#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৪ (এনে দাও ওঁকে!)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“এভাবে যদি আবার হারিয়ে যাই?”
“আবার খুঁজব, আবার পাব..”
“চিরতরে গেলে?”
“আমিও পিছু নেব।”
“মরনেও?”
“পরকালেও।”
শুদ্ধ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তনুজা মাথা নিচু করে ফেলল। বিরবির করে কেবল বলল, “আল্লাহ তোমায় সুখী করুক, শুদ্ধ। খুব সুখী করুক। আমাকে ছাড়াই..”
কথাটা শুদ্ধ শুনল। শব্দ করে সে বলে উঠল, “আমার ভাগেরটুকু তো আমি পাবই। হোক সেটা সুখ! কিংবা অসুখ..”
“আর মায়ায় জড়িয়ো না, ছেলে। আমি পিছলে যেতে পারি।”
“ক্ষতি কী?”
“আছে অনেক।”
“যেমন?”
“আমার মতো অনুভূতিশূন্য যাতে আর কোনো আবেগী কিশোরকে হতে না হয়!”
“আপনি আপন করে নিলেই পারেন!”
“সম্ভব নয়।”
“কেন?”
“কারণ অজানা?”
শুদ্ধ তাকাল। তনুজা চোখ বন্ধ করে ফেলল। হুট করেই একূল-অকূল না ভেবে, দু’হাত টেবিলের উপর দিয়ে এগিয়ে প্রথমবারের মতো শুদ্ধর বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত রাখল। শুদ্ধর সর্বাঙ্গ অধিকতর উত্তেজিত হয়ে উঠল। তনুজা নিজ আঙ্গিকে সেই হাতের উপর মাথা ঠেকাল, চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। কিছু না বলেও, শুদ্ধকে অনেক কিছু বোঝাল।
খানিকক্ষণ বাদে শুদ্ধ অনুভব করল—তার হাতের সিক্ততা। ত্বরিতে হাত সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু তনুজা ছাড়ল না। শুদ্ধর হাতের পিঠে কপাল ঠেকিয়ে ঠোঁট কামড়ে বড়ো করে নিঃশ্বাস নিল। ভেতর থেকে সব দুমড়ে যাচ্ছে। বাইরের কিছু দেখার অবসর কোথায়? এই-যে, আশে-পাশের মানুষদের নজর ওদের উপর, তাতে ওদের খেয়াল কোথায়?
শুদ্ধর কেমন যেন লাগছে। অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে বক্ষপিঞ্জরে। বোঝানো দায় তা! মনে হচ্ছে, কেউ তার কলিজাটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে নিজ-চোখের সামনেই; সে কিছু বলতেও পারছে না। তবে বলতে ইচ্ছে করছে। খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, “অলকানন্দা! আমার অলকানন্দা! আপনি কাঁদবেন না! আপনি কাঁদলে যেন আমার গোটা আকাশ কাঁদতে থাকে, বন্যা হয়ে যায় ধরিত্রীতে। সাঁতরে কূল পাই না! ডুবে যাই আপনার চোখের এই প্রেম-সাগরে; অথচ.. অথচ মরতে পারি না।”
শুদ্ধর মনঃকথন যেন তনুজা শুনতে পেল। বড্ড মিনমিনে গলায় ধীরবুলি আওড়াল, “শুদ্ধ, দোহায় লাগে! আমায় ছেড়ে দাও। এই মানসিক অশান্তি আমি আর নিতে পারছি না। একটুও পারছি না। এর চেয়ে মরণ যেন শ্রেয়! স্রষ্টার দেওয়া জীবনকে তো ফিরিয়ে দিতে পারব না, তাই তোমায় ফেরাচ্ছি। ফিরে যাও, প্লিজ!”
কথাগুলোর প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদাভাবে শুদ্ধর বুকে গিয়ে বিঁধল। শুদ্ধ এখন তনুজাকে কী বলবে—ভেবে পাচ্ছে না। তনুজার কথা মেনে নেওয়া অসম্ভবনীয়, আর এমনভাবে প্রিয় নারীর বলা কোনো কথা ফেলাও দুষ্কর। তথাপি বলে উঠল, “এভাবে আমার জান চেয়ে নিলে—আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে, মুচকি হেসে আপনার সামনে রেখে দিতাম! অথচ, আপনি চাইলেনই এমন কিছু…”
তনুজা মাথা ওঠাল। শুদ্ধ তনুজার চোখে চোখ রাখতে না পেরে নতমুখী হয়ে পকেট থেকে হ্যাংকিটা বের করে তনুজার দিকে এগিয়ে দিলো। তনুজা এদিক-ওদিক না-তাকিয়ে চোখ মুছে নিল। ক’বার নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “সৃষ্টিকর্তার দেওয়া জীবন যার-তার সামনে ফেলে দিতে হয় না। বহু মূল্যবান জিনিস আছে, জীবনের অধিক নেই।”
“আর আপনি তার চেয়েও অধিক.. আপনার জন্য মরতে রাজি।”
“বেঁচে না থাকলে আমাকে পাবে কী করে? অথচ, দেখো! আমি না থাকলেও তুমি বেঁচে থাকবে।”
“আমার গোটা জীবনকে বিপরীতে রেখে, আপনাকে চাইছি!”
“ওভাবে বোলো না, সৃষ্টিকর্তা নারাজ হবেন। তারপর..”
“তারপর?”
“তারপর আমাকে শান্তি দেবেন।”
“একটু ভালোবাসা কি আমি একেবারেই ডিজার্ভ করি না? এই এইটুকুন?”
হাত দিয়ে খানিকটা পরিমাপ করে দেখাল শুদ্ধ। তনুজা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, “সবার ভালোবাসা পাবে তুমি, কেবল..”
“আপনারটা ছাড়া, তাই-তো?”
“হ্যাঁ।”
“আর কারোর ভালোবাসা আমার চাই না।”
“যা চাই, তা কি আদতে আমরা পাই? আর যা পাই, তা কি সব চাই?”
“নাহ!”
“আমি না তোমার প্রিয় অনুশোচনা?”
শুদ্ধ তাকাল তনুজার চোখের দিকে। চোখে চোখ স্থির রেখে বোধহয় শেষবারের মতোই বলে উঠল, “আর আপনার মোহে জড়িয়ে, নিজের জন্য কেবলই আফসোস হয় আমার, অলকানন্দা।”
থামল শুদ্ধ, গভীর শ্বাস টানল। এক আকাশ সমান আফসোস নিয়ে বলে উঠল, “আমার অলকানন্দাকে দুঃখ স্পর্শ না করুক। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটি আমার অপ্রেমিকা হোক। তাঁর উপস্থিতি আমার না-হলেও, আমার অনুপস্থিত সুখ সারাটাজীবন তাঁরই হোক।”
______
আকাশে মস্ত বড়ো একফালি চাঁদ আর বাতাসের সাথে জোনাকি পোকার ঝিঁঝিঁ আওয়াজ! কী স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে! কী সুন্দর শোনাচ্ছে! প্রকৃতির এই শান্ত রূপ বোধকরি সবারই বড্ড প্রিয়। তবে সহ্য হচ্ছে না সিদ্দিকের।
বারান্দায় বসে একের পর এক সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। মনটার বিষাক্ততা এই হাওয়ার চেয়ে কম নয়! সে কি আদতেই এত শক্ত পুরুষ—যতটা দেখাচ্ছে! আচ্ছা, তনুজাকে অন্যের পাশে ভাবতেই তার কেন এত খারাপ লাগছে?
ওদিকে তনুজা বিগত ৬-৭ বছর ধরে তাকে অন্য নারীর সাথে দেখে আসছে! মনের কোণায় প্রশ্ন এলো, ‘সে কী করে পারল, প্রিয়তমাকে ছেড়ে অন্যতে জড়াতে? কী করে পারল অন্য কারো সাথে ঘনিষ্ঠ হতে?’
আর ভাবতে পারছে না। অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে তনুজার জন্য; মেয়েটা আর কত সইবে? তারপরই ভেতর মন জবাব দিলো, “ওর সইতে হবে। ওর এভাবেই ইহজীবনটা কাটাতে হবে। সাহস কী করে হলো ওর—ছেড়ে যাওয়ার? নিজের জায়গা ও নিজেই ছেড়েছে। কী করে পারল এরকমটা করতে? আমি কি ওকে কম খুঁজেছি? ও কেন মায়ের কথায় এত বাজে সিদ্ধান্তে এলো?”
সিদ্দিক দাঁতে দাঁত পিষে চোখ বন্ধ করে ফেলল। যদি কোনোদিন তনুজার সামনে সে নিজেকে.. নিজের রাগকে সামলে রাখতে পারে, তবে শুধাবে, “যা চেয়েছিলি, তাই হয়েছে। খুশি নোস? নোস কি? হাসবি এখন। হেসে দে। জোরে জোরে হাস। আমার জীবনটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে বিজয়ীর হাসি হাস। সব তোর ইচ্ছে মতো হয়েছে, তোর ইচ্ছে মতোই হচ্ছে।”
সবশেষে বলবে, “তনুজা! তুই পাষাণ!”
ভাবনাগুলো দমবন্ধকর হয়ে আসছে! সিদ্দিক সিগারেটটা ফেলে মুখ কুঁচকে ফেলল। ভেতরটা তেতো হয়ে এসেছে। অনুভূতিরা যেন বিষ হয়ে গেছে!
____
তালুকদার বাড়িটা আজ একদমই খালি। ইয়াকুব তালুকদার আর এশহাদ তালুকদার কিছু ব্যবসায়িক কাজে চট্টগ্রাম গেছেন। বয়স সত্তরের কোঠায় গেছে, তবুও ইয়াকুব সাহেব এখনও ভীষণ শক্ত-সামর্থ্য চেহারার ব্যক্তি। মুখভাব দেখে বয়স আন্দাজ করাটা বেশ কঠিন। এই বয়সেও ব্যবসার হালটা পুরোপুরি ছেলের হাতে তুলে দেননি। ছেলেটা ছিল অশান্ত এবং উত্তেজিত স্বভাবের। তাই ভরসা করতে পারেননি; পাছে না এত সাধনার ব্যবসা রশাতলে যায়! তাই তো, একমাত্র নাতিকে নিজের মতন প্রখর জেদি-একরোখা-বুদ্ধিদীপ্ত তৈরি করেছেন। বয়সে খানিকটা অভিজ্ঞ হলেই, সবটা তার হাতে ছেড়ে দিয়ে শান্তির নিদ্রা নেবেন। অথচ, ছেলেটার বয়স বাড়ছে.. খাম-খেয়ালি কমছে না। তাই এখনও নিজের কাঠিন্য ধরে রাখতে হচ্ছে ইয়াকুব সাহেবকে।
রাতের বারোটার দিকে একা বাড়িতে বসে বসে একটা উপন্যাসের বই পড়ছিলেন সুভা বেগম। বাড়িতে সার্ভেন্টস ছাড়া কোনো ফ্যামিলি মেম্বার নেই। হুট করেই তিনি শুনতে পেলেন, কলিং বেলের তীব্র আওয়াজ। সব সার্ভেন্ট ঘুমিয়ে গেছে। এমন অসময়ে কে আসবে!
ত্বরিতে ফোনের সিসিটিভি মনিটরে বাইরের ক্যামেরাটা চেক দিলেন। দরজার সামনে শুদ্ধকে অন্যমনস্কভাবে, খুবই অগোছালো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্বিতীয়বারের মতো ভীষণ রকমের অবাক হলেন। এলোমেলো পায়ে দ্রুত গিয়ে সদর দরজার সামনে গেলেন, দরজা খুললেন।
দেখতে পেলেন—শুদ্ধর অস্বাভাবিকরকমের লাল চোখজোড়া। বুকটা ধুক করে ওঠে তাঁর। কলিজার টুকরোর এই অবস্থা কী করে! সুভা বেগমের রাগ-জেদ-অভিমান সবটাই অনেক বেশি। বৈশিষ্টানুসারে এখন তাঁর কেঁদে ফেলা উচিত। অথচ, তিনি তা করলেন না। ছেলের এই অবস্থার কীসের জন্য হয়েছে, তা বুঝতে বিচক্ষণ সুভার দেরি হলো না। প্রচণ্ড রকমের রাগ গিয়ে পড়ল, এর দায়ী মানবীর উপর।
সেই রাগ এগোনোর আগেই শুদ্ধ সুভা বেগমের চোখে চোখ রেখে বলল, “মা! মা!”
তাঁর মাতৃহৃদয়ে কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিলো, বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। মূহুর্তেই চোখ দুটো ছলছল হয়ে এলো। শুদ্ধ বাচ্চাদের মতো ফোঁপাতে লাগল। ক্ষণিকের ব্যবধানে হাঁটু ভাঁজ হয়ে এলো, মাথা নত হয়ে গেল। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এলো বেদনাশ্রু। বিরবির করে কী যে বলে যাচ্ছে!
সুভা বেগমের চোখ দিয়ে জল গড়ায়, এগিয়ে এসে শুদ্ধর খুব কাছাকাছি দাঁড়ান। কাঁপা-কাঁপা হাত বাড়িয়ে শুদ্ধর কোঁকড়াচুলের উপর রাখেন। শুদ্ধ তাকায় তাঁর দিকে।
মা-ছেলে দুজনেই কাঁদছে। আহ্লাদ পেয়ে শুদ্ধ সুভা বেগমের কোমড় জড়িয়ে ধরল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাচ্চাদের মতো আবদার করে বসল স্বীয় মায়ের কাছে, যার কাছে একবার মজার ছলে তারা চাওয়াতে, তিনি কদিনের মাঝেই শুদ্ধর নামে একটা তারা কিনে দিয়েছিলেন; আর আজ কাঁদতে কাঁদতে চাইল, “মা, আমার ওঁকে লাগবে। এনে দাও, মা। এনে দাও! প্রমিস করছি, আর কিচ্ছুটি চাইব না।”
সুভা বেগম চোখ বুঁজে ফেললেন।
চলবে…
#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৫ (প্রেমপুষ্পের অকাল পতন)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
সকাল সকাল আশা অর্ষার রুমে এলো। ঘুমন্ত অর্ষার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দু’হাতে জড়িয়ে নিল। মায়ের বুকের উষ্ণতা পেয়ে অর্ষা অধর প্রসারিত করে হাসল। বলে উঠল, “গুম্মন্নিং, মাম্মা!”
আশাও তার মতো টেনে টেনে বলল, “গু-ড মর্নিং, প্রিন্সেস!”
“এবার ঘুমাব। গুড নাইট!”
অর্ষার এমন ধূর্ততা দেখে আশা না হেসে পারল না। শক্ত করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “ওরে দুষ্ট!”
অর্ষা বন্ধরত চোখে বলল, “হয়েএএ!”
“স্কুল আছে তো!”
“যাব না, মাম্মা!”
“তো কী করবে?”
“ঘুমাব।”
“তোমার তনুমা কিন্তু এরকম আলসেমি একটুও পছন্দ করে না, সোনা।”
অর্ষা ‘তনুমা’ শুনেই ত্বরিতে চোখ খুলল। কাল রাতে আশা অর্ষাকে তনুজার গল্প শুনিয়েছে। ছোটোখাটো কিছু বিষয়কে সুন্দর মতো উপস্থাপন করেছে অর্ষার সামনে। যেমন, “একটা তনুশ্রী ছিল। খুব পরিশ্রমী, খুব মেধাবী। সবাইকে কী রকম আগলে রাখত, সবাইকে কত ভালোবাসত, সবার কতটা খেয়াল রাখত! ধৈর্য ছিল মাটির মতন, অভিমান ছিল আকাশের মতন।”
দোষগুলো সব ঢেকে-ঢুকে গুনগুলোকে বিশালাকার বানিয়ে অর্ষার সামনে তুলে ধরেছে। নিজের কাছে রাখা তনুজার বেশ কিছু ছবি দেখিয়েছে। অর্ষা তনুজাকে এর আগেও দেখেছিল। আবার ছবি দেখতে পেয়ে বলেছিল, “মাম্মা! তুমিই তো বলেছিলে, এটা আমার আরেক মাম্মা!”
“হ্যাঁ, তো!”
“কী করে? বাবাইকে বলায়, বাবাই রাগ করেছিল প্রচণ্ড!”
“সে কী! বাবাইকে বলতে গিয়েছিলে কেন?”
“তুমি বলোনি বলেই তো গিয়েছিলাম!”
“আচ্ছা! আসলে তোমার তনু মাম্মার অভিমান অনেক বেশি ছিল।”
“অভিমান কী, মাম্মা?”
“আব্.. রাতে বাবাই তোমার জন্য ডেইজি আনতে ভুলে গেলে, তোমার কেমন লাগে?”
“মন খারাপ লাগে, কান্না লাগে, রাগ লাগে!”
“সেটাই! তনুজারও তেমন লেগেছিল।”
“বাবাইকে কি ওকে ডেইজি দেয়নি? বাবাই পচা কাজ করেছে তো!”
“না না, সেটা না। তোমাকে অভিমান শব্দের মানে বোঝাচ্ছিলাম। বুঝেছ?”
“এটাকে অভিমান বলে?”
“হ্যাঁ, মা!”
“আচ্ছা, এরপর?”
“এরপর, সে একদিন লুকিয়ে পড়ে।”
“কোথায়?”
“জানি না তো! বাবাই প্রচুর খোঁজে। পায় না।”
“সেদিনের মতো? ওই-যে, একদিন ফ্রেন্ডসদের সাথে হাইড অ্যান্ড সিক খেলতে খেলতে আমি বেসমেন্টে লুকিয়ে পড়েছিলাম, এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাবাই অনেক খুঁজেও পায়নি। তারপর যখন পেল, তখন আমাকে কত্ত বকল! বাবাই কি তবে এজন্য রাগ করেছে তনু মাম্মার প্রতি?”
“ধরা যায় তা-ই!”
“তাহলে তো বাবাই একদম ঠিক করেছে! বাবাইয়ের টেনশন হয়নি বুঝি? তনু মাম্মা এরকম কেন করল?”
“তুমি কেন করেছিলে?”
“আমি তো খেলছিলাম, ভুলে হয়ে গেছে।”
“তোমার তনু মাম্মাও খেলছিল। এতকিছু হবে, বোঝেনি।”
“আমি ওকে তনুমা বলি? মাম্মা তো তোমায় ডাকি!”
“আচ্ছা, ডেকো।”
“হ্যাঁ, তো তনুমা এখন কোথায়?”
“অনেক দূরে!”
“লুকোতে লুকোতে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল?”
“হ্যাঁ, মা!”
“ফেরেনি আর?”
“নাহ!”
“বাবাই মারবে বলে ভয় পেয়েছিল? ওকে বলে দিয়ো—আমার বাবাই বেস্ট! সবাইকে বোঝে, সবাইকে ভালোবাসে। তাকে ফিরে আসতে বোলো! আমার তাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমরা একসাথে খেলব! সে আমার সাথে খেলবে তো?”
জবাবে আশা বলতে পারে না—তনুজার ফিরে আসার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে সে নিজে। তাকে ডিঙিয়ে তনুজা সিদ্দিকের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। তাকে বলতে পারে না—তার বাবাই সবাইকে বুঝলেও তনুজাকে বোঝেনি, আশাকে বোঝেনি। রমনীদের প্রেম বোঝায় সে বড্ড কাঁচা, এখনও কি নবীন?
“মাম্মা! তনুমার কাছে নিয়ে যাবে?”
ভাবনার মাঝে এখন ঘুমন্ত অর্ষার হঠাৎই জাগন্ত কণ্ঠ শুনে আশা চকিতে চাইল। জবাবে কী বলবে ভাবতে গিয়ে শব্দ খোঁজা লাগল। অর্ষা তাড়া দিলো, “কী হলো! নিয়ে যাবে না?”
আশা কৃত্রিম হেসে বলল, “যাব তো! অবশ্যই নিয়ে যাব। তবে আজ নয়।”
“কবে?”
“যবে তুমি বড়ো হবে!”
“আমি তো বড়োই, মাম্মা! আর কত?”
“আর ততটা বড়ো, যতটা হলে তোমার তনুমাকে দেখার জন্য, আমাদের হেল্পের প্রয়োজন পড়বে না।”
“আমি তো নিজের কাজ সব নিজেই করতে পারি। শুধু জুতোর ফিতেটা বাঁধতে পারি না! আচ্ছা, আমি শিখে নেব। কিন্তু!”
“কী?”
অর্ষা এই ‘কী’-এর উত্তর দিলো না। চোখ পড়ে তার মা মুচকি হাসল। অর্ষাকে বিছানায় বসিয়ে, ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে সে নিজেও বসল। আলতো হাতে তার গাল স্পর্শ করে আশা বলে উঠল, “এখন আপাতত তনুজার সাথে কথা বলতে পারো। তবে বাবাইকে বলা যাবে না।”
“সত্যিই কথা বলতে পারব?”
“হ্যাঁ, পারবে তো!”
“তবে, আমি বাবাইকে একদমই বলব না।”
_____
আকাশের মেঘাচ্ছন্নতার সাথে পাল্লা চালিয়ে যাচ্ছে তনুজার গুমোট-বাঁধা মনটি। কিছুদিন ধরে খুব অসহনীয় লাগছে তার। রোজ-রোজ শুদ্ধর জ্বালাতন, প্রতিদিন নেওয়া খোঁজ, মাঝে মাঝে দেওয়া অনুশোচনা-পত্র, হঠাৎ হঠাৎই পাগলামি, দেখা হলেই মুচকি হাসা, আনমনেই কোঁকড়ানো চুলগুলো চুলকে নেওয়া, গজদাঁত বের করে এক গাল হাসা—বার বার বিরক্ত হলেও, সহ্য করে নেওয়া যেন তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।
মহাপুরুষ ছাড়া কারোরই সাধ্য নেয়, স্ব-অভ্যেসের বহির্ভূত কিছু করা। তনুজাও পারছে না। পারছে না বললে ভুল হবে, পারছে! কিন্তু কিছু একটার ঘাটতি দারুণভাবে ভোগাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে—বুকের মাঝটা শূন্য, অনেকটা আকাশের বুকে যেন নীলিমার অভাব! মনে হচ্ছে—কিছু জ্বালাতন খারাপ না, সুন্দর! অদ্ভুত রকমের প্রশান্তিদায়ক!
কিছু মানুষ থাকে না? যাদের জন্মই হয় একা থাকার জন্য, কষ্ট পাওয়ার জন্য। স্রষ্টা বোধহয় তনুজাকে তেমনই একজন বানিয়েছেন।
তাই তো—তনুজা কাঁদে না, অভিযোগও করে না। আগের মতো অভিমানে গাল ফোলায় না, রাগে রণচণ্ডীও হয় না। কেবল প্রতিপদে চমকে ওঠা মেঘাচ্ছন্ন আকাশটির দিকে তাকায় আর হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে চিৎকার করে বলে ওঠে, “হে, পৃথিবী! তুমি না চাইতেও আমি খুব ভালো আছি। এই দেখো! হাসছি!”
প্রকৃতি বোধহয় লজ্জা পায়। মুখ লুকোয় অন্ধকারে। তনুজা এতে মজা পায়। মজা পায় ঝোড়ো হাওয়া, অশান্ত পরিবেশ দেখে। তনুজার এমন নির্জীবতা দেখে আকাশ যখন বিদ্যুতের ঝলকানি দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে ওঠে, তনুজা তখনও আকাশের কর্ম দেখে রঙ্গ করে হাসে।
আজ দীর্ঘক্ষণ আকাশটা অন্ধকার হয়ে রইল। তনুজা নিষ্পলক ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল ঝুম বৃষ্টির অপেক্ষায়।
ক্ষণিকের মাঝেই বৃষ্টিরা দলবদ্ধ হয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ল। তনুজা নির্নিমেষ নেত্রে আরও এগিয়ে গিয়ে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। দক্ষিণা হাওয়ায় জন্য বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা এমুখো হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে তনুজার সর্বাঙ্গ। মুখে শীতল স্পর্শ পেয়ে সে মুচকি হেসে বিরবির করে বলে উঠল, “আমি কাউকে বলব না—মানুষ দ্বিতীয় বার প্রেমে পড়ে। কাউকে বলব না।”
তারপর থামল। আবার বলল, “প্রথম প্রেমে পড়ার পর মানুষ নব্য প্রেমী হয়। শিরশির করে কাঁপতে থাকা শরীর, উথাল-পাতাল ঢেউ খেলা হৃৎস্পন্দন, প্রিয়তমের শূন্যতায় বুকের হাহাকার, কাছাকাছিতে অবিশ্বাস্য ধরনের সুখ, চোখের ভাষার না-চাইতেও দিক পরিবর্তন, চারপাশে সুখ-প্রজাপতির ওড়াউড়ি, অনুভূতিদের সম্মিলিত সাক্ষাতকার—সবটাই তখন অচেনা। প্রেম পেরিয়ে সম্পর্কটা যখন অনেক দূর এগোয়, তখন তারা বুঝতে পারে যে, এখানটায় প্রেমপুষ্পের প্রস্ফুটন হয়েছে। তারা আগে বোঝে না.. বোঝে না কী করে প্রেয়সীর মান ভাঙাতে হয়, কী করলে প্রেমিকপুরুষও হুটহাট বুকে আগলে নেয় অকারণে! নতুন অনুভূতি তো! বুঝতে বুঝতেই প্রেমপুষ্প ঝরে পড়ে।
তাই, দ্বিতীয় প্রেমের সূচনাতে এই একই অনুভূতি চিনতে আমি ভুল করিনি। তার প্রেমে পড়তে আমার লেগেছিল পাক্কা সাঁইত্রিশ সেকেন্ড। প্রথম বারো সেকেন্ডের মাথাতেই আমি ধরে ফেলেছিলাম—নিজের ভেতরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলাপাকানো অনুভূতিদের একত্রিত হয়ে ডানা ঝাপটানো। আমি এরপরের বিশ সেকেন্ড নিজেকে আটকানোতে লাগিয়েছিলাম। খুব করে চেয়েছিলাম, অনুভূতিরা মরে যাক। অথচ তারা মরল না। শেষ পাঁচ সেকেন্ডে আমি নিজের চেয়ে আ-ট বছরের ছেলেটাতে গভীর থেকে গভীরভাবে ডুবে গেলাম.. তার ডোবার আগেই। সে আমার দিকে প্রেমময়ী নজরে তাকানোর আগেই আমার মনের গহীন থেকে তার জন্য প্রেম-প্রজাপতিরা দলবদ্ধ হয়ে ওড়া শুরু করল। অথচ, শিক্ষিকা তনুজার জন্য স্বীয় শিক্ষার্থীর তরে প্রেম-বিনিময় ছিল নিষিদ্ধ। ইশ, শুদ্ধ! আমি এই প্রফেশনে না থাকলে তোমায় ফেরাতাম না।”
তনুজা চুপ মেরে গেল। অনেকটা সময় লাগাল। বৃষ্টির তেজ বাড়ছে, আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে আস্তে-ধীরে। তনুজার মনে প্রশ্ন জাগে! ধরার আকাশে মেঘ জমে, বৃষ্টি হয়, আকাশ পরিষ্কারও হয়। অথচ, তার মনাকাশের মেঘ কেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে না? সে কি এতটাই পাষণ্ড?
জবাবে স্বকীয় মনও মনের অধিনস্থ দুই পুরুষের মতো বলে ওঠে, “তুই সত্যিই পাষণ্ডী। শুদ্ধর ভাষ্যমতে—সত্যি সত্যি সত্যি!”
তনুজা পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকায়। নতমুখী হয়ে মিনমিনে স্বরে বলতে লাগে, “আ..আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমা চাই। প্রিয় বর্ষন! তার কানে পৌঁছে দিয়ো—তার অলকানন্দা তাকে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না-পারার জন্য ধারা ঝরা ধরণীর মতো দুঃখিত। কেবল বোলো না যে—তার প্রেম এক তরফা ছিল না। বোলো না—প্রেমপুষ্প এই পাশেও ফুটেছিল।”
চলবে?