গল্প : অবশেষে | পর্ব : ছয়
দিয়া যখন কলেজে পড়ত, তখন তার এক সহপাঠী ছিল। মাহফুজ নাম। ছেলেটা স্মার্ট, পড়াশোনায় ভালো। এমনকি তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও খুব ভালো। এদিকে দিয়ার মতো রূপবতী পুরো কলেজে দ্বিতীয়টি চোখে পড়ে না। আর তাই হয়তো মাহফুজের দৃষ্টি পড়েছিল দিয়ার উপর। কিন্তু দিয়াকে সে ঠিক বুঝতে পারত না। মেয়েটা একটু অন্যরকম। ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকে। মেয়ে বান্ধবীও খুব একটা নেই। কলেজে নিয়মিত আসে না। তবুও কী করে যেন ভালো মার্কস পেয়ে যায়।
একটা বছর দেখতে দেখতেই কেটে যায়। দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে মাহফুজ দিয়াকে প্রেম নিবেদন করে। তবে সরাসরি নয়। চিঠির মাধ্যমে। চিঠিটা এক বান্ধবীর হাতে দিয়ে বলেছিল, এটা দিয়ার হাতে দিয়ে দিও প্লিজ। বোলো জবাবের অপেক্ষায় থাকব।
কিন্তু এক মাস কেটে যাওয়ার পরও জবাব পাওয়া গেল না। এবার মাহফুজ সরাসরি দিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই বলে ফেলল, তোমাকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই।
তখনও দিয়া এড়িয়ে গেল। মাহফুজ দমে না গিয়ে আরও একবার চেষ্টা করল। তবে এবার সে একা নয়। তার পুরো পরিবার একসঙ্গে মাঠে নামল। সবাই একযোগে দিয়ার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
দিয়ার বাবা অমায়িক মানুষ। তিনি সবাইকে বসতে দিলেন। চা-নাশতা খাওয়া হলো। মাহফুজের পরিবার দিয়াকে চায় সেটাও জানানো হলো। এমনকি দুপুরের খাবারটাও খাওয়া হলো একসাথে। যেন কত আগের পরিচিত তারা! এমন আচরণ দেখে মাহফুজের পরিবার পুনঃপুন মুগ্ধ। তারা বউ করে কাউকে ঘরে নিলে একমাত্র দিয়াকেই নেবে।
মাহফুজের পরিবার যখন মনে মনে ধরেই নিয়েছিল বিয়েটা হচ্ছে, ঠিক তখনই দিয়ার বাবা আসল কথাটা বললেন। দিয়ার বিয়ে অনেক আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে। রোদের সঙ্গে। মাহফুজের পরিবার চাঁদ হাতে পেয়েও পেল না। তারা যখন নিরাশ হয়ে চলে যাবার উদ্যোগ করছিল, তখন মাহফুজ গোঁ ধরে বসল৷ সে দিয়াকে আঙটি না পরিয়ে এক পা-ও নড়বে না। কিন্তু দিয়ার বিয়ে যে আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে!
সেদিন মাহফুজ চলে যেতে বাধ্য হলেও একেবারে আশা ছেড়ে দেয়নি। দিয়ার পথ আটকানো, ফুল দেওয়া, মিষ্টি মিষ্টি দু’একটা কথা শোনানো এসব প্রায়ই করত। দিয়া পাত্তা দিত না। যথাসাধ্য এড়িয়ে যেত।
শেষের দিকে মাহফুজ হাল ছেড়ে দিয়েছিল। এবং সেই সাথে মেয়েদের উপর প্রবল বিরক্তিও জন্মেছিল ভিতরে ভিতরে। মেয়েরা এমন কেন? এদের বুঝতে পারার ক্ষমতা কি কোনো পুরুষ কোনো কালে পাবে না? আগে মাহফুজের কয়েকজন মেয়ে বন্ধু ছিল। দিয়ার কাছে বারবার ব্যর্থ হবার পর মেয়ে বন্ধুগুলোর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল সে। বন্ধ মানে সম্পূর্ণ বন্ধ। যদিও ওঁদের কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু মাহফুজের বিরক্তি সব মেয়েদের প্রতি এসেছিল৷
সেই মাহফুজ এত বছর পর আজ দিয়াকে দেখে গেছে। স্ত্রী হিসেবে দিয়াকে তার অনেক আগে থেকেই পছন্দ। শুধু দিয়া মত দেওয়া বাকি ছিল। এবার যেহেতু সে নিজে থেকে ডাকিয়েছে, তার মানে সে রাজি। যদিও আঙটি পরানো কিংবা বিয়ের তারিখ নিয়ে কথা হয়নি। দেখাদেখি হয়েছে শুধু।
সব কথা জানে রোদ। আবার জানতে এসেছে। দিয়ার বাবার মুখে শেভিং ক্রিম। তিনি দাড়ি কামাচ্ছিলেন। রোদকে দেখেই বললেন, আরে! কী খবর? বোসো বোসো। মুখ ধুয়ে আসি।
তিনি মুখ ধুয়ে আসার পর রোদ মুখ তুলে তাকায়। বলে, আজ নাকি বরপক্ষ দিয়াকে দেখতে এসেছিল?
দিয়ার বাবা দৃষ্টি নত করে ফেলেন। তার চোখে মুখে অপরাধীর ছায়া। তবে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। রোদকে না জানিয়ে আরেকপক্ষের সামনে দিয়াকে উপস্থিত করেছেন। এই যা! কিন্তু এ-ই তার কাছে পাহাড় সমান অপরাধ বলে মনে হচ্ছে। তিনি এই মুহূর্তে রোদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে পারলে বাঁচেন!
তোমাদের মধ্যে কি ঝগড়া টগড়া কিছু হয়েছে?
রোদ গলা ঝেড়ে বলে, ঝগড়া হয়নি। দিয়া যা করেছে ভালোই করেছে। আমিও তাই চেয়েছিলাম।
দিয়ার বাবা অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন। রোদ মুচকি হেসে বেরিয়ে আসে। তার হাতে দু’টো তাজা লাল গোলাপ। একটি চকোলেট। আর একটি উপন্যাসের বই।
বাসায় ফিরে সদ্য কেনা উপন্যাসের বইয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় রোদ। সেই আগুনে চকোলেট পোড়ায়। পোড়ায় একজোড়া লাল গোলাপ। এগুলো সে দিয়াকে দেবে বলে কিনেছিল। দেওয়া হলো না। আজ তার সবকিছু কেমন যেন বিষাদ লাগছে। সে নিজেই বলেছিল দিয়া যেন জীবনসঙ্গী হিসেবে অন্য কাউকে বেছে নেয়। কিন্তু দিয়া এত সহজে মেনে নেবে, তা ভাবনার বাইরে ছিল।
অন্ধকার ছাদে উঠে আসে রোদ। ছাদের এই জায়গায়। ঠিক এই জায়গায় দিয়াকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল রোদ। তখন বৃষ্টি ছিল। ঝুম বৃষ্টি। এখন বৃষ্টি নেই। আকাশটা কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে। চাঁদ নেই। তারা নেই। রোদের মনের আকাশেও চাঁদ নেই। তারা নেই। আছে শুধু খন্ড খন্ড পাহাড় সমান বিষাদ। সেই বিষাদ প্রতিনিয়ত চিবিয়ে খাচ্ছে।
রোদের চোখের কোলে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। যতদূর মনে পড়ে, মুখে বুলি ফুটবার পর সে কোনোদিন কাঁদেনি। আজ কাঁদছে। কিন্তু কেন? দিয়ার জন্য? দিয়াকে তো সে নিজেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তবে কেন?
নাহ!
রোদ সত্যি সত্যি দিয়াকে ভালোবাসে। সেই দিয়া দূরে সরে গেলে রোদ ভালো থাকবে না। একদম না। তবে কি ফোন দিয়ে দিয়ার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করা উচিৎ? মনের সব কথা বলে দেওয়া উচিৎ?
এই মুহূর্তে যদি দিয়া সামনে থাকত, তবে রোদ ছুটে গিয়ে দিয়ার মাথাটা শক্ত করে বুকের সাথে চেপে রাখত। ফিসফিস করে বলত, তুই আমার ভালো থাকার ওষুধ। দিনশেষে আমার তোকেই চাই।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়। রোদ পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করেও দিয়াকে ফোন দেয় না। তার এবং দিয়ার মাঝখানে বর্তমানে যে দেয়াল দাঁড়িয়ে, সেই দেয়ালের নাম ইগো। সেই ইগো তাকে দমিয়ে রাখে। রোদ সত্যি সত্যি থেমে যায়। সে দিয়াকে আগ বাড়িয়ে ফোন দেবে না। কী দরকার ইমেজ ছোটো করার?
বহুদিন পর রোদ মায়ের কাছে যায়। তখন রাতের একটা। মা রোদকে দেখে আঁতকে উঠেন, কী রে বাপ! এত রাতে!
রোদ কথা বলে না। মা’র হাত ধরে বিছানায় টেনে নিয়ে যায়। মা’কে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মা আন্দাজ করে নেন, খারাপ কিছু ঘটেছে। না হলে রোদ এমন করার কথা না।
আমি আর দেশে থাকব না, মা। যত দ্রুত সম্ভব দেশের বাইরে চলে যাব। রোদ মায়ের কোলে মুখ গুঁজে বলে। মা তার চুলের ফাঁকা আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, তাই যাস। কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো যার জন্য তুই বিদেশে চলে যাবি?
সে কথার জবাব দেয় না রোদ। তার চোখদু’টো ভিজে চপচপ করছে। গলাটা ধরে এসেছে। কথা বলার মতো শক্তি নেই। রোদ ধরা গলায় বলে, কালকেই ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করব। দোয়া কোরো আমার জন্য।
চলবে