#অপ্রিয় সে
#সানজিদা সন্ধি
#পর্বঃ১৯
রাত ১ টা বেজে ৫৫ মিনিট। রূপমের চোখে ঘুম নেই। দেয়ালের সাথে লাগোয়া বেডে শুয়ে আছে সে। হাতের মুঠি শক্ত করে একের পর এক দেয়ালে আঘাত করেই যাচ্ছে জোরে জোরে।। দ্রিম দ্রিম একটা শব্দে ছেঁয়ে গেছে পুরো রুম। এভাবে আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে তার হাত থেকে রক্ত পড়া শুরু করবে। যে অনুপাতে সে নিজের হাতে আঘাত করছে তাতে বিষয়টা অসম্ভব নয়৷
কেন আমি সহজভাবে উপস্থাপন করলাম না নিজেকে? যেসব কাজ বুঝিয়ে করা সম্ভব হতো সেসব কাজ ট্যারামি করে কেন রিমুর মনে নিজের স্থানটা হারালাম? এরকম বোকামি কেউ করে না কি? কী দরকার ছিলো নিজেকে বাজে ভাবে উপস্থাপন করার? ভালো ভাবে করলেই তো পারতাম। কেন করলাম না তখন? আর এখন অন্তর জ্বালায় জ্বলতে হচ্ছে আমাকে। আমি তো ভালোবাসি রিমুকে। ম্যাচিউরিটির অভাবে সম্পূর্ণ লেইম কারণে তার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। বুঝদার হওয়ার পরে যখন তাকে ভীষণ করে চাইছি তখন তাকে পাওয়া পায় আমাবস্যার চাঁদের মতো। বিড়বিড় করছে রূপম। অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছে। তবে সময় পেরিয়ে সে তার ভুলটা বুঝতে পারলো। এখন এই ভুল বুঝতে পারার মূল্য কী পাবে সে রিমুর কাছে? সে অনন্ত যাইহোক ইচ্ছে করে তো আঘাত করে নি রিমুকে। নির্বুদ্ধিতা, ইমম্যাচিউরিটি মানুষের জীবনের বেঁচে থাকার আশা নষ্ট করে দিতে পারে বিষয়টা এখন বোধগম্য হচ্ছে রূপমের।
দেয়ালে আঘাত করতে করতে রূপমের হাতের অবস্থা বেজায় বাজে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে আঘাত করলেও তার ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে না। মনকষ্ট যখন বেশি হয় তখন শারীরিক কষ্টকে তুচ্ছ মনে হয়। হারিয়ে যাবার পর মানুষ মূল্য বোঝে সবকিছুর। রিমু এখন বদলে গেছে, নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে আর এখনই রূপমের ইচ্ছে হচ্ছে শক্ত করে রিমুকে জড়িয়ে ধরে বাকি জীবনটা শান্তি মত
কাটাতে। রাত দু’টো। রূপম ফোন হাতে নিয়ে রিমুর নাম্বারে ফোন দিলো। একবার, দুবার, তিনবার এভাবে পঁচিশ বারের মতো রিমুর নাম্বারে ফোন দিলো রূপম। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স নেই। এতো রাতে মানুষ ঘুমাবে এটাই স্বাভাবিক। রিমুও ঘুমাচ্ছে তাই ফোন ধরছেনা বিষয়টা মাথায় এসেছে রূপমের। তবে এতোবার ফোন দিলে যে কারোরই ঘুম ভাঙার কথা। তবে কী ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছে রিমু? সে যাই হোক রূপম ফোন দিয়ে গেলো ক্রমাগত। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে সে বন্ধ ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।
এই রিমু! ফিরে আয় না রে একটিবার। সত্যি বলছি সব শাস্তি মাথা পেতে নেবো। তুই যা শাস্তি দিতে চাস দিস। যেভাবে পারিস কষ্ট দিস। কিন্তু আমার কাছে থেকে। বালিশে মুখ গুঁজেই রূপম এসব বলে কাঁদছে। এতো করুণ কন্ঠের আকুতি রিমু শুনলে সে কী পারবে এতো নিষ্ঠুর হয়ে থাকতে? রিমু হীন জীবনটা কেমন যেন অনর্থক লাগছে রূপমের কাছে। তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মরার কথা ভাবতে গিয়েও রূপমের মনে হচ্ছে রিমুর সান্নিধ্য পাওয়ার পর তার যা খুশি হোক। কিন্তু রিমুকে পেতেই হবে তার। একবারের জন্য হলেও রিমু তার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিক তাকে৷
সাদিয়া আর ঋষি সারারাত ধরে কথা বলছে। এক টপিক থেকে আরেক টপিকে। কথা যেন ফুরাতেই চায় না। কথার একপর্যায়ে ঋষি বলে ওঠে আচ্ছা সাদিয়া আমাকে কেমন লাগে?
সাদিয়া ঝটপট উত্তর দেয়, ” একদম ভালো লাগে না। ”
বাচ্চাদের মতো কন্ঠ করে সাদিয়ার বলা, ” একদম ভালো লাগে না ” কথাটা ঋষির বুকে ঝড় তুলে দেয়৷ বারবার তার মনে হতে থাকে মেয়েটা এতো সুন্দর করে কথা বলে কীভাবে? অথচ কথাটা একদমই স্বাভাবিক। আহামরি বিশেষত্ব নেই।
ঋষি বোধহয় প্রেমে পড়েছে। ভালোবেসে ফেলেছে সাদিয়াকে। তাই তো সাদিয়ার বলা অতীব সাধারণ কথাটা মধুর মতো ঠেকলো তার কাছে।
ঋষি ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করে এই অল্প কদিনেই আপনি আমার অনেক প্রিয় হয়ে গিয়েছেন।
সাদিয়া উ জাতীয় ভেঙচি কাটার শব্দ করে বলে আর আপনি দিনদিন অপ্রিয় হচ্ছেন আমার। ঋষি মনঃক্ষুণ্ন হয়। তবে সেটা প্রকাশ না করে বলে আজ অপ্রিয় তো কী হয়েছে? কাল হয়তো প্রিয় হয়ে যাবো৷
উহুম আপনি কখনোই আমার প্রিয় হতে পারবেন না। আজীবন অপ্রিয়ই থাকবেন। নাতী নাতনীদের সঙ্গে গল্প করার সময় বলবো, জানিস তোর দাদু আমার ” অপ্রিয় সে ” কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অপ্রিয় সম্মোধন টা আক্ষরিক অর্থে অপ্রিয় বোঝাতে ব্যাবহৃত হয়না। সবার সামনে তাদেরকে অপ্রিয় বলেই বরং বেশি তৃপ্তি পাওয়া যায়। কারণ তারা হয় সবচেয়ে প্রিয়। তাদের ধারেকাছে আসার ক্ষমতাও কারো থাকে না। এটা আমার ব্যাক্তিগত মতামত। একান্তই ব্যাক্তিগত। কথাগুলো এক ধ্যানেই বলতে থাকে সাদিয়া। এদিকে ঋষির মনে হচ্ছে সে বোধহয় দুনিয়াতেই নেই। অলীক স্বপ্নে ভাসছে। এই সাদিয়াটা কী বলছে এগুলো? সুখানুভূতি দিয়ে খুন করার তালে আছে না কি? কষ্ট করে যে জিনিস পাওয়া যায় তার কদর না কি সবচেয়ে বেশি হয়। তবে এতো সহজে যেটা পাওয়া যায় সেটা যে স্বর্গীয় অনুভূতি দেয় সেটাকে কীভাবে প্রকাশ করবে ঋষি?
এতক্ষণ আপনমনে কথাগুলো বললেও কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পায় সাদিয়া। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার। কীসব বলে ফেললো সে। জ্বিবে কামড় দেয় সে। আস্তে করে দিতে গিয়ে কামড়টা জোরেই বসে যায়। সে ধুর বলে চেঁচিয়ে উঠতেই উদ্বিগ্নতা দেখা যায় ঋষির গলায়। মধ্যরাতে সূচনা হয় এক নব প্রেম কাহিনীর। দুজনের অজান্তেই।
ঋষি তার নাতী নাতনীর কী নাম দেবে সেসব নিয়ে সাদিয়াকে জ্বালাতন করছে। এদিকে সাদিয়ার রাগে ফোসফাস করাটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে ঋষি।
এই যে কী শুরু করলেন? নিজের লিমিটে থাকেন। আর কীসের নাতী নাতনী?
ঋষি বুঝলো সাদিয়া ভাঙবে তবু মচকাবে না। কথার মার প্যাঁচে দুজনেই প্রবেশ করলো নতুন দুনিয়ায়।
কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গিয়েছে সাদিয়া। খানিকক্ষণ পরে ফোন কেটে দিলো ঋষি। তারপরই ডায়াল করলো রূপমের নাম্বারে। রূপমকে সবটা জানাতে না পারলে মোটেই শান্তি পাবে না ঋষি। আর সে খুব ভালো করেই জানে রূপম বিষয়টা শুনলে ভীষণ খুশি হবে।
ফোনের রিংটোন বাজতেই লাফিয়ে উঠলো রূপম। রিমু কল ব্যাক করেছে ভেবেই আনন্দে নাচানাচি করার জোগাড় রূপমের। অনন্ত যাইহোক একটু তো কথা বলতে পারবে সে। কিন্তু ফোন স্ক্রিনে ঋষির নাম দেখে ভীষণ হতাশ হলো রূপম। সাথে তার মেজাজটাও বিগড়ে গেলো চরম পর্যায়ে। ধুর বাল বলে সে রিসিভ করলো ফোন। তারপর অকথ্য ভাষায় ঋষিকে গালিগালাজ করে কেঁদে ফেললো।
কিচ্ছু বুঝতে না পারে ঋষি কী করবে সেটাও বুঝতে পারছে না।
এই রূপম কী হয়েছে তোর? এভাবে কান্নাকাটি করছিস কেন? সব ঠিক ঠাক আছে তো? আর গালিই বা দিলি কেন? এতো রাতে ফোন দিয়ে আমি কী ডিস্টার্ব করে ফেললাম তোকে? সরি রে। কিছু কথা জানানোর ছিলো।
ঋষির কথা শুনে ভাবান্তর হলো না রূপমের। সে বাচ্চা ছেলেদের মতো করে কাঁদতে লাগলো।
এইবার ঋষি চটে গেলো।
এই মাইয়া মাইনসের মতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্না থামাবি? কী হইছে কস না ক্যান? কাহিনী করো মিয়া? এরপর লাগাতার গালি।
ঋষি চটে যাবে বুঝেনি রূপম। তৃপ্তির সামনে কান্নাকাটি করলে সে তো শুধু স্বান্তনা দেয়। কিন্তু ঋষি তো ছেলে। তারউপর বেস্টফ্রেন্ড। গালিগালাজ শোনা লাগবে এটাই তো নরমাল।
আমি রিমুকে হারিয়ে ফেলছি ঋষি। সম্পূর্ণ নিজের দোষে ওকে হারিয়ে ফেলছি। এখন ওকে ছাড়া থাকবো কী করে? তুই বল! বলনা রে! কথাগুলো বলতে বলতেই হেঁচকি তুলে কান্না।
রূপমের বলা প্রত্যেকটা কথা তীরের মতো বিঁধলো ঋষির বুকে। অপর পক্ষের কান্নাকাটি যেকারো পক্ষেই বিব্রতকর এবং কষ্টদায়ক। তা সে ছেলে কিংবা মেয়ে যেই কাঁদুক না কেন। ছেলেদের কান্না তো আরো বেশি মারাত্মক।
এই রূপম কান্না থামাবি তুই? কী শুরু করলি? তোর যে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করা স্বভাব এজন্যই হয়তো রিমু আসছে না তোর কাছে।
রিমু তো কখনো আমার চোখের জ্বল দেখেনি ঋষি। দেখলে কী পারতো আমাকে ফেরাতে? তুই বল পারতো?
হ্যাঁ পারতো। কারণ তোর কারণে তাকে অনেক কাঁদতে হয়েছে। তাই না পারাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঋষির ঠোঁটকাটা জবাব ভেঙে দিলো রূপমকে।
ফোনটা কাট ঋষি। তোর সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
ঋষি বুঝলো এমন মানসিক অবস্থায় এতটা কড়া কথা শোনানো ঠিক হয়নি। তাই নিজের মন্তব্য পাল্টালো সে।
আরে রিমু ফিরবে তো। মেয়ে মানুষের মনে অনেক দয়া। আগাগোড়া তাদের মায়া, দয়া, ভালোবাসা দিয়ে মোড়ানো। তোর এতো কষ্ট দেখে ফেরাবে না দেখিস।
এই মিথ্যা স্বান্তনা শুনে রূপম ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বললো, ” স্বান্তনা টা শুরুতে দিতে হতো। এখন আর মিথ্যা স্বান্তনায় প্রশান্তি আসবে না। অবশ্য মিথ্যা স্বান্তনা না দিয়ে ঠিকই করেছিস। সত্যি অনেক বেশি তিক্ত হয়। আর এটা যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা সম্ভব ততই মঙ্গল। তবে সত্য তিতা হলেও পরবর্তীতে এই সত্যই সাহস জোগায়। রিমু বোধহয় ফিরবে না রে। আমিও জানিনা কী করবো। ভালো থাক। ”
কথাগুলো বলেই খট করে ফোন রেখে দিলো রূপম। হতবুদ্ধি ঋষি আফসোস করতে লাগলো বন্ধুর মন ভেঙে দেওয়ার জন্য। তার জীবনের সুখসংবাদটাও এই প্রথম রূপমকে জানাতে পারলো না সে। কে জানে সামনে কী হবে।
চলবে,,,