অবশেষে পর্ব-০২

0
1833

গল্প : অবশেষে | পর্ব : দুই

রোদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, আমি তিন পর্যন্ত গুণব। এর মধ্যে যদি তুই আমার কথা না শুনিস, তা হলে কিন্তু খারাপ কিছু ঘটবে।
বলেই গুণতে শুরু করে রোদ। তিন পর্যন্ত গুণার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে পালায় দিয়া। তাড়াহুড়ো করে ছাদের এক কোণে নিজেকে আড়াল করে নেয়। তবে রোদের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। রোদ ছাদে আসে ঠিকই, তবে বৃষ্টি পড়ছে দেখে আর এগোয় না। দূর থেকে বলে, পালাবি ভেবেছিলি? কই পালাবি? একবার না একবার তো আমার কাছে আসতেই হত। না কি? তখন দেখে নিতাম না?

বৃষ্টির জলে কাকভেজা দিয়া শেষমেশ নিজেকে রোদের কাছে সমর্পণ করে দেয়। রোদ মুখ বিকৃত করে বলে, মোড নষ্ট করে ফেলছিস। এখন তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। তুই বরং বৃষ্টিতে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাক। এটাই তোর শাস্তি।

দিয়া সত্যি সত্যি এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। অন্য সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে। তবে রোদের সামনে ভালো লাগছিল না। অস্বস্তি হচ্ছিল। শীত লাগছিল খুব।

শাস্তি ভোগ করে রোদের কাপড় গায়ে দিয়ে চলে আসে দিয়া। মা-বাবা তাকে ছেলেমানুষের কাপড়ে দেখে অনেক প্রশ্ন করেন। দিয়া জবাব দেয় না। নিজের ঘরে গিয়ে ভেজা কাপড় গায়ে রেখেই শুয়ে পড়ে। রাতে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। দিয়া বিড়বিড় করে রোদের কাপড়ের সঙ্গে কথা বলে, কেন এমন করো তুমি? কেন এতটা কষ্ট দাও? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? না কি অন্য কেউ আছে তোমার জীবনে?

টানা তিন দিন জ্বরে ভোগছে দিয়া। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে গা ব্যথা হয়ে গেছে। বিকেলের পর একটু ঘুম লেগেছিল। হঠাৎ চোখ খুলতেই আৎকে উঠে দিয়া৷ তার সামনে রোদ দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া দ্রুত উঠে বসে কাঁপা গলায় বলে, আ-আপনি!

রোদ দুম করে দিয়ার পাশে বসে পড়ে। দিয়ার হাতের উপর হাত রেখে বলে, একটা জায়গায় যেতে হবে। যাবি?

কোথায় যাবে, কেন যাবে এসব কিছুই জিজ্ঞেস করে না দিয়া। সরাসরি বলে, হ্যাঁ, যাব।

এইতো, গুড। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। এক্ষুণি বেরোতে হবে।

এখনি? দিয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ, এখন। কোনো অসুবিধা? অসুবিধা থাকলে বল। আমি অন্য কাউকে ম্যানেজ করে নেব।

দিয়া মাথা নেড়ে বলে, কোনো অসুবিধা নেই। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

গুড। তাড়াতাড়ি কর। বলে বেরিয়ে যায় রোদ। দিয়া সোজা বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। হঠাৎ আবিষ্কার করে, তার গায়ে জ্বর নেই। বরং শরীরটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। তবে গোসল করতে করতে নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। রোদ হঠাৎ তাকে কোথায় নিয়ে যাবার জন্য এসেছে? এত আর্জেন্ট কী কাজ থাকতে পারে? তা-ও রাতের বেলা!

সে-সব কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে দিয়া। একটা কালো শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সাজগোজ খুব বেশি নয়, শুধু ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক ছুঁয়ে দেয়। তারপর রোদের সামানে গিয়ে দাঁড়ায়। রোদ খপ করে দিয়ার হাত ধরে বলে, তাড়াতাড়ি আয়। অনেক দেড়ি করে ফেলেছি।

বাসার গেটের সামনে গিয়ে বলে, কী রে, কাপড় আনিসনি?

দিয়া নিজের দিকে একবার তাকিয়ে জবাব দেয়, কাপড় পরেই তো এসেছি।

রোদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, গাধা! এক কাপড়ে হবে? আরো কাপড় লাগবে না?

দিয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, আরো কাপড় লাগবে? কোথায় যাচ্ছি আমরা? দূরে কোথাও?

রোদ খানিক ভেবে নিয়ে বলে, থাক। প্রয়োজনমতো কিনে নেওয়া যাবে।

বাসার গেটের সামনে একটা কালো গাড়ি দাঁড় করা ছিল। ড্রাইভার দাঁঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল। রোদকে দেখে সিগারেট হাত থেকে ফেলে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। দিয়া গাড়িতে উঠে বসে। তার পাশাপাশি বসে রোদ। গাড়িটা সাঁই করে বেরিয়ে যায়। খানিক চুপচাপ থাকার পর রোদ প্রশ্ন করে, কী রে, পারফিউম মেরেছিস?

দিয়া মাথা নেড়ে বলে, না তো!

তাহলে এত গন্ধ কীসের?

ড্রাইভার পেছনের দিকে তাকিয়ে বলে, চুলের ঘ্রাণ, ভাইজান। ভাবি চুলে শ্যাম্পু করছে তো। সেই ঘ্রাণ। বলে গাড়ি চালাতে মনোযোগী হয়।

রোদ বিড়বিড় করে বলে, চুলের ঘ্রাণ এত মারাত্মক হয়! স্ট্রেইঞ্জ!

দিয়া চুপচাপ বসে থাকে। তার মাথায় কেবল একটি শব্দ ঘুরপাক খায়। সেই শব্দ হচ্ছে, “ভাবি”। ড্রাইভার তাকে ভাবি বলেছে। হয়তো ভেবেছে দিয়া আর রোদের বিয়ে হয়ে গেছে। কিংবা রোদ ড্রাইভারকে বলেছে, তারা স্বামী-স্ত্রী।

দিয়া হঠাৎ কী যেন ভেবে প্রশ্ন করে, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

রোদ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, হানিমুনে যাচ্ছি।

ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে আরো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দু’জনকে দেখে নেয়। দিয়া প্রচন্ড অস্বস্তি মাথায় নিয়ে বসে থাকে। রোদের কথাটা দিয়ার একদম পছন্দ হয়নি। তারা এখনও বিয়ে করেনি। তা হলে কীসের হানিমুন? রোদকে বিশ্বাস করে ওঁর সঙ্গে চলে আসাটাই ভুল হয়েছে। এখন দিয়া চাইলেও পালাতে পারবে না। কিন্তু তবুও একেবারে হাল ছেড়ে দেয় না দিয়া। সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। সুযোগ পেলেই সে পালাবে।

প্রায় এক ঘন্টা চলার পর একটা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি দাঁড় করানো হয়। ড্রাইভার এবং রোদ দু’জনেই যখন নেমে যায়, তখন দিয়া অতি সাবধানে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। হাইওয়ে রোডের এক পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ বাঁ দিকের কাচা রাস্তা ধরে ছুটতে থাকে দিয়া। একসময় পা দু’টো অবশ হয়ে আসে। দিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটুতে ভর করে থমকে দাঁড়ায়। আকস্মাৎ মাথা তুলে তাকাতেই দেখে কালো, মোটা, মাঝবয়েসি একটা লোক ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। লোকটার পরনে পুলিশের পোশাক। বুকের বাঁ পাশে নাম ফলকে লেখা, “আওলাদ”।

লোকটা দিয়ার চোখ বরাবর টর্চ মেরে বলে, আজকাল ভদ্রলোকের মেয়েরাও এ-পেশায় নেমেছে! গুড, ভেরি গুড! তা ম্যাডাম, আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনার টাকার অভাব। তা হলে এ-লাইনে কেন এসেছেন? ফিজিক্যালি নীডি বুঝি? বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে নিলেই পারতেন।

জঘন্য কথাগুলো শুনেও দিয়া রেগে যায় না। নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রেখে বলে, খুব বিপদে পড়ে পালিয়ে এসেছি। আমাকে সাহায্য করুন।

লোকটা দাঁত বের করে হেসে বলে, এই দ্যাখেন, মিথ্যেটাও ঠিক করে বলতে পারেন না। রাতের অন্ধকারে এরকম সেজেগুজে কারা ঘুরে বেড়ায় তা সবাই জানে ম্যাডাম। নতুন কিছু বলুন। এমন মিথ্যে বলুন, যা বিশ্বাস করা যায়।

দিয়া আবার একই কথা বলে, সত্যি বলছি। বিপদে পড়ে পালিয়ে এসেছি। আমাকে সাহায্য করুন। নাহয় যেতে দিন।

লোকটা আবার দাঁত বের করে হেসে বলে, যেতে দিন বললেই তো যেতে দেওয়া যায় না ম্যাডাম! ধরা যখন পড়েছেন, আজকের রাতটা অন্তত আটকে রাখব। কাল সকালে যেখানে খুশি চলে যাবেন।

বিকৃত প্রস্তাব শুনে দিয়ার গা শিওরে উঠে। এরচে’ রোদের সঙ্গে যেখানে খুশি চলে যাওয়াই ভালো ছিল! তবে কি আরো কঠিন বিপদের মুখে পড়তে চলেছে সে? আরো খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে তার সঙ্গে?

চলবে
মো. ইয়াছিন
#অবশেষে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে