#- অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ৬
বাসার সবাই রিয়াজুল করিমের ঘরে মিটিং বসিয়েছে। রূপম আর রিমুর ঝামেলা দেখতে দেখতে হতাশ তারা। এখন মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি না করলেও হতো।
রূপমের বাবা শিহাব খান বলে উঠলো, ” রূপমের সাথে সবারই কথা বলা উচিত। সে বোধহয় এবার সমস্ত লিমিট ক্রস করে ফেলেছে।”
রায়হান খান বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন, ” রূপমের এরকম বেয়াদব হওয়ার পিছনের দোষটা আসলে কী তার একার? আমাদের দোষ সিংহভাগ। যখন কেউ অন্যায় করে তখন যদি সেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তবে সে সেই অন্যায়কে ন্যায় বলে জ্ঞান করে। এতে তার দোষের চেয়ে আশেপাশের মানুষগুলোর দোষই বেশি। এতদিন সব অন্যায়ে সবাই সায় দিতে দিতে তাকে চরম বেয়াদব বানিয়ে ফেলেছি। এখন সে লাগামহীন হয়ে গিয়েছে। কিছু করার নেই। এখন এসব বলে লাভ আছে? ”
শিহাব খান সহ সবার মাথাই নিচু হয়ে গিয়েছে। তারপরও তিনি বললেন, ” আল্লাহ কখন কাকে হেদায়েত দান করবেন সেটা তো কেউ জানে না বলো? আমার আজ ভীষণ খারাপ লাগছে। ”
রায়হান খান হনহনিয়ে উঠে বেড়িয়ে গেলেন। আশেপাশে এদিক ওদিক রিমুকে খুঁজলেন। তাকে কোথাও না পেয়ে ছাঁদে গেলেন। রিমু দুহাটু একসাথে ভাজ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। ছাঁদ থেকে ততক্ষণে সবাই নেমে এসেছে। রিমুর কাছে সাদিয়া আসতে চাইলেও রিমু তাকে একা থাকতে দিতে বলে সবাইকে চলে যেতে বলেছে।
রায়হান খান এগিয়ে রিমুর মাথায় হাত রাখলেন। রিমু মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন রায়হান খান। সে চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পরে মুখ খুলে বললো। আচ্ছা খালামনি! ধরো আজ আমার সাথে যেটা হচ্ছে সেটা যদি তোমার মেয়ের সাথে আমার ভাই করতো তবে কী তোমরা মেনে নিতে? এককথায় জবাব দিবে কিন্তু। রায়হান খান মাথা নিচু করে বললেন, ” কখনোই না। ”
রিমু স্ব শব্দে হেসে একটা বললো, ” তাহলে আমার বাবা তার নিজের মেয়ের চেয়ে ভাইয়ের ছেলে আর আমার মা তার নিজের মেয়ের চেয়ে বোনের ছেলেকে এতো বেশি মাথায় তুলেছে কেন? ”
রায়হান খান বললেন, ” তোর বাবা শিহাবের ছোট! আর তোর মা আমার ছোট। রিয়াজ তোর মাকে বিয়ে করার পরপরই তোর মায়ের রোগব্যাধি ছাড়েই না। দীর্ঘদিন তোর মায়ের বাচ্চাও হয়নি। তারপর পৃথিবী আলো করে তোর জন্ম হলো। জন্মের সময়টায় তোর দাদু তোর বাবাকে বা তোর অন্যান্য চাচারা কেউই সাহায্য করে নি। কারণ তোর বাবা সম্পত্তি নিয়ে তোর দাদুর সাথে কথা-কাটাকাটি করে। সেসময় রিয়াজকে সাহায্য করে শিহাব। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে করতে তোর বাবা মা কত যে কেঁদেছে। আসলে তুই হওয়ার আগে তো তোর মায়ের কোনো বাচ্চা ছিলোনা। আর রূপম তখন তোর মায়ের কোল আলো করে ছিলো। তাই টানটা হয়তো একটু বেশিই। রূপমের পিঠাপিঠি রিংকি হওয়ায় রূপম তোর মা বাবার কাছেই বেশি থাকতো। ”
রিমুর এসব জানা কথা। তবে আজ যতটা গভীরভাবে জেনেছে ততটাও নয়। তারপরে সে বললো, ” তা নাহয় বুঝলাম। তবে আমার কী মনে হয় জানো? না তোমরা কেউ আমাকে ভালোবেসেছো আর না রূপম ভাইকে। যদি রূপম ভাইকে ভালোইবাসতে তবে তাকে ভালো পথে যেতে উদ্ভুদ্ধ করতে। আমি মানলাম সে শুধু আমার সাথেই খারাপ ব্যাবহার করে । কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো সে কেন এমন করবে? কী অধিকার আছে তার একটা মেয়ের সাথে এরকম বাজে আচরণ করার? ”
খালা মনি আমি চুপচাপ সব মেনে নেই বলে এটা ভেবোনা আমার ঘৃণা লাগে না এসব আচরণ থেকে। আর আমার আত্মসম্মান নেই। রূপম ভাই তোমাদের প্রিয় আর আমার বড় হওয়ায় কখনো তাকে অপমান করিনি। কারণ আমি জানি একজনের প্রিয় মানুষ যতই খারাপ হোক না কেন। সেই মানুষটার দূর্ণাম সহ্য করা কষ্টকর। তোমাদের কখনো কষ্ট দিতে চাইনি। তবে এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল ছিলাম। কে যেন বলেছিলো, ” মাইয়া মানুষ পানির মতো হবি। যিহানো ধরাইবো সেইহানেই যেন ধরতে পারিস!” জানো তো কথাটা এখন অযৌক্তিক মনে হচ্ছে। মেয়েদের শক্ত হতে হয়। পাথর খন্ডের মতো। আগুনের মতো।
রেহনুমা বেগম আড়ালে খালা ভাগ্নির কথা মন দিয়ে শুনলেন। তার ভীষণ অপমানিত বোধ হচ্ছে। বাচ্চামেয়েটার কিছু কথা কেন জানি বুকে এসে লাগলো। নিজে যখন ভুল প্রমানিত হয় তখন আঘাতটা সোজা বুকেই লাগে।
কথা বলতে বলতে রিমুর গলা শুকিয়ে এলো। তারপরেও সে থামলো না। বললো, ” আচ্ছা তুমি চাচী আম্মুরা, আম্মু তোমরা তো মেয়ে। একটা মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়েকে অপমান হতে দেখতে তোমাদের খারাপ লাগতো না? আসলে মানুষ যখন চোখে পট্টি লাগিয়ে ঘোরে তখন তাদের চোখে বোধহয় অন্যায় চোখে পড়ে না। এখানে মেয়ে ছেলে ফ্যাক্ট নয়। অবশ্য একটা কথা আমি বহু শুনেছি। মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু হয়।
আচ্ছা খালা মনি আমি এখন উঠি। ভোর হতে চললো প্রায়। নামাজ পড়বো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মায়ের সাথে চোখাচোখি হলে রিমুর। আস্তে করে গলা নামিয়ে সে বললো, ” মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত! ” তাই কখনো তোমাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে চাইনি মা। তবে এটাও খেয়াল রেখো বেহেশত কিন্তু শুধুই সুখের আশ্রয়। যেখানে কোনো কষ্ট নেই। দোযখের অনুভূতি দিওনা।
রূপম ঘরের এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। রিমু রূপমের ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো। রিমুকে দেখে রূপম ডাকলো, ” এই রিমু শোন! ”
রিমু ব্যাটারি চালিত পুতুলের মতো গেলো রূপমের কাছে। রূপম বললো, ” রাগের মাথায় কী থেকে কী করে ফেলেছি। আই অ্যাম সরি! রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না ”
রিমু চুপ করে রইলো। রিমুকে চুপ থেকে রূপম বললো ভাব বাড়লো? যেই সরি বললাম ওমনি ভাব বাড়লো?
রিমু কঠোর গলায় বললো, ” আপনার সরি বলায় বা না বলায় আমার কিছু যায় আসে না। হু আর ইউ? আপনাকে এতো পাত্তা দেওয়ার সময় আছে না কি আমার কাছে? ”
রিমুর কাঠিন্যতা দেখে রূপম খানিক ভড়কালো । তবুও বললো, ” বেয়াদবি করিস না রিমু। ফল ভালো হবে না। ” রিমু ওই আগের মতোই বললো, ” কী করবেন আপনি? গায়ে হাত তুলবেন? কটু কথা শোনাবেন? কটু কথায় কান দেওয়ার মতো মেয়ে আমি নই। কারণ কুকুড়ের কাজই হচ্ছে ঘেউঘেউ করা। সেবস মনে রেখে চললে হবে না কি? আর গায়ে হাত দিলে আইনি ব্যাবস্থা নেবো। অনেক সহ্য করেছি আর নয়। ভরা বাড়িতে, বাহিরের ভেতরের মানুষের সামনে অপমান হতে কেমন লাগে যদি বুঝতেন কখনো! ”
রিমু আর দাঁড়ালো না। বাহিরে একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আজানের ধ্বনিতে চারিদিকে শান্তির প্রবাশ ছড়িয়ে পড়ছে। রিমু ঘরে এসে দরজা আটকে দিলো। এতদিন তার ধারণা ছিলো কেউ তাকে আগলায় না তবে সে আর নিজেকে আগলে কী করবে? তবে আজকের রাতটা তাকে শিখিয়েছে আগে নিজেকে ভালোবাসতে হয়। নয়তো অন্যদের ভালোবাসাও সম্ভব নয়। নিজের জন্য বাঁচতে হয়। আর বর্তমান দুনিয়ায় কেউ কারো জন্য লড়াই করে না। যার যার লড়াই তাকে একাই করতে হয়। মাঝে মাঝে জীবনে কেউ কেউ আসে পাশে এসে শক্ত করে হাত ধরে সাহস জোগাতে। অনুপ্রেরণা দিতে। রিমু ঠিক করলো আর নয় অপমান। এবার থেকে কেউ কিছু বলতে আসলেই পাল্টা জবাব দিবে সে। দিতেই হবে। নিজেকে ভালোবাসা যে ভীষণ জরুরি।
চলবে,,,,