অবশেষে পর্ব-০৭

0
1645

গল্প : অবশেষে | পর্ব : সাত

দিয়া!

বলুন।

এখনও আপনি করে বলছো! দু’দিন পর আমাদের বিয়ে। তুমি করে বলো। আর জানো তো, তুমি করে বললে প্রেম-ভালোবাসা মজবুত হয়। মায়া জন্মে। বলে আরো একটু কাছে এসে দাঁড়ায় মাহফুজ। অন্ধকার ছাদে তারা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।

সন্ধ্যার পর হুট করে চলে এসেছে মাহফুজ। তার হাতে ইয়া বড়ো মাছ। আরো কী কী যেন এনেছে। ভরসন্ধ্যায় মাছ কোত্থেকে নিয়ে এসেছে, সে-কথা কেউ জিজ্ঞেস করল না। দিয়ার মা আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, আরে! এ-কী কান্ড! এতো বড়ো মাছ! এটা আনতে গেলে কেন? শুধু শুধু টাকা নষ্ট।

বলে তিনি থেমে গেলেন না। মাছটা দু’হাত দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, বড়ো চাকরি করছো ভালো কথা। মোটা বেতন পাও সে-ও ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে এভাবে টাকা খরচ করবে? এখনই হিসেব করে চলতে শুরু করো। ক’দিন পর বিয়ে করবে। বাচ্চাকাচ্চা হবে। তাদের ভবিষ্যতের কথাওতো চিন্তা করতে হবে। না কি?

মুখে এসব কথা বললেও দিয়ার মা বেজায় খুশি। তবে দিয়ার বাবা গম্ভীর। তিনি চোখের সামনে সবকিছু এলোমেলো দেখছেন। ইচ্ছে করলেও গুছিয়ে নিতে পারছেন না। তিনি জানেন, দিয়া মাহফুজের সঙ্গে ভালো থাকবে না। দিয়া নিজেও এ-কথা জানে। জেনেশুনে কেন যে জ্বলন্ত আগুনে পা দিতে চলেছে, তা কেউই জানে না।

মাহফুজ মিহি গলায় প্রশ্ন করে, দিয়া কোথায় আন্টি?

দিয়ার মা আহ্লাদী গলায় বলেন, ঘরেই আছে; যাও।

কিন্তু পুরো ঘরে দিয়াকে পাওয়া গেল না। দিয়া অন্ধকার ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে। মাহফুজ যখন চুপিচুপি দিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন দিয়া একটুও কেঁপে উঠে না। একটুও অবাক হয় না। বরঞ্চ কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

মাহফুজ মিয়নো গলায় ডাকে, দিয়া!

বলুন। দিয়া ফিরে তাকায় না। যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে থাকে।

এখনও আপনি করে বলছো! দু’দিন পর আমাদের বিয়ে। তুমি করে বলো। আর জানো তো, তুমি করে বললে প্রেম-ভালোবাসা মজবুত হয়। মায়া জন্মে।

বলো। দিয়ার কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট।

মন খারাপ?

না।

তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে এসেছি। যাবে আমার সঙ্গে?

কোথায়? এতক্ষণে মুখ তুলে তাকায় দিয়া।

আমার ফ্ল্যাটে। নতুন কিছু জিনিসপত্র কিনে ঘরে সাজিয়েছি। তোমার জন্য। তাই ভাবলাম, সবার আগে তোমাকেই দেখাই!

দিয়ার মন সায় দিচ্ছিল না। তবুও কী যেন মনে করে মাহফুজের সাথে তার ফ্ল্যাটে যেতে রাজি হয়ে গেল। ফ্ল্যাটটা নিঃসন্দেহে খুব যত্ন করে সাজানো হয়েছে। সব আসবাবপত্র দামি দামি। বেশিরভাগ বিদেশ থেকে আনিয়েছে। মাহফুজ ঘুরে ঘুরে দেখায় আর বলে, এটা ইতালি থেকে আনিয়েছি। এটা অস্ট্রেলিয়া থেকে। এটা থাইল্যান্ড। আর এটা আমি চাইনা থেকে এনেছি।

এইসব চোখ জোড়ানো জিনিসপত্র দেখে মন ভরে না দিয়ার। তার মনটা রোদের ঘরের পুরনো জিনিসপত্রে আটকে আছে। সে-সব জিনিসে আলাদা মায়া। আলাদা টান। আলাদা অনুভূতি। কারণ, সব জিনিসেই রোদের ছোঁয়া আছে। এখানে তা নেই।

শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটায় অনুর বিয়ে। বিয়েটা তার বয়ফ্রেন্ড আফফাতের সঙ্গেই হচ্ছে। সেই খুশিতে অনু নিজে এসে দাওয়াত করেছে। দিয়ার মুখ ফ্যাকাশে। সে বিয়েতে যাবে না। আফফাত রোদের খুব কাচের বন্ধু। সুতরাং বিয়েতে রোদ আসবে। তার সামনে পড়লে দিয়ার মন আরো খারাপ হয়ে যাবে। হয়তো সে সেখানেই কেঁদে ফেলবে। বিয়ে বাড়িতে এমন হলে খুবই বিচ্ছিরি দেখাবে। কনে কাঁদছে না, কনের বান্ধবী কাঁদছে!

সুতরাং দিয়া যাবে না। এদিকে অনু জেদ ধরে বসল। দিয়া বিয়েতে না গেলে সে বিয়েই করবে না। এই তার কসম। এবং এ-ও বলল যে, বিয়েতে না গেলে দিয়া যেন আর কোনোদিন তার মুখ না দেখে।

তবুও দিয়া ভেবে রেখেছিল, সে বিয়েতে যাবে না। কিন্তু আজ সকাল থেকেই মনটা খচখচ করছিল। অনু এত করে বলেছে। তার পরও না যাওয়া কি ঠিক হবে?

অগত্যা দিয়া চলে এল। অনু দূর থেকে ডাকল। কাছে যেতেই মুখে ভেঙচিয়ে বলল, যাক! এলি তবে!

হুঁ, এলাম। দিয়ার মুখ মলিন।

তোর বরটার কী হয়েছে বল তো? হঠাৎ এমন চুপসে গেল কেন? কেমন যেন মনমরা দেখাচ্ছে।

বর! দিয়ার বর! অনু কি রোদের কথাই বলছে? বরের কথা শুনেই দিয়ার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে, দুলাভাই কই রে?

ওঁর কথা বাদ দে! তোর বরের কথা বল। লোকটা অসুখ-টসুখে পড়ল নাকি?

দিয়া আবার প্রসঙ্গ পাল্টাল, তোকে আজ পরীর মতো লাগছে। দুলাভাইকে নিশ্চয়ই রাজপুত্রের মতো লাগছে! কোথায় উনি?

উফ! আসার পর থেকে দুলাভাই দুলাভাই! জ্বালিয়ে খেলি! আয় তোকে তোর দুলাভাইয়ের কাছে নিয়ে যাই। বলে কপাল চাপড়ে দিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় অনু। ভীড় ঠেলে আফফাতের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, এই দ্যাখ তোর দুলাভাই। হলো? এবার শান্তি?

দিয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রাখে। অনু হঠাৎ বলে উঠে, এইযে ভাইয়া! আপনার বউকে সামলান। সে দুলাভাই দুলাভাই করে মরছে।

সহসা চোখ তুলে তাকায় দিয়া। তার থেকে খানিক দূরে আফফাতের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে রোদ। চোখাচোখি হতেই একসঙ্গে দৃষ্টি নামিয়ে নেয় রোদ এবং দিয়া। এই অপ্রত্যাশিত দৃষ্টি বিনিময় দু’জনের বুকেই ঝড় তুলে দিয়েছে। দু’জনেই চুপচাপ। দু’জনেই আহত। দু’জনের বুকেই পাহাড় সমান বেদনা।

আমি আসছি। বলে ইতস্তত করতে করতে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় দিয়া। রোদ কিছু না বলেই অন্য দিকে চলে যায়। অনু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কী হলো এটা! ওঁরা এভাবে চলে গেল কেন? তবে এই ভাবনা বেশি সময় স্থায়ী হলো না। ক্যামেরাম্যান সামনে আসতেই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনু।

চোখের জল মুছতে মুছতে পা চালিয়ে হাঁটে দিয়া। রাস্তাটা অন্ধকার। কোনো কোনো ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে। কোনোটায় জ্বলছে না। দিয়া হেঁচকি তুলে কেঁদে কেঁদে পা চালায়। হঠাৎ মনে হয়, কে যেন তাকে অনুসরণ করছে।

প্রায় দশ হাত দূরে দূরে হাঁটছিল রোদ। দিয়া থেমে যাওয়ায় সে-ও থমকে দাঁড়াল। দিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকটা এক পলক দেখে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। বাঁ দিকের গলিতে ঢুকতেই রোদ দৌড়ে গিয়ে পথ আটকায়। বলে, এদিকে যাস না। বিপদ হবে।

দিয়া অভিমানী গলায় বলে, এদিকেই যাব।

আমি বলেছি যাবি না। এদিকে অনেক বখাটে থাকে। ওরা অস্ত্রধারী। আমি চাইলেও তোকে সাহায্য করতে পারব না।

দিয়া আরো দু’পা এগোয়। রোদ ধমক দিয়ে বলে, কথা কানে যায় না? আমি মানা করেছি মানে তুই যাবি না।

দিয়া উল্টো উঁচু গলায় বলে, একশো বার যাব। হাজার বার যাব। আজ আমি যাবই।

আরো এক পা এগোতেই রোদ দিয়ার গালে চড় বসিয়ে দেয়। এর আগেও সে দিয়াকে মেরেছে। অনুশোচনা হয়নি। কিন্তু আজ রোদের ভেতরটা চাপা আর্তনাদে ভরে উঠেছে। এ-কী করল সে?

দিয়া কেঁদে কেঁদে বলে, আজ আমি এই পথ দিয়েই যাব। আজ আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।

রোদের মাথাটা হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠে। সে দাঁত কটমট করে বলে, শুনবি না? শুনবি না আমার কথা?

দিয়া প্রচন্ড অভিমানে বলে, না, শুনব না।
কিন্তু রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে দিয়া। রোদের চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। সে কাঁদছে!

দিয়া হাউমাউ করে বলে, শালা! তুই কাঁদছিস কেন? তুই কাঁদছিস কেন শালা?

রোদ কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে, তোর জন্য কাঁদি। তোর জন্য। বলতে বলতে পা চালায়। দিয়া শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ফুলে ফুলে বেরিয়ে আসছে কান্নার ঢেউ।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে