অবশেষে তুমি আমি পর্ব~১

0
6317

#অবশেষে তুমি আমি,
#পর্ব~১
?️Chhamina Begam

….দাঁত মুখ খিঁচে পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে রোজা । এখানে আসার আগে আম্মু বারবার করে বলে দিয়েছিলেন সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে। কিন্তু বার বার চেষ্টার পরেও রোজা স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারছেনা। বলতে গেলে সহ্য হচ্ছে না এসব। সামনের এই অপরিচিত মুখগুলো দেখে কারি কারি রাগ জমছে । এই মুহূর্তে শাওন কে সামনে পেলে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতো রোজা । এদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে বিরক্তি এসে গেছে ওর । আর এই যে সামনে এত সুন্দর হ্যান্ডসাম পাত্রটি বসে আছে তাকে দেখে রোজার মনে বিন্দুমাত্র ভাললাগা কাজ করছে না। বরং ইচ্ছে করছে ব‍্যাটার সবগুলো চুল টেনে ছেড়ে দিতে । সুন্দর মুখটাতে বিড়ালের মত আঁচড় কেটে মুখের নকশা বদলে দিতে ইচ্ছে করছে। এত সাহস কোথা থেকে পায় না এরা ? একবারও রোজাকে জিজ্ঞেস করার দরকারও মনে করল না কেউ যে রোজা কি চায়? সবাই যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে ওর সাথে। আম্মু আব্বুর উপর যথেষ্ট রাগ উঠছে এখন । কত সুন্দর বলেছিলেন ” আরে দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যায় নাকি ?” আর এখন কত সুন্দর সবাই মিলে বিয়ের দিন তারিখ অবধি ঠিক করে ফেলছে। একবারও ওকে কেউ জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না । অদ্ভুত তো । ওকে কি এরা মানুষ বলে মনে করে না নাকি ?

পাত্রপক্ষ বিদায় নিতেই রোজা ধুপধাপ শব্দ করে নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয় । পরনের শাড়িটা টেনে খুলে ফেলার জন্য সেফটিপিন আটকে গিয়ে অনেকাংশে ছিড়ে যায়। কানের দুল, হাতের চুরি সব খুলে আয়নার দিকে ছুড়ে ফেলে দেয়। টুংটাং আওয়াজ করে চুড়িগুলো গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। এর আগে নিজেকে এতটা অসহায় কখনোই মনে হয়নি রোজার । কি করবে এখন ও ? শাওনকে সামনে পেলে হয়তো ও ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। সবকিছু ওর জন্যই হচ্ছে । এরকম একটা সিচুয়েশনে ও কি করে ওর পাশ থেকে সরে গেল? বলে কিনা ” আব্বু আম্মুর কথা মেনে নাও রোজা। ইউ ডিজার্ভ বেটার দ‍্যান মি । আমার জন্য কেন নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করছ ? ” বিছানায় পা তুলে বসে হাটুতে মাথা রাখে ফুপিয়ে ওঠে।

রাতে আর খাওয়া হয়না রোজার । আম্মু- আব্বু, দাদাভাই সবাই একবার করে এসে বুঝিয়ে গেছে ওকে। কত্তো ভালো ছেলে মিরাজ। কত বড় নামিদামি অফিসে চাকরি করে । অনেক টাকার বেতন পায় । সে নাকি রাজরানি হবে !আসলেই কি হবে ? হলে কোন দিক দিয়ে হবে ? ধনসম্পদ দিয়ে নাকি ভালোবাসা দিয়ে । আসলেই কি ভালো থাকবে রোজা ? উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না ও ! কোথায় ? অনেকবার চেষ্টা করেও তো এত সুন্দর লোকটা মনের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারল না । মিরাজ নামক মানুষটার আকর্ষণীয় মুখটার জায়গায় বারবার ওই ভোলাভালা শান্ত চোখের ছেলেটার মুখটাই চোখে ভাসছে বারবার । শুনতে পাচ্ছে ওর সুন্দর করে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলা কথাগুলো। প্রচণ্ড অভিমান হচ্ছে শাওনের ওপর । ও কি করে বলতে পারল ” রোজা সব ভুলে যাও । সমবয়সীদের মধ্যে প্রেম হলেও ওদের নিয়ে ঘর বাধা যায় না ।” কথাগুলো কাটার মত করে বিঁধে রোজার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে । এর জবাব তো দিতেই হবে ওকে ! পাজি-হতচ্ছাড়া-বদমাইশ ছেলে, প্রেম করার আগে কি এসব মনে ছিল না তোর ! এর বিহিত আমি করেই ছাড়ব । এত সহজে ছাড় পেয়ে যাবি তুই ভাবলি কি করে ? তুই হাত আলগা করলেও এই রোজা আক্তার এত সহজে ছাড়বে না তোকে । এসব ভাবতে ভাবতেই টুপটাপ করে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

বাবার সামনে দাড়ানোর আগেই শাওনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতেই হবে রোজার । কিন্তু আব্বু কি শুনবে ওর কথা ? এসব ভাবতে ভাবতেই একটা নির্ঘুম রাত পার হয়ে যায়। পরদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শাওনের হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়ায় রোজা । আজ শাওন কলেজে আসেনি। রোজা বারবার করে কল, মেসেজ করেছিল শাওনকে । তবুও আহাম্মক টা কি বুঝতে পারছে না । নাকি এর মধ্যেই এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে ? রাগে-দুঃখে নিজের চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে রোজার । কোন দুঃখে যে এই আলাভোলা ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়েছিল ,আল্লাহ মালুম। এমনিতেই গতরাতে চিন্তায় চিন্তায় ঘুমোতে পারেনি রোজা আর এই দিকে মহাশয়ের টিকিটির ও দেখা নেই। ধীরে ধীরে মেজাজ সপ্তমে চড়ে রোজার । দশ মিনিট ধরে হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও কিন্তু একটা পোকাও বেরোচ্ছে না হোস্টেল থেকে । বাধ্য হয়ে হোস্টেলের দারোয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রোজা..

-” চাচা কেমন আছেন ? ”
-” ভালো আছি মা , তুমি কেমন আছো ? ”

-” এইতো চাচা, আছি ভালোই । চাচা আপনি কি শাওন কে বের হতে দেখেছেন ? ”

-” সকাল থেকে তো একে একে সবাই কলেজে চলে গেল। শাওন বাবাকে তো দেখিনি !”
-” ও আচ্ছা ।আমি কি একবার ভিতরে যেতে পারবো চাচা ‌ । ”

-” না মা , হোস্টেলে মেয়ে মানুষের ঢোকার পারমিশন নেই !”

-” আচ্ছা, তাহলে আপনি এক কাজ করবেন ? শাওনের ফোন ঢুকছে না । ওর সঙ্গে যোগাযোগের তো আর কোন ব্যবস্থা নেই। আপনি কি কাউকে দিয়ে ওকে ডেকে আনতে পারবেন ?”

-” তুমি তাহলে এখানে অপেক্ষা করো। আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসি । ”

-“আচ্ছা চাচা ”

একটু পরে দারোয়ান চাচা শাওনকে ডেকে নিয়ে আসে। রোজাকে দেখে শাওন মলিন হাসে । ওকে দেখে চোখের কোল ভিজে ওঠে রোজার । দুদিনেই কি হাল করেছে নিজের । কোকড়ানো চুল গুলো আলুথালু হয়ে আছে । মনে হচ্ছে কত দিন যেন চুলে চিরুনি পড়েনি । চোখের নিচে কালি পড়েছে । চোখ দুটো লাল হয়ে আছে কেন ? ও কি কান্না করেছে ? বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে রোজার। পড়নের টিশার্ট টা এত কুচকে গেছে যে মনে হচ্ছে দুদিন হয়তো এটা পড়েই ছিল । শাওন সামনে আসতেই ওর হাত ধরে রোজা রাস্তায় নিয়ে আসে । টোটো দাড় করিয়ে দুজনেই উঠে পড়ে । রোজা টোটো চালককে বনবিথীকায় নিয়ে যেতে বলে । দশ মিনিটের মধ্যেই ওরা পৌঁছে যায় । পুরো রাস্তা দুজনে চুপ ছিল । বনবিথীকার পুকুর পাড়ে এসে বসে রোজা-শাওন। এখানকার পরিবেশ খুবই নির্জন ,গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা ।পুকুরের এই দিকটায় লোকজন বেশি আসে না । প্রায় তিন একর জমি জুড়ে শাল সেগুন ,মেহগনি, জারুল , শিমুল , কদম গাছ লাগানো হয়েছে ।শহর থেকে বেড়িয়ে অনেকেই এখানে ঘুরতে আসে , কেউ বা একান্তে সময় কাটাতে আসে প্রিয়জনের সাথে আবার কেউ ব‍্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে ছুটে আসে এখানে।

পাশাপাশি থেকেও দুজনেই মুখে কুলুপ এটে বসে আছে । দৃষ্টি পুকুরের জলে আবদ্ধ । গাছের ফাক গলে সূর্যের আলো জলে পড়ে আলো- ছায়ার লুকোচুরি খেলায় পরিবেশকে আর একটু রঙিন করতে চাইছে । কতগুলো মাছ আবার কিছুক্ষণ পর পর পুকুরের গভির থেকে উঠে এসে একটু মাথা উঠিয়েই আবার দ্রুত গভীরে চলে যাচ্ছে । যার জন্য জলের উপরিভাগে হালকা ঢেউ উঠে কিছুক্ষণ পর আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।এসব দেখতে দেখতেই কিছু একটা মনে পড়তেই রোজা নিজের ব‍্যাগ খুলে একটা টিফিন বক্স বের করে শাওনের হাতে দেয় । জলের বোতলটার ছিপি খুলে শাওনের সামনে এগিয়ে দেয় । শাওন তাকায় রোজার দিকে । তারপর বোতল হাতে নিয়ে দু-ঢোক জল পান করে । শাওন কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রোজা জিজ্ঞেস করে ..

-“কি হল , খাচ্ছো না কেন ? ”

-“ক্ষিদে নেই আমার ”

-” ওহ , তাহলে চোখ মুখ এমনি এমনি শুকনো মনে হচ্ছে ? ”

শাওন আবার তাকায় রোজার দিকে । রোজা শাওনের ডান হাত টা জল দিয়ে ধুয়ে দেয় । তার পর টিফিন বক্সটার ঢাকনা খুলে শাওনের সামনে ধরে…

-“একটা কথাও বলবে না আর । আগে চুপচাপ খাও ..”

-“তুমি খেয়েছ?”
– “হ‍্যাঁ , আর কথা নয় । আগে খাওয়া শেষ করো ”

শাওন আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করে। রোজা একরাশ মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে দেখে শাওন কে । আজ সকালে আম্মু অল্প ঝোল রেখে চিকেন রান্না করছে , সাথে আলুভাজি । রোজাকে সামনে বসিয়ে কয়েক গ্ৰাস খাইয়েছে । তারপর রোজা আর খাবে না বলে টিফিন প‍্যাক করে দিতে বলে , কলেজে গিয়ে খাবে সে। আম্মু সেই মতো টিফিন রেডি করে দেয় ।সেটাই ও শাওনের জন্য নিয়ে এসেছে।

খাওয়া শেষ হলে শাওন টিফিন বক্সটা ধুয়ে পাশে রেখে দেয় । আবার দুজনের মাঝে নীরবতা বিরাজ করে। নীরবতা ভেঙে রোজাই প্রথম কথা বলে…..

-“পরশু ওই মেসেজটা তুমি কেন করেছিলে ?”

-“সেটাই কি সঠিক নয় ”

-“কোনটা সঠিক হ‍্যাঁ ? এতদিনের সম্পর্ক আমাদের । আর এখন তুমি বলছ বাড়ির পছন্দে বিয়ে করে নাও । আমাকে এভাবে পর করে দিচ্ছ কেন ? থাকতে পারবে আমাকে ছাড়া ? ” পুকুরের জলের দিকে তাকিয়েই বলে রোজা ।

-“না পারলেও পারতে হবে রোজ । আমরা দুজনেই ছোট । কোনো বাবাই তার মেয়ের জন্য এমন ছেলে আশা করে না । ”

-“তুমি মাঠে নামার আগেই কেন হাল ছেড়ে দিচ্ছ ?”

-” ফলাফল যেখানে নিশ্চিত সেখানে চেষ্টা করা বৃথা ”

শাওন কথা শুনে রোজা ছলছল চোখে তাকায় ।খুব শান্তশিষ্ট ছেলে শাওন । কিন্তু আজ শাওনের এই অতি শান্ত স্বর রোজাকে ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে । অভিমানে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে । শাওন বুঝতে পারে রোজা কাঁদছে । তবুও পুকুর থেকে দৃষ্টি সড়ায় না । কি লাভ মায়া বাড়িয়ে ‌ ? এখন থেকে এই চোখের জলে অভ‍্যস্ত হতে হবে । তাই কাদুক না একটু । যদি একটু হালকা লাগে। শাওনকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে হুট করেই রোজা রেগে যায় । শাওনের দিকে ফিরে ওর টি-শার্টের কলার চেপে ধরে…

-“এই তুই এমন কেন? হ‍্যাঁ । কখনো কেন অধিকার খাটিয়ে বলিস না যে তুই শুধু আমার । কখনো কেন জোর খাটিয়ে বলিস না ‘ রোজ তোকে কোথাও যেতে দেব না আমি , তুই শুধুই আমার ।’ কেন বলিস না বল? কোথাকার কোন লোক এসে দেখে গেল আর তুই নাচতে নাচতে বলছিস ‘বিয়ে করে নাও । সুখে থাকবে তুমি ।’ এটাই যদি বলবি তাহলে কেন ভালোবেসেছিস আমায় ? কেন স্বপ্ন দেখিয়েছিস আমাকে ? কেন ? চুপ করে আছিস কেন ? বল না ? তুই কেন নিজের অধিকার ছেড়ে দিচ্ছিস ? কেন আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস ? তোকে ছাড়া আমি ভালো থাকব না রে। প্লিজ আমাকে দূরে সরিয়ে দিস না ” ……

কাদঁতে কাদঁতে রোজার হেঁচকি উঠে যায় । শাওন ওকে বুকের মাঝে চেপে ধরে । এতে রোজার কান্না আরো বেড়ে যায় । আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে শাওনকে । হাত আলগা করলেই মনে হয়ে হারিয়ে যাবে শাওন। শাওন রোজার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । নীরবতা আজ শব্দের ভূমিকা পালন করে ।

“রোজ কান্না থামাও ,প্লিজ । কাদঁলে তোমাকে বিচ্ছিরি দেখায় । দেখো তোমার নাকের জলে আমার টি-শার্টের কি করুণ অবস্থা হয়েছে । “….শাওন রোজাকে হাসানোর চেষ্টা করে।

To be continue…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে