#অবশেষে_সন্ধি_হলো
#পর্ব:৪
#লেখিকা: ইনায়া আমরিন
সকাল সকাল হু’টোপু’টি করে হাজির হয়েছে অথৈ।চ’টপ’টে চ’ঞ্চল মিষ্টি একটি মেয়ে।খুব সহজে যে কোনো মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার মতো দারুন প্রতিভা আছে তার,সাথে আসর জমাতেও ও’স্তাদ সে। মনে যা মুখেও তা,একবারে টক ঝা’ল মিষ্টি টাইপ।
মায়ের সাথে সকালের নাস্তা বানাচ্ছিলো উর্মি।তার মধ্যেই এক নাগাড়ে কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসতেই বুঝে গেলো দরজার বাহিরের মানুষটি কে। অতি’ষ্ঠ ভঙ্গিমায় দুপাশে মাথা নাড়িয়ে দরজা খুলতে গেলো।মুখে বিরবির করলো,”এই মেয়ে আর শুধ’রালো না।”এমন কান্ড দেখে রাবেয়া বেগম হেসে ফেললো।তার ঘর গরম করার বান্দা হাজির।
দরজা খোলার সাথে সাথে তড়িগড়ি করে ঢুকে গেলো অথৈ।উর্মিকে দেখে কন্ঠে মেকি রা’গ ঢেলে বলে_
“কোথায় থাকিস আজকাল?আমি ম’রে টরে গেলেও তো খবর পাবি না।”
উর্মি কোমরে দুই হাত রেখে ছোট শ্বাস ফেলে বলে,”সকাল সকাল এটা বলতে এসেছিস?”
অথৈ দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলে,”মোটেই না,আমি আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে এসেছি।” তারপর আবার চোখে মুখে মিছে মিছে রা’গা’ন্বিত ভাব নিয়ে বলে,”আর তোর ভাইয়ের পি’ন্ডি চ’টকা’তে।”
উর্মি ভ্রু উঁচিয়ে অবা’ক হয়ে বলে,”ভাইয়া আবার কী করেছে?”
অথৈ উ’ত্তেজিত হয়ে বলে,”আমার ফোন ধরে না, মেসেজের রিপ্লাই করে না।রা’গ হয় না বল? উনার পিছনে এতো ঘুরঘুর করি অথচ পাত্তাই দেয় না আমায়।”
ঠোঁট টিপে হাসে উর্মি। কৌ’তুক করে বলে,”সারাক্ষণ জ্বা’লাতন করলে তো এমন হবেই।”
উর্মির কথায় এবার সত্যি সত্যি রা’গ হয় অথৈয়ের। আঙুল উঁচিয়ে উর্মির দিকে তা’ক করে কিছু বলতে নিবে তার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় রাবেয়া।হাত নামিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো দাড়ায় অথৈ,মুখে হাসি নিয়ে তাকায় রাবেয়ার দিকে।
“কেমন আছো অথৈ?কতো দিন পর এলে।”
অথৈ মুখে হাঁসি নিয়েই মনে মনে আওড়ায়,”আপনার হা’র্টলেস ছেলেটা যদি নিষ্পাপ একটা মেয়ের হা’র্ট নিয়ে লুডু খেলে তাহলে সেই মেয়েটা ভালো থাকতে পারে?”
মুখে বলে,”ভালো আছি আন্টি। আপনাদেরকে দেখে আরো ভালো লাগছে।”
রাবেয়া হাসিমুখেই বলে,”আচ্ছা কথা বলো তোমরা,আমি যাই।চুলোয় রুটি দিয়ে এসেছি,পু’ড়ে যাবে নাহলে।আর হ্যা,অবশ্যই নাস্তা করে যাবে কিন্তু।”
মাথা নাড়ায় অথৈ। রান্নাঘরে চলে যায় রাবেয়া।
অথৈ আর উর্মি দুজন বেস্টফ্রেন্ড।তবে মজার ব্যাপার হলো দুজনের বয়সের মধ্যে এক বছরের ব্যবধান রয়েছে।উর্মির এক বছরের ছোট অথৈ।উর্মি এবার অনার্স প্রথম বর্ষে আর অথৈ এইচএসসি ক্যানডিডেড।তবে বয়সের ব্যবধান হলেও তাদের বন্ধুত্বের গভী’রতা অতুলনীয়।এই বন্ধুত্বের শুরু স্কুল জীবন থেকে।উর্মি স্কুল জীবনে সবার সাথেই মেলামেশা করতো তবে কাউকে তেমন বন্ধু বানায় নি,সবাই ছিলো তার ক্লাসমেট।হ’ঠাৎ করেই অথৈয়ের সাথে পরিচয় হয়।শান্ত উর্মি চ’ঞ্চল অথৈয়ের চ’ঞ্চলতায় মুগ্ধ হয়।অথৈয়ের কথায় কাজকর্মে সে হাসে।মেয়েটা মন ভালো করার যা’দু জানে।স্কুলের ক্লাসগুলো ছাড়া সারাক্ষণ দুজন একসঙ্গে থাকতো।প্রথমে অথৈ তাকে তুমি বলে সম্বোধন করলেও যখন তাদের বন্ধনের দৃ’ঢ়তা বেড়েছে তখন উর্মি তাকে “তুই” বলে ডাকতে বলেছে।অথৈ তো মহাখুশি,তার সিনিয়দেরকে ভালো লাগে।সে সবসময় চাইতো সিনিয়র কারো সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে।সেই হিসেবে উর্মিকে তার দারুন লেগেছিলো।যখন দেখলো উর্মিও তার সাথে থেকে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে,তাকে “তুই” বলারও অনুমতি দিয়েছে।তখন তো তার আনন্দের সীমা নেই।সেই ফ্রেন্ড থেকে আজ তারা দুজন দুজনের বেস্টফ্রেন্ড।
অথৈ আশেপাশে একবার তাকিয়ে তারপর উর্মির দিকে তাকায়।ফিসফিস করে বলে,”তোর ভাই কোথায়?”
“ছাদে,এক্সারসাইজ করছে।”উর্মির স্বাভাবিক উত্তর।
“আর আঙ্কেল?”
“আব্বু তো ঘুমোচ্ছে।এখনই হয়তো উঠে পড়বে।”
“আচ্ছা” বলে অথৈ চ’টপ’টে পায়ে বের হয়ে যাচ্ছিলো।তা দেখে উর্মি বলে,”এই কোথায় যাচ্ছিস?”
“ছাদে।”অথৈয়ের চ’ঞ্চল উত্তর।
উর্মি আর কিছু বলার আগেই সে লাপাত্তা।দু দিকে মাথা নাড়িয়ে উর্মি ভাবে_
“ভাইয়ার ব’কা খাওয়া ছাড়া বোধহয় এই মেয়ের শান্তি হবে না।”
.
ছাদের এককোণে পুশ আপ করছে আহনাফ। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।কালো কালো চুলগুলো ঘামের সাথে মিশে কপালে লে’প্টে আছে।পুশ আপের জন্য হাতের পেশিগুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে।টান টান মেদহীন শরীরের আনাচে কানাচে ঘাম যার দরুন পরিহিত গেঞ্জি ভিজে গেছে।দু একদিন বাদে প্রতিদিনই আহনাফ ছাদে আসে এক্সারসাইজ করতে।সে চাইলে নিজের রুমেও করতে পারে কিন্তু প্রকৃতির মাঝে সকালের ফুরফুরে বাতাস গায়ে মাখাতে মাখাতে এক্সারসাইজ করতেই তার বেশি ভালো লাগে।আর সকাল সকাল কেউ তেমন ছাদে আসেও না, সেজন্য আহনাফের সুবিধাই হয়।
ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সব দেখছে অথৈ।যে হ’ম্বিত’ম্বি করে সে এসেছে,সব ফু’শশ। ভেবেছিলো আজ একটা এস’পার ওস’পার করবে।লোকটা কী ভাবে নিজেকে। সারাক্ষণ তার জন্য পা’গলামি করে দেখে এমন অব’হেলা করবে?ফোন তুলবে না?
নাহ,এসবে ভুললে চলবে না। কৈ’ফিয়ত নিতে হবে।তার ছোট্ট তুলোর ন্যায় হৃদয়খানা দিয়ে তা’মাশা করে এই লোক কী মজা পায় সেটা জানতে হবে না? অবশ্যই হবে।মুখে রা’গ নিয়ে আবারো হ’ম্বিত’ম্বি দেখিয়ে আহনাফের সামনে এসে দাড়ালো।
সামনে অথৈকে দেখে পুশ আপ করা থামায় আহনাফ। মুখ দিয়ে বির’ক্তিসূচক শব্দ বের করে দাঁড়িয়ে পড়ে।সকাল সকাল এসে হাজির। এবার প’কপ’ক করে তার মাথা ব্য’থা উঠিয়ে দিয়ে তবে ক্ষ্যা’ন্ত হবে এই মেয়ে।
“আপনি আমাকে ব্ল’ক করেছেন কেনো?”কোমরে দুই হাত রেখে রা’গা’ন্বিত কন্ঠে বলে অথৈ।তবে যেই রা’গটা দেখাবে বলে ভেবেছে ভেতর থেকে তা আসছে না। এরজন্য মনে মনে সে নিজের ওপর নিজে বির’ক্ত।
আহনাফ কোনো উত্তর দেয় না।পাশ থেকে পানির বোতল নিয়ে পানি খায়।যেনো তার আশেপাশে কোনো মানুষের অ’স্তিত্বই নেই।তা দেখে অথৈ আবার বলা শুরু করে_
“আপনি জানেন আমি এক রাত ঘুমাতে পারি নি।কেন পারিনি?কার জন্য পারিনি? আপনার জন্যই তো।ফোন ধরেন নি কেনো,কেনো ব্ল’ক করেছেন? একটু কথাই তো বলতাম।বেশি কিছু তো না।”
আহনাফ চোখে মুখে বির’ক্তি প্রকাশ করে বলে_
“তোমার মুখটা একটু ব’ন্ধ রাখবে,প্লিজ।এতো কথা কীভাবে বলো?”
“আপনি পটে গেলে কী আমার আর এতো কথা বলতে হতো?”দুখী দুখী ভাব করে কথাটা বলে অথৈ।
এই কথা শুনে ভ্রু কুঁ’চকে তাকায় আহনাফ।মাথার স্ক্রু কী ঢি’লা নাকি এই মেয়ের।বলে_
“আশ্চর্য!এর সাথে পটে যাওয়ার কী সম্পর্ক?”
“ওহ হো,পরিক্ষার রেজাল্ট দেয়ার পর কাউকে পড়াশোনা করতে দেখেছেন?তেমনি আপনি পটে গেলে কী আমি আপনার পিছে পিছে এতো ঘুরতাম?এতো ক’ষ্ট করতাম? তখন তো আপনি আমার পিছে পিছে ঘুরতেন।উপস!!ভাবলেই লজ্জা লাগে আমার।”মুখে দুই হাত দিয়ে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে ফেলে অথৈ।
মুখ ফুলিয়ে দম ছাড়ে আহনাফ। বির’ক্তিটা এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।কখন ঠা’শ করে লাগিয়ে দেয় আল্লাহ জানে। বির’ক্তিটা এক কোণে রেখে বলে_
“এসব আবেগ পকেটে রেখে পড়াশোনায় মন দাও। ফিউচারে কাজে দিবে।”
আহনাফের কথায় মন খা’রাপ হয় অথৈয়ের।মন খা’রাপ করেই বলে_
“কী করে পড়ালেখায় মন দিবো?মন তো পড়ালেখা চায় না,মন আপনাকে চায়।বিয়ে করে আপনার সাথে সংসার করতে চায়। আপনার বাচ্চাকাচ্চাকে সামলাতে চায়। পড়ালেখা অনেক ক’ঠিন,ঘর সংসার করা আরো সহজ।আপনি পটে গেলে এখন আমার ছোট খাটো একটা সংসার থাকতো।”
আহনাফের অলরেডি মাথা ব্য’থা করতে শুরু করে দিয়েছে।এখানে আর থাকা যাবে না।
“স্টু’পিড।”অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে চলে যায় আহনাফ।
“হা’র্টলেস।”
থেমে থাকে না অথৈও। আহনাফের প্রতিটা কথার পাল্টা উত্তর তাকে দিতেই হবে।
সেদিন রাবেয়ার কথায় সবার সাথে নাস্তা করেই গেছে অথৈ।খাবার টেবিলে ধু’ম আড্ডা দিয়েছে সে।আড্ডটা বেশি জমেছে আশফাক সাহেবের সাথেই।এটা সেটা বলে হাঁসির ফোয়ারা লাগিয়ে দিয়েছে।হেসেছে উর্মি,রাবেয়াও। আহনাফ শুধু চোখ পা’কিয়ে তাকাতো বার বার,পাত্তা দেয় নি অথৈ।সে শশুরকে পটাতে ব্যস্ত।
অথৈ যাওয়ার পর আশফাক সাহেব রাবেয়াকে বলে_
“মেয়েটা ভারি মিষ্টি।খুব মিশুক,তাই না?”
মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় রাবেয়া।
.
বিকেলে টিউশনিতে যাচ্ছে উর্মি।সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ব্যাগে তার স্টুডেন্টের জন্য বাবার আনা চকলেট ভরছে। ছোট্ট মাইশা চকলেট খেতে খুব ভালোবাসে।আজ এতো চকলেট পেয়ে নিশ্চই খুব খুশি হবে।
“আমি কী চকলেট পাবো না?”
দাঁড়িয়ে যায় উর্মি।পিছু ফিরে দেখে দীপ্তকে।সে জানতো এটা দীপ্ত ছাড়া আর কেউ না। একবার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে তারপর দীপ্তের দিকে তাকিয়ে বলে_
“এগুলো তো আমার স্টুডেন্টের জন্য।”
“আর আমার জন্য?”
খানিকটা অপ্র’স্তুত হয় উর্মি।আমতা আমতা করে বলে_
“আপনি চকলেট খাবেন?”
দীপ্ত হেসে ফেলে। সেভাবেই রয়ে সয়ে বলে_
“কেনো?আপনি খান না?”
দীপ্তের কথার বলার ধরনে হেসে ফেলে উর্মি।হেসেই বলে_
“মেয়েরা তো সা’ধারণত চকলেট আইসক্রিম পছন্দ করেই।আমিও তার বাহিরে নই।”
মুচকি হেসে এগিয়ে আছে দীপ্ত।উর্মির সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে টান টান হয়ে দাঁড়ায়। তারপর হাল্কা একটু ঝুঁকে উর্মির দিকে তাকায়।কন্ঠে ঘোর লাগিয়ে বলে_
“সামটাইমস,ছেলেরাও চকলেট পছন্দ করে।
মেয়েটার সারা মুখে বিচরণ করে তার মুগ্ধতা মিশ্রিত চোখ জোড়া।সেভাবেই আবার বলে_
“হোয়াইট চকলেট।”
ভ্রু কুঁ’চকে তাকায় উর্মি।বলে_
“মানে?”
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দীপ্ত। হাত দিয়ে চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বলে,”আমার হোয়াইট চকলেট বেশি ভালো লাগে সেটাই বলছিলাম।”
ব্যাগ থেকে একটা বড়ো ডেইরি মিল্ক বের করে দীপ্তের দিকে বাড়িয়ে দেয় উর্মি।
“হোয়াইট চকলেট নেই। আপাতত এইটা আছে,চলবে?”
চকলেটটা নেয় দীপ্ত।মুখে বলে,”না চললেও চালিয়ে নেবো।”
উর্মি হালকা হেসে বলে,”আসি।”
মাথা নাড়ায় দীপ্ত।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয় আহনাফ। হ’ঠাৎ ফোনে মেসেজ টোন বে’জে ওঠে।হাতে নিয়ে মেসেজটা চেক করেই চ’মকে ওঠে।মুখে হালকা হাসি।পুরো মেসেজটা পড়তে পড়তে হাসি বি’স্তৃত হয়।চোখ ব’ন্ধ করে শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর কাছে।
অনেকদিনের কাঙ্ক্ষিত চাওয়া যখন পূর্ণ হয় তখন মানুষের মনটা আনন্দে পু’লকিত হয়ে ওঠে। প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় হৃদয়। আহনাফের অ’বস্থাও তাই।
চলবে…