অপ্রিয় সে পর্ব-১৮

0
1700

#অপ্রিয় সে
#সানজিদা সন্ধি
#পর্ব: ১৮

আহানাকে জড়িয়ে ধরেই কান্নায় ভেঙে পড়লো রিমু। তার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আহানা তাকে স্বান্তনা দিতে গেলেই রিমু বলে উঠলো, ” আমি আর পারছিনা আহানা। আমি কী করবো তুই বল। ছোট থেকে আমার সাথে যা যা হয়েছে সেগুলো আমি মেনে নিবো কী করে। এদিকে সাদিয়াকে কীভাবে বশ করলো রূপম খান সেটাই বুঝতে পারছি না। বন্ধুত্বের মধ্যে অহেতুক ঝামেলা আমার বিন্দুমাত্র পছন্দ হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই কষ্ট দিলাম মেয়েটাকে। আমি সত্যিই বাজে আচরণ করে ফেলছি। ”

আহানা ধমক দিলো রিমুকে। তুই কেন বাজে আচরণ করবি রিমু? তুই যা করছিস সেটা করা একদমই স্বাভাবিক। নিজেকে অহেতুক ব্লেম করা বন্ধ কর। তোর সাথে ছোট থেকে যা যা হয়েছে তাতে তো এগুলো কমই হয়ে গেলো। আর সাদিয়াই বা কেন রূপম ভাইকে সাপোর্ট করছে? মানলাম কোনো একটা কারণে তার মনে হয়ে রূপম খান তোকে ভালোবাসে৷ মনে হতেই পারে। তাই বলে যে তোকেও পাল্টা ভালোবাসতে হবে এমন কথা কী লেখা আছে কোথাও? এতদিনের সব অন্যায় হোক বুঝে কিংবা না বুঝে। ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় সব এতো সহজেই মাফ পাওয়ার যোগ্য? রূপম ভাই কী শুধু একমাত্র মানুষ যে তোকে মন থেকে ভালোবাসে? অন্য কেউ বাসে না? তবে সাদিয়া কেন সেই সঠিক মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে না বলে রূপম রূপম বলে চিল্লাচ্ছে? তুই একটু বেশিই আবেগী। যেসব মানুষদের জন্য বাঁশ খাবি তাদের জন্যই পাগল হবি আবার। এখানে তোরেই বা ব্লেম করি কীভাবে? মানুষের স্বভাবই তো এমন। যাদের কাছে বেশি যন্ত্রণা পায় তাদের জন্যই মরিয়া হয়ে ওঠে সমস্ত আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে। এসব বাদ দিয়ে ক্যারিয়ারে ফোকাস কর। মাথা থেকে আজাইরা চিন্তা ভাবনা সরিয়ে ফেল। আর যদি নাও সরাতে পারিস তবে দয়া করে আমার সামনে এসব আজাইরা আবেগ দেখাতে আসবি না।

রিমু বুঝলো আহানার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। তাই কান্না থামিয়ে সে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

রিমুর ফোনটা বেজে যাচ্ছে ক্রমাগত। তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ফোন রিসিভ করলো রিমু। রূপম ফোন দিয়েছে। রিমু সালাম দিয়ে এমন আচরণ করলো যেন অপরিচিত কেউ ফোন দিয়েছে।

রূপম বলতে লাগলো, ” তোর সাথে দেখা করতে চাই রিমু। আহানার বাসার সামনে আছি বের হ তাড়াতাড়ি। ”

নিরুত্তর রইলো রিমু।

কী ব্যাপার? তুই কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না? তোর সাথে কথা বলাটা জরুরি আমার। দেখ তুই আমার উপরে ভীষণ বিরক্ত এটা আমি জানি। আমার উপর তোর এই ঘৃণা, রাগ, বিরক্তি অস্বাভাবিক কিছু নয়। তোর জীবনকে নরক বানিয়েছি আমি। আমার ইন্টেনশন ছিলো না এসবের। বা ইচ্ছে করে তোকে আঘাত করার। আমি করতে চেয়েছি একটা হয়ে গেছে আরেকটা। আমি তোর কাছে আগে মাফ চাইলেও এখন চাচ্ছি না। কারণ আমি জানি মাফ পাওয়ার যোগ্যতা নেই আমার। তোকে আমার সাথে কথা বলতে হবে না। কিচ্ছু করতেও হবে না। আমি জ্বালাবও না তোকে। শুধু তুই একটিবার বের হ রিমু। প্লিজ!

কী ব্যাপার সেলিব্রেটি রূপম খান? আপনি আমার মতো সাধারণ একটা মেয়ের পিছনে ধরনা দিচ্ছেন কেন? আর এতো আজাইরা সময় আপনি কবে থেকে পেলেন? আমার জানামতে আপনি ভীষণ ব্যাস্ত একজন মানুষ। আর শোনেন। আমি আপনার সাথে কস্মিনকালেও দেখা করতে আগ্রহী নই। কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। আমি যথেষ্ট মনযোগী শ্রোতা। খুব মন দিয়ে ভীষণ যত্ন সহকারে আপনার কথা শুনতে রাজি আছি।

রিমু প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর। তোর সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চাই আমি। প্লিজ বের হ একটিবার।

বাপরে এতো করে রিকুয়েষ্ট করছেন। কাহিনী টা কী? আচ্ছা আমি আসছি। আমি আবার মানুষের এতো আকুতি ফেলতে পারিনা। তাও আবার যদি হয় এমন সেলিব্রেটি।

রূপম বুঝলো রিমু সব কথা গুলো তাকে বিদ্রুপাত্মক ভাবে বলছে। অবশ্য সে এসব কিছুরই যোগ্য। তারপরও রূপম খুশি হলো এটা ভেবে যে সামনাসামনি থেকে সে কথা বলতে পারবে রিমুর সাথে।

রিমু ফোন কানে রেখেই গায়ে একটা ওড়না পেঁচিয়ে বাড়ির বাহির হলো। এতো অনুরোধ তার ফেলতে ইচ্ছে হলোনা। রূপমের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রিমু হাত নাড়ালো। বাইরে থেকে গাড়ির ভেতরের কিছু বোঝা না গেলেও ভেতর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। আর রিমু জানে রূপম আহানার দরজার দিকেই এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রূপম গাড়ি থেকে বের হলো। তার শরীরে ব্ল্যাক কালারের একটা হুডি। মাথা ঢাকা টুপি দিয়ে। মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস।

রূপমের গেট আপ দেখে খানিকটা হাসি পেলো রিমুর। আবার খানিকটা কষ্টও পেলো সে। এই গরমের মধ্যে ছেলেটাকে হুডি পরে ঘুরতে হচ্ছে। সেলিব্রেটি বলে কথা। কোনো ভক্ত দেখলেই তো ঝাঁপিয়ে পরবে প্রিয় ব্যাক্তিত্বের মুখ দর্শনে। তাই এমন সাজ। রিমু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। যে মানুষটা হাজার হাজার মানুষের এতো প্রিয়। তাকেই সহ্য করা সম্ভব নয় রিমুর জন্য। একজন মানুষ কখনোই সবার প্রিয় হতে পারে না।

রূপম গাড়ি থেকে বের হয়েই রিমুর কাছাকাছি চলে এলো। আহানার বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা ধরে হাঁটলেই একটা শিশু পার্ক আছে। রূপম ভাবলো সেখানে গিয়েই কথা বলবে।

রিমু গাড়িতে উঠে আয়। পার্কটাতে গিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আর তোকে বেশ খানিকটা সময় দিতে হবে আমাকে। পারবি তো?

হ্যাঁ পারবো। আর পাঁচ মিনিটের রাস্তা আমি গাড়িতে যেতে পারবোনা। আপনি বরং গাড়ি নিয়ে যান আমি একাই আসছি হেঁটে।

রিমুকে আর কোনো জবাব না দিয়ে রূপমও হাঁটতে শুরু করলো রিমুর সাথে। রূপমের মনে হলো, এই পথ যদি অনন্তকালের জন্য চলতো। তবে তার চেয়ে সুখী বোধহয় আর কেউ হতো না।

পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে রিমু। বেঞ্চটার সামনেই একটা আমগাছ। আম গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রূপম।

রিমু! আস্তে করে ডাকলো রূপম।

জি। যা বলার বলুন। আমি শুনছি। কী এমন জরুরি কথা যেটা না বলতে পেরে হাসফাস করছেন আপনি।

মাথাটা অর্ধনমিত করে রূপম বললো আমি তোকে ভালোবাসি রে।

তাতে আমি কী করতে পারি? রিমুর কড়া জবাব।

তোকে কিছু করতে হবে না। আমি তোকে ভালোবাসি শুধু এটাই জানি। দেখ রিমু ছোট থেকে তোর সাথে যা যা করেছি সবকিছুর উদ্দেশ্য আমার দৃষ্টিতে। আই রিপিট। আমার দৃষ্টিতে ভালো ছিলো। এই যেমন তোর চুল কাটা। আমি জানি এটা তোর দূর্বলতা। এখানে আঘাত করায় তুই মানসিক আঘাত পেয়েছিস। কিন্তু আমি তোর চুল কাটানোর ব্যাবস্থা করেছিলাম যাতে চুলের কারণে ঠান্ডা বাঁধিয়ে তুই বড় সড় অসুখ না বাঁধাস। বিষয়টা আমার দৃষ্টিকোণ থেকে ভালো ছিলো। কিন্তু এটা তোর মানসিক স্বাস্থ্যহানী করেছে। এছাড়া আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলো তোর ভালোর জন্য করতে গিয়ে পক্ষান্তরে তোর খারাপই করে ফেলেছি। আমি তো জীবনের অনেক সুন্দর সময় নষ্ট করেছি। আমার অনিচ্ছায়। এখন তোর বাকি জীবনটা আমি আলোয় রাঙিয়ে দিতে চাই। তুই কি দিবি আমাকে সেই সুযোগটা? আজীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো।

রিমু থামিয়ে দিলো রূপমকে। আমি বুঝতে পারলাম আপনি আমার ভালো করতে গিয়ে পক্ষান্তরে খারাপ করে ফেলেছেন। কিন্তু খারাপ তো হয়েইছে আমার তাইনা? সেসব কী পারবেন ফিরিয়ে দিতে? কিছু জিনিস কখনোই ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আমার বাকি জীবনটা আমি নিজের আলোয় আলোকিত করতে চাই। সেখানে আপনার ভূমিকা কখনোই কাম্য নয় আপনার। আমি শ্রদ্ধভরে আপনার প্রেম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। আর কিছু বলার আছে কী আপনার?

রূপমের চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। জ্বালা করছে তার দুটো চোখ। মনে হচ্ছে দু এক ফোঁটা এখনই টুপ করে ঝড়ে পড়বে। সানগ্লাসের আড়ালে থাকায় তার চোখদুটো কারো দৃষ্টিগোচর হলো না।

রূপম মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো, “রিমু, ও রিমু। মাফ করে দে না রে। ”

রিমু কর্ণপাত করলোনা রূপমের কথায়। আপনার আর কিছু বলার না থাকলে আমি উঠতে চাই। বাসায় যাবো। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন। অতিথি আপ্যায়ন ভালোই করবো।

রিমু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রূপম চেঁচিয়ে বললো, ” রিমু! ভালোবাসি তো। ”

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে