#অবশেষে_সন্ধি_হলো
#পর্ব :৩
#লেখিকা :ইনায়া আমরিন
সাদা গাড়িটি ইমতিয়াজ ভিলার সামনে এসে থামলো।গাড়ি থেকে নেমে এলো আশফাকুর রহমান,উর্মি, আহনাফ ও দীপ্ত। আশফাক সাহেবের চেহারায় স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ।আহনাফ উর্মিকে আস্তে করে বলে,”ওনাকে নিয়ে বাসায় যা।আমি ব্যাগগুলো নিয়ে আসছি।”
উর্মি হাসিমুখে মাথা নেড়ে বাবাকে নিয়ে যায়। আহনাফ দীপ্তের দিকে তাকায়।সে গাড়ি থেকে একাই ব্যাগ গুলো নামাচ্ছে।
“এবার আমাকে দাও,আমি নিয়ে যাচ্ছি এমনিই অনেক ক’ষ্ট করেছো।”
দীপ্ত মুচকি হেসে বলে,”তেমন কিছুই করি নি।আমার জায়গায় থাকলে তুমিও একই কাজ করতে।”
হালকা হাসে আহনাফ।তারপর দুজনে মিলে শেয়ার করে ব্যাগগুলো পাঁচ তলা পর্যন্ত নিয়ে আসে। দীপ্ত আর ভেতরে যায় না।ব্যাগ গুলো যথাস্থানে রেখে বলে_
“আহনাফ,এবার আমি আসি।তোমরা রেস্ট নাও।”
আহনাফ ব্রু কু’চকে বলে,”আসি মানে কী?ভেতরে এসো।অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যাও।”
উর্মি দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ভেবেছিলো দীপ্তকে সৌজন্যতার খাতিরে ভেতরে আসতে বলবে।তার বলার আগেই আহনাফ বললো। আহনাফের কথায় দীপ্ত এক পলক উর্মির দিকে তাকায় তারপর আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে_
“আজ না।অন্য একদিন।”
.
“কেমন আছো রাবেয়া?”
জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো রাবেয়া বেগম।আট বছর পর স্বামী নামের মানুষটার সাথে দেখা।কোথাও একটা জ’ড়তা,সং’কোচ কাজ করছে।মুখ থেকে কথা বের হতে চায় না। তারপরেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে থেমে থেমে বলে_
“ভালো আছি।আপনার আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো?না মানে দেখে ক্লান্ত লাগছে।”
স্মিত হাসে আশফাক সাহেব। রাবেয়ার কথার উত্তরে বলে_
“এতো বছর পর তোমাদেরকে দেখে যেই শান্তিটা পাচ্ছি তার কাছে এই ক্লান্তি কিছুই না।”
রাবেয়া মাথা নাড়িয়ে নরম কন্ঠে বলে _
“রুমে যান,ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি খাবার বাড়ছি।”তারপর উর্মিকে ইশারা করে।যেনো যা লাগে সব এগিয়ে দেয় তাই।
.
পরিবারের চার সদস্য একসাথে খেতে বসেছে। আশফাক সাহেবের মুখে তৃপ্তময় হাসি।এখন আর ক্লান্তির ছাপ নেই।স্ত্রী সন্তানকে কাছে পেয়ে যেনো তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে। উর্মি বারবার বলছে “আব্বু এটা নাও” “আব্বু ওটা নাও”। রাবেয়া নিজের হাতে বেড়ে দিচ্ছে। তারপর স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক আগের মতো।যেমনটা তিনি বিয়ের পর থেকে করে আসতেন।এসব দেখে খুব ভালো লাগছে আশফাক সাহেবের। অথচ এই মানুষগুলোকে একটা সময় দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আহনাফের দিকে তাকালেন।সে গম্ভীর মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে।তার সাথে একটা কথাও বলে নি ছেলেটা।
“খাচ্ছেন না কেনো?”
রাবেয়ার কথা সম্বিত ফিরল আশফাক সাহেবের। মাথা নেড়ে বললেন,”খাচ্ছি।” তারপর আবার রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমিও বসো, একসঙ্গে খাই।”
“আমি পরে খাবো।”
রাবেয়ার কথায় অস’ন্তোষ হয়ে বললেন,”না না।পরে কেনো খাবে। এখনই বসো সবাই একসঙ্গে খাবো। পরিবারের সকলে একসাথে খাওয়ার মজাই আলাদা।”
তারপর স্ত্রীর হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। রাবেয়া আর না করেনা।তবে আহনাফের মুখে হালকা তা’চ্ছিল্যের হাসি দেখা গেলো। আশফাক সাহেবের “পরিবার” কথাটায় যেনো জ্ব’লে উঠলো সে,স’হ্য হলো না। তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে চলে গেলো। আহনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।
“ছেলেটা এখনো আমায় ক্ষমা করতে পারে নি।”
স্বামীর কথায় দী’র্ঘশ্বাস ফেলে রাবেয়া।এটা উনিও জানেন। আশফাক সাহেবের হাত ওপর এক হাত রেখে বলে_
“সব ঠিক হয়ে যাবে,চিন্তা করবেন না। আহনাফকে আমি চিনি। বুঝিয়ে বললে ও বেশিদিন রাগ নিয়ে থাকতে পারবে না।”
আশফাক সাহেব জানে ওনাকে সান্তনা দিতে এই কথাগুলো বলা। অতীতে এমন কিছু ভুল করেছেন তিনি যার দা’গ এখনো রয়ে গেছে। রাবেয়া সব ভুলে ক্ষমা করেছে কিন্তু আহনাফ করে নি।ছেলেটা এখনো বাবার ওপর রা’গ পুষে রেখেছে।আর এই রা’গ উনাকেই ভা’ঙাতে হবে।ছোট শ্বাস ফেলে উর্মির দিকে তাকায়।মেয়েটা কেমন নিষ্পাপ চাহনিতে তাকিয়ে আছে।উনি তাকাতেই কেমন বোঝানোর ভঙিতে বলে_
“তুমি ক’ষ্ট পেওনা আব্বু।সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মুখে হাসি টেনে আদরের একমাত্র মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন আশফাক সাহেব।
.
আহনাফের বয়স তখন ছয় বছর।বাবা মা,দাদা দাদি,চাচা চাচি মিলে বড়ো এক পরিবার ছিলো তার। কিন্তু দাদি মানুষটা ছিলো তার চোখের বালি। কিছুতেই স’হ্য হতো না দাদিকে।তার সবচেয়ে বড়ো কারণ হচ্ছে দাদি তার মাকে খুব ক’ষ্ট দিতো।সারাদিন তার মাকে দিয়ে খা’টাখা’টনি করাতো,কাজে ব্যস্ত রাখতো।তার মা এতোটাই ব্যস্ত থাকতো যে তাকেও ঠিক মতো সময় দিতে পারতো না। এদিকে তার বাবা বাড়িতে থাকতো না।তার দাদা আজহার রহমানের রেখে যাওয়া ছোটখাটো একটা ব্যবসা ছিলো।দাদার মৃ’ত্যুর পর তার বাবাই তার দেখাশোনা করতো, সারাদিন তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। ছোট আহনাফ একা অনুভব করতো,মন খা’রাপ হতো।তার মন খা’রাপ আরো বেড়ে যেতো যখন দেখতো তার মা দাদির কথায় ক’ষ্ট পেয়ে আড়ালে গিয়ে কাঁদে।মায়ের কান্না দেখে তারও কান্না পেয়ে যেতো।
একদিন সে তার বাবাকে বলে দেয় তার দাদি তার মাকে ক’ষ্ট দেয়,বাড়ির সব কাজ মাকে দিয়ে করায়।সেইদিন তার দাদি সেলিনা খাতুন নিজের ছেলের সামনে নিজের মতো করে বা’নোয়াট যুক্তি দেখিয়ে পুরো দো’ষটাই রাবেয়া ঘাড়ে চাপান সাথে রাবেয়ার নামে উল্টো পাল্টা কথা বলে ছেলের কান ভারি করতে ভুলেন না। মায়ের কথা যাচাই-বাছাই না করেই স্ত্রীকে চ’রম ব’কাব’কি করেন আশফাক সাহেব।বাবার কাছে মাকে ব’কা শুনতে দেখে আহনাফের কান্না পায়। কিন্তু সেলিনা বেগম শুধু ছেলের কান ভারি করে বউকে বকা খাইয়ে ক্ষ্যা’ন্ত হয় নি।বাবার কানে সব লাগিয়ে দেয়ার জন্য আহনাফকে একা ডেকে বেধরক পি’টিয়েছে।সাথে হুঁ’শি’য়ারি দিয়েছে বাবার কাছে যদি আর কোনো কথা লাগায় তাহলে আবার মা’রবে।ছোট আহনাফ দাদির ভ’য়ে আর কোনো দিন কিছু বলে না।তার দাদি চ’ন্ডীরূপ বাবার অনুপস্থিতিতেই দেখাতো।বাবার সামনে বাবাকে দেখিয়ে দেখিয়ে তাকে খুব আদর করতো। কিচ্ছুটি বলতে পারতো না আহনাফ,মনে মনে দাদিকে চু’ড়ান্ত ঘৃ’ণা করতো।
তারপর তার বাবা বিদেশ চলে গেলো। একদিন তার মা হ’ঠাৎ করে দাদির সাথে ঝ’গড়া করে তাকে নিয়ে চলে এলো বাবার বাড়ি। মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলো আহনাফ।দাদির জ্বা’লা য’ন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেলো।কিন্তু নানা বাড়ি গিয়েও শান্তি পেলো না। সেখানেও মানুষ তাদেরকে নানা কথা বলে অপ’দস্থ করতে লাগে। তারপর তার মা ছোট একটা বাসা ভাড়া নেয়।তাকে নিয়ে সেখানে চলে যায়।এতো ক’ষ্টের মাঝে একটা খুশির সংবাদ এলো,তার একটা ভাই অথবা বোন হবে।সেই খুশিতে ঘুমাতে পারতো না আহনাফ। সারাক্ষণ মাথা ঘুরতো তার একটা খেলার সাথী আসবে।কী যে খুশি সে।কিন্তু সেই খুশি বেশিদিন থাকে না।তার বাবা কেমন পরিবর্তন হতে শুরু করে। তাদের সাথে ঠিক মতো কথা বলতো না। ফোন করে খোঁজ খবর নিতো না। বিদেশ থেকে সংসার খরচ টাকা পয়সা কিচ্ছু পাঠাতো না।
প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মাকে দি’শেহারা হয়ে ছুটতে দেখেছে।বাসা ভাড়া সময় মতো দিতে না পারায় অপ’মানিত হতে দেখেছে।টাকার অভাবে ঠিকমতো খাওয়াও হতো না তাদের।এতো ক’ষ্টের মাঝেও তার মা আত্মসম্মান খু’য়িয়ে বাপের বাড়িতে হাত পাতে নি।অনেক ক’ষ্ট করে একটা ছোটখাটো চাকরি জোগাড় করেছে।সেই চাকরির টাকা দিকে তাদের ছোট সংসার চালিয়েছে।তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে,পড়ালেখার খরচ চালিয়েছে।
তার এখনো মনে পড়ে যখন তার মায়ের লেবার পে’ইন ওঠে তখন সে দি’শেহারা হয়ে গিয়েছিল।ছোট আহনাফ বুঝতে পারছিলো না কি করলে মায়ের ব্যা’থা কমবে। মায়ের আ’র্তনাদ জড়িত কান্না দেখে তারও কান্না পেয়েছিলো।এই ব্যা’থাতে যে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় তা বাচ্চাটা জানতো না।
তবে বুদ্ধি করে বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কথা বলে। আহনাফের কান্না দেখে রা’গচটা বাড়িওয়ালারও হৃদয়ে দা’গ কা’টে।সেই রেশ থেকেই তার স্ত্রী আর তিনি মিলে রাবেয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই জন্ম নেয় উর্মি।ছোট্ট ফুটফুটে ফুলের ন্যায় কোমল শিশুটিকে প্রথম কোলে নেয় আহনাফ। তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চোখ,কান,নাক,ছোট ছোট হাত পা।সে হয়ে যায় বড়ো ভাই।ভালো লাগায় মন প্রাণ ছেয়ে যায়।আদুরে চুমু খায় বোনের কপালে।সেই কথা মনে পড়লে আজও মুখে হাসি ফুটে ওঠে আহনাফ। উর্মি তার বোন,তার কলিজা।তার সুখের অন্যতম কারণ।
তাদের সংসারে এতো টান’পো’ড়ন দেখে,মাকে এতো ক’ষ্ট করতে দেখে আহনাফ কখনো যেচে নিজের শখ আল্লাদের কথা বলতো না।মা যা দিতো তাতেই খুশি থাকতো।তখন থেকে নিজেকে শ’ক্ত করেছে,পরিস্থিতি বুঝতে শিখেছে, মায়ের ক’ষ্ট বুঝতে শিখেছে।সাথে মায়ের এই সংগ্রাম দেখে মায়ের প্রতি আহনাফের ভালোবাসা,শ্রদ্ধা,সম্মান অনেক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে।মা হয়েছে তার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ নারী।
অন্যদিকে বাবার প্রতি রা’গ অ’ভিমান বেড়েছে,বেড়েছে দূরত্ব।সেই থেকে বাবাকে স’হ্য হতো না তার।
একদিন আশফাক সাহেব আসে তাদের কাছে। হ’ঠাৎ বাবাকে দেখে রা’গে দুঃ’খে চোখ ফে’টে কান্না আসে আহনাফের। কিন্তু সে কাঁদে না বাবার সামনে,ফিরেও তাকায় নি।যখন দেখলো তার বোনকে কোলে নিতে উদ্যত হচ্ছে আহনাফ ছুটে তার ছোট বোনটাকে কেড়ে নেয়।দা’রাজ কন্ঠে বলে_
“আমার বোনকে আপনি ছুঁবেন না।”
উর্মিরকে নিয়ে চলে যায়।যতোদিন তাদের বাসায় আশফাক সাহেব ছিলো আহনাফ না ওনার সাথে কথা বলেছে না তার বোনের কাছে ওনাকে ঘেঁ’ষতে দিয়েছে।তখন তার সবচেয়ে বেশি রা’গ লাগছিলো মায়ের ওপর।কেনো এই লোকটাকে বাসায় থাকতে দিয়েছে।যেই লোক ওদেরকে দুঃ’খের সাগরে ভাসিয়ে একা করে দিয়েছে।
অনেক মাস পরে আশফাক সাহেব আবার বিদেশে যান। আহনাফের কৌতুহল জাগে হ’ঠাৎ কেনো এলো তাদের কাছে আবার চলেই বা গেলো কেনো? কিন্তু অহং বোধ থেকে কাউকে জিজ্ঞাসা করে না।সেই থেকে বাবা ছেলের দূরত্ব যেনো তির’তির করে বেড়ে যায়।সেইবার বিদেশ যাওয়ার পর আশফাক সাহেব নিজের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেন। ঠিকভাবে টাকা পয়সা পাঠাতেন।দিনে অনেকবার রাবেয়ার কাছে ছেলে মেয়ের খোঁজ নিতেন।উর্মির সাথে ভিডিও করে কথা বলতেন। আহনাফের সাথে কথা বলতে চাইতো কিন্তু আহনাফ বলতো না উল্টো প্রচ’ন্ড রা’গারা’গী করতো।তাই এরপর থেকে কেউ তাকে জোর করে নি।আজও আহনাফ নিজের রাগ জেদ বহাল রেখেছে।
অন্ধকার নিঃশব্দ রুমটাতে দী’র্ঘশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া গেলো।যেই দী’র্ঘশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে অতীতে পাওয়া ক’ষ্ট, অভি’মান,জমে থাকা রা’গের রেশ।
চলবে…