#- অপ্রিয় সে
#-সানজিদা সন্ধি
#-পর্বঃ৫
রিমু কোনোরকমে ঘরের দরজা খুলে রূপমের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। বিয়ে বাড়ি হওয়ায় রাতের বেলা শুনশান নিরবতার বদলে রয়েছে এক অন্যরকম কোলাহল। বাচ্চারা যেন আজ মুক্ত, স্বাধীন। বাড়ির বড়রা জীবনের নানা পর্যায় নিয়ে গল্পের আসর জমিয়েছে । আর কিশোর, কিশোরী, যুবক যুবতীরা আড্ডায় মেতেছে। ঘরের মধ্যে রূপমকে দেখতে না পেয়ে রিমু সারা বাড়িতে খুঁজতে লাগলো তাকে। তার মাথা এখন কোনোভাবেই কাজ করছেনা। হাত পা কাঁপছে। মাথা ঘুরে যেন মুহুর্তের মধ্যেই পড়ে যাবে এমন একটা অবস্থা।
ছাঁদের উপর থেকে গান বাজনা আর সবার চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। সাদিয়া সবসময় জোরে কথাই বলেই অভ্যস্ত। বন্ধুমহলে নাম নাম দেওয়া হয়েছে ফাটা বাঁশ। আরো রাত হওয়ায় সাদিয়ার কন্ঠস্বর গমগম করছে। সাদিয়ার আওয়াজ ছাঁদ থেকে আসছে শুনেই দৌড়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো রিমু। দৌড়াতে গিয়ে বা পায়ে ভালো রকমের আঘাত পেলো সে। এখন পা চালানোর শক্তিও তার নেই। রেলিং ধরে ধরে ছাঁদে পৌঁছুতেই রিমুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
ছাঁদের মধ্যে থাকা দোলনায় আরামসে বসে আছে রূপম। আর তার হাত এক হাত জড়িয়ে ধরে পাশেই বসে আছে তৃপ্তি।
তৃপ্তি রূপমের বেস্ট ফ্রেন্ড৷ ভীষণ মিশুকে আর মিষ্টভাষী মেয়ে । তবে রিমু বুঝতে পারছে না ওরকম ভয়ঙ্কর চিরকুট দিয়ে রূপম কী করে এতো স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে।
রিমু দৌড়ে গিয়ে রূপমের কলার চেপে ধরে তাকে দাঁড় করালো। রিমুর আচরণে সবাই স্তম্ভিত।
রিমু চিৎকার করে বললো, ” আপনার সমস্যা কোথায় রূপম খান? আমি আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছি? আমার মা বাবা বা অন্যকেউ আমাকে বিয়ের করার প্রস্তাব দিয়েছে আপনাকে? আমার জানামতে এমন কিছু কেউই করে নি। কদিন আগে আপনি নিজে এসে আমাকে বিয়ে করবেন বলে পুরো বাড়ি মাথায় তুললেন। আপনার ইচ্ছার সম্মান রক্ষার্থে আমাকে আমার ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হলো। আর সেই আপনি কেন এখন আমাকে বিয়ে করতে চাননা? আমি আমার জীবনকে কী সার্কাসের স্টেজ পেয়েছেন? এখন যদি আপনি বিয়ে করতে না চান তাহলে সবাই মেনে নিবে। তবে আমি যে অপমানিত হবো এটা একবারো ভেবেছেন? সবাই বলবে নিশ্চয়ই মেয়ের বিশাল কোনো দোষ পেয়েছে রূপম। নয়তো কী আর বিয়ে ভাঙে? আপনাকে তো আবার পীর মানে সবাই। তাই আপনার দোষ কেউ দেখতেই পারবে না।”
রিমু যখনই রূপমের কাছে এসে তার কলার ধরেছে তখনই পুরো ছাঁদে নেমে এসেছে পিনপতন নিরবতা। নিস্তব্ধতার মধ্যে রিমুর জোরে জোরে চিৎকার করে বলে ওঠা কথাগুলো নিচে থাকা বড়দের কানেও স্পষ্টভাবে পৌঁছে গেলো। সবাই হতবিহ্বল। কী বলছে এসব রিমু? রূপম কী সত্যিই এমন কিছু চিরকুটে লিখেছে? নিচ থেকে সবাই ছাঁদে আসতে লাগলো।
হুট করে এসে রূপমকে আপনি করে সম্মোধন করা আর জীবনে দ্বিতীয় বারের কেউ তার কলারে হাত দেওয়াতে রূপমের মিশ্র অনুভূতি হতে লাগলো। রিমু সবসময় রূপমকে তুমি করে সম্বোধন করে এসেছে। তাদের মধ্যে হাজার ঝামেলা হলেও তুমিই বলেছে। সেই রিমু আজ আপনি বলে ডেকেছে। মাঝে মাঝে এই “তুমি”, “আপনি” বা “তুই ” বলে সম্বোধন পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। বলে দেয় মানুষের মনের অবস্থা আর অপর পাশের মানুষের প্রতি সম্মান।
রূপম কিছু কিছু বিষয় একেবারেই সহ্য করতে পারে না। এরমধ্যে অন্যতম হলো কেউ তার কলার ধরার সাহস দেখাবে বা ভুলক্রমে ধরে ফেলবে। ইন্টারে থাকাকালীন রূপমের বন্ধু মজার ছলে তার কলার ধরেছিলো। সেদিন রূপম কিছু বিবেচনা না করেই তাকে ইচ্ছে মতো পিটিয়েছিলো। স্কুলে এটা নিয়ে গার্জিয়ান কলও হয়। রূপমদের বাড়ির সবাই জানে রূপমের পছন্দ অপছন্দ। তার অপছন্দের কিছুই তারা করে না। সেদিনের পর থেকেই সবাই জানে রূপমের এই বিষয়টা। বন্ধুদের মধ্যে কেউ মজার ছলেও এটা করার সাহস দেখায়নি আর। আজ দ্বিতীয় বারের মতো রূপমের কলারে হাত পড়েছে। আর সেটা দিয়েছে রিমু। যেই রিমু যমের মতো ভয় পায় তাকে।
রিমুর অত্যাধিক দুঃসাহস দেখে রূপম নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারলল রিমুকে। রিমু একপ্রকার ছিটকেই পড়লো। ততক্ষণে সবাই হাজির। রায়হান খান দৌড়ে এসে রিমুকে ধরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রূপমের দিকে তাকালো। রূপম দোলনায় শেকল ধরে সেটাকে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে উপরে উঠিয়ে তারপর ছাঁদে পড়ে থাকা একটা লাঠি হাতে নিলো। রায়হান খানকে সরে যেতে বলে, রিমুর গায়ের দিকে এগোলো রূপম। সবাই বুঝলো অবস্থা ভীষণ বেগতিক। সাজ্জাদ এসে রূপমকে আটকালো।
রূপম রেগে অস্থির হয়ে বললো,” এই মেয়ের সাহস হয় কীভাবে আমার কপাল চেপে ধরে আমার মুখের উপর কথা বলার? কলিজা বড় হয়ে গেছে তার তাইনা? কার আশকারাতে এতো বাড় বেড়েছে সে?”
রিমু ভয়ে রায়হান খানের পেছনে রইলো। রেহনুমা বেগম এসে রূপমের সামনে দাঁড় করালো রিমুকে। তারপর বলতে লাগলো, ” এতো বড় বেয়াদবি তুই কী করে করতে পারলি রিমু?”
রিমুর ডুকরে কান্না আসছে। কী যেন একটা বলতে চাচ্ছে সে। কিন্তু গলার কাছে কান্নারা এতো দলা পাকিয়েছে যে তার মুখ থেকে কথাই আসছে না। কাঁপা কাঁপা গলায় রিমুর বেশ জোরেই বললো, “সরি!”
রিমুর কান্না মিশ্রিত গলা শুনে রূপমের রাগ যেন বেড়ে গেলো। এখন নাটক করছিস? আমাকে অপমান করে এখন নাটক করছিস বলেই সাজ্জাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলো।
পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে নেই বুঝতে পেরে রূপন, রিমু দুজনকে নিয়েই বসলো সবাই। এরপর রিমুকে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে, ” রিমু গায়ে হলুদের সময় থেকে এই অবধি হওয়া সব ঘটনা বললো। স্বভাবত কেউই বিশ্বাস না করে রূপমকে বললো রূপম এসব কী সত্যি?
রূপম পুরোপুরি ভাবে অস্বীকার করে বললো, ” আমি কেন ওকে চিরকুট দিয়ে এসব বলতে যাবো? আমার কী অন্য কোনো কাজ নেই যে এসব আজাইরা কাজ করে বেড়াবো?” রিমু মিথ্যা বলছে।
রিমু হাতের মধ্যে থাকা চিরকুট সবাইকে দেখিয়ে বললো, ” তাহলে এটা কোথা থেকে আসলো আমার কাছে? ”
রূপম ছোঁ মেরে রিমুর হাত থেকে চিরকুটটা নিলো। তারপর অট্টহাসি দিয়ে বললো, ” তুই যে মিথ্যা বলছিস এটা তো স্পষ্টই। মাথা ভর্তি গোবর নিয়ে আমার সাথে গেম খেলতে আসছিস? এই হাতের লেখা আমার নয়।”
রিমুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সবাই চিরকুটটা দেখে বললো রিমু এটা তো রূপমের হ্যান্ডরাইটিং নয়। তবে মিথ্যা বলার কী প্রয়োজন ছিলো? আর এমন হাঙ্গামা করেই বা কী লাভ হলো তোর? শুধুশুধু সবাইকে পেরেশানি করালি।
প্রশ্নগুলো রিমুকে করা হলেও উত্তরগুলো যেন রূপমের সব জানা। সে চটপটে বললো, ” ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তো। তাই এরকম নাটক করলো। যাতে আমি রেগে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে। কী ! ঠিক বলছি না রিমু?
রূপম সহ সবার কথা বুঝতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রিমুর। এটা রূপমের হ্যান্ডরাইটিং না হলে কার? রিমুর স্পষ্ট মনে আছে চিরকুটটা রূপমই দিয়েছিলো। এখানে কোনো রকম ভুল নেই। চিরকুটটা নিজের হাতে আরেকবার নিয়েই ভীষণ আফসোস হলো রিমুর। নানান প্রেশারে রূপমের হাতের লেখা চিনতে তার ভুল হলো কী করে? এটা নাহয় রূপমের হাতের লেখা নয় তবে সে যে রিমুকে চিরকুট দিয়েছে এটা স্বীকার না করে কেন এতো মিথ্যাচার করছে। রিমুকে ইচ্ছে মতো কথা শুনিয়ে সবাই নিচে চলে যায়। ছাঁদে থাকা বাকিদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়েছে। লজ্জায় অপমানে রিমুর অবস্থা নাজেহাল। আল্লাহর কাছে মনে মনে একটা কথাই সে বললো, ” হে আল্লাহ! কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছো আমাকে?”
চলবে,,,,,