অপ্রিয় সে পর্ব-০৮

0
1763

#-অপ্রিয় সে
#-সানজিদা সন্ধি
#-পর্বঃ৮

রূপম কল্পনাও করতে পারেনি তার সাথে এমন কিছু হবে বা রিমু এমন কিছু করবে। তবে মানুষ সবসময় যা ভাবে তা আসলে হয়না৷ রূপম রিমুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবছে একরাতের মধ্যে রিমুটা কতখানি বদলে গেলো। শান্তশিষ্ট, অভিমানী, কষ্ট পুষে রাখা মেয়েটা হয়ে গেলো একদম রাগী,বদমেজাজি আর প্রতিবাদী মেয়ে।

রিমু বোধহয় রূপমের মনের কথা বুঝতে পারলো। সে ভারী গলায় বললো, ” রূপম ভাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সবাই ঘুরে দাঁড়ায়। আমার দেয়ালে পিঠ আগেই ঠেকে গিয়েছিলো কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হয়নি। তবে এখন মনে হচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানো ভীষণ প্রয়োজন।

রূপম হকচকিয়ে গেলো । আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য দিন। না জানি কতকিছু সহ্য করতে হবে তাকে। তবে কিছু করারও নেই। সে ঠিক করলো কোনোমতে ফ্রেশ হয়েই প্রেসের সামনে যাবে। কারণ যা হওয়ার তা হবেই। ভাগ্যে যা নির্ধারিত আছে তা কেউ ঠ্যাকাতে পারবে না। তাই যা হওয়ার আগেই হোক৷

রিমুর আর ভালো লাগছিলো না রূপমের ঘরে থাকতে। সে চলে যেতে উদ্যত হলেই রূপম তার হাত ধরে হেঁচকা টানে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। রিমু প্রথম কয়েক সেকেন্ড স্তম্ভিত হয়ে রইলো। কারণ রূপম তাকে কখনো এভাবে স্পর্শ করেনি। রিমুর মনে হলো তার যেন প্রচন্ড রকমের জ্বর আসছে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে রূপমকে ধাক্কা দিলো সে। বেকায়দায় ধাক্কা খেয়ে খাটে গিয়ে পড়লো সে। রূপম এবার কিছু বলতে যাবে তখনই একপ্রকার চিৎকার করে রিমু বলতে লাগলো, ” আপনার সাহস হয় কী করে আমার গায়ে স্পর্শ করার? কোন সাহসে হাত ধরে বুকের কাছে নিলেন? আমি কি আপনার বিবাহিত স্ত্রী না কি যে আমাকে এভাবে স্পর্শ করার অধিকার রয়েছে আপনার? ”

রূপমও রেগে গিয়ে বললো, ” আগে বোধহয় তোকে স্পর্শ করিনি? এতো ওভার রিয়্যাক্টের কী আছে? ”

রিমু তার কন্ঠস্বর দ্বিগুণ করে বললো ওভার রিয়্যাক্ট মানে? আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন অথচ আমি কিছু বলবো না? শোনেন অনধিকার চর্চা করতে আসবেন না খবরদার। কাজিন কাজিনের মতো থাকুন। আমার কারো স্পর্শ সহ্য হয়না। আর কী যেন বললেন! আগেও স্পর্শ করেছেন তবে তা একান্তই স্বাভাবিক ভাবে বা আমাকে প্রহার করার উদ্দেশ্য। তবে আজকে যেটা করলেন সেটাতে আমি একদমই ভালো ফিল করিনি । নেক্সট টাইম এই ধরনের আচরণ করলে আমি কিন্তু খারাপ হতে বাধ্য হবো৷ আশা করি নিজের সীমা অতিক্রম করবেন না। ”

রূপম এবার হতাশ হয়ে গেলো। ভালো লাগছে না কিছু তার। কেউ কখনো তার সাথে এই ধরনের আচরণ করেনি। তবে অন্য কেউ হলেও মানতে পারতো রূপম৷ কেন যেন রিমুর থেকে এই ধরনের আচরণ সে সহ্যই করতে পারছেনা। কোথাও একটা ভীষণ অপমানিত বোধ করছে সে আর কোথাও যেন অসহায় বোধ করছে।

রিমু রাগে ফোসফাস করতে করতে চলে গেলো। রূপম ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।

রূপমের চারপাশে এখন অসংখ্য ক্যামেরা। সাংবাদিকদের অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সে অসহায় বোধ করছে। রূপমের কাছে ক্যামেরা, সাংবাদিক, হাজার মানুষের ভীড় কোনো বিষয়ই নয়। এসব হ্যান্ডেল করে সে অভ্যস্ত। তবে আজকের বিষয়টা সম্পূর্ণ অন্যরকম। রিমু যে কাজটা করেছে তাতে রূপমের দিকে আঙ্গুল ওঠা খুব স্বাভাবিক। সবার মনে প্রশ্ন আসাটাও স্বাভাবিক যে কোনো ঘাপলা না থাকলে কী কেউ বিয়ে ভাঙে? আর সেটা বিয়ের দিন সকালেই?

সাংবাদিকদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,” স্যার আপনি বিয়েটা খুব একটা জমকালো ভাবে আয়োজন করেননি যতটা হওয়া উচিত ছিলো। কাছের মানুষজন আর বাহিরের সামান্য কিছু মানুষ নিয়েই আয়েজন করেছিলেন। এর কী বিশেষ কোনো কারণ আছে? ম্যাম কী আগে থেকেই বিয়েতে নাখোশ ছিলো? বা এই বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা? স্যার প্লিজ অ্যানসার দিন। ম্যাম আজকে কেন বিয়ে ভেঙে দিলো? ”

রূপম কোনো উত্তর দিতে পারলোনা। কী বলবে সে? কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সে বললো, ” বিষয়টা একান্তই পারিবারিক। আমাদের মধ্যে কিছু মিসঅ্যান্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। খুব শীঘ্রই রিমুকে আমার স্ত্রী রূপে দেখবেন ইনশাআল্লাহ। ইনশাআল্লাহ বলার মধ্যে সবাই ভীষণ অদ্ভুত একটা জোর পেলো সবাই। ”

সাংবাদিকদের কাজই হচ্ছে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তথ্য বের করা। তাই তারা একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে থাকলো। রূপম ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। মেজাজ খুইয়ে যাচ্ছে তার। জীবনে প্রথমবার এরকম অপমান, লাঞ্ছনা এবং অবাঞ্ছিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার। তার ভেতরটা জলে পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু প্রকাশ করতে পারছেনা। হাসিমুখে সবটা সামলাতে হচ্ছে তাকে। মানুষের জীবন একেক সময় একেক পরিস্থিতিতে দাঁড় করায় তাকে। কখনো ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে গেলেও হাসিমুখে থাকতে হয়। আসলে এই হাসির আড়ালে কষ্ট লুকানোর অনুভূতিটা জঘন্য।

রিমুর আজকে ভেতর থেকে ভীষণ ভালো অনুভূত হচ্ছে। কানে হেডফোন খুঁজে সে গানে মত্ত হলো।

টুপ টাপ গুপ চুপ চাপ
টুপ টাপ খুব চুপ চাপ
আমি জানি একা নদী
অভিমানী তার চোখ
সাবধানে থাকি যদি
কথা নয় নাই হোক
পারিনা, ছাড়িনা (২)
পারিনা তার নাম
এ বোবা ঠোঁটে থাক
ঘুম ঘুম মৌসুম
ঘুম সুম এ মর্সুম
আমি জড়িয়ে থাকি যাতা
গায়ে লেগে ডাক নাম
বাজে ছড়িয়ে ফেলি যাতা
মুঠোর বাদাম
পারিনা, ছাড়িনা
পারিনা তার নাম
এ বোবা ঠোঁটে থাক।

গানটা শুনলেই অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে রিমুর। ভীষণ ভালো লাগে তার। অরিজিৎ এর গলায় যাদু আছে। মানুষকে আকর্ষিত করার জন্য যথেষ্ট। কানে হেডফোন থাকায় বাহিরের জগতে মন ছিলোনা৷ এদিকে তার মা রেহনুমা বেগম তাকে সমানে ডেকেই চলছেন। একপর্যায়ে তিনি রিমুর কান থেকে হেডফোন খুলে সেটাকে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন। রিমুর প্রচন্ড রাগ উঠলো। কিছু সে চুপ করে রইলো। হাজার হোক মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার কিছুতেই সে করতে চায়না। তবে তার যে পরিমাণ রাগ উঠছে তাতে সে হয়তো আজকে একটা অকাজ করেই বসবে।
রেহনুমা বেগম স্থির গলায় বললেন, “রিমু তুই না কি রূপমকে ধাক্কা দিয়েছিস? ”
কথা বাড়ানোর ইচ্ছে না থাকায় রিমু ছোট্ট করে জবাব দিলো ” হু।”

রেহনুমা বেগম একপ্রকার তেড়ে এলো তার দিকে। রিমু আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। আবারো চেঁচিয়ে উঠলো। বললো, ” তোমাদের গুণধর ছেলের প্রেস কনফারেন্স শেষ হলো বুঝি? তা কী কী ফেস করলো সে? এতো এতো প্রশ্নের জাঁতাকল আর সন্দেহের তীরের স্বাদ কেমন ছিলো? বাই ওয়ে তোমাদের ছেলের তো মেয়েলি স্বভাব। কোনো কথা পেটে চেপে রাখতে পারেনা। তা কেন ধাক্কা দিয়েছি সেটা নিশ্চয়ই বলেছে?

রেহনুমা বেগম বললো, ” না সে বলেনি!”

রিমু হেসে বললো মা ঘর থেকে বের হয়ে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।
রেহনুমা বেগম বললেন, ” ভালোই বেয়াদব হয়েছিস ভালোই। মায়ের সাথে কেমন আচরণ করতে হয় ভুলে গিয়েছিস?”

রিমুর সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় সে নিজেই নিজেকে আঘাত করলো রুমে থাকা একটা লাঠি দিয়ে। রেহনুমা বেগম কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। রিমুর আচরণ দেখে রেহনুমা বেগম অত্যাধিক কষ্ট পেয়েছেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্তানের বাজে আচরণ দেখলে সব বাবা মা আঘাত পায়। রেহনুমা বেগম ঘর থেকে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলেন আর রিমু ধরাম করে দরজা বন্ধ করে নিজেকে আঘাত করতে লাগলো। সে নিজের জীবনের উপর বিরক্ত। ভীষণ রকম বিরক্ত। একপর্যায়ে তার নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়ার ইচ্ছে হলো। একদৃষ্টিতে সে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে