইয়ার সাথে মনে মনে ঠিক করে রাখে।
দীপ্তের হাত ধরে চলে যায় তার রাজ্যে। নতুন সংসার, নতুন জীবনে।
.
উর্মির বিদায়ের পর প্রায় সব মেহমানই চলে গেছে।আছে শুধু কিছুসংখ্যক।তখন অথৈ এসে রাবেয়াকে বলে_
“আন্টি এবার আসি তাহলে।”
অথৈয়ের কথা শুনে রা’গ দেখায় রাবেয়া।
বলে_
“আসি মানে?তোমাকে আজকে যেতে দিচ্ছে কে?আমার এক মেয়ে গেছে এখন আরেক মেয়ে গেলে কীভাবে থাকবো।আমার ঘর ফাঁকা করতে চাইছো সবাই মিলে তাইতো?”
অথৈ ইত’স্তত করে হেসে উঠে বলে_
“আসলে আম্মু,ভাই একা তো।আর আমার পরিক্ষা সামনে। আরেকদিন আসবো আন্টি,আজকে যাই?”
হার মানে রাবেয়া। সেভাবেই বলে_
“ঠিক আছে যেও।কিন্তু ডিনার করে যাবে তারপর আহনাফকে বলবো তোমাকে দিয়ে আসবে।”
চ’মকে উঠে অথৈ। কিছু বলতে যাবে তার আগে দরজায় চোখ পড়ে। আহনাফ আসছে।সে দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে বলে_
“আন্টি আমার একটা ফোন করার ছিলো।একটু আসছি।”
তারপর ঢুকে পড়ে উর্মির রুমে।এই বাসায় যতোক্ষন আছে ততোক্ষণ এটাই তারজন্য সেইভ জোন।
অথৈ কী আহনাফকে দেখেই এমন করলো?মেয়েটা কেমন পরিবর্তন হয়ে গেছে না?ভাবে রাবেয়া।
আহনাফ সব দেখেছে।অথৈয়ের আবার সেই একই কাজ।তাকে দেখে পালানো। এবার মেজাজটা খি’চ’ড়ে গেছে।অনেক হয়েছে,এবার জবাবদিহি হতে হবে তাকে আহনাফের কাছে।
“কোথায় ছিলে? উর্মি তোমাকে কতোবার খুঁজেছে জানো?”
মায়ের কথা ফিরে তাকায় আহনাফ। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলে_
“চলে গেছে ওরা?”
“না তোমার জন্য বসে থাকবে।”কন্ঠে একটু রাগ নিয়ে বললো রাবেয়া।
“ওকে আমি বিদায় দিতে পারবো না তাই থাকিনি।”
আহনাফের এই কথায় আর কিছু বলে না রাবেয়া। বোনের প্রতি খুব দু’র্বল আহনাফ সেটা জানে রাবেয়া।মুখে হাসি নিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।এর মধ্যে আশফাক সাহেব ডাকলেন তাই সেই দিকে চলে গেল।
.
“আপু আপু, আহনাফ ভাইয়া এটা তোমাকে দিতে বলেছে।”
ছোট বাচ্চা একটা ছেলে কথাটা বলে অথৈয়ের হাতে একটা চিরকুট দিয়ে চলে যায়।
আহনাফের নাম শুনে বুকটা ধ’ক করে ওঠে অথৈয়ের।তাকে চিরকুট পাঠিয়েছে আহনাফ।ভেবেই দ্রুত হাতে চিরকুট মেলে ধরে।
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমাকে আমি ছাদে দেখতে চাই।”
অথৈ ভাবে সরাসরি একবার কথা বলা দরকার। এভাবে পালিয়ে থাকতে তারই অস্ব’স্তি হচ্ছে।
.
পরনের শুভ্র পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ।চোখ মুখ শ’ক্ত। অনেকদিনের রা’গ পু’ষে রেখেছে। তাকিয়ে আছে ছাদের দরজার দিকে। চিরকুট পেয়েও যদি অথৈ না আসে তাহলে আজকে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবে না। সত্যি সত্যি তার হাতের থা’প্পড় পড়বে অথৈয়ের গালে। কিন্তু তা আর করতে হয় নি।
তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অথৈ এসেছে। ছাদে এসে অথৈয়ের সোজা চোখ পড়ছে আহনাফের দিকে। আহনাফও তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যায় কিন্তু বুকের ভেতর তু’ফান চলছে। আবার নিজেকে শ’ক্ত করে।সে কিছুতেই তার দু’র্বলতা আর দেখাবে না আহনাফকে। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা কতোক্ষণ টিকে সেটাই দেখার বিষয়।
আহনাফ নিজেই খানিকটা এগিয়ে যায়। কন্ঠে অধৈ’র্য,রা’গ, অস্থি’রতা ঢেলে বলে_
“কী সম’স্যা তোমার? হ’ঠাৎ এমন উইয়ার্ড বিহেভ করার মানে কী?”
“আমার জানা মতে আমি আপনাকে আর জ্বা’লাই না, বির’ক্ত করি না।আপনার তো কোনো সম’স্যা হওয়ার কথা না। বরং খুশি হওয়ার কথা।”দৃ’ঢ় কন্ঠে চোখে চোখ রেখে কথাটা বলে অথৈ।
“শাট আপ!” দাঁতে ফাঁকে প্রায় গ’র্জে ধ’মকে উঠলো আহনাফ।
আহনাফ ধ’মকে চোখ বন্ধ করে ফেলে অথৈ।চোখ জ্বা’লা করছে।ভেতরে ভেতরে ভে’ঙে যাচ্ছে সে। কান্না আসছে। সে আহনাফের সামনে কাঁদতে চায় না। কিন্তু আমরা যেটা চাই না সেটাই হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে না পেরে ডুকরে কেঁ’দে উঠে অথৈ।
আহনাফ চূড়ান্ত অবাক। মেয়েটাকে সে সবসময় হাসতে দেখতে অভ্যস্ত। কাঁদতে দেখে নি কখনো। এই প্রথম অথৈ তার সামনে এভাবে কাঁদছে।এটা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো।
আহনাফের সামনে কেঁদে ফেলেছে ভেবে কান্না থামায় অথৈ।হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে।বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে আহনাফের দিকে তাকায়।বলে_
“আমি এখানে এসেছি আপনাকে স্যরি বলতে।”
ভ্রু কু’চকায় আহনাফ। অথৈ আবার বলে_
“আমি আমার কাজের জন্য ল’জ্জিত। আপনাকে এতোগুলো দিন বির’ক্ত করা, ফোন দিয়ে,মেসেজ দিয়ে জ্বা’লাতন করা, নির্ল’জ্জের মতো সারাক্ষণ পেছন পেছন ঘোরা সবকিছুর জন্য
আ’ম স্যরি।”
আহনাফের মনে হচ্ছে ওর কানে কেউ বি’শ ঢেলে দিচ্ছে। হাতের মুঠোয় শ’ক্ত হয়ে রগগুলো ফুলো উঠছে। রা’গে শরীর কাঁপছে। কিন্তু অথৈয়ের সেদিকে মন নেই।সে নিজের কথা বলতে ব্যস্ত।
“সেদিন যদি আম্মু আমাকে না বোঝাতো তা হলে হয়তো আমি নিজের ভু’ল বুঝতেই পারতাম না।”
“মানে?”রাগ নিয়েই কথাটা বলে আহনাফ।
অথৈ সেইদিনের কথা ভাবতে থাকে যেইদিন সে আহনাফের সাথে শেষবার ফোনে কথা বলেছে।
.
আহনাফ ফোন কে’টে দেওয়ার পর অথৈ রুমের দরজায় ফিরে তাকায়। হোসনে আরা বেগম দাড়িয়ে আছে।তার মানে মা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে সব কথা শুনেছে?ভ’য় হয় অথৈয়ের।এখন কী হবে?
মেয়ের ভ’য়ার্ত মুখ দেখে এগিয়ে আসে হোসনে আরা। বিছানায় বসে অথৈকেও বসতে বলে।মনে একঝাঁক ভ’য় নিয়ে অথৈও বসে। শান্ত কন্ঠে হোসনে আরা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে_
“আহনাফকে ভালোবাসো?”
চ’মকে তাকায় অথৈ। তারমানে সব শুনে ফেলেছে।ভ’য়ের মাত্রা বেড়ে যায় এবার। শরীর কাঁপছে অথৈয়ের।তা দেখে হোসেন আরা বলে_
“অনেকদিন থেকেই তোমায় খেয়াল করছি।বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু সেটা যে আহনাফ আজ জানলাম। এবার সত্যি করে বলো,ভালোবাসো?”
নিরুত্তর অথৈ।ভ’য়ে মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। চোখের পাপড়ি কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে।মেয়ের এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে আসে হোসনে আরা।ভ’য় কমাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে_
“মা হিসেবে নয়।তুমি আমাকে বন্ধু ভেবে নির্ভয়ে বলতে পারো।”
চম’কের ওপর চম’ক।
অনেক্ষণ পর অথৈয়ের ভ’য় অনেকটা কমে।উপর নিচে মাথা নাড়ায় যার অর্থ হ্যা ভালোবাসে।
“ও বাসে?”
এর উত্তর কী হবে? আহনাফ তো কখনো বলেনি সে ভালোবাসে।উল্টে তার উপর বির’ক্ত। তারপরেও সাহস করে দু পাশে মাথা নাড়ায়।তার মানে আহনাফ অথৈ পছন্দ করে না।বুঝতে পারে হোসনে আরা।শূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে।
“আমি সব শুনতে চাই। কোনো কথা লুকোবে না।”
মায়ের আশ্বাস পেয়ে একটু স্বস্থি পায় অথৈ।আস্তে ধীরে সব কথা শেয়ার করে,ঠিক যেনো তার বান্ধবী। আহনাফের প্রতি তার অনুভূতি আবার আহনাফের প্রতিক্রিয়া সব বলে। কোনো কথাই বাদ রাখে না।সব কথা শুনে যা বোঝার বুঝলেন হোসনে আরা।
মেয়ের মাথা আদুরে হাত বুলিয়ে বলে_
“আমি কিছু কথা বলবো এখন।মন দিয়ে নয় বিবেক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে,ঠিক আছে?”
মাথা নাড়ায় অথৈ। হোসেনে আরা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বলেন_
“ভালোবাসা কোনো দো’ষের বিষয় নয়।এটা খুব সুন্দর অনুভূতি যদি সেটা দুপাক্ষিক হয়।তবে সেই সুন্দর অনুভূতিও কখনো কখনো খুব বি’চ্ছিরি হয় যখন সেটা একপাক্ষিক হয়।
তুমি আহনাফকে ভালোবাসো,বাসতেই পারো।মন কারো নিয়ন্ত্রণে থাকে না মা। কিন্তু আহনাফকেও তোমাকে ভালোবাসতে হবে এমন কিছু কোথাও লিখা নেই। তোমার যেমন মন আছে তারও আছে।তার মন হয়তো তোমাকে চায় না। নিজের মনকে গুরুত্ব দেওয়া সাথে সাথে অপর জনের মনটাকেও গুরুত্ব দিতে হবে।মনের ওপর জোর খাটে না। ভালোবাসা জোর করে আদায় করা যায় না।
ভালোবেসে সুখের কারণ হতে হয়, বির’ক্তির নয়।তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে ভালো রাখতে পারলে তুমি শান্তি পাবে। কিন্তু তুমি কী চাইবে তার অশা’ন্তির কারণ হতে? বির’ক্তির কারণ হতে?
এই যে তুমি আহনাফকে ভালোবাসো কিন্তু সে বাসে না।এর জন্য তাকে বির’ক্ত করলে কী সে তোমাকে ভালোবাসবে?
উল্টো সে বির’ক্ত হচ্ছে। তোমার ভালোবাসার মানুষের বির’ক্তের কারণ হচ্ছো।এটা কী ঠিক?শুনতে ভালো লাগছে?
যে তোমাকে চায় না তাকে কেনো তুমি বির’ক্ত করবে?তোমার উচিত সে যেভাবে থাকতে চায় সেভাবে থাকতে দেওয়া।
সব কিছুর পূর্ণতা পেতে হবে এমন কোন মানে নেই। তুমি যদি একজীবনে শুধু পূর্ণতাই পেয়ে যাও তাহলে জীবনের স্বাধ পাবে না।পূর্নতা অপূর্নতা নিয়েই আমাদের জীবন।”
টপ টপ করে বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়ছে অথৈয়ের চোখ থেকে।সে তো এভাবে কখনো ভাবে নি। সত্যি তো সে তার ভালোবাসার মানুষের বির’ক্তির কারণ হচ্ছে। আহনাফ তাকে চায় না।এই যে এতো পা’গলামি করে অথচ কখনো আহনাফের মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শোনে নি।কখনো বলে নি তাকে সে পছন্দ করে।তার কাজে আহনাফ সবসময় বির’ক্ত হয়েছে।তাহলে কীসের ভিত্তিতে এতো আশা রাখে অথৈ?
মায়ের বুকে আছড়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল।তখন সে ঠিক করে সে আর জ্বা’লাবে না।আর ভালোবাসতে বলবে না।যে যেভাবে ভালো থাকতে চায় তাকে সেভাবে থাকতে দিবে।
.
অথৈয়ের মুখে সব কথা শুনে আহনাফ স্তব্ধ। বুকের ভেতর তোলপা’ড় চলছে।অথৈ ওকে ভুলে যেতে চাইছে?আর জ্বা’লাবে না মানে কী?
অথৈ চোখে পানি নিয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে_
“আমি বুঝতে পারিনি আমি যেটা করছি সেটা ঠিক নয়।আসলে আব্বু ছোট বেলায় মারা যাওয়ার পর আম্মু আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। আমাদের কথা ভেবেই স্কুলে চাকরি করেছে। তাই কখনো সেইভাবে সময় দিতে পারতো না।আমাকে কখনো এতো সুন্দর করে কেউ বোঝায় নি জানেন?
সেইদিন যখন আম্মু আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝালো তখন আমি বুঝেছিলাম,আমি ভুল করেছি।”
“ওহ,তার মানে এখন ভালোবাসা শেষ?”
কন্ঠটা কী একটু কাঁপছিল?। আহনাফের এমন কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় অথৈ।চোখে টলমলে পানি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে_
“আমি কী একবারও সেটা বলেছি?
আমি শুধু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি।বুঝতে পেরেছি ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন কোনো মানে নেই।আমি ভালোবাসি আপনাকে,সত্যি খুব ভালোবাসি।আর এটা আমার ব্যাপার।
আপনি বাসেন না ওটা আপনার ব্যাপার।তবে আমি আর আপনাকে বির’ক্ত করবো না।আমি চাই আপনি ভালো থাকুন। আমি আপনার বির’ক্তির কারণ হচ্ছি এই ব্যাপারটা আমার স’হ্য হচ্ছে না।তার চেয়ে ভালো আপনি আপনার মতো করে ভালো থাকুন।আর আমি আপনাকে ভালোবেসে ভালো থাকি।”
আহনাফ নিস্তব্ধ।এক ধ্যানে চেয়ে আছে অথৈয়ের দিকে।
অথৈ একটু সময় নিয়ে চোখের পানি মুছে আবার বলে_
“আবারো সবকিছুর জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।আমি সত্যি আমার কাজের জন্য ল’জ্জিত। আশা করি মাপ করবেন।আর হ্যা কিছুদিন পর আমার পরিক্ষা। দোয়া করবেন,আসি।”
আর এক মুহূর্তও দাড়ায় না অথৈ।এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে নিচে চলে যায়।
কথার ছুরি চালিয়ে কারো বুকের ভেতর যে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে টেরই পেলো না মেয়েটা।
চলবে…
(ছারপ্রাইজ এভ্রিভাডি🧛🏻♀️)