অপ্রিয় সে পর্ব-০৪

0
1929

#-অপ্রিয় সে
#-সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ৪

রিমুকে চুমু দেওয়ার সময়কার মুহূর্তটা সাজ্জাদের ফোনের ক্যামেরা বন্দি হয়ে গেলো। অন্ধকারে সবাই যখন আলোর সন্ধানে ব্যাস্ত তখন হলুদের স্টেজে থাকা টিমটিমে আলোয় ছবিটা তুলে নিয়েছে সাজ্জাদ।সে বোধহয় সারাক্ষণ রিমু আর রূপমের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সাজ্জাদ আস্তে করে রূপমের পাশে গিয়ে বললো,” রূপম ভাইয়া মুহূর্তটা ভীষণ সুন্দর লেগেছে আমার কাছে। তাই ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম। ” রূপম খানিকটা বিব্রতই হলো। তখনই সাথে সাথে কারেন্ট চলে এলো। রূপম ছবিটা দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে সাজ্জাদের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে রিমুকে ছবিটা দেখালো। রূপম ভালোই জানে সে এটা দেখে রাগে গজগজ করবে আর ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করবে। রূপম বুঝতে পারে না এই রিমুকে জ্বালাতে পারলে তার এতো শান্তি লাগে কেন।

রিমুকে চুমু দেওয়ার সময় রিমুর গালের হলুদ রূপমের ঠোঁটে লেগে যায়। পাশ থেকে সাদিয়ার নজর রূপমের ঠোঁটের দিকে যেতেই সে সবার সামনেই বলে ওঠে,” রূপম ভাইয়া তোমার ঠোঁটে হলুদ এলো কী করে? তুমি বুঝি কিছু খেতে না পেরে হলুদই খেয়েছো? তোমাকে তো এখনো হলুদ ছোঁয়ানো হয়নি আর তুমি নিষেধ করেছো বলে কেউ ছোঁয়াবেও না।” রূপম হকচকিয়ে গেলো।

সাজ্জাদ চেঁচিয়ে বললো, ” আরে রিমুর গাল থেকে ঠোঁটে হলুদ ট্রান্সফার হয়েছে। ছবিও তুলেছি। সাজ্জাদ রিমুর হাত থেকে ফোন নিয়ে সবাইকে দেখালো ছবি। ততক্ষণে সেই ছবি প্রায় সবার দেখা শেষ। সাজ্জাদের কাহিনী দেখে রিমু মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আর কমবেশি সবাই রূপমকে এসে ক্ষেপাচ্ছে। রূপম সবার সাথেই ভীষণ ফ্রি। একমাত্র রিমুকেই সে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করার চিন্তায় মত্ত থাকে।

সাজ্জাদ রিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো সে প্রচন্ড অভিমান করেছে। সাজ্জাদ ভাবলো বোধহয় এসব করে রিমুকে কষ্ট না দিলেও পারতো। কিন্তু পুরো বিষয়টা ঝোঁকের মাথায় হয়ে গিয়েছে। সে রিমুকে সরি বলতে যাবে তখনই ঋষি এসে রূপমকে গান গাইতে বললো। রিমু আরো বেশি বিরক্ত হলো এসবে। রূপম গান গাওয়ার জন্য সানন্দেই রাজি হয়ে গেলো।

রিমুকে ঘিরে সবাই গোল হয়েছে বসেছে। রূপমের হাতে গিটার।

কী নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে (২)

আমি যে মাতাল হাওয়ারই মতো হয়ে
যেতে যেতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে( ২)

কী করি ভেবে যে মরি বলবে কী লোকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে।

পালাতে পারিনি আমি যে দিশা হারা
দুটি চোখ যেন আমায় দিচ্ছে পাহারা

ধরা পড়ে গেছি আমি নিজেরই কাছে
জানিনা তোমার মনেও কী এতো প্রেম আছে

সত্যি যদি হয় বলুক যা বলছে নিন্দুকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে।

গিটারের অনবদঢ় সুর আর রূপমের মাতাল করা গান সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। রিমুর এই গানটা প্রচন্ড রকমের প্রিয়। যেদিন ঝোঁক ওঠে সেদিন যে কতবার সে শোনে তার কোনো হিসাব নেই। নিজের অজান্তেই রূপমের সাথে তাল মিলিয়ে গাইতে লাগলো রিমু৷ সে এখন নিজের মাঝেই নেই। রূপম সহ বাকি সবাই অবাক হলো। অবাক বলতে প্রচন্ড রকমের অবাক। যারা কখনো রিমুকে গুনগুন করে গাইতেও শোনেনি তাদেরই চোখের সামনে আজ রিমু গলা ছেড়ে গাইছে। একদম প্রফেশনাল সিঙ্গারের মতো।

ঋষি আর সাদিয়া মুখোমুখি বসেছে। সাদিয়া অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছে ঋষি চৌধুরী যেন তাকে একধ্যানে দেখছে। মুখোমুখি বসায় একে অপরের সাথে চোখাচোখিও হয়েছে তাদের বেশ কয়েকবার। সাদিয়ার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। ভীষণ রকমের। কেউ কারো দিকে যদি একধ্যানে তাকিয়ে থাকে আর সেই মানুষটা যদি বুঝতে পারে তাকে কেউ দেখছে তবে অস্বস্তি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সাদিয়া মাথা নিচু করেই আছে। একপর্যায়ে সে হুট করে সামনের দিকে তাকাতেই সে দেখলো ঋষি তাকিয়েই আছে। এবার চোখাচোখি হতেই ঋষি চোখ টিপে দিলো। রূপম আর রিমুর অনবদ্য রোমান্টিক গানের মধ্যেই চোখটিপ। সাদিয়া রাগ হলেও সে চুপ করে বসে রইলো। নিজেকে বোঝালো এটা বিয়ে বাড়ি৷ এরকম ছোটখাটো ঘটনা ঘটতেই পারে।

কিন্তু পরপরই সাদিয়ার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সে ঋষির সামন থেকে সরে এসে ঋষির পেছনে বসলো। তারপর একটু ঋষির কানে কানে বললো, ” এক্সকিউজ মি! আপনি কী একটু উঠতে পারবেন? ঋষি কিছু বুঝলো না। এখানে এসেই সাদিয়াকে ভীষণ মনে ধরেছে তার। কিছু না বুঝলেও সাদিয়ার কথাতে সে উঠে দাঁড়ালো। তার পর পরই সাদিয়া তাকে বসতে বসলো। ঋষি কিছু না ভেবেই বসে পড়লো। তবে চেয়ারে নয়। সোজা মাটিতে। হুট করে এমনটা হওয়ায় কোমড়ে ভালো রকমেরই ব্যাথা পেলো সে। সবাই গানে এতো বেশি ব্যাস্ত যে কারো চোখ এদিকে আসলোই না। ঋষি তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়ালো। হাজার হলেও প্রেসটিজের বিষয়। তারপর পিছন ফিরে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো। সাদিয়া সেখান থেকে উঠে রিমুর কাছে যাবে কিন্তু ঋষি সাদিয়ার হাত চেপে ধরে তাকে পাশে বসালো।

সাদিয়া রেগে গেলো। মিনমিন করে বলতে লাগলো চোখ টিপ দেওয়ার ফলাফল স্বরূপ মাটিতে পড়তে হলো। এখনো অসভ্যতামি কমলো না?

ঋষি ব্যাথা নিয়েও মুচকি হেসে বললো, ” কী করবো বলো সুন্দরী! তোমাকে যে ভীষণ মনে ধরেছে। তাই তো চোখ টিপ দিয়েছি। তুমি এমন করতে পারলে আমার সাথে? কোমড়টা যদি ভাঙতো কী হতো বলোতো? তোমাকেই তো সেবাযত্ন করতে হতো। ”

সাদিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” আপনার তো বড্ড বেশি সাহস। এতবড় সেলিব্রিটি হয়ে ছ্যাঁচড়ামি করতে লজ্জা করে না?”

ঋষির ব্যাথা বাড়তে লাগলো, ” তাই সেখানেই চুপ করে সাদিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বসে রইলো। ” এখন তার তর্ক করতে ভালো লাগছে না।
নিজের যায়গায় এসে সাদিয়া ভাবতে লাগলো
মিডিয়া, ফটোগ্রাফারস সবাই রূপম আর রিমুকে কভার করতে গিয়ে আরেক সেলিব্রিটির অসাধারণ কাহিনি মিস করে ফেললো। এটা যদি কারো ক্যামেরায় বন্দি হতো তাহলে নিশ্চয়ই একটা মুখরোচক নিউজ হতো। হেডলাইনটা এমন হলে কেমন হতো?

” বিয়েবাড়ির এক সুন্দরীকে চোখ টিপ দেওয়ার অপরাধে সেই সুন্দরী বিশিষ্ট গায়ক ঋষি চৌধুরীকে ধপাস করে ফেলে দিয়েছেন।”

কথাটা ভেবেই ফিক করে হেসে দিলো সাদিয়া।তবে তার কিঞ্চিৎ অনুশোচনাও হলো। এভাবে ফেলে না দিলেও পারতো। ব্যাথা নিশ্চয়ই অনেক পেয়েছে।

ততক্ষণে রূপম আর রিমুর গান গাওয়া শেষ। হাততালিতে মুখরিত চারিপাশ। রিমু লজ্জায় মাথা অর্ধনমিত করে ফেললো। সে এটা কী করলো ভেবে পেলো না। এরকম বোকামি কেউ করে না কি? রিমুর আফসোস হলো এটা ভেবে যে সে এখনো নিজেকে আয়ত্তে রাখলেও আজ কী করে এই ধরনের কাজ করলো। হইহট্টগোলের মাঝখানে রিমুর কিছু সময়ের জন্য মনে হলো রূপম বোধহয় তাকে উদ্দেশ্য করেই গানটা গেয়েছে। কিন্তু তারপরই নিজের বোকাবোকা চিন্তার জন্য নিজেকে ধিক্কার জানালো সে। রূপম গাইবে গান তাও আবার রিমুর জন্য। এ যে ব্যাঙের সর্দি হওয়ার মতো ঘটনা।

রিমুকে কখনোই গান গাইতে শোনেনি রূপম। তবে আজ রিমুর কন্ঠ নিঃসৃত গান শুনে সে চমকে গেলো। রিমু এমনিতে মিষ্টভাষী মেয়ে। কিন্তু তার গানের গলা যে এতো সুন্দর হতে পারে সেটা কখনো মাথাতেই আসেনি রূপমের।

রিমু হট্টগোল থেকে বাঁচতে শরীর খারাপের কথা বলে নিজের রুমে চলে এলো। তারপর নিজের হাতে মুঠোয় বন্দি করা চিরকুটটা তার পড়ার টেবিলের মধ্যে থাকা একটা বইয়ের ভেতরে রেখে ফ্রেশ হতে গেলো। ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। সারাদিনের ক্লান্তিতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। ভেতর থেকে দরজা আটকানো ছিলো।

রাত একটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো রিমুর। তৎক্ষনাৎ তার চিরকুটের কথা মনে পড়লো। তড়িঘড়ি উঠে বইয়ের ভেতর থেকে চিরকুট বের করেই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সেখানে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা। ” সাদা পেত্নী আমি তোকে বিয়ে করতে পারবোনা। ইতি রূপম!”

রূপমের সাথে বিয়ে হবে না ভেবে ভীষণ খুশি হওয়া উচিত রিমুর। কিন্তু সে খুশি হতে পারছেনা। এক বোবা কান্না তাকে চেপে ধরলো। তার হাত পা কাঁপছে সমানে। এভাবে রিমুকে হেনস্তার মধ্যে ফেলার মানেটা কী?

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে