#অবশেষে_সন্ধি_হলো
#পর্ব:১
#লেখিকা:ইনায়া আমরিন
পরিপাটি হয়ে বাসা থেকে বের হয়েছে মেয়েটি। উদ্দেশ্য স্টুডেন্টের বাসা।মাকে বিদায় দিয়ে পাঁচ তলা থেকে সিড়ি বেয়ে নামছে।সিড়ি অ’তিক্রম করে তিন তলা অবধি আসার পর হঠা’ৎ থেমে গেলো।মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে নিজেকে তৈরি করলো।সাইড ব্যাগ খা’মচে ধরে কোনদিকে না তাকিয়ে দ্রু’ত গতিতে তিন তলার সিড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে।তার কাছে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তিন তলা অ’তিক্রম করা। কিন্তু ভাগ্য তাকে বুড়ো আঙুল দেখি মুখ ফিরিয়ে নিল।
“মিস উর্মি।”
পুরুষালী ভরাট কন্ঠের ডাকে উর্মির দ্রুত গতিতে চলমান পা জোড়া থেমে গেলো। বির’ক্তিতে চোখ মুখ কুঁ’চকে ফেললো,ফর্সা হাতের মুঠো হয়ে গেল শ’ক্ত। ফোঁ’স করে শ্বাস ছেড়ে পিছু ফিরে তাকালো। মুখোবয়ব স্বাভাবিক রেখে ছোট জবাবে বলল,”জ্বী?”
প্যান্টের পকেটে দু হাত পুড়ে সটান হয়ে তিন তলার প্রথম সিড়িতে দাড়িয়ে আছে দিপ্ত। মুখের ভাবভঙ্গি মিশ্র। শ’ক্ত চোয়াল অথচ ঠোঁটের কোণে সূ’ক্ষ্ম হাঁসি, চশমার আড়ালে চোখ জোড়ার দু’ষ্টুমির ছাপ।তার দু’ষ্টু চোখ জোড়া বিচরণ করে চলছে শে’ষ সিড়িতে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির স্নিগ্ধ মুখে।
“পালাচ্ছিলে কেনো?”
দিপ্তের কথায় মনে মনে একটু চম’কে উঠে উর্মি। ধরা পড়ে গেলো নাকি?সে কী বুঝে গেলো তার সম্মুখীন হতে চায় না দেখেই উর্মির এই কার্যকলাপ।কিন্তু উপর থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। ভেতরের অবস্থা বুঝতে না দিয়ে সহজভাবে বলে,”টিউশনির দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই।পালাতে যাবো কেনো?”
উর্মির কনফিডেন্সের সাথে মি’থ্যে উত্তর শুনে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে দিপ্ত।আসন্ন হাসিটা আট’কানোর ক্ষুদ্র চেষ্টা বোধহয়।সে জানে উর্মি তার মুখোমুখি হতে চায় না বলেই সব সময় তাদের বাসায় সামনের দিয়ে দ্রু’ত হেঁটে যায়। কিন্তু সে তা হতে দিলে তো।
হাতের মোটা কালো ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বলে_
“আমি যতোটুকু জানি, টিউশনি ঠিক পাঁচটায়। স্টুডেন্টের বাসা এখান থেকে দশ মিনিটের রাস্তা।আর এখন বা’জে সাড়ে চারটা।দেরি হচ্ছে কী করে যদি বুঝিয়ে দিতেন ম্যাডাম।”
চট করে দিপ্তের পানে তাকালো উর্মি।কী দু’র’ন্ত,সব জানে?
এই সব জানাটাই উর্মির বির’ক্তির কারণ।তার ব্যাপারে এতো নাক গলাবে কেনো এই লোক।নেহাত বাড়িওয়ালার ছেলে তা না হলে মুখের ওপর কথা শোনাতে এক সেকেন্ড সময় নিতো না উর্মি।ভালোই তো ছিলো বিদেশ।কেনো আসতে গেলো। অবশ্য না আসলে উর্মি জানা হতো না বাড়িওয়ালার একটা ছেলে আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না জানা থাকলেই ভালো হতো।না দেখা হলেই ভালো হতো।অন্তত এই ধ’নুকের মত শি’ড়শি’ড়ানি দৃষ্টি থেকে তো রেহাই পেতো।যেই দৃষ্টি ওকে বারে বারে অ’স্ব’স্তি’তে ফেলে।
নিজের চিন্তা ভাবনা এক কোণে ফেলে কন্ঠ আগের মতই স্বাভাবিক রেখে বলে_
“টিউশনির আগে আমার পার্সোনাল কাজ আছে।তাই একটু আগে বেরিয়েছি।কাজটা করতে দেরি হলে তো টিউশনিতে যেতেও দেরি হবে, তাই না?”
কন্ঠে দৃ’ঢ়’তা রেখে মি’থ্যে কথাগুলো বলল উর্মি।আরো একটা মি’থ্যে শুনে দিপ্তে হাঁসি চওড়া হলো।এক পা এক পা করে সিড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে বলল,”বুঝলাম।”
তারপর উর্মির দাড়ানো এক সিড়ি উপরে এসে থামলো। চোখে চোখ রেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই বলল_
“কাল রাতে যে টেক্সট দিয়েছিলাম রিপ্লাই করো নি কেনো?”
“ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,দেখিনি।”
আবারো দৃ’ঢ়’তার সহিত উত্তর। খানিকক্ষণ দৃ’ঢ় চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় উর্মি। তাকিয়ে থাকা যায় না দিপ্তের দিকে।কেমন অ’দ্ভু’ত অ’স্থি’রতা চেপে ধরে ওকে।
উর্মির উত্তরে অস’ন্তো’ষ প্রকাশ পেলো দিপ্তের চোখে মুখে। উত্তরটা যেনো তার মনমতো হয় নি। কিছু বলতে যাবে তার আগেই উর্মির ফোন বে’জে ওঠে। উর্মি স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে অথই কল দিচ্ছে। মনে মনে এক হাজার অদৃ’শ্য চুমু পাঠালো অথইকে।এই সময়ে ফোন করে তার এতো বড়ো উপকারটা করার জন্য। উর্মি দিপ্তের দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বলে_
“আমার বান্ধবী কল করছে।দেরী হয়ে যাচ্ছে,আজ আসি।ভালো থাকবেন ভাইয়া, আসসালামুয়ালাইকুম।”
দিপ্তের পিত্তি জ্ব’লে উঠলো। উর্মির মুখে ভাইয়া ডাকটা ঠিক বিরিয়ানির এলাচির মতো লাগে তার কাছে। চোখ মুখ শ’ক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল_
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
.
অ’ন্ধকার রুমে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আহনাফ। বালিশের পাশে ফোন বা’জছে।স্ক্রিনের অল্প আলো অ’ন্ধকার রুমটাকে তাদের সাধ্য মতো আলোকিত করছে। হঠা’ৎ ঘুমে ব্যা’ঘা’ত ঘটায় ত্য’ক্ত বির’ক্ত আহনাফ। হাতড়ে ফোন মুখে সামনে এনে নাম দেখেই এতোক্ষণের বির’ক্তটা যেনো দুই গুণ বেড়েছে।ক্ষণে ক্ষণে মেজা’জ খারা’প হচ্ছে।রে’ড বাটন প্রেস করে কলটা কে’টে নম্বরটা ব্ল’ক করে দিলো।জীবন থেকে ব্ল’ক করে রাখতে পারলে আরো শান্তি পেতো।
“ভাইয়া?আসবো?”
সদ্য কাঁ’চা ঘুম ভা’ঙা কন্ঠে আহনাফ বললো_
“আয়।”
হাতে কফি নিয়ে রুমে ঢুকলো উর্মি।মুখে মিষ্টি হাসি।বোনকে দেখে খি’চ’ড়ে যাওয়া মেজা’জটা কিছুটা শান্ত হলো।এখন কফিটা আসলেই দরকার ছিলো। উর্মি রুমে ঢুকলে সে আ’ড়মো’ড় ভে’ঙে বিছানা ছেড়ে বললো,”বোস।ফ্রেশ হয়ে আসি।”
ফ্রেশ হয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বোনের কথা শুনতে পেলো আহনাফ।
“সন্ধ্যার পর কেনো যে ঘুমোতে যাও।ডিনারের সময় হয়ে এলো। জানোই তো আম্মু অনিয়ম পছন্দ করে না।”
আহনাফের থেকে কোনো উত্তর এলো না। টেবিল থেকে কপির মগ নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল_
“টিউশনি থেকে কখন ফিরেছিস?”
“আটটায়।”
উর্মি উত্তরের কপালে ভাঁ’জ পড়ে আহনাফের। বলে,”আজ এতো দেরি কেনো?”
উর্মি জড়’তাহীন ভাবে বলে,”টিউশনি শে’ষে অথইয়ের সাথে টিএসসি গিয়েছিলাম ঘুরতে।তাই ফিরতে দেরি হলো।”
চোখ মুখ শ’ক্ত হলো আহনাফের।মুখ তে’তো হয়ে উঠে। কারনটা কী কফির স্বাদ নাকি কারো নাম, জানা নেই। মুখোবয়ব গ’ম্ভীর রেখে গম’গমে কন্ঠে বলে_
“আমাকে জানাস নি কেনো?”
উর্মি ঠোঁট উ’ল্টে বলে,”অথই হঠা’ৎ করেই বলল চল টিএসসি ঘুরে আসি।তখন তোমাকে ফোন করেছিলাম জানানোর জন্য। কিন্তু তুমিতো রিসিভই করলে না। বিশ্বাস না হলে চেক করে দেখো।”
আহনাফের কুঁ’চকা’নো ব্রু যুগল মিলিয়ে গেলো। গ’ম্ভীর মুখোবয়ব নরম হলো কিছুটা।কফির মগ টেবিলে রেখে বোনের দিকে তাকালো। কন্ঠে নমনীয়তা ঢেলে বলতে লাগলো_
“এখন থেকে যেখানেই যাবি ভাইয়াকে জানিয়ে যাবি।ফোন রিসিভ না করলে টেক্সট করে জানাবি। কখনো একা কোথাও যাবি না সাবধান।এসবের মানে এই নয় যে তোর নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা নেই,অবশ্যই আছে।তবে দুনিয়াটা অনেক ক’ঠিন। মেয়েদের নিরাপত্তা খুবই কম,বড়ো হয়েছিস আশা করি এসব জিনিস বুঝবি।”
তারপর উর্মির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”আমার একমাত্র বোন তুই,আমার কলি’জার টু’করা। ভাইয়া কখনো তোর খা’রাপ চাই না। সবসময় চাই তুই ভালো থাক, হাসিখুশি থাক।যা বললাম সবসময় মাথায় রাখবি, ঠিক আছে?”
এতোক্ষণ আহনাফের কথা মন দিয়ে শুনেছে উর্মি।তার ভাই যখন তাকে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝায় সেই সময়টা তার খুব ভালো লাগে। ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গ সে খুব কম পেয়েছে। ভাইয়ের ছায়াতলেই তার বড়ো হওয়া। জগতের যাবতীয় ভালো ম’ন্দ ধারণা সব ভাইয়ের কাছ থেকেই শেখা।তার প্রথম শিক্ষক তার আহনাফ ভাইয়া। আহনাফ ভাইয়ার কাছেই নিজেকে সবসময় নিরাপদ ভাবে।তার ভাইয়া তার জীবনে অন্যতম পুরুষ।বড়ো শ্রদ্ধীয়,সম্মানীয় একজন।
মুখে হাসি ফুটিয়ে দুদিকে মাথা নেড়ে বলে,”ঠিক আছে।”
মুচকি হাসে আহনাফও। মিষ্টি করে বোনের গাল টি’পে দেয়।
“আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে। এবার খেতে এসো।”
“তুই যা,আমি আসছি।”
মাথা নেড়ে কফি মগ নিয়ে চলে গেলো উর্মি। সাথে সাথে আহনাফ মুখটা আগের ন্যায় শ’ক্ত হয়ে উঠলো। কিছুটা রা’গ নিয়ে বিরবির করে বলে_
“নিজে এক উড়’নচ’ন্ডী সাথে আমার বোনকেও বানানোর পাঁ’য়তারা।স্টু’পিড একটা।”
.
খাবার টেবিলে বসে নিঃশব্দে খাচ্ছে তিনজন। আহনাফ, উর্মি এবং তাদের মা রাবেয়া বেগম। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর একটু নড়েচড়ে বসলেন রাবেয়া। মায়ের দিকে তাকালো আহনাফ, উর্মি।বুঝতে পারলো তিনি কিছু বলতে চাচ্ছেন। আহনাফ বলল_
“কিছু বলবে আম্মু?”
“হ্যা।”রাবেয়ার দৃ’ঢ় জবাব।
খাওয়া ব’ন্ধ রেখে ভাই-বোন দুজন মায়ের কথা শুনার অপেক্ষায় সেই দিকে চেয়ে আছে। রাবেয়া ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আহনাফ উর্মি দিকে তাকিয়ে বলে_
“কাল তোমাদের বাবা দেশে ফিরছে।আমি চাই তোমরা দুজন গিয়ে তাকে রিসিভ করবে।আর এই ব্যাপারে আমি কোনো না শুনবো না। ধরে নাও এটা আমার আ’দেশ।”
হাসি ফুটে উঠল উর্মির মুখে,বাবা আসছে। কিন্তু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে হাসি নি’ভে গেলো।সাথে সাথে ভাইয়ের দিকে তাকায়। কালো আঁ’ধারের ন্যায় ছেয়ে আছে আহনাফের মুখশ্রী। সচরাচর রাখা গ’ম্ভীর মুখটা এখন রা’গা’ন্বিত।হাতে মুঠো শ’ক্ত। মায়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।নিচের ঠোঁট কাম’ড়ে ধরে উর্মি। ভাইয়ের উত্তর শোনার জন্য চেয়ে আছে।
অনেকক্ষন পর আহনাফ মায়ের দিকে তাকায়।ছোট করে বলে_
“ঠিক আছে যাবো।”
সূ’ক্ষ্ম পাতলা হাসি ফুটে রাবেয়ার অধর কোণে। কিন্তু সেই হাসি নি’ভে যায় আহনাফের দ্বিতীয় বাক্যে।
“জাস্ট ফর ফরমালিটি।”
খাওয়া অস’মাপ্ত রেখেই চলে গেলো আহনাফ। কিছু বললেন না রাবেয়া শুধু দীর্ঘ’শ্বাস ছাড়লেন।
আহনাফের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে উর্মি।সে জানে শুধুমাত্র মায়ের কথাতেই ভাইয়া যাচ্ছে।কারন আর যা-ই হোক, মায়ের কথা অমান্য করে না আহনাফ।
বাবা আসার খুশিতে সেই রাতে ঘুম হলো না উর্মির। শুধু উর্মি নয় আহনাফেরও ঘুম হয় না তবে তা খুশিতে নয় অতীতে পাওয়া কিছু ক’ষ্টের কথা মনে পড়ে।
চলবে…