অপ্রিয় সে পর্ব-০৯

0
1731

#-অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#-পর্বঃ৯

সিলিং ফ্যানটাকে আজ বড্ড বেশি আপন মনে হচ্ছে রিমুর। ছোট থেকে অবহেলা যেন তার নিত্যসঙ্গী। রিমুর জীবনে অনেক মানুষ এসেছে আবার চলেও গিয়েছে। অসংখ্য প্রিয় বস্তু তার কাছে এসেছে আবার নষ্টও হয়েছে । এগুলোর কোনোটার স্থায়িত্বই অবহেলার মতো দীর্ঘমেয়াদি নয়। সেই ছোটবেলা থেকে অবহেলা ওই যে তাকে আপন করে নিলো! আজ অবধি ছাড়লো না। সে বোধহয় রিমুর মায়ায় পড়ে গিয়েছে। আজীবনের সঙ্গি হতে চায় তার। তাই এতো কাল ধরে আগলে রাখছে তাকে।

গলায় থাকা জর্জেটের ওড়নাটা ফ্যানের সঙ্গে পেঁচিয়ে গলায় দিলো রিমু। তার পা এখন খাটের ওপরে থাকা একটা টুলের ওপর।

প্রেস কনফারেন্স শেষে ঘরে এসে হাঁপ ছাড়লো রূপম। সবাই তাকে এমন ভাবে চেপে ধরেছিলো যে মনে হচ্ছিলো সে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে। জীবনে প্রথমবার এমন পরিস্থিতিতে পড়ে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত । এতকিছু যার কারণে হয়েছে তার মতামত নেওয়ার জন্য যখন মিডিয়ার লোকেরা রূপমকে ফোর্স করছিলো তখন মিশ্র অনুভূতিতে সে স্তব্ধ পাথর। তবে একটা জিনিস তার মাথায় ঢুকছেনা। একটা রাত সবকিছু কী করে চেঞ্জ করে দিতে পারে?

কিছু কিছু মানুষের মানসিকতায় নির্দিষ্ট কিছু জিনিস বা আচরণের প্রতি রাগ বা বিরক্তি বোধ থাকে। তার মধ্যে রূপমের যে বিষয়টা বিরক্ত লাগে সেটা হচ্ছে কলার ধরা। রিমু যেদিন রূপমের কলার চেপে ধরেছিলো সেদিন তার রাগ হয়েছিলো। রিমুর থেকে এই ধরনের আচরণ তো অকল্পনীয় তার কাছে। সেই রিমুই কলার চেপে ধরে যখন রূপমের উপর জোর গলায় কথা বলেছিলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলো রূপম।

তবে চিরকুটটা রূপমই দিয়েছিলো রিমুকে। এটা তার বাম হাতের লেখা। সে দুই হাতেই লিখতে পারে। এবং বিষয়টা সে ছাড়া কেউই জানে না। যেটার ফায়দা সে তুলেছে। সে রেগে না গেলে হয়তোবা স্বীকার করতো৷ যা হবার হয়ে গিয়েছে ভেবে সে এসি ছেড়ে দিয়ে ধরাম করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

বাহিরে রৌদ্রের ঝাঁজে চোখ মেলে তাকাতেও সমস্যা হচ্ছে সাদিয়ার। সে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকাতে নিলেই চোখে আলো এসে পড়ছে তার। আজকের দিনটা তার জন্য ভীষণ গুরত্বপূর্ণ। রিমু যে শেষ অবধি তার ভুলটা শুধরে নিয়ে নিজেকে ভালোবাসতে শুরু করছে এটা তার জন্য ভীষণ প্রশান্তির বিষয়।

কিছু মানুষ থাকে তারা যেখানেই যাক না কেন সবার সমস্যা সমাধান করে দেয়। অথচ তাদের নিজের জীবনই সমস্যায় ভরপুর। সবাইকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেয়। সবার প্রচন্ড খেয়াল রাখে অথচ মানুষ তার থেকে শুধু ভালোবাসা আর যত্ন নিয়েই যায়। বিনিময়ে তাকে খুব কম ভালোবাসা দেয়। সাদিয়ার জীবনে এই রকম মানুষটা হলো রিমু। যেদিন থেকে রিমু আর সাদিয়ার বন্ধুত্ব হয়েছে সেই দিন থেকে রিমু তার সবটুকু দিয়ে সাদিয়াকে আগলে রেখেছে। রিমু সাদিয়ার জন্য যা যা করেছে সেটা সাদিয়া কখনোই ভুলতে পারবেনা। পক্ষান্তরে সাদিয়া কখনো রিমুর কোনো কাজে আসতে পারেনি। তবে সাদিয়া যে রিমুকে ভালোবাসে এটা সে নিশ্চিত।
পেছন থেকে কারো ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো সাদিয়া । ঋষি ডাকছে তাকে। সাদিয়া ঋষির দিকে তাকাতেই বাচ্চাদের মতো মুখ করে খানিকটা অভিযোগের সুরেই ঋষি বললো, ” আপনি তো ভীষণ পাষন্ড! আমাকে ফেলে দিয়ে কোমড় ভেঙে দিলেন অথচ একবারো খোঁজ নিলেন না? ”

রিমুর কথা ভাবার মুহুর্তে ঋষির আগমন আর অহেতুক বাড়িয়ে কথা বলায় রিমু চোখ মুখ কুঁচকে বললো, ” এ কেমন বিচার! এই তো আপনি দিব্যি দাঁড়িয়ে আছেন। কোমড় ভাঙলো নিশ্চয়ই এখন আমার সামনে না থেকে আপনাকে হসপিটালে থাকতে হতো। অ্যাম আই রাইট মিস্টার ঋষি চৌধুরী? ”

ঋষি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সে বুঝলো এই মেয়ের মাঝে কিছু তো স্পেশাল আছেই। অন্য কোনো মেয়ে হলে ঋষি চৌধুরী তার সাথে কথা বলছে ভেবেই সারারাত ঘুমাতে পারতো না আর সাদিয়া তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বিষয়টা ঋষিকে আকর্ষিত করে তুললো সাদিয়ার প্রতি।

সাদিয়া আগের মতোই ভ্রু কুঁচকে বললো, ” আপনি এখান থেকে যান তো মশাই! না জানি কখন কোন রিপোর্টার কি নিউজ করে দেয়।”

ঋষি আর কিছু বলার আগে সাদিয়াই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

রিমুর হাত কাঁপছে। সবকিছু একে একে মনে পড়ছে তার। সে ভাবছে কীভাবে মানুষ পারে একটা মানুষকে এতো যন্ত্রণা দিতে যাতে সে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে চায়? শেষবার সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চেয়ে যেই সে গলায় ফাঁস দিতে যাবে অমনিই কোথায় থেকে যেন ঋষি চলে এলো। রিমুর ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। নিজের মন মানসিকতার উপর এতোটাই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে রিমু যে ঘরের দরজা না আটকেই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলো। ঋষি রিমুকে ধরে টুল থেকে নামানোর পরপরই প্রচন্ড রেগে থাপ্পড় মারতে গিয়েও থেমে গেলো। নিজেকে শান্ত করে আস্তে সে বললো, ” সরি!”

রিমুর এখন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে কয়েক সেকেন্ডর জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলো। হুস ফিরেছে তার৷ একটু আগেই অভিমান , রাগ, জেদের কারণে সে কী জঘন্য পাপটাই না করতে যাচ্ছিলো৷ আল্লাহর হুকুমে ঠিক সময়ে ঋষি চলে এসেছিলো। নয়তো কী যে হতো।

ঋষি রিমুর দিকে তাকিয়ে বললো, ” এসব কী রিমু? আপনার মতো মেয়ে কী করে এই ধরনের কাজের দিকে ধাবিত হওয়ার কথা ভাবতে পারে? আপনি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন? এটা কতটা জঘন্যতম পাপ আপনি জানেন না? আমি আপনার সম্পর্কে এতদিন যা যা শুনেছি সবটাই কী তাহলে ভুল? শুনেন! আমি রূপম, আপনাদের পরিবার সম্পর্কে কমবেশি অনেক কিছুই জানি। যতটুকু শুনেছি রূপম আপনাকে অনেক যন্ত্রণা দেয়। সে নিজেই স্বীকার করেছে। আপনি সব সহ্য করেও শক্ত থাকতেন। কখনো নিজের ক্ষতি করার কথা ভাবেননি। তাহলে এখন যখন নিজের কথা ভাবার পথে চলেছেন তখন কেন এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলেন? এতো সাহস কে দিয়েছে আপনাকে?”

রিমু কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। তবে এতটুকু এই মুহুর্তে তার মাথায় আছে সে যা করতে যাচ্ছিলো সেই স্টেপ নেওয়ার কথা ভাবাও মহাপাপ হয়েছে তার। জীবনটা তো সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সেরা একটা উপহার। আল্লাহর আমানত। তবে সে কী করে পারলো এসব ভাবতে?

নিম্ন সুরে রিমু বললো, ” ভাইয়া কেউ যখন নিজের জীবনের উপর ভীষণ বিরক্ত হয় তখনই সে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। যাইহোক
যেটা বলছিলাম আমি ভুল করতে যাচ্ছিলাম। আপনি সেখান থেকে বের হতে সাহায্য করলেন তার জন্য ধন্যবাদ।

ঋষি ঘর থেকে চলে গেলো। তবে রিমু ভেঙে পড়লো একেবারে। জায়নামাজ বিছিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

আত্মহত্যার প্রবণতা কমবেশি অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। যারা নিজের জীবনের উপর হতাশ, বিরক্ত মানুষেরাই এমন করে। কিন্তু আত্মহত্যা কখনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। এতে হয়তো পৃথিবীর সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব কিন্তু পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আল্লাহ লিখে রেখেছেন। আত্মহত্যা যারা করে তাদের পরিবারের মানসিক অবস্থা খারাপ হয়। আশেপাশের মানুষজনের কথা তো আছেই।
সেজদারত অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লো রিমু। আল্লাহর কাছে বারবার সে চাইছে আল্লাহ যেন তাকে ধৈর্য ধরার শক্তি দেন। রিমুর মনে একটা প্রশ্ন প্রায়ই জাগে। আল্লাহ কেন তাকে এতো বেশি কষ্ট প্রদান করেন। পরে সে নিজেই নিজেকে উত্তর দেয় আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা করেন। এটা ভেবেই সে একটু প্রশান্তি পায় মনে। হুট করে রিমুর ফোনে ক্রমাগত মেসেজের শব্দ আর অসংখ্য ফোনকল আসতে থাকে। রিমু উঠে ফোনটা হাতে নেয়। ফোনের ওপারে থাকা মানুষটার মেসেজ দেখে রিমুর মনে হচ্ছে মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে