#অবশেষে_সন্ধি_হলো
#পর্ব:৬
#লেখিকা:ইনায়া আমরিন
ভার্সিটি থেকে বের হয় উর্মি। অনেক দিন বাদে এসেছে।বাবা আসার খুশিতে কয়েকদিন আসে নি ক্যাম্পাসে। বাবাকে সময় দিয়েছে।স্টুডেন্টের পরিক্ষা শে’ষ তাই আপাতত সেই দিকের ঝা’মেলা নেই।এই ব্যাপারটা ঠিক ঝা’মেলা নয়। টিউশনিটা উর্মি স্বেচ্ছায় করে।ছোট বাচ্চাদের পড়াতে তার খুব ভালো লাগে।আর মাইশা তো আস্ত একটা আদর। পড়াশোনায়ও বেশ মনোযোগী।শান্ত ভদ্র একটা বাচ্চা।তার স্টুডেন্ট তারই মতো।টিচার আর স্টুডেন্টের দারুন মিল,ভেবেই আনমনে হেসে ফেলে উর্মি।
হাঁটতে হাঁটতে আশে পাশে তাকায়।আজ তো দীপ্তের আসার কথা। কোথায় সে? উর্মি একবার ভাবলো ফোন করবে। তারপর ভাবলো না একটু অপেক্ষা করুক এরমধ্যে যদি দীপ্ত না আসে তারপর না হয় ফোন দেওয়া যাবে।
আগে দীপ্তের সাথে কথা বলতে অস্ব’স্তি হতো উর্মির।তবে এখন সময়ের সাথে সাথে অস্ব’স্তি বোধ অনেকটাই কে’টে গেছে।এখন আর দীপ্তকে দেখলে পালাই পালাই করে না বরং সাচ্ছন্দ্যের সাথে কথা বলে।
হঠাৎ মেসেজ টোনের আওয়াজে ভাবনা থেকে বের হয় উর্মি।ব্যাগ থেকে ফোন নিয়ে দেখে দীপ্তের মেসেজ।
“Cafeteria te wait korchi”
.
ছোট একটা টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে দীপ্ত আর উর্মি। সচরাচর যেই মুখে প্রাণবন্ত হাসি লেগে থাকে সেই হাসি আজ নেই।আছে এক ঝাঁক না’র্ভাসনেস।যা খুব সূ’ক্ষ্ম ভাবে পরখ করে চলেছে উর্মি। দীপ্তকে আজকে অন্যরকম লাগছে। এতো না’র্ভাস কেনো সে?ভাবে উর্মি,কিন্তু যেচে কিছু জিজ্ঞাসা করে না। দীপ্ত নিজ থেকে বলার জন্য অপেক্ষা করে।
নিস্ত’ব্ধতাকে বিদায় জানিয়ে মুখ খোলে দীপ্ত। একটু নড়েচড়ে মুখে হাসি টেনে বলে_
“কী খাবে বলো?”
তাকায় উর্মি। স্বভাবসুলভ হেসে বলে_
“কিছু খাবো না।”
“কিছু তো একটা খেতেই হবে।চা অর কফি,কোনটা?”
“আচ্ছা,একটা হলেই হবে।”
দু কাপ কফি অর্ডার করে দীপ্ত। তারপর আবার নিস্ত’ব্ধতা।ঠিক কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে।উর্মি ঠিক কীভাবে নেবে তার কথাগুলো?ইতিমধ্যে কফি এসে হাজির। দীপ্ত ভাবে,না এভাবে সময় ন’ষ্ট করার মানে হয় না।
“কিছু কথা বলবো তোমায়,শুনবে?”
“শোনার জন্যই তো আসা। বলুন শুনছি।”দীপ্তের কথার জবাবে বলে উর্মি।
মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ে দীপ্ত।চোখ বুজে আবার খোলে। তারপর উর্মির চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো কিছু না ভেবেই বলে_
“যদি বলি তোমাকে ভালোলাগে তাহলে কী তুমি রাগ করবে?”
এটা কী কনফেশন ছিলো নাকি অন্য কিছু। ভেবে পাচ্ছে না উর্মি।দীপ্তর কাছ থেকে এমন কিছু আশা করেছিলো সে।আর যাই হোক একটা ছেলের চোখের ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা একটা মেয়ের থাকে। উর্মিও তার ব্য’তিক্রম নয়। মাঝে মাঝে তার মনে হতো দীপ্ত তাকে পছন্দ করে। কিন্তু সে নিশ্চিত ছিলো না তবে আজ হলো। একটু আগের দীপ্তের বলা কথাটা মনে পড়ে হাসি পাচ্ছে উর্মির।হাসি আ’টকাতে কফির মগে চুমুক দেয়।
উর্মির কাছ থেকে কোনো প্রতি’ক্রি’য়া না পেয়ে দীপ্ত আবার বলে_
“কিছু বলছো না যে?”
কফি মগে চুমুক দিতে দিতেই উর্মি দীপ্তের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
“ভালো লাগার কোনো স্পেসিফিক কারণ?”
চোখে হাসে দীপ্ত। একটু সময় নিয়ে তাকায় উর্মির পানে। অতঃপর কন্ঠে কোমলতা চোখে মুগ্ধতা নিয়ে ধীরে বলে_
“নেই,নির্দিষ্ট কোনো কারণ আমার নিজেরও জানা নেই। শুধু জানি তোমাকে দেখলে আমার শান্তি লাগে,তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।সম্ভব হলে সারাক্ষণ চোখের সামনে বসিয়ে রাখতাম।বুকপকেটে রাখার মতো কোনো ক্ষমতা থাকলে ট্রাস্ট মি সেটাও করতাম।
সময়ে অসময়ে তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে,দেখতে ইচ্ছা করে।তবে আমি পারি না। নির্দিষ্ট একটা সীমাতে আমাকেও থাকতে হয়। কিন্তু আজকাল আর নিজেকে আ’টকাতে পারি না,পারছিও না।তোমাকে নিজের কাছে এনে রাখতে ইচ্ছা করছে।ভেতরে ভেতরে অস্থি’রতা কাজ করছিলো। মনের কথাগুলো বলে দিতে ইচ্ছে করছিলো।এখন বলছি_
“I’m fall in love with you Urmi.”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে দম ছাড়ে দীপ্ত।শ’ক্ত হয়ে বসে আছে উর্মি। দীপ্তের কথাগুলো তার ভেতরে ঝ’ড় তুলে দিচ্ছে।সেই ঝ’ড়ের আভাস কী দীপ্ত শুনতে পাচ্ছে?
সে ভাবে নি এতো সহজভাবে কথাগুলো বলে ফেলবে মানুষটা। সহজভাবে বললেও সে তো সহজভাবে নিতে পারছে না। নিজেকে সবসময় যতোই সহজ স্বাভাবিক দেখাক আদতে সেও একটা মেয়ে,আর মেয়েমানুষ নরম মনের অধিকারী হয়।দীপ্তের এসব কথা যে তার মনে বেশ ভালোভাবেই প্রভাব ফেলেছে সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যায়।সে স্থি’র থাকতে পারছে না।
নিচের দিকে তাকিয়ে আছে উর্মি।আর উর্মির দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে দীপ্ত। তারপর চোখ যায় টেবিলে উপর রাখা উর্মি কোমল হাত জোড়ায়।সেই কোমল হাতজোড়া নিজের শ’ক্তপো’ক্ত হাতের মুঠোয় ব’ন্দি করতে ইচ্ছে করছে খুব।
“তোমার হাতটা একটু ধরি?”
চট করে তাকায় উর্মি।চোখে চ’মকানো ভাব। দীপ্ত আবার বলে_
“একবার প্লিজ।”চোখে কন্ঠে দুটোতেই কা’তরতা।
উর্মি দ্রুত হাতগুলো নামিয়ে নিজের কোলের উপর রাখে। এতোক্ষণ দীপ্তের মাঝে ছিলো না’র্ভাসনেস। সেগুলো যেনো এবার উড়ে এসেছে উর্মির কাছে। দীপ্তের এমন প্রেমিময় রূপ সে ঠিক নিতে পারছে না।পারবে কী করে? এমন করে তো কখনো কোনো ছেলের সাথে কথা হয় নি।কেউ তাকে এভাবে বলেও নি।এই কথাগুলো তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন। না’র্ভাসনেস স্বাভাবিক নয় কী?
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে_
“আপনার আর কিছু বলার আছে।”
উর্মি কী রা’গ করলো? দীপ্তকে চিন্তিত দেখে উর্মি আসন্ন পাতলা হাসিটা আড়াল করে আবারও স্বভাবসুলভ সহজ ভঙ্গিতেই বলে_
“আর কিছু বলার আছে? থাকলে বলতে পারেন।”
দীপ্ত ঠোঁট কা’মড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে কতক্ষন। ভাবে যা হওয়ার হবে,কিন্তু সে মনের মধ্যে আর কোনো কথা লুকিয়ে রাখবে না।এমন সুযোগ আর নাও আসতে পারে। উর্মির উত্তর যাই হোক,অন্তত এটা ভেবে তো শান্তি পাবে যে সে নিজেকে প্রকাশ করেছে উর্মির কাছে।
ছোট একটা শ্বাস ফেলে আবার সামনে তাকায়।বলতে থাকে_
“আমি তোমাকে চাই উর্মি,একেবারে আমার করে।আমি চাই তুমি আমার হয়ে থাকো সারাজীবন।হ্যা আমি ভালোবাসি তোমাকে,তারমানে এই নয় যে তোমাকেও বাসতে হবে। জো’রপূর্বক কোনো কিছু আদায় করা আমার স্বভাবে নেই।আমি ভালোবেসেই তোমার ইচ্ছেতে তোমার ভালোবাসা পেতে চাই। সারাজীবনের জন্য তোমায় নিজের করে রাখতে চাই।সেই সুযোগটা দিবে আমাকে?”
প্রায় অনেকক্ষণ ধরে নীরবতা পালন করছে উর্মি।তার চোখ বাহিরে ছু’টন্ত গাড়িগুলোতে। দীপ্তও তাড়া দিচ্ছে না।সময় নিক তার কোনো অসু’বিধা নেই। কিন্তু শে’ষে যেনো নে’তিবাচক কোনো উত্তর না আসে সেই দোয়াই করছে।
উর্মি দীপ্তের দিকে তাকায়। দুজনেই চেয়ে আছে দুজনের দিকে।খানিক বাদে উর্মি হালকা হেসে টেবিলের নক দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে বলে_
“একটু আগে হাত ধরতে চাইছিলেন না?”
ভ্রু কুঁ’চকায় দীপ্ত। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে থাকে।উর্মি এবার টেবিল থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি দীপ্তের দিকে তাকিয়ে বলে_
“যদি আমার পরিবারের সম্মতি নিয়ে বৈধভাবে হাতটা ধরতে পারেন,তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
তারপর এক কোণে পড়ে থাকা দীপ্তের কফির দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ওঠে_
“কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,খেয়ে নিন।আর বিলটা দিয়ে দিয়েন।আসি,আসসালামুয়ালাইকুম।”
হেসেই চলে যায় উর্মি। পেছনে ফেলে যায় বি’ষ্মি’ত হয়ে চেয়ে থাকা দীপ্তকে।তার বিষ্ময় মুখোবয়বে আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে হাসি।এটাকেই বোধহয় বলে ইনডিরেক্টলি সম্মতি দেওয়া।উর্মির কথাতে তো দীপ্তের সেটাই মনে হচ্ছে। ঠোঁট কা’মড়ে শব্দ করেই হেসে ফেলে সে।পিঠ এলিয়ে দেয় চেয়ারে।চোখে মুখে প্রশান্তি।যা উর্মির বলা কথাটা মনে পড়লেই প্রগাঢ় হচ্ছে।
.
বিছানায় শুয়ে আছে আহনাফ,হাতে ফোন। তার পছন্দের ব্রান্ড এর অনলাইন পেইজে স্ক্রল করছে।এক তারিখ থেকে অফিস জয়েনিং।তাই কিছু শার্টস,ব্লেজার,সুট বুট দেখছে,ভালো লাগলে অর্ডার করবে। মনোযোগ তার সেইদিকেই ছিলো।
“আসবো বাবা?”
ফোন থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। আশফাক সাহেব দাড়িয়ে আছেন। আশফাক সাহেব আহনাফের রুমে তেমন আসেন না।এখন হ’ঠাৎ ওনাকে দেখে ভ্রু কুঁ’চকায় আহনাফ।ফোন অফ করে শোয়া থেকে উঠে বসে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না।আসতেও বলে না আবার চলে যেতেও বলে না,চুপ থাকে।
ছেলের চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়েই ভেতরে ঢোকে আশফাক সাহেব। রুমের চারপাশে তাকায়। পরিষ্কার গোছানো পরিপাটি একটা রুম। আহনাফের যে অ’পরিষ্কার অগো’ছালো পছন্দ নয় সেই ব্যাপারটা তিনি জানেন। অবশ্য এমন হবে না-ই বা কেনো? রাবেয়া নিজেও তো এমন ধাঁচের। অ’পরিষ্কার অগো’ছালো থাকা,অ’নিয়ম চলাফেরা একদম স’হ্য করতে পারে না। আহনাফ তো তার হাতেই মানুষ হয়েছে,এমন তো হবেই।ছেলে মেয়ে দুটোই স্বভাবে মায়ের মতো হয়েছে। শুধু আহনাফের চেহারা আর রা’গের মাত্রা উনার সাথে মিলে যায়।যুবক বয়সে উনারও রা’গ ছিলো মাত্রারি’ক্ত। আহনাফও উনার সেই রা’গটা পেয়েছে।ভেবেই হালকা হেসে ফেলে।তবে উর্মি ওনার মতো নয়। উর্মির চেহারা কিছুটা তার দাদির মতো।মেয়েটার দিকে তাকালে মায়ের কথা মনে পড়ে।তবে উর্মি স্বভাবে পুরো রাবেয়া।সবসময় শান্তশিষ্ট আর নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে।
ক্ষীণ শ্বাস ফেলে ছেলের দিকে তাকান।ভ্রু কুঁ’চকে ওনার দিকে তাকিয়ে আছে আহনাফ। নিশ্চয়ই ভাবছে তিনি হ’ঠাৎ ওর ঘরে কেনো?মুখে হাসি বজায় রেখে বিছানায় আহনাফের মুখোমুখি বসেন।
“বির’ক্ত করলাম?”
“কেনো এসেছেন?”আশফাক সাহেবের কথার পিঠে জবাব দেয় আহনাফ।কথায় রা’গ দ’ম্ভ বিদ্যমান।
“তোমাকে কিছু কথা বলার আছে,বাবা। যেগুলো তোমার জানা জরুরী।যেই অতীতের রেশ ধরে তুমি আমার সাথে রে’গে আছো তার মধ্যে আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে যা তোমার অজানা।”
একটু থেমে আবার বলে,”আমি পরিস্থিতির স্বীকার ছিলাম,বাবা।তুমি যা কিছু দেখেছো তা আমি নিজের ইচ্ছাতে করি নি। তোমার মা আর আমার মাঝে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করা হয়েছে।”
“আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না,যা বলার খুলে বলুন।”কৌতুহলী হয়ে কপালে ভাঁ’জ ফেলে বলল আহনাফ।
জানালার বাহিরে চোখ রাখে আশফাক সাহেব,তাকায় দূর দূরান্তে। অতীতে কথা ভাবতে ভাবতে বলতে শুরু করেন_
“পরিবারের বড়ো সন্তান ছিলাম আমি,বাবা মায়ের তিন ছেলের বড় জন।সেই হিসেবে দায়িত্বও কম ছিলো না। অ’ভাবের সংসার ছিলো আমাদের।ছোট থেকেই সবসময় দেখতাম সংসার চালাতে বাবা হিম’শিম খেতো।অল্প আয়ের ছোট একটা ব্যবসা ছিলো উনার।আয় অল্প কিন্তু খরচ অনেক বেশি,সব দিক ম্যানেজ করতে পারতো না তোমার দাদা। আমাদের তিন ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ, সংসারের খরচ,আত্মীয় স্বজন বেড়াতে আসলেও খরচ আবার ছোট ব্যবসা হলেও সেখানেও টাকা ব্যয় করতে হতো তাও অ’ভাব অন’টন পিছু ছাড়তো না। অ’ভাবের পরিমাণ এতো ছিলো যে অনেকসময় মুরি আর পানি খেয়েও থাকতে হয়েছে।সবশেষে দিশে’হারা হয়ে যেতেন বাবা।কোনো কূল কিনারা খুঁজে পেতেন না।
এসব দেখে খা’রাপ লাগতো খুব।মনে হতো বড়ো ছেলে হয়ে কিছু করতে পারছি না পরিবারের জন্য।তবে পড়ালেখা করতে খুব ভালোলাগতো। ইচ্ছে ছিলো পড়ালেখা শে’ষ করে চাকরি বাকরি করে টাকা পয়সা কামাবো।পরিবারকে ভালো একটা অ’বস্থায় নিয়ে যাবো।
কিন্তু দিন যতো যাচ্ছিলো খরচ যেনো বাড়ছিলো। এদিকে তোমার দাদার ব্যবসার আরো অব’নতি হচ্ছিলো। পরিবারের ক’রুন অবস্থা দেখে পড়ালেখা ছেড়ে বাবার ব্যবসায় হাত লাগালাম। খুব ক’ষ্ট হয়েছিলো নিজের স্বপ্নকে ব’লি দিতে। তারপর ভাবলাম যেখানে ঠিক মতো খাওয়া জুটছে না সেখানে পড়ালেখা করার স্বপ্ন দেখা বিলাসীতা,এই ভেবে নিজেকে সামলেছি।মন দিয়ে বাবার সাথে ব্যবসা করেছি।
আল্লাহর অশেষ দয়ায় কয়েক বছরে ব্যবসা মোটামুটি ভালো জায়গায় পৌঁছে গেছে।তখন তোমার দাদা আর দাদি বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন আমাকে,আমিও রাজি হয়ে গেছি।বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করলাম রাবেয়াকে।সে আমার জীবনে একটা রহমত হয়ে এসেছে।যাকে আমি কদর করতে পারি নি।
এরমধ্যে তোমার দাদা চলে গেছেন আমাদেরকে ছেড়ে। ভে’ঙ্গে পড়েছিলাম খুব।বাবার ছিলো মাথার ছায়া,সেই ছায়া চলে যাওয়ার পর দিশা হারিয়ে ফেলি।তখন রাবেয়া বুঝিয়েছিলো আমায়,বাবার পর আমিই তো পরিবারের অভিভাবক। পরিবারের বাকি সদস্যরা তো আমার মুখের দিকেই চেয়ে আছে।সেখানে আমিই ভে’ঙে পড়লে চলবে কী করে?মানুষিক ভাবে রাবেয়া খুব সাপোর্ট করতো। নিজেকে শ’ক্ত করলাম। পরিবারের সবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলাম,ভালোভাবে ব্যবসার হাল ধরলাম। নিজের পড়ালেখা করতে পারি নি তো কী হয়েছে বাকি দুই ভাইকে পড়ালেখা শেষ করাবো, প্রতি’জ্ঞাবদ্ধ হলাম।ওদের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে গেলাম। পরিবার ব্যবসা সব সামলাতে গিয়ে আমিও হিম’শিম খেতাম,তখন অনুভব করতাম বাবাকে।
বিয়ের দুই বছরের মাথায় আমাদের ঘর আলো করে এলে তুমি। খুব খুশি হয়েছিলাম।বাবা হওয়ার আনন্দে তখন বাঁ’ক হারা আমি।এর মধ্যে তোমার বড়ো চাচা আমিন কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে।সে আরেক ঝা’মেলা। মায়ের তুমুল ঝ’গড়া, কিছুতেই মানবে না।উনার কথা একে তো আমিন পড়ালেখা করছে,বেকার সে। তার মধ্যে আবার বউ।কে চালাবে?এসব নিয়ে বাড়িতে অশা’ন্তি।এতো অশা’ন্তি ভালো লাগছিলো না।বাধ্য হয়ে আমিনের বউ শিল্পীর ভরণপোষণের দায়িত্বও নিজের ঘাড়ে নিলাম। সারাক্ষণ ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম।আমি কাজ না করলে পরিবার চলবে কী করে।তাই তোমাকে, রাবেয়াকে কাউকে সময় দিতে পারতাম না। সারাদিন কাজ শে’ষে যখন বাড়ি ফিরতাম সেখানেও শান্তি নেই। রাবেয়ার নামে মা অভি’যোগ করতো।ভালো লাগতো না শুনতে মেজাজ খা’রাপ হতো,মায়ের মুখের ওপর কিছু বলতেও পারতাম না।সব রা’গ দেখাতাম রাবেয়ার ওপর,অথচ ওর কোনো দো’ষই ছিলো না।ওকে ব’কাব’কি করলে নিজেই আবার ক’ষ্ট পেতাম।
যতোদিন যাচ্ছিলো খরচ বাড়ছিলো।এদিকে ব্যবসা লাভ ল’স নিয়েই চলছিল, কোনো উন্নতি হচ্ছিলো না।কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। তখন একজন পরামর্শ দিলো বিদেশে যাওয়ার,মনে ধরে কথাটা।বাড়ি এসে তোমার মায়ের সাথে কথাটা শেয়ার করি।ও সবসময় ভালো কাজে আমাকে সাপোর্ট দিতো,তখনও তাই দিয়েছে। বিদেশ যাওয়ার জন্য সব রকমের কাগজ পত্র জমা দিলাম। কিন্তু পথটা এতোটা সহজ ছিলো না,অনেক টাকার দরকার।এতো টাকা কোথায় পাবো? রাবেয়া তখন ওর বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া গয়নাগুলো আমাকে দেয় বি’ক্রি করার জন্য।গয়না বলতে ওগুলোই ছিলো ওর।আমি কখনো ওকে কিছু দিতে পারি নি।প্রথমে নিতে চাইনি পরে ভাবলাম এখন বি’ক্রি করি,বিদেশে গিয়ে টাকা ইনকাম করতে পারলে আবার গড়িয়ে দেব। গয়না বি’ক্রিতে যেই টাকা পেয়েছি তা দিয়ে হবে না আরো দরকার ছিলো।মাথা কাজ করছিলো না,কী করবো।
রাবেয়া একবার ওর বান্ধবীর সাথে কথার প্রসঙ্গে এই কথাটা শেয়ার করে।তখন ওর বান্ধবী রুমি বলে সে হেল্প করতে চায়।তার স্বামী ছিলো ভালো ব্যবসায়ী।কিন্তু তোমার মা কিছুতে রাজি হয় না।তার আত্মসম্মান প্রবল।রুমিও বার বার করে বলে ধার হিসেবে নিতে পরে যখন আমি বিদেশে যাবো তখন না হয় শোধ করে দিবো।সেই কথার প্রেক্ষিতে রাবেয়া রাজি হয়।আমাকে জানায়, পরিবারের কথা চিন্তা করে অন্য কিছু আর ভাবি নি রাজি হয়ে যাই।রুমির স্বামী কবির আমাকে টাকা পাঠায়,আমিও কথা দেই একটু সময় লাগবে তবে আমি শোধ করে দিবো।
অনেক অপেক্ষার পর ভিসা এসেছে।ফ্লাইট ডেট পড়েছে। খুব খুশি ছিলাম।পরিবারের সবার অব’স্থাও তাই।আমি সবাইকে বলি এই সবকিছুতে রাবেয়ার অবদানই বেশি।সে আমাকে মানুষিক ভাবে আর্থিক ভাবে খুব সাহায্য করেছে।এই কথাগুলো নিতে পারতো না তোমার দাদি। সারাক্ষণ রাবেয়াকে খোঁ’চা মে’রে কথা বলতো।সময়ের সাথে সাথে যেনো রাবেয়া ওনার চক্ষু’শূ’ল হয়ে উঠছিলো।অথচ রাবেয়া চক্ষু’শূ’ল হওয়ার মতো কোনো কাজই করতো না। সবসময় সবার ভালোটাই চাইতো।
বিদেশে যাওয়ার দিন তোমাকে আর তোমার মাকে নিয়ে যাই, সাথে যায় তোমার বড়ো চাচা আমিনও। তোমার ছোট চাচাও যেতে চেয়েছিলো,আরিফের পরিক্ষা ছিলো দেখে আমিই বারণ করেছিলাম।তারপর তোমাদেরকে রেখে চলে আসি বিদেশে।
বিদেশে এসেও শান্তি পাই নি। সারাক্ষণ মা রাবেয়ার নামে নালিশ করতো, উল্টো পাল্টা কথা বলতো।তাই ফোন করাই ব’ন্ধ করে দিই। অনেকদিন বাদে ফোন করে খোঁজ নিতাম। একদিন জানতে পারি রাবেয়া তোমাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। প্রচন্ড অবা’ক হই তখন।কারণ জানতে চাইলে মা বলে…”
এই পর্যন্ত বলে চুপ হয়ে যায় আশফাক সাহেব,চোখ বুজে ফেলে।আহনাফ কৌতুহল কন্ঠে বলে,”কী বলেছে?”
“বলেছে রাবেয়া পর’কী’য়া করে।তাও আবার তার বান্ধবীর স্বামীর সাথে। সেইদিন মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। খুব ভালোবাসতাম তোমার মাকে।ওর নামে এমন কথা স’হ্য হচ্ছিলো না।জানতে চাইলাম কোন বান্ধবী আর কীসের ভিত্তিতে তারা এমন কথা বলছে।আমাকে অবা’ক করে দিয়ে জানায় রুমির স্বামী কবির।
নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।মা এসব বলে থেমে থাকেনা, কবিরের সাথে রাবেয়াকে জড়িয়ে নানা বি’শ্রী কথা বলে। রাবেয়া নাকি ফোনে সারাক্ষণ কবিরের সাথে কথা বলতো,দেখা করতো।আর সে সব কিছু মা নিজে দেখেছে,আমাকে সেটাই জানালো। তারপরেও আমি বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না।হিতা’হিত জ্ঞান শূ’ন্য হয়ে পড়ি।
সবার সাথে যোগাযোগ বি’চ্ছিন্ন করে ফেলি। তারপর একদিন জানতে পারি রাবেয়া অন্তঃসত্ত্বা।খবরটা মা-ই আমাকে জানায়।আরো একটা মি’থ্যে কথা বলে আমাকে দুম’ড়ে মুচ’ড়ে দিয়ে তোমার মায়ের সাথে ভু’ল বোঝাবুঝি তৈরি করে দেয়।”
“কী কথা?”স্ত’ব্ধ কন্ঠে বলে আহনাফ।
“রাবেয়ার পেটের বাচ্চাটা কবিরের।”এই একটা বাক্য বলতে যেয়ে কন্ঠ কেঁ’পে ওঠে আশফাক সাহেবের।
চলবে….