অপ্রিয় সে পর্ব-১০

0
1750

#- অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ১০

আরিয়ান নামের একটা ছেলে তাকে একের পর এক মেসেজ আর ফোন দিয়ে যাচ্ছে। রিমু আরিয়ানকে খুব ভালো করে চেনে। সে যখন ক্লাস সেভেনে পড়তো তখন থেকে এই আরিয়ান তার পেছনে আঠার মতো লেগে আছে। রিমুকে না হলেও হাজার বারের মতো প্রেম প্রস্তাব দিয়েছে। তবে কখনো রিমুর থেকে আশানরূপ উত্তর মেলেনি তার। বারবার প্রত্যাখিত হয়েও রিমুর পিছু ছাড়ার যেন নাম-গন্ধই নেই তার।

রিমু নজরকাড়া সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই অসংখ্য প্রেম প্রস্তাব পেয়ে এসেছে। কত শত ছেলে তার পেছনে পাগলের মতো ঘুরেছে। তার প্রত্যাখান পেয়ে যে কতজনের মন ভেঙেছে তার হিসাব নেই। তথাকথিত প্রেম প্রস্তাবে ভরপুর রিমুর জীবন। সবার থেকেই সে একটা কথা শুনেছে, ” ভালোবাসি।” তবে রিমু প্রচন্ডভাবে অনুভব করেছে কেউ তাকে ভালোবাসেনি। কারণ প্রত্যেকের কারণেই সে মানসিক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। সবাই তার রূপের মোহে ক্ষনিকের জন্য রিমুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। রিমুর কানে অনেক সময় এমন কথাও এসেছে যেই ছেলেটা কয়েকদিন আগেও তাকে পাওয়ার জন্য পাগলামি করতো সেই ছেলেটাই প্রত্যাখিত হওয়ার পরে সবাইকে বলেছে রিমু না কি ভালো নয়। সবকথা রিমুর কানে এসেছে। রিমু শুধু মুচকি একটা হাসি দিয়ে চুপচাপ থাকতো। ভালোবাসি কথাটা সবাই বলতে পারে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে কজন? যদিওবা সবাই সমান নয়। ভালো, খারাপ সবকিছুতেই আছে।

রিমু ভার্সিটিতে ওঠার পর পরই কোনো এক অজ্ঞান কারণে আরিয়ান হুট করেই হারিয়ে যায়। আবার আজই সে পাগলের মতো একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে রিমুকে। রিমু ফোনটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময়ই আরিয়ান মেসেজ লিখলো, ” প্লিজ রিমু ফোনটা ধরো। আমি আরিয়ান। তোমার ভীষণ চেনা! ”

খুব জটিল কিছু ভেবে রিমু কল ব্যাক করলো। সাথে সাথে আরিয়ান বলতে লাগলো, ” প্লিজ রিমু যাই হোক না কেন তুমি রূপমকে বিয়ে করো না। আরিয়ানের গলার স্বরে তীব্র অস্থিরতা টের পেলো রিমু। এই কথার প্রতিত্তোরে সে কিছু না বলে সালাম দিলো আরিয়ানকে। সালামের জবাব দিয়ে সে একটু লজ্জিত বোধ করলো। এমন পাগলামি শুরু করেছিলো যে সালাম বিনিময় করতেও ভুলে গিয়েছিলো।

সালাম নেওয়ার পরে বেশ কিছুক্ষন আরিয়ানকে চুপ করে থাকতে দেখে রিমু বললো, ” আমি কী কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? আর আপনি এতদিন পরে হুট করে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। ”

আরিয়ান ভেবেছিলো, ” ফোন ধরে রিমু হয়তো ভীষণ কড়া কথা শোনাবে তাকে। ” কিন্তু আরিয়ান তো জানেই না রিমু ভীষণ রেগে না গেলে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। রিমু খুব কমই রেগে যায় কারো প্রতি। মানুষকে সে সহজে ঘৃণাও করতে পারে না। কিন্তু একবার যার উপর থেকে তার মন উঠে যায় পরবর্তীতে তাকে আপন করে নিতে অনেক সময় লাগে রিমুর।

আরিয়ানকে চুপ করে থাকতে দেখে রিমু আবার বলে ওঠে, ” কী হয়েছে বলবেন কী?”

আরিয়ান এক নিঃশ্বাসে বলতে শুরু করলো, ” দ্যাখো রিমু আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা তুমি জানো। আমি তোমাকে বিয়ে করবো। আমি এবং শুধুই আমি। অন্য কেউ নয়। তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো রিমু। আমাকে আর মেরে ফেলোনা। ”

রিমু মনযোগ দিয়ে সবটা শুনে বললো, ” দেখুন জন্ম, মৃত্যু কিংবা বিয়ে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক
পূর্ব নির্ধারিত। তিনি যা চান সেটাই হবে। তবে আপনার অবগতির জন্য আমি জানিয়ে দিচ্ছি যে রূপম খানকে আমি বিয়ে করবোনা।

আরিয়ান যেন শান্তির প্রশ্বাস ফেললো। অতি উত্তেজনায় আরিয়ান আরেকটা কাজ করে বসলো। সে বললো, ” তোমার থেকে কতদিন দূরে থাকতে হয়েছে। তোমাকে ছেড়ে থাকার দিনগুলো আমার জন্য ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু কী করবো বলো! নয়তো রূপম খান আমার লেখাপড়ায় বাঁধা দিতো। ”

আরিয়ানের কথা রিমু কিছুই বুঝলো না। সে বললো রূপম খান কী করেছে? আর তার জন্য কেনই বা আপনার আমার কাছ থেকে দূরে যেতে হয়েছে?

আরিয়ান ভারী গলায় বললো, ” রূপম আমাকে থ্রেট দিয়েছিলো যেন তোমার আশেপাশে না আসি। নয়তো সে আমাকে মেরে ফেলবে। তাই এতদিন তোমার থেকে দূরে থেকে লেখাপড়াটা কমপ্লিট করছিলাম। কিন্তু যেদিন তোমার আর রূপম খানের বিয়ের বিষয়টা আমি নিউজপেপারে দেখেছিলাম সেদিন মনে হচ্ছিলো কেউ যেন আমার কলিজায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছিলো। কী করবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ তোমার সাথে দেখা করতে তোমার বাড়ির সামনে যাই। বিষয়টা রূপম জেনে ফেলে কোনোভাবে। সে আমাকে আবার থ্রেট দেয়। আমি বাসায় এসে কয়েকঘন্টা পাগলের মতো কেঁদেছি শুধু। তোমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবো ভেবে। আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছি যেন তোমাদের বিয়েটা বন্ধ হয়। দেখো আল্লাহ আমার কথা শুনেছে। এবার আর ভয় পাবোনা। তোমাকে সম্পূর্ণ আমার করে নিবো। যা হয় হোক।

রূপম আরিয়ানকে থ্রেট দিয়েছিল এই বিষয়টা কেন জানি আষাঢ়ে গল্প মনে হচ্ছে রিমুর কাছে। রূপম কেন আরিয়ানকে রিমুর কাছ থেকে দূরে থাকতে থ্রেট দিবে? এতে কিইবা লাভ আছে তার। কিন্তু আরিয়ানের গলা শুনে রিমুর মনে হচ্ছে সে যা বলছে তা সত্যি। রিমুর মন আর মাথার ভেতরে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব বেজে গেলো। মন বলছে আরিয়ান সত্যি বলছে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে আরিয়ান মিথ্যা বলছে। রূপম কেন তাকে থ্রেট দিবে? অবশেষে মনের কথাকে সায় দিয়ে রিমু আরিয়ানকে সরাসরি বললো, ” আমাকে যদি পেতে চান তবে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিন। ” কথাটা বলার সময় রিমু বুঝলো তার শরীরের শক্তি হয়তোবা নিঃশেষ হয়ে আসছে। এদিকে আরিয়ান খুশিতে পাগলপ্রায়। সে পরদিনই আসবে বলে জানিয়ে দেয়।

এ কথা শুনেই রিমু কল কেটে ফোন অফ করে রাখে। তার মাথায় হঠাৎই আবার একটা প্রশ্ন আসে। মন জিজ্ঞেস করছে, ” রূপম তোর কে?” রূপম রিমুর কী হয় রিমু বোধহয় নিজেও জানেওনা। সব সম্পর্কের উর্ধে গিয়ে রিমু নিজেকে জবাব দিলো, ” রূপম ভাই আমার ‘অপ্রিয় সে ‘। আর কেউ নয়।”

রিমুর সুইসাইড এটেম্প্ট নেওয়ার বিষয়টি ঋষি সবাইকে জানিয়ে দেয়। সবাই হুড়মুড় করে রিমুর ঘরে আসতে থাকে। এতজনকে একসাথে দেখে রিমু ভাবতে থাকে সে আবার কী দোষ করলো। কিন্তু খানিক পরেই এ চিন্তা তার মাথা থেকে বের হয়ে যায়। সবাই এসেছে রিমুর প্রতি তাদের ভালোবাসা জাহির করতে। রিমু সবার আচরণে ভীষণ ভড়কে যায়। সবার হলোটা কী! এত ভালোবাসা কেন দেখাচ্ছে সবাই?

রেহনুমা বেগম এসে রিমুর হাত দুটো চেপে বলে, ” ঋষির কাছে শুনলাম তুই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলি রিমু। এটা কী করে করতে পারলি? একবারো ভাবলি না তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা বাঁচবো কীভাবে? ”

রিমু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, ” এ কেমন আজব ব্যাপার মা! বেঁচে থাকতে যাকে কখনো গুরত্ব দাওনি সে মরে গেলে তোমাদের তো একটুও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এসব কথা বলে তোমরা কী অপমান করছো না আমাকে? এতো ভালোবাসা কেন জানি না নিতে পারছিনা। আর ভয় পেওনা তো। আমি তো মরিনি। মরলেও বা কী হতো! শুনো মা। বেঁচে থাকতে মানুষের কদর করতে হয় যেন সে বেঁচে থাকার আশা খুঁজে পায়। মরার পরে হা হুতাশ করে লাভ নেই। আর আমরা ভীষণ আজব জাতী বুঝলে? বেঁচে থাকতে মানুষের কদর করিনা। অথচ মরে গেলে আমাদের কতো শোক পালন। এসব আমার লোক দেখানোই লাগে।

রেহনুমা বেগম সহ সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। রিমুর বলা প্রতিটা কথা তাদেরকে ক্ষত বিক্ষত করছে। রিমু বড্ড বেশিই অবহেলিত হয়েছে। সবাই সেটা বুঝতেও পারছে। তবে রিমুর মনে যে বাজে প্রভাব পড়েছে তার কোন প্রায়শ্চিত্ত করলে কাটবে জানে না কেউ। রেহনুমা বেগমের সাথে কথা শেষ করেই রিমু বললো, ” আমি সম্পূর্ণ সুস্থ সবল আছি। আমাকে নিয়ে এতো বেশি ভাবতে হবে না। আমাকে একা থাকতে দাও।

সবাই ঘর থেকে চলে যেতে উদ্যত হলো। সবার অনেক কথা বলার ছিলো রিমুর সাথে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। এতকিছুর পরও রিমুর অবচেতন মন একবার বোধহয় রূপমের দেখা পেতে চেয়েছিলো। কিন্তু রূপম তো আসলো না।

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে